দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমোচনের জন্য মহৎ আত্মোৎসর্গের জীবন ছিল নেতাজী। সুভাষচন্দ্র বসুর। দেশের স্বাধীনতা অর্জনে তাঁর অবদানই সর্বাধিক। ছোটোবেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ও দেশভক্ত ছিলেন সুভাষ। ১৯১৯ সালে বিএ (দর্শনশাস্ত্র) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় হন। তারপর বিলেত যান তিনি। সেখানে গিয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সসম্মানে ট্রাইপস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর আই সি এস পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করা সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকারের অধীনে উচ্চপদের সিভিল সারভিস পরিত্যাগ করে ১৯২১ সালে ফিরে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে।
সেই সময় রাউ লাট অ্যাক্ট, জালিয়ানওয়ালাবাগের গণহত্যা ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯১৯ সাল থেকে গান্ধীজীর নেতৃত্বে সারাদেশ জুড়ে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল। সুভাষচন্দ্র সেই আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েন এবং দেশবন্ধুর সঙ্গে ১৯২১ সালের ১০ ডিসেম্বর কারাবরণ করেন। এটা তাঁর প্রথম কারাবাস। এই আন্দোলন যখন তীব্র হয়ে উঠছিল তখন। উত্তর প্রদেশের চৌরিচৌরার ঘটনার । প্রেক্ষিতে ১৯২২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গান্ধীজী আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন, সত্যাগ্রহীরা হিংসার আশ্রয় নিয়েছে এই অজুহাতে।
১৯২৭ সালের শেষ দিকে সাইমন কমিশনকে কেন্দ্র করে দেশ আবার উত্তাল । হয়ে উঠে। ১৯২৮ সালের ৩০ অক্টোবর লাহোরে সাইমন কমিশন-এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাবার সময় পুলিশ অফিসার স্যান্ডার্স কর্তৃক বিক্ষোভকারীদের উপর নির্মম লাঠিচার্জ, ফলস্বরূপ লাজপত রায়ের মৃত্যু, এর বদলা হিসেবে বিপ্লবী ভগত সিংহ, শুকদেব এবং রাজগুরু কর্তৃক ১৯২৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর স্যান্ডার্সকে হত্যা, চরমপন্থী বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে দেশের পরিস্থিতি যখন ক্রমশই গরম হয়ে উঠছে তখন আবার গান্ধীজী আসরে নামলেন তাঁর অহিংসা ও সত্যাগ্রহের মন্ত্র নিয়ে। ১৯৩০ সালের ১২ মার্চ সবরমতী আশ্রম থেকে ডান্ডি অভিযানের মাধ্যমে গান্ধীজী ইংরেজের বিরুদ্ধে অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলন আরম্ভ করেন। এই আন্দোলন সারাদেশ জুড়ে বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল। ইংরেজ সরকারও নির্মম ভাবে দমন করে এই আন্দোলন। এই আন্দোলন যখন তীব্র আকার ধারণ করছিল তখন সাইমন কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা করার জন্য বিলেতের গোল টেবিল বৈঠকে আমন্ত্রণ পেতেই গান্ধীজী আন্দোলন প্রত্যাহার করে, ইংরেজের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে এই বলে আলোচনা করার জন্য বিলেতে চলে গেলেন। কিন্তু। ফিরে এলেন খালি হাতে।
গান্ধীজীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের। আন্দোলনে মনপ্রাণ দিয়ে অংশগ্রহণ করে এবং গান্ধীজীর অহিংস আন্দোলনের ধারা দেখে সুভাষচন্দ্র হতাশ হন। আন্দোলন যখনই চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে তখনই কোনও না কোনও কারণ দেখিয়ে সেই আন্দোলন। বন্ধ করে দেন গান্ধীজী। সুভাষচন্দ্র উপলব্ধি করেন গান্ধীজীর পথে শক্তিশালী ধুরন্ধর। ইংরেজকে কাবু করে স্বাধীনতা লাভ সম্ভব নয়। স্বাধীনতা অর্জন করতে গেলে কংগ্রেসকে গান্ধীজী প্রদর্শিত প্যাসিভ রেসিস্ট্যান্স-এর পথ পরিহার করে অ্যাকটিভ রেসিস্ট্যান্স-এর পথ ধরতে হবে। তিনি 1671—“The latest Act of Mohatma Gandhi in suspending civil disobedience is a confession of failure. We are of opinion that Mohatma as a political leader has failed. The time has come for a radical reorganisation of the Congress on a new principle with a new method for which a new leader is essential, as it is unfair to expect the Mohatma to work on a programme not consisted with his lifelong principle.”
সুভাষ গান্ধীবাদীদের মতো নরমপন্থী ছিলেন না। তিনি ছিলেন গরমপন্থী নেতা। গান্ধীজী যে চরমপন্থী বিপ্লবীদের বিপথগামী বলে নিলেমন্দ করতেন, সুভাষচন্দ্র তাদের সঙ্গে কৌশলে যোগাযোগ রেখে তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে শামিল করতে চাইতেন। সুভাষ ক্রমশই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে লাগলেন এবং ১৯৩৮ সালে জাতীয় কংগ্রেসের সর্ব। ভারতীয় সভাপতি নির্বাচিত হলেন। সভাপতি নির্বাচিত হয়ে তিনি কংগ্রেসকে ইংরেজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করার জন্য এগোতে চাইলেন। অহিংসার পূজারি গান্ধীজী সুভাষের এইসব কার্যকলাপ পছন্দ করলেন না; তাই পরের বছর ১৯৩৯ সালে সুভাষচন্দ্র আবারও সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হলে গান্ধীজী কূটকৌশলে তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। শুধু তাই নয়, গান্ধীজী সুভাষচন্দ্রকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করেন। দমে না গিয়ে সুভাষচন্দ্র নিজের পার্টি। ‘ফরোয়ার্ড ব্লক’ তৈরি করে নতুন উদ্দ্যমে তৈরি হতে থাকলেন।
এই সময়ে ১৯৩৯ সাল থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যুদ্ধের পটভূমিকায় ইংরেজ সরকার অর্ডিনেন্স করে সবরকম আন্দোলন, মিটিং, মিছিলের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সুভাষচন্দ্র ইংরেজ সরকারের এই ফরমানের বিরোধিতা করে ১৫০ বছর ধরে কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে। থাকা দাসত্বের প্রতীক হলওয়েল মনুমেন্ট ভেঙে ফেলার উদ্দেশ্যে ১৯৪০ সালের ৩ জুলাই তাঁর অনুগামীদের নিয়ে হলওয়েল মনুমেন্টের দিকে মিছিল আরম্ভ করলেন। ইংরেজের পুলিশ সুভাষচন্দ্রকে গ্রেপ্তার করে প্রেসিডেন্সি জেলে ঢুকিয়ে দিল। এটা ছিল সুভাষচন্দ্রের ১১তম জেল যাত্রা। সুভাষ উপলব্ধি করলেন যুদ্ধের পটভূমিকায়। ইংরেজের উপর চূড়ান্ত আঘাত হানতে হবে, তঁাকে জেলে বসে সময় নষ্ট করলে হবে না। তাই কৌশল হিসেবে তিনি হুমকি দিলেন তাকে মুক্তি না দিলে তিনি আমরণ অনশন করবেন। ইংরেজ সরকার কোনো ঝুঁকি না নিয়ে তাকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে এলগিন রোডের বাড়িতে নজরবন্দি করে রাখল। সুভাষচন্দ্র অসামান্য দক্ষতায় পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে ১৯৪১ সালের ১৬ জানুয়ারি এলগিন রোডের বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলেন।
তিনি মহম্মদ জিয়াউদ্দিন নাম নিয়ে এক পাঠান ইস্যুরেন্স এজেন্টের ছদ্মবেশে ভাইপো শিশির বসুর গাড়িতে করে পালিয়ে গোমো চলে যান। গোমো রেলস্টেশন থেকে ফ্রন্টিয়ার মেল ধরে চলে যান পেশওয়ার। সেখান থেকে ছদ্মবেশে কাবুল হয়ে মস্কো। মস্কো থেকে জার্মানির বার্লিনে চলে যান। ১৯৪১ সালের ৩ এপ্রিল। ২ মাস ১১ দিনের ভয়াবহ রোমহর্ষক বিপদসঙ্কুল ছিল সেই যাত্রা। জার্মানি পৌঁছে তাদের বিদেশ দপ্তরের সহায়তায় গঠন করেন— Working Group India’, Special Department for India’, Azad Hind Radio’ Zustia আজাদ হিন্দ রেডিয়ো থেকে ১৯৪১ সালের নভেম্বরে ভেসে আসে সুভাষচন্দ্রের কণ্ঠস্বর— আমি সুভাষ বলছি। আজাদ হিন্দ রোডিয়োর মাধ্যমে ভারতবাসীর উদ্দেশে নানারকম অনুপ্রেরণামূলক ভাষণ বিভিন্ন ভাষায় প্রচার করা হতো। তিনি ইতালির মুসলিনি এবং জার্মানির হিটলারের সঙ্গে দেখা করে ভারতের স্বাধীনতার লড়াইয়ের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করেন। এই সময় অক্ষ শক্তির শরিক জাপান ১৯৪১ সালের ৮ই ডিসেম্বর অ্যালাউড ফোর্সের ব্রিটেন ও আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। জাপান দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার রণাঙ্গনে। ব্রিটিশকে পর্যদুস্ত করতে থাকে।
এদিকে জাপানে আত্মগোপন করে থাকা আর এক বীর বিপ্লবী রাসবিহারী বসু পশ্চিম এশিয়াতে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। জাপানিদের হাতে ব্রিটিশ বাহিনীর বন্দি সেনানিদের নিয়ে রাসবিহারী বসু তৈরি করেছিলেন আজাদ হিন্দ বাহিনী। সুভাষচন্দ্র তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছিলেন। রাসবিহারী বসু সুভাষচন্দ্রকে পূর্ব এশিয়ার রণাঙ্গনে এসে ইন্ডিয়ান। ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ ও আজাদ হিন্দ বাহিনীর দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেন। সুভাষচন্দ্র ঠিক করলেন জাপানের সহায়তায় আজাদ হিন্দ বাহিনী নিয়ে পূর্বএশিয়ার রণাঙ্গণে ব্রিটিশশক্তিকে আক্রমণ করবেন। সেই পরিকল্পনা করে সহযোগী আবিদ হাসানকে নিয়ে তিনি ১৯৪৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কিয়েল বন্দর থেকে জার্মান নৌবাহিনীর ডুবোজাহাজে রওনা হন। দীর্ঘ দু’মাসেরও বেশি সময় ধরে অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল সাবমেরিন যাত্রা করে তিনি পূর্বএশিয়ার জাপানে এসে উঠলেন। সেখান থেকে। গেলেন টোকিয়ো। ১৯৪৩ সালের জুনের প্রথম দিকে জাপানের প্রধানমন্ত্রী তোজোর সঙ্গে মিটিং করেন। ১৯৪৩ সালের ২৭ জুন রাসবিহারী বসুর সঙ্গে সিঙ্গাপুরে পৌঁছন সুভাষচন্দ্র। রাসবিহারী বসু ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগের সভাপতি হিসেবে সুভাষচন্দ্রকে বরণ করে নেন। তাঁকে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বাধিনায়কের পদেও বরণ করা হয়। সেখানে সবাই তাকে ‘নেতাজী’ বলে সম্বোধন করতে থাকেন।
আজাদ হিন্দ বাহিনীতে ৫০,০০০ সৈনিক এবং ১.৫০০ অফিসার যোগদান করেছিলেন। তাদের উদ্দেশে আবেগপূর্ণ দেশাত্মবোধক ভাষণ দেন তিনি। সেখানেই তিনি রণনাদ তুলেছিলেন ‘দিল্লি চল’, ‘ইনক্লাব জিন্দাবাদ’, ‘আজাদ হিন্দ জিন্দাবাদ। যেসব সৈনিক এতদিন ব্রিটিশের হয়ে লড়াই করেছেন তারা দেশের জন্য প্রাণ দেওয়ার। জন্য উন্মুখ হয়ে উঠলেন। বহু তেজদীপ্ত মহিলা প্রাণদানের জন্য এগিয়ে এলেন। নেতাজী সুভাষ তাঁদের নিয়ে গড়লেন রানি কঁসি বাহিনী। নেতাজী জাপানের সহায়তায় আজাদ হিন্দ বাহিনী নিয়ে পশ্চিম এশিয়ার রণাঙ্গণে ব্রিটিশ বাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়লেন এবং কোহিমা, ইম্ফল ইত্যাদি এলাকা দখল করে নেন। আজাদ হিন্দ বাহিনীর ২৬০০০ সৈনিক প্রাণদান করেন এই যুদ্ধে। অধিকৃত ভারতীয় ভূমিতে ১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর নেতাজী সুভাষ গঠন করেন অখণ্ড স্বাধীন ভারতের প্রথম স্বাধীন সরকার ‘আজাদ হিন্দ সরকার’। উত্তোলন করেন তিরঙ্গা পতাকা। ছাপা হয় স্বাধীন। সরকারের মুদ্রা। জাপান, জার্মানি, ইটালি-সহ বিশ্বের ১১টি দেশ স্বীকৃতি দান করে সেই সরকারকে। জাপানিরা আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দখল করে আজাদ হিন্দ সরকারের হাতে ছেড়ে দেয়। নেতাজী ১৯৪৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর সেখানে স্বাধীন সরকারের পতাকা উত্তোলন করেন এবং দ্বীপ দুটির নামকরণ করেন ‘শহিদ’ ও ‘স্বরাজ’ দ্বীপ। ইতিহাসের নিরিখে নেতাজী সুভাষই হলেন স্বাধীন অখণ্ড ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী।
যাইহোক, ১৯৪৪ সালের মে মাস থেকে জাপান যুদ্ধে পরাজিত হতে থাকে। অবশেষে মিত্রশক্তি শরিক আমেরিকা সারা বিশ্বকে হতচকিত করে ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে অ্যাটম বোমা ফেলে। ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জাপান আত্মসমর্পণ করে। ঠিক হয় নেতাজী আত্মগোপন করবেন। এরপর নেতাজীর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। কেউ কেউ বলেন ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট জাপানের টোকিয়ে যাওয়ার পথে তাইওয়ানের তাইহোকুতে বিমান দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছে। তার মৃত্যু নিয়ে শেষ যে তদন্ত কমিশন হয়েছিল, সেই বিচারপতি মনোজ মুখার্জি কমিশনের (১৯৯৯-২০০৫) মতে ১৮ আগস্টে তাইহোকুতে বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজীর মৃত্যুর কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনানীদের বন্দি করে দিল্লির লাল কেল্লায় যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তাদের বিচার আরম্ভ হয়। দেশের স্বাধীনতার জন্য নেতাজী সুভাষ ও তাঁর আজাদ হিন্দ বাহিনীর বীরত্ব ও আত্মবলিদানের কাহিনি সারা দেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনানীদের বিচারের প্রহসনে দেশের মানুষ বিক্ষেভে ফেটে পড়েন। ব্রিটিশ বাহিনীতে যে লক্ষ লক্ষ ভারতীয় সেনা ছিল তারা যখন দেখল তাদের বন্ধু ও ভাইয়েরা দেশের স্বাধীনতার জন্য দুঃসাহসিক লড়াই করেছেন, অকাতরে প্রাণ বলিদান করেছেন; আবার তাদেরই বিচার করে শাস্তিদানের ব্যবস্থা করছে ইংরেজ, তখন তারা দেশপ্রেমের আবেগে উদ্বেল হয়ে উঠলেন। সারা ভারত জুড়ে সেনাবিদ্রোহ আরম্ভ হয়ে গেল। মুম্বাইয়ে প্রথমে নৌবাহিনী বিদ্রোহ করল, ক্রমে তা পদাতিক এবং বিমান বাহিনীতে ছড়িয়ে পড়ল। বলা চলে আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচারকে কেন্দ্র করে সারাদেশ জুড়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহ আরম্ভ হয়ে গেল। ইংরেজ নারী শিশুরা নিরাপত্তার অভাবে দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠল। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বযুদ্ধে ক্লান্ত ব্রিটিশ সেনানীরা নতুন করে সংঘাতে যেতে আগ্রহী নয়। ইংরেজ সরকার খুব চাপে পড়ে গেল।
প্রশ্ন জাগে, ১৯৪২ সালের আগস্টে গান্ধীজীর ডাকা ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে ইংরেজরা দু’তিন সপ্তাহের মধ্যেই নির্মম ভাবে দমন করে ফেললেও বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী ইংরেজ কেন হঠাৎ ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে গিয়েছিল? তা কি গান্ধীজীর অহিংস আন্দোলনের ভয়ে? আসল কারণটা হলো— নেতাজী সুভাষ আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনানীদের মধ্যে দেশপ্রেমের যে আগুন জ্বেলে দিয়েছিলেন, তাদের বিচারের প্রহসনে দেশপ্রেমের সেই আগুন ব্রিটিশ বাহিনীর ভারতীয় সেনাদের মধ্যেও দাবানলের মতো বিদ্রোহের আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই বিদ্রোহের কথা নেতাজীর মৃত্যু রহস্যের মতোই চেপে রাখা হয়েছে। ইংরেজ দেখল—ভারতীয় সৈনিক, ভারতীয় পুলিশ যাদের সাহায্যে ভারতীয়দের এতদিন দমন করা হতো, নেতাজীর মন্ত্রে তারা এখন জেগে উঠে বিদ্রোহ করছে। আধুনিক অস্ত্র নিয়ে দুটি বড়ো বড়ো বিশ্বযুদ্ধে লড়াই করার অভিজ্ঞতা তাঁদের আছে এবং তারা সংখ্যায় ভারতে থাকা ইংরেজ সৈনিকদের থেকে অনেক বেশি। বিশ্বযুদ্ধের ফলে ব্রিটিশ সরকারের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। এমতাবস্থায় অন্য জায়গা থেকে গোরা সৈন্য এনে বিরাট ভারতবর্ষকে দাবিয়ে রাখা আর ইংরেজের পক্ষে সম্ভব নয়। তারা উপলব্ধি করল মানসম্মান নিয়ে ইংরেজের পক্ষে ভারতবর্ষে থাকা আর সম্ভব নয়, ভারতবর্ষকে আর দাবিয়ে রাখা যাবে না। তাই মানসম্মান বজায় রেখে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ইংরেজ তড়িঘড়ি ভারত ছেড়ে চলে যায়। এটাই ঐতিহাসিক সত্য। এই সত্যটা তখনকার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্রিমেন্ট অ্যাটলি স্বীকার করেছেন। এই সত্যকে কংগ্রেস ও তাদের তাবেদাররা এতদিন ধরে চেপে রেখেছিল।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই ঐতিহাসিক সত্যকে মর্যাদা দিয়ে আজাদ হিন্দ সরকারের ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর দিল্লির লালকেল্লায় ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে নেতাজী সুভাষচন্দ্রকে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্বীকার করে নেন। আবার ৩০ ডিসেম্বর তিনি আন্দামানে গিয়ে নেতাজী কর্তৃক স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলনের ৭৫ বছর পূর্তি পালন করেন। সেখানকার রস আইল্যান্ডের নামকরণ করেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস দ্বীপ। সেখানকার ‘নীল আইল্যান্ড’ও ‘হ্যাভলক আইল্যান্ড’-এর নাম নেতাজীর রাখা শহিদ দ্বীপ’ও ‘স্বরাজ দ্বীপ পুনরায় ঘোষণা করে নেতাজীর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর এই কাজে কোটি কোটি ভারতবাসীর আহত আবেগ কিছুটা শান্ত হয়েছে।
দেশবাসীর আশা, প্রধানমন্ত্রী যেন। ১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবরকে ভারতের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন এবং নেতাজীর মৃত্যু রহস্য উদঘাটনের জন্য নেতাজী সংক্রান্ত সমস্ত ফাইল উন্মোচনের ব্যবস্থা করেন।
প্রণব দত্ত মজুমদার