We do not think that anything western should be adopted simply because it is western, we also do not think that anything western should be rejected simply because of its origin. Knowledge and truth are universal in character. Truth knows no class, caste or nation. We are, therefore, in favour of assimilating knowledge from all peoples. Of course, we must scrutinise it in the light of our past traditions and present requirements, and then decide how much of it is to be adopted, how much adapted, and how much rejected. — Dattopant Thengadi
আমরা মনে করি না যে পাশ্চাত্যের যেকোনো বিষয় আমাদের গ্রহণ করতে হবে কেননা তা পাশ্চাত্য; আমরা এটাও মনে করি না যে পাশ্চাত্যের যেকোনো বিষয় আমাদের বর্জন করতে হবে, কেননা তা একান্তই প্রাশ্চাত্য। জ্ঞান এবং সত্য সার্বজনীন। সত্য কোনো গোষ্ঠীকে চেনে না, চেনে না সম্প্রদায় কিংবা জাতিকে। সুতরাং আমরা সকল মানুষের কাছ থেকেই জ্ঞানান্বেষণে উৎসাহী। অবশ্য সেই জ্ঞানকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চিনে নিতে হবে আমাদের পুরাতনী ঐতিহ্যের আলোয়, বর্তমানের প্রয়োজনানুসারে। তারপরেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কতটুকু গ্রহণ করবো কিংবা কতটুকু বর্জন করবো। — দত্তপন্থ ঠেংড়ী
*কে এই রাষ্ট্রঋষি?*
রাষ্ট্রঋষি দত্তপন্থ বাপুরাও ঠেংড়ী একজন হিন্দু-ভাববাদী দার্শনিক ও চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব। বহু প্রতিভার অধিকারী এই যুগদ্রষ্টা, তপস্বী মানুষটি ভারতের শ্রেষ্ঠ মজদুর ও কৃষক নেতা/কার্যকর্তা; এই বছর তাঁর জন্মশতবর্ষ শুরু হয়েছে (১৯২০ -২০১৯)। তিনি প্রণম্য এই কারণেই, তিনি চিন্তার খোরাক যুগিয়ে, রাষ্ট্রের কাজে নিয়োজিত হয়ে সমকালের গন্ডি বহুদূর পেরিয়ে এসেছেন। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্র সংগঠন যথাক্রমে ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ, ভারতীয় কিষান সঙ্ঘ এবং অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের তিনি প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর মৌলিক চিন্তার অনবদ্য প্রকাশ যে গ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে তা হল ‘Third Way‘, বইটির পরতে পরতে তাঁর ভারত-বিকাশ ভাবনা আমাদের ঋদ্ধ করেছে। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, জ্ঞান ও বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে স্থিতপ্রজ্ঞা যুক্ত না হলে মানবসভ্যতার ধ্বংস অনিবার্য। তারই প্রয়াসে ব্রতী হয়েছিলেন ঠেংড়ীজী। ভারতীয় দর্শন বিশ্বের দরবারে প্রচার করতে তিনি ৩৩ টি দেশে দীর্ঘ প্রবাস-যাপন করেছিলেন। এই অনন্য প্রতিভার অধিকারী রাষ্ট্র-ঋষির জন্মশতবর্ষ ভারত জুড়ে পালিত হচ্ছে।
*রাষ্ট্রঋষি দত্তপন্থ ঠেংড়ীজীর সাংগঠনিক প্রতিভা*
বহু প্রতিভার অধিকারী দত্তপন্থ ঠেংড়ীজীকে কেবল তাঁর সঙ্গেই তুলনা করা যায়। একজন মানুষ তাঁর জীবদ্দশায় এত সংগঠনের প্রাণ-পুরুষ ছিলেন, তা না জানলে তাঁর অবদান আমাদের কাছে অধরাই থেকে যাবে। দত্তপন্থকে যে জন্য সারা বিশ্ব মনে রাখবে, তার কারণ, তিনি বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনের সংস্থাপক। সংগঠন দু’টির নাম যথাক্রমে ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ (BMS) যার প্রতিষ্ঠা ১৯৫৫ সালের ২৩ জুলাই ভোপালে এবং ভারতীয় কিষান সঙ্ঘ (BKS) যার প্রতিষ্ঠা ১৯৭৯ সালের ৪ মার্চ রাজস্থানের কোটা শহরে। এ ছাড়াও তিনি ১৯৮৩ সালের ১৪ এপ্রিল সামাজিক সমরসতা মঞ্চ, ১৯৯১ সালের ১৪ এপ্রিল মুম্বাই নগরে সর্বপন্থ সমাদর মঞ্চ এবং ১৯৯১ সালের ২২ নভেম্বর নাগপুর শহরে স্বদেশী জাগরণ মঞ্চের সংস্থাপনা করেন। পর্যাবরণ মঞ্চও তাঁরই প্রতিষ্ঠা। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা জীবনের প্রারম্ভে কিশোর বয়স থেকেই লক্ষ্য করা যায়। ১৯৩৫ সালে তিনি জন্মস্থান আর্বী (ওয়ার্ধা জেলা, মহারাষ্ট্র) তালুকা-র বানর সেনা কমিটির অধ্যক্ষ হন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৫ বছর। ১৯৩৫-৩৬ সালে আর্বী বিদ্যার্থী সঙ্ঘের মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুল কমিটির অধ্যক্ষ হন। ঐ সময়েই তিনি মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুলে গরিব ছাত্র ফান্ড সমিতির সচিব মনোনীত হন। ১৯৩৬ সালে তিনি আর্বী গোবারী ঝুগ্গী ঝুপড়ী মণ্ডলের সংগঠক ছিলেন। এরপর নাগপুরে ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে হিন্দুস্তান সমাজবাদী রিপাবলিকান সেনার প্রোবেশনার হন। ১৯৪২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬২ বছর তিনি ছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রচারক। অখিল ভারতীয় অধিবক্তা পরিষদের এবং ভারতীয় বিচার কেন্দ্রমের (১৯৮২ সালের ৭ অক্টোবর প্রতিষ্ঠা)-ও তিনি ছিলেন মার্গদর্শক ও উদঘাটন কর্তা।তিনি অন্তত ১৭ টি সংগঠনের সংস্থাপক সদস্য ছিলেন। এরমধ্যে অন্যতম হল অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (প্রতিষ্ঠা ১৯৪৯ সালের ১৯ জুলাই), সহকার ভারতী, অখিল ভারতীয় গ্রাহক পঞ্চায়েত, ভারতীয় শিক্ষণ মণ্ডল প্রভৃতি। বনবাসী কল্যাণ আশ্রম সহ ৭ টি সংগঠনে তিনি সহায়ক সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন অপর দুটি শ্রম-সংগঠনে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তাঁর সফল পদচারণা। নানান সময়ে তিনি ভারতীয় জনসঙ্ঘের প্রদেশ সংগঠন মন্ত্রী হিসাবে কাজ করেছেন। ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত তিনি রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন, ছিলেন রাজ্যসভা উপাধ্যক্ষ মণ্ডলের সদস্যও। জনতা পার্টি গঠনে তাঁর বিশেষ ভূমিকা চোখে পড়ে। অন্য নানান সংগঠনেরও তিনি সদস্য ছিলেন, যেমন — প্রজ্ঞাপ্রবাহ, বিজ্ঞান ভারতী, আরোগ্য ভারতী, বনবাসী কল্যাণ পরিষদ, ভারতীয় সাহিত্য পরিষদ, ভারতীয় বুদ্ধ মহাসভা প্রভৃতি।
*রাষ্ট্রঋষির সংক্ষিপ্ত জীবনী*
দত্তপন্থের জন্ম ১৯২০ সালের ১০ ই নভেম্বর ব্রিটিশ ভারতের মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধা জেলার আর্বি গ্রামে। তাঁর পিতা শ্রীবাপুরাও দাজীবা ঠেংড়ী, মাতা জানকী দেবী। ১৯৩৬ সালে তিনি বাপুরাও পালধীকরজীর দ্বারা স্বয়ংসেবক হন এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের সরসঙ্ঘ চালক শ্রী মাধবরাও সদাশিবরাও গোলওয়ালকরের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। ১৯৪২ সালে সঙ্ঘের প্রচারক হিসাবে কেরলে কাজ শুরু করেন। ১৯৪৮-৪৯ সালে বাংলার প্রান্ত প্রচারক হিসাবে কাজ করেন। কর্মজীবনে বাবা সাহেব আম্বেদকর এবং পন্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায়ও তাঁর উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেন। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্ব পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের পূর্ণকালীন প্রচারক ছিলেন। শিক্ষাগত যোগ্যতায় তিনি ছিলেন কলা ও আইন বিষয়ে স্নাতক।তিনি ছিলেন ব্যাপক ভ্রমণশীল ব্যক্তি; সাংগঠনিক কাজ করতে গিয়ে দেশের প্রায় সকল জেলা শহর এমনকি বহু তালুক ও গ্রাম ভ্রমণ করেন এবং নিবাসী-প্রবাস যাপন করেন। সাংসদ প্রতিনিধিরূপে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং হাঙ্গেরি (১৯৬৯) ভ্রমণ করেছিলেন; ১৯৭৯ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভাতে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক Anti-Apartheid Conference-এ অংশগ্রহণ করতে গিয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রিটেন ও যুগোস্লাভিয়া থেকে আমন্ত্রিত হয়ে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের উপর উদার অর্থনীতির প্রভাব সংক্রান্ত অনুধ্যান করেন। অসাধারণ বাগ্মীতার সুবাদে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে আমন্ত্রিত হয়ে তিনি চীন, জাকার্তা, বাংলাদেশ, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কেনিয়া, উগান্ডা ও তাঞ্জানিয়ায় ভ্রমণ করেন। এছাড়া মিশর, মরিশাস, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইতালি, জার্মানী, লুক্সেমবার্গ, হল্যান্ড, ডেনমার্ক, মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, ইজরায়েল, ফিজি, ত্রিনিদাদ, ওয়েস্ট ইন্ডিজও ভ্রমণ করেছেন।তিনি অসংখ্য পুস্তকের রচয়িতা, তাতে কেবল ভাবাদর্শ স্থান পেয়েছে তা নয়, তাতে উপস্থাপিত হয়েছে তাঁর অজস্র অভিজ্ঞতার উজ্জ্বল উদ্ধার। তাঁর বিখ্যাত বইগুলির মধ্যে ‘পার্সপেক্টিভ’, ‘থার্ড ওয়ে’, ‘ফোকস অন সোশ্যাল ইকোনমিক প্রবলেম’, ‘কম্পিউটারাইজেশন’, ‘হোয়াই ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ’, ‘রাষ্ট্রীয় পুনর্নির্মাণ কা আধার’, ‘ধ্যেয় পথ পর কিসান’, ‘ভারতীয় কিসান’, ‘জাগৃত কিসান’, ‘অপনি রাষ্ট্রীয়তা’, ‘লোক-তন্ত্র’, ‘রাষ্ট্রীয় পুরুষ ছত্রপতি শিবাজী’, ‘সঙ্কেত রেখা’, ‘কার্যকর্তা’ প্রভৃতি অন্যতম।
*ঠেংড়ীজী ভারতীয় কিষান সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা*
ভারতীয় কিষান সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা, পরিচিতি ও প্রচারে তাঁর অনবদ্য ভূমিকা; গ্রাম সংসদকে সমৃদ্ধ করে সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখানোর তিনি অন্যতম কারিগর। তাঁরই যোগ্য নেতৃত্বে ও যোগ্য উত্তরসূরী নির্মাণের প্রেক্ষিতেই ভারতীয় কিষান সঙ্ঘ আজ বিশ্বের সর্ববৃহৎ কৃষক সংগঠনের অবয়ব লাভ করেছে।
*ভারতীয় কিষান সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচী*
রাজস্থানের কোটা শহরে ১৯৭৯ সালের ৪ ঠা মার্চ ভারতীয় কিষান সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা। অখিল ভারতীয় এই অরাজনৈতিক কৃষক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী দত্তপন্থ ঠেংড়ীজী। তিনি দক্ষ সংগঠক ছিলেন, ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ (১৯৫৫) এবং স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ (১৯৯১)-ও তাঁরই প্রতিষ্ঠা। তাঁরই সুযোগ্য নেতৃত্বে কোটা শহরে কয়েকশো কর্মী সম্মিলিত হলেন, এরা ভারতের নানা অঞ্চলে কৃষকদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করছিলেন। তাদের সমবেত চিন্তা-চেতনা ও আলোচনা-পর্যালোচনার পর সর্বসম্মতভাবে স্থির হল দেশব্যাপী একটি জাতীয় কৃষক সংগঠন গড়ে তোলা হবে, তার নাম হবে ‘ভারতীয় কিষান সঙ্ঘ’। সংগঠনের উদ্দেশ্যগুলি হল এইরকম : ১. আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক শিক্ষাগত অবস্থার উন্নতির জন্য কৃষকদের একত্রিত ও সংগঠিত করা। কৃষি-শিল্পের সক্রিয়তা বৃদ্ধি করে জীবন-জীবিকার জন্য ও টিকে থাকার জন্য এক স্থায়ী পথ খুলে দেওয়া। ২. কৃষি-প্রযুক্তিতে নতুন প্রবর্তন, উন্নয়ন এবং পদ্ধতিগুলিকে কৃষকদের মধ্যে সম্প্রসারণের জন্য কৃষি-সাহিত্য ও পুস্তিকার যোগান দেওয়া এবং তা গ্রহণ করার জন্য কৃষিজীবী মানুষকে উৎসাহিত করা।৩. সনাতনী ও পুরাতনী কৃষি-কলাকৌশল ও পদ্ধতিগুলিকে গুরুত্ব আরোপ করে তার সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির মেলবন্ধন ঘটিয়ে পরিবেশ-নিরাপত্তার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া যাতে মাটির উর্বরতা, লভ্য জল, বীজ, গবাদিপশু, উদ্ভিদ ও জৈব বৈচিত্র্যে কোনরূপ সংকট ঘনীভূত না হয়। ৪. শত শত বছর ধরে প্রচলিত দেশীয় পুরাতন কৃষি পদ্ধতিগুলি সংগ্রহ, পরীক্ষণ, উদ্ভাবন, উন্নতিকরণ ও বহুল প্রচলনের মাধ্যমে তার সুফল গ্রহণ এবং তা যাতে পেটেন্টকৃত হয়ে কোন সুবিধাবাদী ব্যক্তি বা সংগঠনের কুক্ষিগত না হয় তার বন্দোবস্ত করা।৫. কৃষি-বিষয়ক অধ্যয়ন-গোষ্ঠী, অধ্যয়ন-ভ্রমণ, প্রদর্শনী, আলোচনা সভা, মিলোনোৎসব, শোভাযাত্রা, প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ইত্যাদি সংগঠিত করা যাতে কৃষিজীবী মানুষের সমস্যার সমাধান করা যায় এবং তা কৃষকের প্রয়োজনে লাগে। ৬. কিষান সঙ্ঘের কাজ ত্বরান্বিত করতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানান প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করে নেওয়া যাদের সদৃশ উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম রয়েছে। ৭. ঘোষিত উদ্দেশ্য সফল করতে নানান শ্রম-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান, সমবায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সহায়তা গ্রহণ করা। ৮. কৃষি বিষয়ক নানান ক্রিয়াকলাপকে উৎসাহিত করতে বিবিধ ভারতীয় গো-বংশ ও অন্যান্য প্রাণীকূলকে সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধ করা।৯. ভারতীয় কৃষক ও কৃষি-শ্রমিকদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও হৃদ্যতা বাড়ানো এবং গ্রামীণ পেশাগত কাজে নিযুক্ত ছুতার, কামার প্রভৃতি লোকগোষ্ঠী যাতে গ্রামে যথোপযুক্ত পরিবেশে তাদের সৃষ্টিমূলক কাজ চালিয়ে যেতে পারেন তার ব্যবস্থা করা। ১০. উপরিউক্ত উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এবং কৃষকের স্বার্থে নানান ক্রিয়াকলাপ ও কার্যক্রম গ্রহণ করা। ১১. জমি, জল, শক্তি, সম্পদ ও বাস্তুতন্ত্র ব্যবস্থাপনার জন্য নানান সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সহায়তা গ্রহণ করে কৃষককে প্রশিক্ষিত করা।১২. উন্নত সেচ ব্যবস্থাপনার জন্য এবং জলের অপচয় রোধ করতে নানান সাজসরঞ্জাম ও পদ্ধতি উদ্ভাবন, গ্রহণ ও তার সম্প্রসারণ করা।
এক নজরে ভারতীয় কিষান সঙ্ঘের পরিচয়প্রতিষ্ঠা দিবস: ১৯৭৯ সালের ৪ ঠা মার্চ (রাজস্থানের কোটা শহরে)ধ্যেয়বাক্য: ‘কৃষিমিত্ কৃষস্ব’ — ঋগ্বেদ থেকে গৃহীত, অর্থ শুধু কৃষিকাজই করো (Do farming itself)প্রতীক চিহ্ন (Emblem) : বিশ্ব ভূমন্ডলে অখন্ড ভারতবর্ষের মানচিত্রের মধ্যে লাঙ্গল চিহ্ন পতাকা : প্রতীক চিহ্ন অঙ্কিত গৈরিক পতাকা দেবতা : ভগবান বলরামকৃষি দিবস : বলরাম জয়ন্তী (ভাদ্র শুক্ল ষষ্ঠী) নীতি : অরাজনৈতিক সংগঠন সংকল্প : কিষানের উত্থান — রাষ্ট্রের উত্থান, কৃষকের উন্নতি — রাষ্ট্রের উন্নতি।বৈশিষ্ট্য : সংগঠন নেতা নির্ভর নয়, কার্যকর্তা নির্ভরকাজের লক্ষ্য : দেশকা হাম ভান্ডার ভরেঙ্গে, লেকিন কিমত পুরা লেঙ্গে ( দেশের ভান্ডার ভরিয়ে তুলবো, কিন্তু দাম পুরো নেবো)স্বপ্ন : হর কিষান হমারা নেতা হ্যায় (সকল কৃষকই আমাদের নেতা)সর্তক বাণী : যব তক কিষান দুঃখী রহেগা, ধরতি পর তুফান বহেগা (যতদিন কৃষক দুঃখী থাকবে ততদিন পৃথিবীতে অস্থিরতা থাকবে)
The four mandatory programs of Bharatiya Kishan Sangha, please observe those.ভারতীয় কিষান সঙ্ঘের সাংগঠনিক বিস্তারের জন্য গ্রাম-সমিতি থেকে শুরু করে প্রান্ত-স্তর পর্যন্ত নিম্নলিখিত ৪ টি কার্যক্রম অবশ্যই পালন করতে হয়। ১. বলরাম জয়ন্তী বা কিষান-দিবস (ভাদ্র মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে উৎযাপিত) Baloram Jayanti or Kishan-dibos — Bhadra Shukla Shasthi২. গো-মাতা পূজন বা গোষ্ঠাষ্টমী (কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে উৎযাপিত) Go-mata Pujon or Goshthastomi — Kartick Shukla Ashtomi৩. ভারতমাতা পূজন (২৬ শে জানুয়ারি) Bharat-Mata Pujon — 26 January ৪. স্থাপনা দিবস (ভারতীয় কিষান সঙ্ঘ ৪ ঠা মার্চ স্থাপিত হয় ১৯৭৯ সালে) Foundation Day of Bharatiya Kishan Sangha — 4th March
সারা ভারতবর্ষের নানান প্রান্তের সঙ্গে ভারতীয় কিষান সঙ্ঘের পশ্চিমবঙ্গ প্রান্তও রাজ্যস্তর থেকে শুরু করে জেলা, ব্লক ও গ্রাম স্তরে ঠেংড়ীজীর জন্মশতবর্ষ উদযাপনে মনস্থ হয়েছে; নানান পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে — প্রতিটি জেলা ও রাজ্যে একটি করে বৃহত্তম মনোজ্ঞ আলোচনা সভা, বাংলাভাষায় ঠেংড়ীজীর কর্ম ও জীবনদর্শন সংক্রান্ত পুস্তক প্রকাশ; প্রতিটি জেলায় কৃষি বিশেষজ্ঞকে আহ্বান করে ‘Dattapanth Thengedi Memorial Lecture’ প্রদান করে কৃষিজীবী মানুষকে আধুনিক প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয়ে অবহিত করা এবং রাজ্যের দু’একটি জেলায় ভারতীয় কিষান সঙ্ঘের জেলা-করণের নাম ঠেংড়ীজীর নামে অভিহিতকরণ ইত্যাদি। এ রাজ্যে বর্ষব্যাপী নানান কার্যক্রম রূপায়ণ করে তাঁর জন্মশতবর্ষ পালিত হবে।
*দত্তপন্থজী ছিলেন ভিশনারী আর্কিটেক্ট* এদিন বিকেলে একটি টেলি কনফারেন্সের আয়োজন করে ‘উত্তর ২৪ পরগণা দত্তপন্থ ঠেংড়ী জন্মশতবর্ষিকী উৎযাপন সমিতি’৷ তাতে মুখ্য বক্তা ছিলেন স্বদেশী জাগরণ মঞ্চের সর্বভারতীয় কার্যকর্তা শ্রী সরোজ মিত্র। সরোজ বাবু বলেন, অসম্ভব দূরদৃষ্টি ছিল ঠেংড়ীজীর, ১৯৬৮ সালেই ভাবতে পেরেছিলেন কমিউনিজম ভারতবর্ষে ভবিষ্যতে আর কাজে আসবে না। রাজ্যসভায় এবং একবার সঞ্জীব রেড্ডির সামনে বলেছিলেন, Communism is in reverse gear in Russia. ভারতবর্ষে তার প্রাসঙ্গিকতা শেষ হওয়া কেবল সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু দেখা গেলো, তার পরেও পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসেছে। পুরনো কথা স্মরণ করিয়ে দিলে বলতেন, ক্ষমতায় আসা আলাদা জিনিস। সিপিএম একটা বিনা-কমিউনিজমের দল। ২০০৪ সালে ১৪ ই অক্টোবর তাঁর দেহাবসান হয়। সিপিএম-এর জামানা সমাপ্তি দেখে যেতে পারেন নি তিনি। ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘকে তৈরি করে ভবিষ্যৎ ৫০ বছরের রসদ দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৫ সালে এই সংগঠন (বিএমএস) গড়ে তোলেন। একটি মানুষের একটি সংগঠন গড়ে তুলতেই সারা জীবন লেগে যায়, কিন্তু তিনি একের পর এক সংগঠন তৈরি করতে লাগলেন। যেন এক অদ্ভুত সাংগঠনিক-ব্যক্তিত্বের পরাকাষ্ঠা! শুধু ভারতবর্ষ কেন, সারা বিশ্বে এমন নেতৃত্ব দেবার লোক খুঁজে পাওয়া মুস্কিল। তাঁর লক্ষ্যটা ছিল অন্য জায়গায়, গঠন করতে করতেই তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন তাঁর লক্ষ্যের অভিমুখে। কী সেই লক্ষ্য? তা হল Total Renaissance, সম্পূর্ণ রেনেসাঁস; জয়প্রকাশ নারায়ণের মতো ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ বিপ্লব (Total Revolution) নয়। ১৯৭৫ সালের ২৬ শে জুন জরুরি অবস্থা জারী হয়। জয়প্রকাশ নারায়ণ, মুরাজ্জী দেশাই প্রমুখ বিরোধী নেতাকে গ্রেপ্তার করা হল। নানাজী দেশমুখ ‘লোকসংঘর্ষ সমিতি’-র নেতৃত্ব দিলেন, তাঁকেও গ্রেপ্তার করা হলে নেতৃত্ব দেবার অনুরোধ এলো ঠেংড়ীজীর কাছে। তিনি তখন ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘের জেনারেল সেক্রেটারি। ১৯৭৫ সালের ৯ ই সেপ্টেম্বর ঠেংড়ীজী কটক থেকে সরোজ মিত্রকে ডেকে পাঠিয়েছেন। কলকাতার সেন্ট্রাল এভিনিউ-এর একটি বিল্ডিং-এ বৈঠক হচ্ছে। চেনাই যাচ্ছে না ঠেংড়ীজীকে, এমন ছদ্মবেশ নিয়েছেন তিনি। সরোজ বাবুর পাশেই বসে আছেন, সরোজ বাবু চিনতে পারেন নি প্রথমে। ওই সভায় সার্বিক হতাশা ঝরে পড়লো — আর কিছু করার নেই জরুরি অবস্থায়; সিপিএম পালিয়ে গেছে; ইন্দিরা এক এক করে সকল নেতাকে জেলে ঢোকাচ্ছেন; বিরোধী দলগুলির কাজ থমকে আছে; অথচ ইন্দিরার সভায় হাজার হাজার মানুষের জমায়েত হচ্ছে। গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ হয়েছে, এভাবে কাজ হবে কী করে? শান্তকণ্ঠে ঠেংড়ীজী বললেন, এই অবস্থা থাকবে না। ১৭ মাস পরেই ইন্দিরার শাসন খতম হয়ে যাবে। সরোজ বাবু বিনীতভাবে জানতে চাইলেন, আপনি কি কোনো জ্যোতিষীর মতামত দিচ্ছেন? এইরকম মাস গুণে বলা যায়? ঠেংড়ীজী বললেন, ইন্দিরা গান্ধী এইভাবে প্রশাসন চালাতে পারবেন না, কারণ ওনার ডিক্টেটর হবার যোগ্যতাও নেই। এত বড় দেশে জরুরি অবস্থা দীর্ঘদিন জারী রেখে নিজের ভাবমূর্তি ধরে রাখা ওনার কম্ম নয়; তার জন্য যোগ্যতা লাগে। এরপর ঘটনাচক্রে সরোজ মিত্রও জেলে গেলেন। ছাড়া পেলেন যখন, মিলিয়ে দেখলেন, ১৭ মাস।সঙ্ঘবিচার ধারার রাজনৈতিক দল জনসঙ্ঘকে জনতা পার্টিতে মিশিয়ে দেওয়া হল। এই দল পরবর্তী নির্বাচনে ইন্দিরা কংগ্রেসকে পর্যুদস্ত করলো। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সমস্ত পার্টিকে একত্রিত করার কাজে সক্রিয় হয়ে ইন্দিরাকে হারানো পর্যন্ত থাকলেন তিনি, তারপর বেরিয়ে এলেন। কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব নেবার, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের পদ পাবার মোহ তাঁর ছিল না। পদ্মভূষণ, অন্য অসামরিক পুরস্কারও ফিরিয়ে দিতে পারেন অনায়াসে। এমনই উচ্চকোটির মানুষ ছিলেন তিনি। বিনয়ের সঙ্গে বলতেন, আমার কাজ শেষ হয়ে গেছে; এবার আমি মুক্ত। বিএমএস প্রেসিডেন্ট নরেশ গাঙ্গুলীর অনুরোধে তার দায়িত্বও নিলেন না। সেই পত্রবাহকের কাজ করেছিলেন সরোজ মিত্র। সরোজ বাবুকেই তিনি বললেন চিঠিটি খুলে, পড়ে শোনাতে। ইতস্তত করছেন সরোজ বাবু; ঠেংড়ীজী বললেন, আরে খোলো, নরেশ বাবুর চিঠিতে এটাই লেখা আছে। ঠেংড়ীজী দৈনিক ব্যবহার লিপিবদ্ধ না হলেও তা ছিল চমকপ্রদ। ৫৭, সাউথ এভিনিউ; নিউদিল্লীতে রয়েছেন। মে মাসের রোদ্দুর, দুপুর দু’টো। গেঞ্জি-লুঙ্গি পড়ে সরোজ বাবুকে সঙ্গে নিয়ে ওই দুপুরে চক্কর কাটছেন ঝুপড়িতে ঝুপড়িতে। কেন? প্রিয় এক মুচির সঙ্গে দেখা করে যাবেন, প্রিয় ধোপা যে ওখানেই থাকেন, তার সঙ্গে দেখা করা চাই। দিল্লিতে এলে তাদের সঙ্গে দেখা না হলে কষ্ট পেতেন। এক ঘন্টা রোদে রোদে চরকি কেটে দুজনে এক গ্লাস লস্যি খেয়ে ফিরে এলেন, তারপর সরোজ বাবুকে বললেন, স্টেশনে নিয়ে চলো, নাগপুর যাবো। এমন ব্যক্তিগত জীবন ভাবা যায় না!
একবার দিল্লিতে রয়েছেন ঠেংড়ীজী। ১০-১২ জন দর্শনার্থী, সবাই প্রবুদ্ধ মানুষ। এদের মধ্যে রয়েছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপকও। তিনি এসে সরোজ বাবুকে বলছেন, ঠেংড়ীজীকে একটি থিসিস দেখতে দিয়েছি মতামতের জন্য। ঘটনার কথা স্মরণ করে সরোজ বাবু স্তম্ভিত হয়ে যান। থিসিসের টাইটেল “Dialectical materialism versus Anasakta Yoga” কতটা দূরদৃষ্টি থাকলে তাঁকে এই থিসিসের জন্য মত নিতে আসেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক! আর কত কী বিষয়ে গভীর জ্ঞান ছিল তার — ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট দলের প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মতাদর্শ থেকে দীনদয়াল উপাধ্যায়ের একাত্ম মানব দর্শন সব বিষয়েই তাঁর পড়াশোনা ছিল।
ঠেংড়ীজীর ব্যক্তিত্বের পুরোটা কেউ জেনে উঠতে পারেন নি। বলা হয়, একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের Time Horizon ৫ বছর, একজন দেশনেতা বা স্টেটসম্যানের Time Horizon ১০ বছর, কিন্তু একজন সাধুসন্তের Time Horizon ১০০ বছর। রাষ্ট্রঋষি দত্তপন্থ ঠেংড়ীজীর প্রাসঙ্গিকতা ১০০ বছরেও অম্লান। তাঁর জন্মশতবর্ষে আমরা স্মরণ করতে পারি, ১৯৮২ সালে নাগপুরের সঙ্ঘ অধিবেশনে তাঁর ভবিষ্যৎ বাণী, আগামী শতাব্দী (২০০০ সাল থেকে পরবর্তী ১০০ বছর ও তারপরেও) হবে হিন্দু-শতাব্দী। পৃথিবীর জ্ঞানীগুণী মানুষের জ্ঞানভাণ্ডার শেষ সীমায় উপনীত হয়েছে, আর নতুন লক্ষ্যে পৌঁছাচ্ছে না, এগোচ্ছে না, একটি স্থবিরতা যেন পেয়ে বসেছে; তাই এখন সমগ্র বিশ্ব ভারতীয় বেদ-দর্শনের মধ্যে নতুন আশার সন্ধানে মনোনিবেশ করেছে। বিশ্বজুড়ে ভারততত্ত্ব এক অভূতপূর্ব অধ্যয়ন।
সমস্ত সংগঠন রচনার মধ্যে যে একটা বৃহৎ লক্ষ্য স্থির করে এগোতে হয়, তা কর্মজীবন ও দর্শনের মধ্যে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন ঠেংড়ীজী। শ্রমিক সংগঠন ও তার রাজনীতির পরত কেমন হবে, তার একটি উদাহরণ দিয়ে দত্তপন্থজীর আন্দোলনের রূপরেখা দেখিয়েছেন সরোজ বাবু। ১৯৬৯ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট ভি ভি গিরি-র কাছে ট্রেড ইউনিয়নের পক্ষে মেমোরেন্ডাম দিচ্ছেন, তাতে রাজ্যসভা ভেঙ্গে দিয়ে Functional Representation করতে দাবী জানাচ্ছেন। রাজ্যসভায় সমস্ত বিষয়ের প্রতিনিধি-স্থানীয় ব্যক্তিত্বকে পাঠাতে হবে, ছিল দাবী। রাজ্যসভা হবে ভারতের একটি এক্সপার্ট গ্রুপ। আজকের শ্রমিক সংগঠনগুলি এসব ভাবনা ভাবতেও পারে না!
স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ যখন গঠন করলেন বিদেশী পূঁজিপতিদের প্রতি একটি পরিস্কার বার্তা দিয়ে রাখলেন। তিনি বুঝেছিলেন বিশ্বের যা কিছু রিসোর্স, আমেরিকাকে বাদ দিয়ে, তা প্রায় সবই রয়েছে সাউথ-এ। আর ক্যাপিট্যাল যা আছে তা নর্থ-এ। যে দেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ, তা কেন পরমুখাপেক্ষী হবে? বিকল্প অর্থনীতির কথা এবং মার্গদর্শন করিয়ে তিনি লিখলেন ‘Third Way‘ গ্রন্থ। Preface of Hindu Economics -এ তিনি পরিস্কার উল্লেখ করলেন, দেশের অর্থনীতি কোন দিকে যাওয়া দরকার, Sustainable Development বা চিরায়ত উন্নয়ন কোন পথে তা বুঝিয়ে দিলেন। Self-employment System -এর পক্ষে তিনি সওয়াল করেছেন, যা নেহেরু জামানায় রাশিয়াকে নকল করতে গিয়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আগে ভারতবর্ষের গ্রামগুলি সমস্ত পেশার মানুষের বসবাসে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল; নাপিত, ছুতোর, মুচি, তন্তুবায়, কামার, কুমোর, স্যাঁকরা সবাই থাকতেন এক গ্রামে। দত্তপন্থজী মনে করতেন, দরকার ছিল স্বাধীন ভারতে এদের সকলকে Skill Development করিয়ে দেওয়া এবং মার্কেটিং-এর ব্যবস্থা করা; তা না করে নেহেরু রুশ মডেলে ITI গড়ে তুলে কিছু আধা কারিগর বানিয়ে শিল্পের জন্য নতুন ভারত গড়তে চাইলেন। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই স্বয়ং-সম্পূর্ণ কাঠামো ভেঙ্গে পড়লো, কারিগর সমাজ নষ্ট হয়ে গেল। শিল্পকারখানায় কাজের লোভে সামান্য ট্রেনিং নিয়ে ছাত্রেরা ছুটলো মাসকাবারি চাকরি করতে। কলের সস্তা জিনিস বাজারে এলো, গ্রামে কামারের জিনিস, কুমোরের জিনিস আর বিকোলো না। ঠেংড়ীজী বলতেন, দেশীয় জিনিস যদি সামান্য নিম্নমানেরও হয়, তাই পরম আদরে ব্যবহার করা দরকার, স্বদেশী আন্দোলনের সময় ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’-ই তো মাথায় তুলে নিয়েছিল দেশবাসী! এসব স্বদেশী চিন্তাচেতনার প্রয়োজন আজ এসে পড়েছে। বাড়িতে বাড়িতে কেন ফলের গাছ লাগানো হবে না? উদ্ভিজ্জ নানান সামগ্রী নির্মাণের জন্য গাছ লাগাতেই হবে। সরোজ বাবু রাষ্ট্রঋষি ঠেংড়ীজীর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, আর্থিকক্ষেত্রে দেখতে হবে অঞ্চলে অঞ্চলে সমীক্ষা করে কী করা যায়! কতটুকু আছে সেই অঞ্চলে, কতটুকু নেই, কতটুকু ছাড়াই দৈনন্দিন জীবন চলে যায়, কতটুকু সেই অঞ্চলেই উৎপাদন করে নেওয়া যায় ইত্যাদি। যেমন সাবানের পাউডার উৎপাদনের জন্য তো আহামরি হাই-টেকনোজলির দরকার নেই, এরজন্য মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানি সাবান কেন কিনবো? বাইরে থেকে যা আসছে, তার মধ্যে করোনা নেই, অন্য রোগজীবাণু মুক্ত কে তার গ্যারান্টি দেবে? সরোজ বাবু রাখঢাক না রেখেই বলেছেন, ইকোনোমিকসের ওই প্রফেসরদের দিয়ে কিছু হবে না; ওইসব নোবেলবিজয়ী দিয়েও হবে না। দেশীয় আর্থিক চিন্তন নষ্ট করে দিয়ে কৃত্রিম উন্নয়ন কোনো কাজের কথা নয়! ঠেংড়ীজীর ‘কার্যকর্তা’ নির্মাণ সম্পর্কিত বই আমাদের সকলের পড়া দরকার। এটি যেকোনো সংগঠনের জন্যই প্রযোজ্য। ব্যক্তিত্ব নির্মাণের জন্য পড়া উচিত, কীভাবে কাজ করতে হবে, তার দিশা দেখিয়েছেন তিনি। এমন দুর্লভ সংগঠক পৃথিবীতে বিরল।
*সংগঠন কাকে বলে? সাংগঠনিক বল, কার্যকর্তা নির্মাণ কী করে হয়?* যৌবন বয়সে দত্তপন্থ ঠেংড়ীজী গাঁয়ের কয়েক বন্ধু মিলে এক কৃতবিদ্য গুরুজির কাছে কুস্তি, লড়াই আর লাঠিখেলা শিখতে যেতেন। আখড়াটি পারিপার্শ্বিক অঞ্চলে খুবই বিখ্যাত ছিল। অতি দ্রুত তারা খুবই পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন শরীরচর্চার নানান আঙ্গিকে। কিন্তু প্রতিদিন ফেরার সময় তারা লড়াইয়ের পোষাক পরে, ঢিণ্ডোরা পেটাতে পেটাতে, সোজা পথের বদলে আশেপাশের গ্রাম ঘুরে, নিজেদের জাহির করে তবে সদলবলে ফিরতেন। একদিন পাশের গাঁয়ের এক দোকানদার তাদের ডেকে বললেন, বাবা, তোমরা সোজা পথ ধরেই তো ফিরতে পারো, শুধু শুধু আমাদের গ্রাম ঘুরে যাও কেন? রোজ কি তোমরা বীরত্ব দেখাতে চাও? কিন্তু তোমাদের গুরু, যিনি এলাকায় সবচেয়ে বিখ্যাত কুস্তিগির, তিনি তো তোমাদের শিখিয়ে-পড়িয়ে চুপচাপ মাথা নিচু করে চলে যান; তারপর তাড়াতাড়ি স্নান সেরে আখড়ার লালপোষাকটিও ছেড়ে ফেলেন। আসলে জ্ঞানের গভীরতা তোমাদের কম বলেই তোমাদের ব্যক্তিগত গর্ব তৈরি হচ্ছে! তোমাদের গুরুজীর জ্ঞানের গভীরতা বেশি বলে, তার মধ্যে কোনো গর্ব নেই, বরং সকলের প্রতি নিষ্কাম কর্ম আছে। সম্পূর্ণ শিক্ষা হয়ে গেলে, তার ভেতরে গর্ব থাকে না, দেখনদারি থাকে না। তোমাদের প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা ভাবে গর্ব আছে। ব্যক্তিগত গর্ব ভালো নয়। নিজের জীবন থেকে ঘটনাটি বিবৃত করে ঠেংড়ীজী বলছেন, কোনো ব্যক্তির নিজস্ব গর্ব তার জ্ঞানের দীনতাকে প্রকাশ করে; যার জ্ঞান ও অভ্যাস যত গভীর, তার গর্ব ততই কম হবে। গর্ব যখন একের থেকে বহুর মধ্যে চলে যাবে, তখনই তৈরি হবে সংগঠন। আমি নই, আমরা। যখন আমার দর্শন আমার গর্ব, তখন তাতে কোথাও একটা দম্ভের ব্যাপার আছে। যখন আমার গর্ব আমাদের দর্শন হয়ে দাঁড়ায়, তখনই তৈরি হয় সংগঠন। গর্ব ভালো, সেটা হল সমষ্টির গর্ব। ‘ম্যাঁয়’ না বলে ‘হাম’ বলার গর্ব, ওটাই সংগঠন তৈরির চাবিকাঠি। যখন আমি আমাদের কোনো বিষয় নিয়ে গর্ব করি, তখন তা হয়ে ওঠে সুন্দর একটি সংগঠন। সংগঠনে We feeling বড় কথা। এভাবে দত্তপন্থজী সংগঠনের সংজ্ঞা দিয়েছেন।
আরেকটি ঘটনা। একজন ঠেংড়ীজীকে খানিকটা ঠাট্টা করেই জিজ্ঞেস করছেন, আরএসএস-এর কত ক্ষমতা? উনি বললেন, কী করে বলবো? প্রশ্নকর্তা অবাক হলেন– মানে? সদস্য সংখ্যা বলবেন! সব সদস্য যোগ করলেই পেয়ে যাবো, আপনাদের শক্তি কত!ঠেংড়ীজী বললেন, সংগঠনের ক্ষমতা বলার ব্যাপারে A+B — একথা তো ঠিক নয়। আমি এভাবে সংগঠনকে দেখি না। যখন A একটা মানুষ, B আরেকটি মানুষ; A-র ক্ষমতা আলাদা, B-র ক্ষমতা আলাদা। যদি ক্রমান্বয়ে তাদের সক্ষমতা বাড়ে, তবে আপনার মতানুসারে দুজনের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে তা হওয়া উচিত A2+B2 (A square plus B square); কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় A এবং B মিলিত সংগঠনের সমষ্টিগত শক্তি বেড়ে হচ্ছে (A+B)2 (A plus B whole square); এখন (A+B)2 = A2+ 2AB+ B2, চলে এলো আরও একটা 2AB-র মতো অতিরিক্ত কিছু! এটা কোথা থেকে এলো? ঠেংড়ীজী বলছেন, এটাই হল সাংগঠনিক ক্ষমতা। সংগঠনের শক্তি সংগঠনের মোট সদস্যের ব্যক্তিগত শক্তির যোগফলের সমান হবে, এমন কোনো কথা নেই। সংগঠনের একটা নিজস্ব ক্ষমতা থাকে, নিজস্ব শক্তি থাকে। যখন আমি আমাদের নিয়ে গর্ব করছি, তখন আমাদের একটি সাংগঠনিক ক্ষমতা তৈরি হয়, তার মাপনি অত সহজ ব্যাপার নয়।
সংগঠনের একজন সদস্যের কতটা ক্ষমতা, সেটা কখনও পরিমাপ করা যায় না। বিশেষ সময়ে ব্যক্তি বিশেষের ক্ষমতা, বিশেষ রকমের হয়। কোনো কোনো পরিস্থিতিতে কোনো ব্যক্তির ক্ষমতা অনেকগুণ বেড়ে যেতে পারে। কী শর্তে, কী মনোভাব নিয়ে, কী পরিস্থিতিতে কোনো সদস্য কাজ করছেন, তার উপর তার ক্ষমতা কমতে বা বাড়তে পারে। এ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ঠেংড়ীজী তাঁর পরিবারের একটি ঘটনা বললেন। তাঁর এক নিকটাত্মীয় খুব ধনী পরিবারের একটি মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। নববধূ একেবারেই রান্নাবান্নার কাজে পটু ছিলেন না। তখনকার দিনে উনুন জালিয়ে রুটি করতে হত। তা করতে গিয়ে সামান্য একটু গরম রুটির ছেঁকা লাগলে তিনি ‘উফ্-আফ্’ করতেন। এই নিয়ে বাড়ির সবাই রীতিমতো মজা করতেন তার সঙ্গে। একদিন তাদের বাড়িতে আগুন লেগে গেলো, তখন গভীর রাত। পাড়ার লোকেরা তাদের ঘুম ভাঙ্গিয়ে তুললেন। ঘুম ভেঙ্গে পড়ি কি মরি করে সেই বধূ ছুটে বেরিয়ে এলেন। এসেই মনে পড়লো বাড়ির দোলনায় ছোট্ট শিশু ঘুমোচ্ছে। তৎক্ষণাৎ তিনি ওই আগুনের মধ্যে ফের বাড়িতে ঢুকে পরপর দু’টো ঘর অতিক্রম করে তৃতীয় ঘরে গিয়ে দোলনা থেকে শিশুটিকে কোলে করে ফিরলেন। শিশুটি প্রাণ পেলো। তবে তিনি ফিরে আসার পর জ্ঞান হারালেন, অগ্নিদগ্ধতার চিকিৎসায় পরে সুস্থও হয়ে উঠলেন। দত্তপন্থজী বলছেন, যে মানুষটা আগুনের তাপে সামান্য ছেঁকা লাগার জন্য এত ব্যথা পেতেন, তিনিই কিনা অগ্নিকাণ্ডের বিশেষ পরিস্থিতিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, আপন সন্তানের প্রাণ বাঁচাতে। অর্থাৎ পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে মানুষের কর্মদক্ষতা বাড়ে বা কমে যায়।
প্রত্যেক সদস্যের একটা নির্দিষ্ট স্টাইল থাকে। সবাইকে দিয়ে সব কাজ হয় না। যে যে কাজটি করতে সবচাইতে সক্ষম, তাকে দিয়ে সেই কাজটিই করাতে হবে। সেটি সংগঠনের কার্যকর্তাকে বুঝতে হবে; এটাই নেতৃত্বের বড় গুণ। একবার দত্তপন্থজী লক্ষ্নৌ গেছেন, সঙ্গে একজন সহকারী। সেটাই তাঁর প্রথম লক্ষ্নৌ যাওয়া! ফলে লক্ষ্মৌর ভাষার স্টাইল সম্পর্কে তিনি কিছু জানতেন না; তাঁর সহকারী জানতেন সে সব। সেখানে একজন স্বয়ংসেবক তাঁকে বললেন, গরীবের বাড়িতে একবার যেতে হবে। দত্তপন্থজী সম্মতি দিলেন; কিন্তু পৌঁছে দেখলেন প্রাসাদোপম গৃহ। সহকারী ভদ্রলোক আস্তে করে তাঁকে বললেন, এটাই লক্ষ্নৌর কথার স্টাইল। অতঃপর সেই স্বয়ংসেবক বারবার তাঁকে বলতে লাগলেন, এটি আপনার ঘর, এটি আপনার বাগান, এটি আপনার রান্নাঘর ইত্যাদি; এসবই আপনার জন্য। অবশেষে ভদ্রলোকের চারটি ছেলেমেয়ে স্কুল থেকে ফিরলে, উনি তাদের ডেকে দত্তপন্থজীকে প্রণাম করতে বললেন এবং আরও বললেন, এরা আপনারই ছেলেমেয়ে। দত্তপন্থজীর ধৈর্যের বাঁধ এবার ভেঙ্গে গেলো। বলে উঠলেন, আমি ব্রহ্মচারী মানুষ, আমার কীভাবে ছেলেমেয়ে হবে? সহকারী পাশ থেকে বলে উঠলেন, এইভাবেই এখানে বলা হয়, এটাই এখানকার স্টাইল। এই ঘটনার অবতারণা করে দত্তপন্থজী বোঝাতে চাইলেন, সংগঠক বা নেতার বুঝতে হবে সদস্যের স্টাইল কোনটা? তার সেই স্টাইলের মধ্যে দিয়েই তার সর্বাধিক কুশলতার প্রকাশ কীভাবে হতে পারে, তা ভাবতে হবে। যে স্টাইলের কথাবার্তা নিমেষে মানুষকে আপন করে নেয়, তার একটি সদর্থক দিক থাকে, তার আকর্ষণী ক্ষমতাও হতে পারে অনন্য, অভূতপূর্ব। কে ভালো বক্তৃতা দেবে, কে ভালো বই লিখবে, কে সেবার কাজ ভালো করবে – সেটি নির্বাচনের মধ্যে দিয়েই দলের সামগ্রিক কর্মকুশলতা নির্ভরশীল। কার্যকর্তার উচিত হবে, তারাই সুলুকসন্ধান করে বেড়ানো; যোগ্য কাজের জন্য যোগ্যকে চয়ন করা।
*সংগঠককে ক্যারিশ্মা এবং ব্যক্তিপূজা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।*
সংগঠনের সামূহিক ভিত নির্ভর করে কার্যকর্তার নেতৃত্বদানের যোগ্যতার উপর; যেখানে স্ব-পূজন বা ব্যক্তিপূজা নেই; প্রতিভা যেখানে ধারাবাহিক প্রচেষ্টা ও অধ্যাবসায়কে খাটো করে রাখে নি কখনও; কার্যকর্তা যেখানে সদাসক্রিয় এবং প্রত্যুৎপন্নমতি ও জিজ্ঞাসু; সমস্ত রকম দীর্ঘসূত্রতা যেখানে সদা পরিত্যজ্য এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে নিরলস ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সেখানেই সংগঠনের জয়জয়কার। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রঋষি দত্তপন্থ ঠেংড়ী ‘Beware of Charisma‘ শীর্ষক একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তা থেকেই প্রস্তুত আলোচনা।
নেতৃত্বহীন সংগঠন কোনো কাজ করলে শেষ পর্যন্ত এগোতে পারে না। সামগ্রিক নেতৃত্বের দ্বারাই সংগঠনের ভিত রচিত হয়। এ প্রসঙ্গে ঠেংড়ীজী একটি উদাহরণ দিলেন। ভারতীয় কিষান সঙ্ঘের প্রথম কৃষক আন্দোলন হয়েছিল গুজরাটে; ৪০-৫০ জনের একটি যুবদল সেখানে সক্রিয় হয়েছিল, সাইকেল-মোটরসাইকেলে চড়ে হাজার হাজার কৃষক জড়ো হলেন, পুলিশ লাঠি চালালো, গোলাগুলি চললো, অনেকে হতাহত হলেন, তারমধ্যে দু’জন মহিলাও ছিলেন। তখন গুজরাটে কংগ্রেসী শাসন, মুখ্যমন্ত্রী অমর সিং চৌধুরী (Amar Singh Chowdhury as CM from 1985-1989)। সবাই মুখ্যমন্ত্রীকে বললেন, আপনি এদের সঙ্গে কথা বলুন; এদের দাবী কি? মুখ্যমন্ত্রী বললেন, আমি কার সঙ্গে কথা বলবো! আমি কী হাওয়ার সঙ্গে কথা বলবো? এটা তো একটি নেতাবিহীন আন্দোলন! শেষে সংগঠনের তরফ থেকে হাসমুখভাই দাবে (Hasmukhbhai Dave)-কে সংগঠনের তরফে পাঠানো হল। মুখ্যমন্ত্রী কথা বললেন। অর্থাৎ সংগঠনের জন্য সামগ্রিক নেতৃত্ব প্রয়োজন। এখন নেতা বা কার্যকর্তা কীভাবে কাজ করবেন? তাঁকে প্রতিটি মজদুর বা কৃষককে প্রাধান্য দিতে হবে, তাকে জাগ্রত করতে হবে, তাকে নির্দিষ্ট কাজের জন্য উদ্যত করতে হবে, তাকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে সংগঠনের সুনির্দিষ্ট মতাদর্শে। এটাই সামগ্রিক নেতৃত্বের মূল কাজ।
এখন নেতৃত্ব কতটা বিশ্বাসযোগ্য হবেন? এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি আমেরিকান সাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচক স্টিফেন কোভে (Stephen Covey)-র প্রসঙ্গ আনলেন। কোভে দেখালেন ইংরেজি সাহিত্যের দু’শো বছরের ইতিহাসের প্রথম ১৩০ বছর হল সাহিত্যে ব্যক্তিচরিত্র নির্মাণ বিষয়ে আলোচনা ও কাহিনীর বিস্তার; যাকে বলা হয় Character Ethic. How to become great? সাহিত্যের পরতে পরতে দেখানো হয়েছে সারাজীবন ধরে চেষ্টা করে কী করে চরিত্রগুলি নিজেরা মহৎ হয়ে উঠেছে তার আনুপূর্বিক বর্ণনা। কিন্তু পরবর্তী ৭০ বছরে সাহিত্যে দেখা গেলো চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠছে Personality Ethic. How to appear great? এই দ্বিতীয় রকমের চরিত্রগুলিতে ইমেজ বিল্ডিংয়ের ব্যাপার ছিলো, যাকে বলা যায় Image Breeding. তারা গ্রেট কিনা বড় ব্যাপার নয়, কিন্তু গ্রেট দেখাতে হবে। এর প্রভাব ভারতবর্ষেও পড়লো, কারণ সাধারণ ভারতীয় শিক্ষিতেরা পাশ্চাত্যকে অনুসরণ করে। ফলে ভারতীয় সাহিত্যেও এই How to become great বদলে গিয়ে How to appear great — এই চর্চা ও তার প্রতিমা নির্মাণ চললো। এখন ১৯৪৭ সাল; যা ভারতবর্ষে স্বাধীনতা প্রাপ্তির বছর, তার আগে ও পরে ভারতীয় নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য কী? না, ৪৭-এর আগে হল How to become great, ৪৭-এর পর হল How to appear great. ৪৭-এর পরের মানুষের মধ্যে ইমেজ বিল্ডিংয়ের ব্যাপার চলে এলো।
এ প্রসঙ্গে আলোচনা করার সময় দত্তপন্থজী ফিলিপস্ ডোনাল্ড (Phillips Donald) নামে এক মার্কিন প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচকের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন। ডোনাল্ড সাহেব বলছেন, তদানীন্তন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টনের ক্যারিশ্মা নিষ্প্রভ হয়েছে, কিন্তু কিছুদিন আগেও তো দেখেছি তার বিরাট ক্যারিশ্মা! তার পর্যালোচনা করতে গিয়ে ডোনাল্ড গবেষণাধর্মী কাজ করলেন। খুঁজতে লাগলেন, একজন নেতার কী কী সদর্থক গুণ থাকা উচিত এবং কী কী নঞর্থক গুণ থাকা উচিত নয়। তিনি ক্রিটিকাল অ্যানালিসিস করতে উদ্যত হলেন। সেখানেও বাধা পেলেন। কারণ ওদেশে যে নেতাদের নিয়ে সবচাইতে বেশি সাহিত্যে আলোচনা হয়েছে, তিনি হলেন আব্রাহাম লিঙ্কন (Abhraham Lincoln)। তিনি যা কিছু বই পেলেন পড়ে ফেললেন। দেখলেন তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে কোনো সাহিত্যিক কাজ সেখানে নেই। তখন তিনি দেশের সমস্ত সাহিত্য সমালোচক ও পত্রকারদের কাছে চিঠি লিখলেন, জানতে চাইলেন লিঙ্কনের লিডারশিপ কোয়ালিটির উপর কী কী লেখা আছে? কেউ-ই পথ দেখাতে পারলেন না। এইবার তিনি লিঙ্কনের নিজস্ব লেখায় লিডারশিপ নিয়ে কী বলেছেন, কী কী কাজ কীভাবে করেছেন — সেসব নিয়ে পড়াশোনা ও আলোচনা করতে লাগলেন। তিনি একটি বই লিখলেন ‘Lincoln on Leadership‘. সেখানে উল্লেখ রইলো একজন নেতার কী কাজ করা উচিত, কী করা উচিত নয়। সে বইয়ে যা লেখা হল, তাকে বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে একজন অস্ট্রিয়ান-আমেরিকান ম্যানেজমেন্ট বিশারদ পিটার ড্রাকার (Peter F. Drucker), Science of Management এবং Practice of Management -এর উপর একটি বই লিখলেন। নাম দিলেন ‘Beware of Charisma‘. ড্রাকার সাহেব রিয়ালিটিতে প্রতিষ্ঠা করে গেলেন, একজন নেতা কেমন হওয়া উচিত।
দত্তপন্থজী বলছেন, নেতাকে সবসময় হতে হবে, How to become great. কখনোই তিনি ইমেজ ব্রিডিং করবেন না। বাস্তব থেকে দৃষ্টান্ত নিলেন কয়েকজন নেতার, ইমেজ ব্রিডিং আছে এমন তিন বিশ্বনেতার নাম করলেন, যারা বিগত শতকে বহুশ্রুত, অথচ হারিয়ে গেছেন; তারা হলেন হিটলার, মুসোলিনি এবং স্ট্যালিন। এরা স্ফূলিঙ্গের মতন ক্যারিশ্মাতে প্রচণ্ড জ্বলে উঠলেও বেশিদিন স্থায়ী থাকতে পারলেন না। ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করে অপর দিক থেকে তিনি আরও দুই বিশ্বনেতার দৃষ্টান্ত তুলে ধরলেন। প্রথম, জার্মানীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশচালানোর নেতার অভাব হয়ে পড়লো। তখন কার হাতে দেশের দায়িত্ব দেওয়া হবে? একজন আর্মি অফিসার অ্যাডেনআওয়ার (Konrad Hermann Joseph Adenauer)-এর হাতে পশ্চিম জার্মানীর দায়িত্ব (As Chancellor from 15 September 1949 –11 Oct, 1963) দেওয়া হল। তিনি সেনা অফিসার হিসাবে যথেষ্ট সৎ, দায়িত্ববান ও নিয়মানুবর্তী ছিলেন। কিন্তু রাজনীতিবিদের ক্যারিশ্মা ছিল না, সামাজিক পরিচিতিও ছিল না। অথচ তিনিই সাড়ে তিন বছরের মধ্যে নতুন জার্মানীর ভিত তৈরি করলেন। দ্বিতীয়, আমেরিকার দৃষ্টান্ত তুলে ধরলেন। বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন রুজভেল্ট (Franklin D. Roosevelt, 4 March 1933 — 12 April 1945)। তিনি ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসাবে নিলেন ট্রুম্যান (Harry S. Truman)-কে। দেখা যায়, সবসময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট একজন অদক্ষ মানুষকে ভাইস-প্রেসিডেন্ট বাছেন, যাতে গ্ল্যামারে, ক্যারিশ্মায় প্রেসিডেন্টকে ছাপিয়ে যেতে না পারেন। ফলে রুজভেল্টের যেমন ক্যারিশ্মা ছিল, ট্রুম্যান তার ধারেকাছেও ছিলেন না। রুজভেল্ট প্রবল জনপ্রিয় থাকা অবস্থাতেই মারা গেলেন, ভাইস-প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান হয়ে উঠলেন প্রেসিডেন্ট (12 April, 1945 — 20 January, 1953)। আমেরিকার মানুষের দুঃখের শেষ রইলো না। সবাই ঠাট্টা-তামাশা করতেন তাঁকে। আমেরিকা জুড়ে চলতি কথা ছিল, “ভুল কাজ মহিলারা করে, আর ভুলকাজ করেন ট্রুম্যান“। এই ট্রুম্যানের হাতেই আধুনিক আমেরিকা তৈরি হল। তিনি কতটা জানেন আর কতটা জানেন না বুঝে নিয়ে, যেটা জানেন না জেনে নিয়ে, পড়াশোনা করে, শিখে সেদেশ চালাতে লাগলেন। তাঁর ব্যক্তিগত ক্যারিশ্মা ছিল না, কিন্তু How to become great-এর এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠলেন। এইভাবে একজন দলনেতার ব্যক্তিগত স্তাবকতা যে কতটা বর্জনীয়, তা বুঝিয়ে দিলেন দত্তপন্থজী৷ প্রসঙ্গের অবতারণা করে ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘে ব্যক্তিপুজো বন্ধের ব্যাপারে সরাসরি নিজস্ব মতামত দিয়েছেন তিনি। হরিদ্বারে BMS-এর প্রথম ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং হল। সেখানে দু’টি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। প্রথম, কোনো ব্যক্তিগত নেতার নামে জয়জয়কার করা হবে না। দ্বিতীয়, BMS-এর কোনো সদস্য বা নেতার জন্মদিন পালন হবে না। এরপর উদয়পুরে BMS-এর এক অধিবেশনে গেলেন তিনি। সেখানকার কার্যকর্তা তাঁকে অত্যন্ত যত্ন করলেন। স্টেজে সেই কার্যকর্তার সঙ্গে উপস্থিত হলে হাজার দুয়েক সদস্য তাঁর নামে জয়ধ্বনি দিলেন। ঠেংড়ীজী বক্তব্য রাখার সময় বললেন, আপনারা আমার জয়জয়কার করেছেন, এতে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি। কোথাও আমার ব্যক্তি চেতনা খুশী হয়েছে। কিন্তু আমি এটা ভেবে অত্যন্ত দুঃখ পাচ্ছি যে, হরিদ্বার অধিবেশনে কোনো নেতার জয়ধ্বনি হবে না, এই মর্মে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তা সত্ত্বেও এখানে এটা হল। এরপর সভা শেষ হলে ঠেংড়ীজীকে হোটেলে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে একজন সদস্য তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা সত্যি সত্যিই কি এমন সিদ্ধান্ত হয়েছিল? না-কি আপনি মজা করে এমন কথা বলেছেন! দত্তপন্থজী উত্তর দিলেন, সিদ্ধান্ত হয়েছে বলেই একথা বলেছি। সেটা নোটিশ আকারে সমস্ত শাখাতেই গেছে। অন্য কোনো শ্রমিক সংগঠনে এমন প্রচলন থাকলেও BMS কখনই ব্যক্তিগত জয়জয়াকারের জায়গা নয়। এরপর তিনি বললেন, অন্য সংগঠনের সঙ্গে ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ বা BMS -এর পার্থক্য কোথায়। বললেন, BMS-এর কার্যকর্তারা প্রত্যক্ষভাবে BMS-এর কার্যকর্তা, অপ্রত্যক্ষভাবে ইউনিয়নের কার্যকর্তা। অন্যান্য মজদুর সংগঠনের কাজটা ঠিক এর বিপরীত। অন্যান্য মজদুর সংগঠনের কার্যকর্তারা প্রত্যক্ষভাবে ইউনিয়নের কর্মী এবং অপ্রত্যক্ষভাবে তার নিজস্ব সংগঠনের কর্মী। BMS-এর ক্ষেত্রে এটা একেবারেই উল্টো।
যারা অন্য মজদুর সংগঠন থেকে BMS-এ যোগদান করেছেন, তাদের সম্পর্কে ঠেংড়ীজী বলেছেন, তারা শারীরিকভাবে BMS-এর জন্য কাজ করলেও, যতদিন না তারা BMS-এর কর্মসূচী বা কর্মপদ্ধতির সঙ্গে সঠিকভাবে পরিচিত না হবেন এবং মানসিকভাবে মেনে নিতে না পারবেন, ততদিন তাদের সম্পূর্ণ সদস্য বলে ধরে নেওয়া যাবে না। পূর্ববর্তী সংগঠনের মতাদর্শকে বর্জন করে BMS-এর মতাদর্শকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করে কাজ করতে হবে, তবেই তারা যথার্থ সদস্য হতে পারবেন। রাষ্ট্রঋষির বক্তব্যের মূল কথাটি সব সংগঠনের জন্যই শাশ্বত সত্য। নানান কারণে দলে দলে উপস্থিত হওয়া মানুষজন কোনো বিশেষ সংগঠনের প্রকৃত শক্তি হতে পারেন না। তাদের আশু-নেতৃত্বও সংগঠনের পক্ষে স্বাস্থ্যকর নয়। সংগঠন বিকাশের ক্ষেত্রে এবং প্রকৃত সদস্য বিচারে আলোচ্য সংগঠনে কোনো এক ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক ও দার্শনিকতার সম্পূর্ণ ও অমোচ্য মেলবন্ধন জরুরি। তা ব্যতিরেকে সংগঠন কখনই শক্তিশালী হয় না।
*ধর্ম মানুষের মজ্জাগত ব্যাপার,’ইজম্’ সচেতন মনের আমদানি*
১৯৬২ সাল, ভারত-চীন যুদ্ধ (২০ অক্টোবর — ২১ নভেম্বর)-এর কাছাকাছি সময়। ত্রিভুবন নারায়ণ সিং-এর সঙ্গে জহরলাল নেহেরু-র একটি কথোপকথনের কথা বলছেন দত্তপন্থ ঠেংড়ীজী। টি. এন. সিং উত্তর প্রদেশের মানুষ; পরে সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী (১৮ ই অক্টোবর, ১৯৭০ — ৪ ঠা এপ্রিল, ১৯৭১) এবং তারও পরে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল (৬ ই নভেম্বর, ১৯৭৯ — ১২ ই সেপ্টেম্বর, ১৯৮১)। সেসময় পার্লামেন্টের অধিবেশন চলছে; নবরাত্রির আশেপাশে কোনো এক সময়। গৃহে নিয়মিত চণ্ডীপাঠ করতেন শ্রী সিং। পার্লামেন্টের অধিবেশনের আগে প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু বাইরে এসে বসতেন, নানান সদস্যের সঙ্গে আলাপচারিতা চলত, সেদিনও বসেছেন; টি. এন. সিং-এর সঙ্গে তাঁর দেখা হল৷ নানা কথায় তিনি বললেন, আমাদের ধর্মাচারগুলি যারা তৈরি করেছেন, তারা তো এই পৃথিবীর মানুষ নন, তাহলে দেশের মানুষের বাস্তব সমস্যা — ক্ষুধা, তৃষ্ণা, দারিদ্র্য কী করে ধর্মাচার দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব? টি. এন. সিং বললেন, তা তো নয়! শ্রীচণ্ডীতে তো এটা লেখা আছে “যা দেবী সর্ব ভূতেষু সুধারূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমাে নমঃ।।…. যা দেবী সৰ্ব্ব ভূতেষু নিদ্রারূপেণ সংস্থিতা।…. ইত্যাদি ইত্যাদি।” এসব অবাস্তব হয় কী করে! ক্ষুধা, সুধা, নিদ্রা, ভ্রান্তি এসবই তো বাস্তবের প্রতিভূ, জীবনচর্যা থেকে আগত বিষয়! তখন নেহেরুজী টি. এন. সিং-এর কাছ থেকে সমস্ত বিষয়টা গুরুত্ব দিয়ে শুনলেন। এরপর থেকেই তাঁর জীবনে ধর্ম নিয়ে নতুন চিন্তা-চেতনার উদয় হল। ১৯৬৪ সালে নেহেরু মৃত্যুর ঠিক ২৪ ঘন্টা আগে শ্রীমন্ত নারায়ণের একটি বইয়ের প্রস্তাবনায় তিনি লেখেন, “মনুষ্যকে মন আচ্ছা হো ধরম্ কে আধার পর।” এটাই তাঁর লিপিবদ্ধ শেষ দার্শনিক উপলব্ধি। তার আগে ধর্ম নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না তাঁর। হিন্দুধর্ম অবিশ্বাসী মানুষকেও প্রভাবিত করতে পারে, যদি তার সঠিক ব্যাখ্যা করা যায়।
২.ঠেংড়ীজী কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিয়ে বলতে চেয়েছেন, মানুষ বলেন, সে ধর্ম মানেন না; কিন্তু তার জীবনাচরণ ধর্মাচারকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। একটি ঘটনার কথা বলছেন। সিপিআই-এর মহারাষ্ট্র শাখার সম্পাদক ছিলেন ক্রান্তিসিন্হ নানা পাটিল (৩ রা আগষ্ট, ১৯০০ — ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭৬; দলের প্রতিনিধি হিসাবে মারাথওয়ারা অঞ্চলের বীড কেন্দ্র থেকে সাংসদ হয়েছিলেন ১৯৬৭ সালে, তার আগে ১৯৫৭ সালে সাঁতারা কেন্দ্র থেকে সাংসদ হন)। তিনি কোনো একবার আরএসএস-এর একজন উচ্চাধিকারীর সঙ্গে একই ট্রেনের কোচে সহযাত্রী হয়ে যাচ্ছিলেন। স্বয়ংসেবকদের ক্ষেত্রে নিয়ম হল, যখন ট্রেনে কোনো উচ্চাধিকারী যান, তখন খাবার সময় সকল স্বয়ংসেবক তাঁর কাছে আসেন ও একসঙ্গে খাওয়া হয়। তাই দুপুরে খাবার সময় সকলেই সেই আধিকারিকের কাছে আসলেন। তিনি পাটিলজীকেও ডাকলেন, আসুন, আমাদের সঙ্গে একসাথে ভোজন করবেন। তখন পাটিলজী একটু দূরে সরে গিয়ে বললেন, না না, আজকে আমার নির্জলা একাদশীর উপবাস। আর স্বয়ংসেবকেরা যা খাচ্ছেন, তা হল, রুটি আর পেঁয়াজের আচার। তাহলে ভাবুন, সিপিআই-এর মানুষটি নিরম্বু উপবাস করছেন, আর হিন্দুত্ববাদী মানুষটি একাদশীর দিন রুটির সঙ্গে পেঁয়াজ খাচ্ছেন!
৩.দত্তপন্থ ঠেংড়ীজী একবার রসিকতা করে বলছেন, “হিন্দুত্বকা পরিভাষা সমঝনা বহুতি কঠিন হ্যায়।” এরপর একটি ঘটনার কথা বললেন। ১৯৬৮ সালে সংসদীয় দলের সদস্যরূপে তিনি সরকারি যাত্রায় রাশিয়া গিয়েছিলেন। দলের প্রমুখ ছিলেন নীলম সঞ্জীব রেড্ডি। ওই দলে সিপিআই-এর হীরেন মুখার্জীও ছিলেন। মস্কোর ইন্সটিটিউট অফ ওরিয়েন্টাল স্টাডিজে হীরেন বাবুর বক্তব্য ছিল। সেখানে অনেক রাশিয়ান বিদ্বান মানুষ উপস্থিত ছিলেন। বক্তব্যের বিষয়: Religion and God, ধর্ম ও ঈশ্বর। মার্ক্সীয় আধরে পুরো ভাষণ, হীরেন বাবু সিদ্ধান্তে এলেন, God is Fraud. ঈশ্বর ধোকা হ্যায়, জালসাজি হ্যায়। অন্য কারো মন্তব্য বা বিতর্কের অবতারণার সুযোগ সেখানে ছিল না। রাশিয়ার বিদ্বানরা প্রচুর হাততালি দিলেন। সভা শেষ হল। হোটেলে দুপুরে হীরেন বাবুর একটা বই ফেরত দিতে তাঁর ঘরে গেছেন ঠেংড়ীজী। দরজা বন্ধ, তবে সামান্য ফাঁক ছিল। হোটেলে বলে দেওয়া হয়েছিল, কারো ঘরে গেলে বেল বাজিয়ে অনুমতি নিয়ে তবে ঢুকতে হবে, কারণ রুমের আবাসিকরা নিজেদের স্বাভাবিক পোষাকে থাকতে পারেন, তাই এই অলিখিত নিয়ম। ঠেংড়ীজী বেল বাজিয়েই যাচ্ছেন, ফেরার তাড়াও ছিল। কিন্তু হীরেন বাবুর দুটি কানে যথেষ্ট বধিরতা; কর্ণযুগলে শ্রবণযন্ত্র ব্যতিরেকে প্রায় কিছুই শুনতে পেতেন না। ঠেংড়ীজীর মনে পড়লো সে কথা। তিনি এবার দরজায় উঁকি মারলেন। দরজার দিক পিঠ দিয়ে সোফায় পদ্মাসনে বসে আছেন হীরেন বাবু, কানের যন্ত্রদুটি পাশে খুলে রাখা, ধ্যানমুদ্রায় উচ্চারণ করে চলেছেন “চিদানন্দরূপঃ শিবোহম শিবোহম”। স্বাভাবিক পোষাকে নেই জেনে ঠেংড়ীজী এবার দরজা ঠেলে ঢুকলেন, হীরেন বাবু তখনও চোখ বন্ধ করে নিবিষ্ট মনে স্তোস্ত্রগীত করে চলেছেন। স্তোত্র শেষ হল, হীরেন বাবু ঠেংড়ীজীকে দেখে চমকে উঠলেন। শ্রবণযন্ত্র পরে নিয়ে বললেন, ” How long you are standing here?” দত্তপন্থজী বললেন, “Two or three minutes.” হীরেন বাবু বলে উঠলেন, “Mind you, I don’t believe in God.” ধ্যান রেখো, আমি ঈশ্বরে অবিশ্বাসী। ঠেংড়ীজী বললেন, “ঠিক আছে”।
৪.আরও একটি ঘটনা দিয়ে তিনি হিন্দুত্ব ও ধর্মাচরণ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য শেষ করেছেন। ১৯৭০ সাল। রামকৃষ্ণ রেড্ডির সঙ্গে কন্যাকুমারিতে তাঁর একটি মিটিং ঠিক হল মহালয়ার দিন সকাল ন’টায়। কন্যাকুমারীর মানুষ বিশ্বাস করেন, মহালয়ার দিন খুব সকালে স্নান করে দেবীর পূজা করলে পুণ্য হয়। ন’টায় মিটিং বলে যথেষ্ট সকালে উঠে স্নান করে মন্দিরের দিকে ভিজে কাপড়ে যাত্রা শুরু করলেন ঠেংড়ীজী। সঙ্গে ছিলেন ডিএমকে-র কোনো একজন এম.পি.। মন্দিরে ঢোকার আগে তিনি ঠেংড়ীজীকে বললেন, আমি শুধু এখানকার নেতাই নই, সমগ্র তামিলনাড়ুর একজন পরিচিত নেতা, ফলে এই মন্দিরের চারপাশে সবাই আমাকে চেনেন। ঠেংড়ীজী বললেন, সে তো খুব ভালো কথা। ভদ্রলোক বললেন, আরে সেটাই তো আমার সমস্যা! — কেন? — ১৫ দিন আগে আমার পার্টি ঘোষণা করেছে God does not exist. ভগবানের অস্তিত্ব নেই। এবারও আমাকে রাজ্যসভার টিকিট নিতে হবে। আগামী ২ রা এপ্রিল রাজ্যসভার সমাপ্তি, মাত্র কয়েকমাস বাকী। এখন যদি আমি মন্দিরে ঢুকি আর এই ঘটনা যদি চারপাশে রটে যায়, তাহলে টিকিট পাওয়া সম্ভব হবে না। কারণ কয়েকজন হেবিওয়েট প্রতিদ্বন্দ্বী আছেন এই টিকিট পাবার লোভে। — তাহলে আপনি যাবেন না! — (অত্যন্ত ভেঙ্গে পড়ে তিনি বললেন) কিন্তু মহালয়ার পুণ্য অর্জন তো আমায় করতেই হবে। আমি একটি উপায় বের করেছি। (মন্দিরের পাশে একটি ছেলের কাছ থেকে কাগজ আর পেনসিল নিয়ে তামিল ভাষায় নিজের নাম, গোত্র, ঠিকানা লিখে চিরকুটটি ঠেংড়ীজীর হাতে দিলেন।) আমার নামে একটি স্পেশাল পূজা আপনাকে দিতে হবে। ঠেংড়ীজী বললেন, ঠিক আছে। মন্দিরের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। দু’পা এগোতেই তিনি আবার ডাকলেন। তারপর ব্যাগ খুলে অনেকগুলি টাকার নোট দিয়ে বললেন, এটা তার হয়ে স্পেশাল দক্ষিণা পুরোহিতকে পৌঁছে দিতে হবে। ঠেংড়ীজী তা নিলেন এবং এগিয়ে চললেন। আবারও ডাকলেন তিনি। এবার বিরক্তই হলেন ঠেংড়ীজী, কারণ ন’টার সময় নির্ধারিত বৈঠক, হাতে সময় বিশেষ নেই, তাই তাড়াহুড়ো ছিল। কিছুটা বিরক্তির সুরে বললেন, কী ব্যাপার? এবার এম.পি. ভদ্রলোক তাঁকে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করলেন। ঠেংড়ীজী অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, এ কী করছেন? ভদ্রলোক উত্তরে বললেন, “Kindly transfer this also“. এই ঘটনাটি বলে ঠেংড়ীজী মুচকি হেসে বললেন, এত বড় বড় লোকেরা ধর্মাচরণ নিয়ে এত বড় বড় কথা ভেবেছেন যে, আপনাদের আর বেশি ভাবার দরকার নেই। ধর্ম মানুষের মজ্জাগত, আর ‘ইজম’ (ism) সচেতনভাবে মানুষ শেখে এবং সেটাকে অন্তরের যুক্তিবোধের মধ্যে মান্যতা দেয়। ধর্ম প্রতিদিন বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহ্যের অনুবর্তনে মানুষের ভেতরে প্রবেশ করে। জীবনচর্যা থেকে ধর্মাচারকে আলাদা করা যায় না। ‘ইজম’ সচেতনতার সামগ্রী কিন্তু ধর্মাচরণ মানুষের জীবনচর্যার পরতে পরতে অবচেতন ভাবেই প্রবাহিত হয়। এইভাবে দৃষ্টান্ত দিয়ে দত্তপন্থ ঠেংড়ীজী বুঝিয়ে দিলেন, সামাজিক লাভের জন্য কোনো ইজমে যেতে হয়। কিন্তু অন্তর অন্য কথা বলে, তাই অন্য পুণ্যার্থীকে প্রণাম করে তাকে বলতে হয়, এটাও দেবতার চরণে পৌঁছে দেবেন! একদম খাঁটি সত্যকে তুলে ধরেছেন রাষ্ট্রঋষি
স্বদেশী জাগরণের প্রাসঙ্গিকতা
স্বদেশী জাগরণ মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা দত্তপন্থ ঠেংড়ীজী আত্মনির্ভরশীল ভারত নির্মাণের স্বপ্ন বহুদিন ধরেই দেখেছেন। সেই স্বপ্ন আজ করোনা পরিস্থিতিতে বাস্তবায়নের পথে। সমগ্র দেশে আজ দ্বিতীয় বারের জন্য স্বদেশী আন্দোলন শুরু হয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গীর প্রকাশক ও প্রচারক ছিলেন তিনি। তাঁর চিন্তার আলোকে আপন বোধ জারিত করে কিছু প্রাসঙ্গিক কথা বলে রাষ্ট্রঋষি-তর্পণ শেষ করবো।
স্বদেশ কাকে বলে, রাষ্ট্রের ধারণা কি, শিকড়-সংস্কৃতি কি — সেটাকে ভুলিয়ে দেবার এক বহুমুখী প্রচেষ্টার বহু ব্যাপকতার নাম গ্লোবালাইজেশন। বিশ্বায়নের মধ্যে যদি কেবল সামগ্রীর ব্যবহারখানি থাকতো, বিজ্ঞানের তত্ত্বের ও প্রযুক্তির প্রয়োজনীয় ব্যবহারটুকু গৃহীত হতো, প্রয়োজনীয় জিনিসটির আমদানিটুকু থাকতো তবে স্বাদেশিকতার সমস্যা, স্বাবলম্বনে পুনর্ব্যবস্থা ও পুনর্বাসন সমস্যাটি এতটা গভীর ও জটিল হত না, কিন্তু ইদানীং কালে তাই অনুভূত হচ্ছে। সমস্যার মূল কারণ হল কিছু রাজনৈতিক দলের বিদেশি তাত্ত্বিকতা। তারা বিদেশি তত্ত্ব অনুসরণ করতে চায়; বিলাতের শিক্ষা উত্তম; পশ্চিমের তত্ত্ব, দর্শন-রাজনীতি-সমাজনীতি-অর্থনীতি ভারতে প্রয়োগে সামূহিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে, ‘ইজম’-কে প্রতিষ্ঠা দিতে হবে; ভারতের ধর্ম-দর্শন-সংস্কৃতির যাবতীয় মাটি চেঁছে তাতে বিদেশি তাত্ত্বিকতার পিলার বসিয়ে তবে অট্টালিকা নির্মাণ করতে হবে; রাষ্ট্রকে ছাপিয়ে আন্তর্জাতিকতার এলাহি আয়োজন করতে হবে — তা থেকেই তৈরি হয়েছে পরনির্ভরতার যাবতীয় সমস্যা। বিদেশি বিচারধারার প্রচার ও প্রসারে রাজনৈতিক সংকল্প ও ব্যাপকতা বিষয়টিকে বহুজটিল করে তুলেছে। দেশে অনেক মানুষের মধ্যে স্বদেশী ভাবনা নেই, সংস্কৃতির সংরক্ষণ নেই, অথচ আন্তর্জাতিকতার মানস-সিংহাসন মজবুত। কোথায় স্বাবলম্বনের বেড়া দিতে হয়, কোথায় দেশরক্ষার জন্য আত্মবলিদান করতে হয়, তার নির্দেশ নেই যে মতাদর্শে, যে মস্তিষ্কে, যে চেতনা-প্রবাহে — তার ভরকেন্দ্র ভারতবর্ষ নয়, হতে পারে ভারতবর্ষের বাইরের কোন দেশে, বিদেশি শক্তির মন্ত্রগুপ্তির শপথে। তাদের সঙ্গে দেশব্রতী মানুষের বিচার ধারার মূল পার্থক্য হল এইরকম — রাষ্ট্রবাদী মানুষ মনে করেন, “আগে দিয়ে বেড়া/তবে ধরো গাছের গোড়া।” দেশকে আত্মনির্ভরতা দিয়ে, অর্থনৈতিক সুরক্ষা দিয়ে প্রতিটি জীবনবৃক্ষকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, তাই রাষ্ট্রীয় বেড়া দিতে হবে। বিদেশী নির্ভরতা কমিয়ে ভারতীয় সামগ্রীর উৎপাদন ও উৎকর্ষতা বৃদ্ধির নতুন নামকরণ হোক আজকের স্বদেশী জাগরণ। এই চিন্তা বহু আগেই করে গিয়েছিলেন রাষ্ট্রঋষি। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সেরা পথ হল বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে স্বদেশী জাগরণের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হবে। প্রথম আয়োজনটি হওয়া উচিত পুঞ্জীভূত মানসিক ধার মেটানোর কার্যক্রম; এতদিনের মানসিক ঋণের বোঝা দূর করা। স্বদেশী ঘরানার মানসচর্চা কোথা থেকে কোথা পর্যন্ত বিস্তৃত, কোথায় তার নানান সমৃদ্ধি, কোথায় তার বিকাশ ও সম্ভাবনা — তার সুলুকসন্ধান করার নিত্যকর্ম হবে জাগরণের-পূজারী ও প্রচারকবৃন্দের আশু কর্তব্য।
কিন্তু তাই বলে কী পাশ্চাত্যের প্রভাব খারাপ? কোথায় প্রাচ্য আর কোথায় পাশ্চাত্য খাপ খাবে, সে সম্পর্কে আধুনিক ভরতবর্ষের রাষ্ট্রবাদী মানুষের বাইরে সেই জ্ঞানের দীনতা বরাবরই ছিল। কোথায় ভারতবর্ষ চিন্তায়-চেতনায়, সম্পদে-আয়োজনে ধনী, কোথায় আমাদের দারিদ্র্য, কোথায় আমাদের বিদেশী দই-এর দম্বলটুকু নিয়ে ভারতে দই পাততে হবে, সে ধারণার যারপরনাই খামতি ছিল। আজ করোনা পরিস্থিতিতে সুযোগ এসেছে বিদেশি বিদায় করে স্বদেশী আহ্বানের কাজকে বাস্তবায়ন করা। এটাকে বলা যেতে পারে অকাল দীপান্বিতা লক্ষ্মী-পূজার আয়োজন। অলক্ষ্মীকে দূর করে লক্ষ্মীকে গৃহে প্রতিষ্ঠা। দেশীয় বিচারধারার ভিত্তিপ্রস্তর পাকা করার নামই হল নবতর-স্বদেশী-জাগরণ।
আমরা অন্য দেশ, অপর জাতি থেকে সামগ্রী, সম্পদ ও জ্ঞানান্বেষণে আগ্রহী, উৎসাহী; কিন্তু তাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চিনে নিতে হবে আমাদের পুরাতনী ঐতিহ্যের আলোয়, বুঝতে হবে বর্তমানের প্রয়োজনানুসারে, ধরতে হবে তার সাযুজ্য; কারণ একটি প্রবাদ বাক্য হল, “এক গাছের ছাল আর গাছে জোড়ে না”। সিদ্ধান্ত নিতে হবে কতটুকু গ্রহণ করবো, আর কতটুকু বর্জন করবো। বিদেশের মোহ আর অন্ধ অনুকরণ বন্ধ করার নাম স্বাদেশিকতা। আপন সামর্থে, দেশীয় সৌকর্যে আপনার বাগানে ফুল ফোটান যিনি, তিনিই স্বদেশী। আপনার চিন্তা-চেতনায় আপন দেশের মাটি যার কাছে বহুগুণ পবিত্র তিনিই স্বদেশী। বিদেশে বসবাস করেও ভারতের মানুষের মঙ্গলের জন্য সতত পরিকল্পনা করতে পারেন যিনি, সেই ত্যাগী মানুষকে স্বদেশীয় বলা চলে। যার মস্তিষ্কে, মননে, করসেবায় ভারতের তপস্যা তিনি ভারতীয়। ভারতে বসে ভারতরাষ্ট্রের ভিত যিনি প্রতিনিয়ত দুর্বল করার সিঁদ কাটেন তিনি বিদেশি। ভারতে বসবাস করে যার হেড কোয়ার্টার বিদেশের সিগনাল ক্যাচ করে তিনি অবশ্যই বিদেশি। দেশী-বিদেশীকে চিনতে পারার অন্য নাম স্বাদেশিকতা।
টুথপেষ্ট, ব্রাশ, সাবান, নানান প্লাস্টিক সামগ্রী, ইলেকট্রনিকস জিনিসপত্র ইত্যাদি দিয়ে দেশের বহু মানুষের সকাল থেকে সন্ধ্যা কাটে। হয়তো ব্যবহারকারীরা জানেনই না যে জিনিসগুলি বিদেশি কোম্পানির তৈরি। হয়তো জিনিসগুলি যারা বিপণন করেন — দোকানদার, মুদি, ফুটপাতে পসরা সাজিয়ে বসেছেন যিনি তারও জানেন না, জিনিসগুলি ভারতীয় প্রোডাক্ট নয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বহু জিনিস বিদেশি, অথচ যে জিনিস উৎপাদনের সক্ষমতা, বিপণনের সুযোগ ও সম্ভাবনা ভারতেই আছে, তবুও তা অঢেল বিকিকিনি হচ্ছে। ডাক দেওয়া হয়েছে স্বনির্ভর ভারত গড়ার, প্রচেষ্টা হচ্ছে স্বদেশী জাগরণের, তবে যে জিনিসটি দিয়ে শুরু করতে হবে তা হল, দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ব্যবহার-জনিত ধার মেটানোর মানসিকতা। দেশের সব মানুষকে জানতে হবে কোন প্রোডাক্ট, কোন কোম্পানির মালিকানা ভারতীয় নয়, কোন কোন বিদেশি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান তাদের নানাবিধ পণ্য সমগ্র ভারত জুড়ে ছড়িয়ে বসে আছে। জানতে হবে এই সামূহিক বেচাকেনায় কত লক্ষ কোটি ভারতীয় মুদ্রা সেই বহুজাতিক সংস্থাগুলি তাদের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। ভারতবর্ষের মতো দেশে যদি ভারতীয় কোম্পানিগুলি সেই সব পণ্য উৎপাদন করতে সক্ষম হয়, তবে এই দীর্ঘকালের বিদেশী নির্ভরতা কতটা কমবে, তারও একটি অর্থনৈতিক সমীক্ষা পাশাপাশি করা জরুরী।
আত্মনির্ভর-ভারত আন্দোলনের দু’টি দিক — প্রথম বিদেশী বয়কট, পিকেটিং, প্রতীকী প্রতিবাদ-স্বরূপ এক দু’টি সামগ্রী পোড়ানো যা বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে দেখা গিয়েছিল, দ্বিতীয় দিকটি হল দেশীয় উৎপাদনের তোড়জোড় ও গবেষণা। দু’টি আন্দোলনকেই যুগপৎ চালাতে হয়েছে ভারতবর্ষ সহ নানান দেশে। বিদেশী জিনিস বয়কটের মূল প্রতিবন্ধকতা হল, সাধারণ মানুষ জানেন না, কী কী অতি সহজেই বয়কট করা সম্ভব, কী কী সামগ্রী দেশীয়ভাবে নির্মাণ করা যায়। আরও মনে রাখতে হবে, কোন পণ্য কোন কোন উৎস সামগ্রী বা র-মেটেরিয়ালের উপর নির্ভরশীল যা বিদেশ থেকে আমদানি না করলে চলে না; খেয়াল রাখতে হবে আপাতত বিদেশ থেকে যা আমদানি না করেও চালিয়ে নেওয়া যায় সেই সমস্ত জিনিসগুলি কী কী। আর একটি বিষয় হল কোনো কোনো দেশীয় কোম্পানির বিদেশী স্লিপিং পার্টনার থাকে, যারা প্রযুক্তিগত ও পরিকাঠামোগত সহায়তা দেয়, তাদের কতটা বিদেশী কোম্পানি বলে ধরা হবে; তাদের সেই বিদেশী কারিগরি সম্পর্কটি কতটা বলবৎ রাখা সম্ভব, পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এ সবই বিশ্লেষণ করা দরকার। এজন্য প্রয়োজন হচ্ছে ভারত-মনস্ক দেশীয় উদ্যোগপতিদের উদ্যম, ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সততা। নানাবিধ উৎপাদনের জন্য দেশীয় উদ্যোগপতিদের এগিয়ে আসতে হবে। যে জিনিস খুব সহজে, সুলভ প্রযুক্তিতে কম পুঁজি ব্যবহারে ক্ষুদ্র উদ্যোগপতিরা গ্রামে, শহরের উপান্তে তৈরি করতে সক্ষম হবেন, তা দেশজুড়ে তৈরি হোক।
সাবলম্বী ভারতের একটা বৃহৎ মানে হল, ভারতের গ্রামগুলিকে যথাসম্ভব উৎপাদনে ও আয়োজনে, জীবনচর্যায় আগের মতোই সাবলম্বী করে তোলা, যেটা নেহেরু জামানায় রুশ মডেলে আইটিআই-ধাঁচের কিছু কারিগর বানিয়ে তাদের শিল্প কারখানায় পাঠিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। গ্রামের মানুষ আর কামারের বানানো জিনিস কিনলো না, কুমোরের তৈরি পাত্র দৈনন্দিন জীবনে কাজে লাগালো না, গ্রামের স্যাঁকরার ব্যবসা উঠে গেলো, মুচি তার জুতো বানানো বন্ধ করে দিল। সবাই ছুটলো কলের জিনিস কিনতে, শহরের দোকানে বহুজাতিক কোম্পানির জুতোয় ছেয়ে গেলো।
কৃষি পণ্য তো বটেই, গ্রামীণ জীবনচর্যায় ও মানসচর্চার পরতে পরতে স্বাবলম্বন আনতে হবে। ব্যবহৃত নানান সামগ্রীতে স্বাবলম্বন আনতে হবে। কৃষির ক্ষেত্রে স্বাবলম্বিতা মানে হল বীজ, সার, কীটঘ্ন ও কৃষি যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে স্বাবলম্বন। বীজ নীতি এমন হওয়া উচিত, যাতে কৃষক চাষের কাজে নিজের বীজ নিজেই তৈরি করে নিতে পারে, কোনো বহুজাতিক বীজ কোম্পানিগুলোর উপর অন্যায়ভাবে নির্ভর করতে না হয়। এতে বীজের খরচ যেমন কমে, তেমনই নির্দিষ্ট ফসল চাষ করিয়ে বা বীজ ব্যবহার করিয়ে কৃষককে পরিচালিত করার বহুজাতিক স্বার্থ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, কৃষক চাষ থেকে লাভবান হন। যে কৃষকের বীজ উৎপাদন করা সম্ভব নয়, সরকারী খামারগুলি স্থানীয়ভাবে তাদের জন্য বীজ উৎপাদনের ব্যবস্থা করবে। কোনো বীজ খামারকেই ফসল বিহীন পতিত করে রাখা চলবে না। প্রয়োজনে কৃষকের জমিতে পার্টিসিপেটরি সীড প্রোডাকশনের জন্য কৃষক, প্রজননবিদ ও সীড সার্টিফিকেশন আধিকারিকদের জুড়ে দিতে হবে। রাসায়নিক সারের জন্য প্রচুর বিদেশি নির্ভরতা আছে। জৈবিক চাষাবাদের মাধ্যমে রাসায়নিক সারের ব্যবহার যথাসম্ভব কমিয়ে শূণ্যে আনাটাই সবচাইতে বড় স্বাবলম্বন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, জৈবসারের গুণগত মানের ক্ষেত্রে কৃষিজীবী মানুষ কোনো দুর্নীতি সহ্য করবেন না। সমন্বিত কীটশত্রু ব্যবস্থাপনা বা ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট করার মধ্যে যতটা সম্ভব প্রাকৃতিক ব্যবহার বিধির আয়োজন রাখা যায়, তারই নাম স্বাবলম্বন। দেশীয় গরু, বলদকে কৃষিকাজে সংযুক্ত করে তাদের গোবর-গোমূত্র ব্যবহার করার মধ্যে যে কৃষি-আধার তার সামগ্রিকতা, তার নাম হচ্ছে স্বাবলম্বন। দেশীয় ধারায় জমির মাপ ও ফসল বৈচিত্র্যের উপর নির্ভর করে দেশীয় কারিগরি দিয়ে সহজ-সরল-সুলভ যন্ত্রপাতি নির্মাণের নাম স্বাবলম্বন। আশাকরি আগামী দিনে কৃষি গবেষক, প্রশাসক, আধিকারিকেরা এই স্বনির্ভর কৃষির দিকে ধাবিত হবেন। কৃষিজীবী মানুষের সন্তান যতক্ষণ না পর্যন্ত জমি, ফসল, প্রকৃতি ভালোবাসতে না পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত এই স্বাবলম্বী ভাব আসবে না। আর এই ভাব আনতে হলে কৃষি ও কৃষককে শহরবাসী প্রবুদ্ধ মানুষের দ্বারা মান্যতা দিতে হবে। জীবনের সবচাইতে বড় শিল্প হল প্রাকৃতিক পরিবেশে দেশীয় উপায়ে কৃষিকাজে সবচেয়ে বেশি ও উৎকর্ষ মানের ফসল পাওয়া। গ্রামীণ যাবতীয় উৎপাদনের মার্কেটিং এর ব্যবস্থা করে দেওয়াটা সবচাইতে বড় কাজ, এটা যেকোনো মূল্যে করতে হবে।
বহু সামগ্রী তৈরি হয় উদ্ভিজ্জ উপাদান থেকে, যেমন রিঠা, শিকাকাই থেকে ভেষজ স্যাম্পু ; নানান গাছগাছালি থেকে মশা নিরোধক ধূপ; চিরাচরিত ও অচিরাচরিত জৈব তন্তু দিয়ে নির্মিত বস্ত্র ও থলে। আগে কর্মশিক্ষার অঙ্গ হিসাবে সাবান, ফিনাইল, কালি, কাঠের হ্যাঙ্গার, ইত্যাদি তৈরি স্কুল স্তরেই শেখানো হত; বানানো খুব কঠিন নয় সেগুলি। প্রয়োজনে তুলনামূলকভাবে বড় উদ্যোগে, যৌথভাবে, স্বসহায়ক গোষ্ঠীর দ্বারা গ্রামে বা শহরে তার উৎপাদন সম্ভব, তাতে উদ্ভিজ্জ উপকরণ যথাসম্ভব ব্যবহার করা যায়। প্রসাধনী সামগ্রী বিদেশি কোম্পানির কেন কিনবো? নিজেরাই আগে তো বানাতাম আমরা, অনেক দেশীয় কোম্পানিও বানায়। ভেষজের ব্যবহার কেন বন্ধ হল? কেন তা ব্যবহারে উদাসীনতা? বিদেশী ওষুধ কোম্পানিগুলোকে সুবিধা করে দিতে অনেক অসাধু মানুষ দেশীয় গাছগাছড়াকে ব্রাত্য করে রেখেছে। জীবনের সকল ক্ষেত্রে সম্পদের পুনর্ব্যবহার করার মধ্যেই সমৃদ্ধশালী ভারতবর্ষ নির্মাণ করা সম্ভব। বৃষ্টির জল, সূর্যালোক, ফসলের খড়নাড়া-কুটিপাতি কোনো কিছুই ফেলনা নয়। প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ সংরক্ষণ ও বর্জ্য পদার্থকে সম্পদ করে তোলার মধ্যে আত্মনির্ভরতা কাজ করে। দেশীয় জিনিস দিয়েই আমাদের রোজকার জীবন চালানোর অভ্যাস করতে হবে। দেশীয় জিনিস হল মায়ের দান, ভারত মায়ের অমূল্য রতন, মাতৃদুগ্ধ। অপচয় নয়, এই সম্পদকে বিচার বিশ্লেষণ করে দোহন করার নামই হল স্বাদেশিকতা। বাংলার ‘কান্তকবি’ রজনীকান্ত সেনের দেশাত্মবোধক গানে স্বদেশী জাগরণের চৈতন্য পরতে পরতে রয়েছে।
“মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়
মাথায় তুলে নে রে ভাই ;
দীন-দুঃখিনী মা যে তোদের
তার বেশী আর সাধ্য নাই।
ঐ মোটা সূতোর সঙ্গে, মায়ের
অপার স্নেহ দেখতে পাই ;
আমরা, এমনি পাষাণ, তাই ফেলে ঐ
পরের দোরে ভিক্ষা চাই।
ঐ দুঃখী মায়ের ঘরে, তোদের
সবার প্রচুর অন্ন নাই ;
তবু, তাই বেচে কাচ, সাবান মোজা,
কিনে কল্লি ঘর বোঝাই।
আয়রে আমরা মায়ের নামে
এই প্রতিজ্ঞা ক’রব ভাই ;
পরের জিনিষ কিনবো না, যদি
মায়ের ঘরের জিনিষ পাই।
সবশেষে স্বদেশী চেতনাসম্ভূত, আদ্যন্ত ভারতপ্রেমী এই মনস্বীর প্রতি রইলো আমার অশেষ শ্রদ্ধা এবং শতকোটি প্রণাম। এই ঋষিতুল্য মানুষটি একটি অনন্য-বোধ এবং সাংগঠনিক ক্ষমতার আশীর্বাদ-স্বরূপ হয়ে নিয়ত আমাদের মধ্যে প্রকটিত হোন। জন্মশতবর্ষে সেই প্রার্থনা জানাই।
* ড. কল্যাণ চক্রবর্তী * (Dr. Kalyan Chakraborty) অধ্যাপক, বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কল্যাণী।