গোলি মারো এখানে চলবে না।
এটা দিল্লি নয়, কলকাতা।
বুদ্ধিজীবীদের শহর। কবি সাহিত্যিকদের শহর। এখানে ওভাবে কথা বলা যায় না। চলে না। এখানে যদি বলতেই হয়, এসব দুষ্টু দুষ্টু কথা যদি বলতেই হয়, তাহলে কথায় কাব্যগুণ মেশাতে হবে। সাহিত্য মেলাতে হবে। রুপক জানা আছে? ইংরিজিতে অ্যালিগোরি বলে। জানা আছে? প্রতীক জানো? প্রতীক? সিম্বল বোঝো তো? এখানে কথা বলতে গেলে সিমবলিজম জানা চাই। নইলে কথা না বলাই ভাল।
চড়াম চড়াম বলো। চলবে।
গুড় বাতাসা বলো। চলবে।
উন্নয়ন দাঁড়িয়ে আছে বলো। চলবে। তাই বলে কিনা কোথাও কিছু নেই গোলি মারো! কেন বাপু একটু ঘুরিয়ে বলতে কি হয়? চড়াম চড়াম তো জানা আছে। তুমি বলো দড়াম দড়াম। কেউ কিচ্ছু বলবে না। তা না বলে বলে কিনা গোলি মারো!
এসব বলতে গেলে না একটা জনগণতান্ত্রিক শিক্ষা লাগে। একটা বৈপ্লবিক চেতনা
যাকে বলে আর কি। সেই সব শক্ত শক্ত জিনিষ গুলো লাগে। জানো হিংসা কয় প্রকার?
জানো না তো। জেনে নাও। হিংসা দুই প্রকার। শিক্ষিত হিংসা আর অশিক্ষিত হিংসা।
এসব জানতে হয়। এসব জানার জন্যে কবিদের সঙ্গে মিশতে হয়। সাহিত্যিকদের সঙ্গে
মিশতে হয়। আর শোনো, ভেবো না সব বুদ্ধিজীবী একটু পাইয়ে দিলেই আসে। আদর্শবান
নিষ্ঠাবান রুপবান বুদ্ধিজীবীও আছে। না। রুপবান কথাটা এখানে যাচ্ছে না। ওটা
বাদ দাও। স্নিপ অফ টাঙ্গ।
শোনো এটা কলকাতা। এটা বাংলা। এটা জয় বাংলা। এখানে গোলি মারো বলা চলে না। এখানে জগ ছুঁড়ে মারা অবধি অ্যালাও আছে। শিক্ষককে মারো, হেড মাস্টারকে মারো, অধ্যাপক, প্রিন্সিপালকে রাস্তায় ফেলে মারো। সব অ্যালাও আছে। হতচ্ছাড়া বলে কিনা গোলি মারো! অত যদি মারপিট করার শখ, বলো না মালিকের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও। সে মালিক কালো হোক বা ফর্সা, সে কিচ্ছুটি মনে করবে না। এটা বাংলার মাটি। এখানে সন্যাসীদের গুলি করে মারার ইতিহাস আছে। এখানে শরণার্থীদের গুলি করে মারার ইতিহাস আছে। সেই গর্বের ইতিহাসে কালি ছেটাতে চাও? গোলি মারতে হয় পুলিশ তো আছে। পুলিশকে গুলি মারো বললে কোনও দোষ নেই। ওদের যা চাকরি, একটু আধটু গুলি টুলি খেলে কোনও মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। তাছাড়া আন্দোলন করতে হয় করো। একটু আধুনিক আন্দোলন হোক। গুলি খাওয়ার কথা কেন উঠছে? চুমু খাও। প্রকাশ্যে চুমু খাও। মিডিয়া ডাকো। ক্যামেরার সামনে চুমু খাও। একে অপরকে খাও। সে সব না করে গোলি মারো গোলি মারো! হতভাগা গুলো মারার জন্যে আর কিচ্ছু জুটছে না!
এটা কলকাতা। এটা বুদ্ধিজীবীদের শহর। এখানে কবিরা শাসকের হাতে কলা খায়। রুপবান, থুড়ি আদর্শবান অভিনেতা দুষ্টু নাতির বেপরোয়া বাইক দুর্ঘটনার কেস সামাল দিতে শাসকের পাশে আলো করে বসে পড়েন। কোনও না কোনও ভাবে ফাটা বাঁশে আটকানো এক শ্রেনীর গুণী শিল্পী লাইন দেন শাসক সরণীতে। ফাটা বাঁশে যা আটকে আছে তা ছাড়িয়ে দেওয়া হয় না ঠিকই তবে যাতে ব্যথা না লাগে সে জন্য নাড়াচাড়াও করা হয় না। গান জানো গান? গলায় সুর আছে? হাতে লেখা আছে? যদি থাকে তাহলে এসব বলতে পারো। এই শহরের বুকেই হাতের তালু আর তর্জনীকে রিভলবারের মতো করে দেখিয়ে বিজেপি নেতাদের গুলি করে মারার কথা বলেছিলেন কলকাতার কবিয়াল। তিনি কিন্তু তিরস্কৃত হন নি বরং পুরস্কৃত হয়েছিলেন। নিজেকে সেই লেভেলে নিয়ে যেতে হবে। কালজয়ী গান বাঁধতে হবে। তবে না তুমি ওইসব গুলি টুলি করার কথা বলতে পারবে।
তাছাড়া তুমি কে হে, কে দেশের গদ্দার আর কে দেশের বফাদার ঠিক করার?
ধর্ষকের ফাঁসি চাও। পুণ্য কাজ। দাবি জানাও ধর্ষনের শাস্তি হোক ফাঁসি। সঠিক কাজ। তাই বলে দেশের গদ্দারের শাস্তি কি হবে তাই নিয়ে দাবি জানিও না। ওটা কিন্তু উস্কানিমূলক।
রসিকতা তো হল। তা বাবুরা দুটো সিরিয়াস কথা কই। বাংলা ব্যাকরণ পড়েছ তো? বাক্যের উদ্দেশ্য আর বিধেয় কাকে বলে জানো নিশ্চয়ই। এক্ষেত্রে ‘দেশ কে গদ্দার’ উদ্দেশ্য আর ‘গোলি মারো শালোকো’ বিধেয়। দেশের গদ্দার কারা? যারা বলছে ‘ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে, ইনসাল্লা ইনসাল্লা।’ আর কারা? যারা জঙ্গির জন্যে কেঁদে ভাসাচ্ছে, তারা। মানে যতটুকু বোঝা যাচ্ছে এরকমই তোমরা মনে করো। এইসব স্লোগান দিচ্ছে কারা? মুসলমানরা বুঝি? তা তো নয় ভায়া। দিল্লিতে যা হল, যে কালো সময় দিল্লি দেখল, সেই কালোর মধ্যে কিছু আলো তো মুসলমানও ঢেলেছে। ঢেলেছে হিন্দুও। পরস্পর পরস্পরের সাহায্যে, পরস্পরের রক্ষায় এগিয়ে এসে দেখিয়ে দিয়েছে এ দেশে সাধারণ ভাবে হিন্দু মুসলিমের সম্পর্ক ভাল। আর পাঁচটা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে যেমন স্বাভাবিক সম্পর্ক তেমনই সহজ ও স্বাভাবিক সম্পর্ক। যদি আইন কানুনের কথাই বলো…যদি কেউ বলে তুমি কোনও ব্যক্তিকে গদ্দার বলার কে? সে তো নির্ণয় করবে আদালত। গুলি মারবে, না ফাঁসি দেবে, না যাবজ্জীবন, সে তো ঠিক করবে আদালত। এরকম কথা বলার লোকের তো অভাব নেই। মজার বিষয় হল, এরাই ঠিক করে বসে আছে সিএএ মুসলিম বিরোধী। এইসব ব্যাপারে তারা আদালতের রায়ের অপেক্ষা করে না। এরা যেটা মানুষকে ভাবাতে চাইছে, সেটা বারংবার জাবর কাটার মতো বলে যায়। এরপর যদি দেখা যায়, আদালত বললেন সিএএ-তে আপত্তিকর কিছু নেই। তখন এরা কি বলবে সেটাও ঠিক করা আছে। বলবে এই আদালত নাগপুরি আদালত। এই বিচারক সঙ্ঘী। এরা মনে করে, এরাই শেষ কথা। ভাল খবর একটাই, এ দেশের মানুষ তাদের শেষ শয্যায় শুইয়ে দিয়েছে। দিন চলে গেছে কিন্তু ভুলোনা আলো এখনও পুরো যায়নি। আলো রয়ে গেছে। জানো তো গোধুলির আলোয় মায়া বেশি। দেশে ভোট শতাংশ তলানির তলায় তবু তারা মানুষের ভাব জগতে এখনও প্রভাব ফেলতে সমর্থ হচ্ছে। আর তোমরাও এই শশ্মানবাসীর কথায় গুরুত্ব দিয়ে এদের গুরুত্বপূর্ণ করে রাখছ। আর এইসবের মধ্যে লেগে পড়ছে সিএএ-র পক্ষে ও বিপক্ষের জনগোষ্ঠীর বিরোধ। মরছে কে? তুমি অথবা আমি অথবা সে। সুতরাং মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা তুলতে গিয়ে মরছে সেই হানিফ কিংবা মুহম্মদ অথবা গগন কিংবা বিপিন।
তাই বলছিলাম কি কর্তা গুলি মারামারি থাক। তার চেয়ে বরং নিজের বুদ্ধির গোড়ায় গুলি মেরে বুঝে নিন এই বাচালদের কথায় কান দিয়ে ভুল বোঝাবুঝির বাতাবরণ আরও বাড়াবেন নাকি প্রতিবেশী মুসলিম পরিবারকে বোঝাবেন এই আইন তাদের বিরুদ্ধে নয়। কোনও ভারতীয় মুসলমানের বিপক্ষে নয় এই আইন।
জলদি ভাবুন কি করবেন? তার আগে একবার শুনে নিন সত্যা ছবির সেই বিখ্যাত গান,
‘গোলি মার ভেজে মে…
ভেজা শোর করতা হ্যায়।’
দেবক বন্দ্যোপাধ্যায়