হিন্দুরা বিতাড়িত হলে যাবে কোথায়? পৃথিবীর একটিমাত্র দেশ ভারতবর্ষ যেখানে আজও হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ রয়েছে। কিন্তু সেখানেও পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক মানসিক আঘাত , অপমান ও লাঞ্ছনা সহ্য করতে হচ্ছে। স্বাধীন ভারতে এমন একটি রাজ্য আছে যেখান থেকে হিন্দুরা বিতাড়িত হয়েছে। সেইসব হিন্দু শরণার্থী হয়ে ভারতের অন্য রাজ্যে বসবাস করছে। তারা নিজ ভূমেই পরবাসী হয়েছে। তাদের ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনার জন্য ভারত সরকার বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে। গণতান্ত্রিক ভারতেই হিন্দুদের এই অবস্থা, তাহলে সাংবিধানিক ভাবে ঘোষিত ইসলামিক দেশ পাকিস্তান, বাংলাদেশ বা আফগানিস্থানে হিন্দুদের অবস্থা কী হচ্ছে , তা কখনো ভেবে দেখেছেন? দিল্লি ও অন্যান্য রাজ্যের রাজধানী শহরে জাঁকজমক পূর্ণ বিলাসবহুল অট্টালিকায় থাকা হিন্দু ও অহিন্দুরা তা কীভাবে বুঝবেন? পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে থাকা হিন্দু ও শিখদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এই পার্থক্য শুধুমাত্র ভারতেই রয়েছে। সেখানে রামায়ণ, গীতা, গ্রন্থসাহেব একই স্থানে রাখা হয়। এভাবেই সেখানকার হিন্দু ও শিখবন্ধুরা বেঁচে থাকার রসদ পায়। পেশোয়ার, করাচি, কর্তারপুরের মতো জায়গায় অথবা বালুচিস্থানের কাছে মিট্টি, লাসবেলার মতো এলাকাতে গুটিকতক হিন্দু ও শিখ থাকলেও ইদানীং সেখানে হিন্দু মা-বোনেদের অপহরণ করে জোর করে বিয়ে ও বিভিন্ন ভাবে ইসলামিকরণ যেন সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মোদী সরকারের নাগরিকত্ব বিল শুধুমাত্র সেই অ-মুসলমান সংখ্যালঘুদের রক্ষার জন্য যাদের একমাত্র আশা এবং আশ্রয় হলো ভারত। পাকিস্তানের খ্রিস্টান সমাজের অধিকাংশ খ্রিস্টানই হিন্দু বাল্মীকি সমাজ থেকে ধর্মান্তরিত। আমি লাহোর, করাচি ও মীরকোটে এমন হিন্দু মা-বোনদের সাথে দেখা করে এসেছি যাঁরা ঘরের বাইরে বেরানোর সময় কপালে টিপ, গলায় মঙ্গলসূত্র পরে বেরোতে পারেন না। করাচির কাছে ক্লিফটন সাগরতটে একটি বিখ্যাত শিব মন্দির রয়েছে, সেখানে আজও মন্দিরের পুরোহিত মন্দিরের ভিতরে অর্ধচন্দ্রাকার তুর্কি টুপি পরে থাকতে বাধ্য হন। কিন্তু যদি সেই হিন্দুদের অন্য কোনো দেশে আশ্রয় নিতে হয় তাহলে তারা ইরান, সৌদি আরব বা কুয়েতে কি নাগরিকত্ব পাবেন? এঁরা বছরের পর বছর আক্রমণকারীদের হাত থেকে নিজেকে ও নিজের ধর্মকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এই পরিস্থিতির মধ্যে স্বাধীনতার ৭০ বছর পর ভারতে এমন এক জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রী হলেন যিনি এই ধরনের হিন্দু, শিখ ও খ্রিস্টানদের দৈনিক অপমান ও প্রতারণার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য নাগরিকপঞ্জি বিল আনার সাহস দেখিয়েছেন। এই বিল সর্বদলীয় সম্মতি লাভের পরিবর্তে বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে।
ভারতে নাগরিকত্ব আইন পাশ করা হয়েছিল ১৯৫৫ সালে। সেখানে ভারতে আসা সমস্ত শরণার্থীকে অবৈধ নাগরিক হিসেবে ঘোষিত করা হয়েছে। তাদের বৈধ পাশপোর্ট বা অন্য কোনো কাগজপত্র নেই অথবা মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও তারা এদেশে থেকে গিয়েছেন। এখন এই অনুচ্ছেদে আরও একটি সংশোধনী পঙক্তি জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। সেখানে বলা হয়েছে – ‘আফগানিস্তান, বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তান থেকে হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পার্শি বা খ্রিস্টান এদেশে এসেছেন, যাঁরা ১৯২০-র পাশপোর্ট আইনের ৩ ধারা বা উপধারা ২ থেকে ছাড় পেয়েছেন অথবা ১৯৪৬-র বিদেশি নাগরিক আইন থেকেও ছাড় পেয়েছেন তাঁরা এই আইনের বলে বিদেশি বলে গণ্য হবেন না।’
মুসলমান ভোট হারানোর ভয়ে নাগরিকপঞ্জির বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে। এটি অত্যন্ত দুঃখের কথা যে, বিপদে পড়া নিজ ধর্মের বন্ধুদের শুধুমাত্র ভোটের লোভে ভারতে আশ্রয় দেওয়ার বিরোধিতা করা হচ্ছে। আর হিন্দুদের বিপদে পাশে দাঁড়ানোয় মুসলমানরা কেন চিন্তিত হচ্ছেন? তাঁদের তো প্রায়শ্চিত্ত করতে আরও বেশি করে হিন্দুদের রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসা উচিত। গত জুলাই মাসে লোকসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, আফগানিস্তান-সহ ৭১ টি দেশ থেকে ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য ৪০৪৪ টি আবেদনপত্র বিবেচনাধীন রয়েছে। আবেদনপত্রগুলি ধর্মের ভিত্তিতে কোনোরূপ শ্রেণীবিভাগ করা হয়নি। সারা দেশে ৭৬৮৫ জন বিদেশির সময়সীমা পার হওয়ার পরও ভারতে থেকে যাওয়ার তথ্য সামনে এসেছে। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে নাগরিকত্ব আইন চালু থাকা সত্ত্বেও নির্দিষ্ট কোনো প্রদেশে বিশেষ কোনো চাপ পড়ছে না। ভেবে দেখার সময় এসেছে যে অসম, অরণাচলের মতো রাজ্যগুলির সমস্যা সর্বস্বান্ত হয়ে আসা হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখেদের জন্য, না উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে আসা মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের জন্য?
সব কাজ সবাই করতে পারেন না। তিরুবন্ধুবরের ‘তিরুক্কল’, সুদর্শনের ‘হার কী জিত’, প্রেমচন্দের ‘গোদান’, নরেন্দ্র কোহলির ‘রামকথা’ – এক একটি রচনাই তাদের অমর করে রাখার জন্য পর্যাপ্ত। তাদের আরও রচনা রয়েছে, কিন্তু সেগুলি না থাকলেও তাদের মহিমা বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ হতো না। ইন্দিরা গান্ধীর ১৯৭১ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে বিজয়, অটলবিহারী বাজপেয়ীর পোখরানে পরমাণু পরীক্ষণ তাঁদের অমর করে রেখেছে। তেমনি নাগরিকত্ব আইন প্রণয়নের জন্য কোটি কোটি ভারতবাসীর কৃতজ্ঞতা এবং বিশ্বব্যাপী হিন্দুদের ভারতের প্রতি আস্থা অর্জনের জন্য নরেন্দ্র মোদীকে দেশবাসী সদৈব স্মরণ রাখবে। ভারত হিন্দুস্থান এটা যেমন সত্য, তেমনি ভারত হিন্দুদের দেশ এটাও ততখানিই সত্য। আজকের কিছু হিন্দু যাঁরা নয়া রাষ্ট্রীয়তার ঝান্ডা উড়িয়ে অর্থ ও ক্ষমতার দ্বারা নির্বাচনী সমীকরণ করে দেশের অবস্থা বিগড়ে ফেলছেন, তাঁরা ভারতকে চিনতে ও জানতে সমর্থ হচ্ছেন না। তাঁরা ভাবতেই পারছেন না যে এই ভারতের ধর্ম, সংস্কৃতি ও দেশের মানুষকে রক্ষার জন্য লালকেল্লার সামনের চৌরাস্তায় এই দেশের মহাপুরুষরা নানান অত্যাচার সহ্য করে তাদের প্রাণ বলিদান দিয়েছেন। তাদের কারোর মাথা করাত দিয়ে আড়াআড়ি ভাবে কাটা হয়েছে, কাউকে ফুটন্ত তেলে ডুবিয়ে মারা হয়েছে, কারো সারা শরীরে তুলো জড়িয়ে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, কাউকে গরম সাঁড়াসি দিয়ে গায়ের মাংস খুবলে নিয়ে মারা হয়েছে।
এটা সেই দেশ— যে দেশের মানুষ যারা ১৮ বার দিল্লির নরসংহার, লুণ্ঠন ও দেশবাসীকে উদ্বাস্তু হতে দেখেছে। এখানে সোমনাথ মন্দির বার বার ধ্বংস করা হয়েছে এবং আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে দেখেছে। কিন্তু এই আত্মবিস্মৃত জাতির দেশে দাসত্বের উৎসব শুধু ধুমধাম করে পালন করা হয় না, বরং সেই দাসত্বের প্রতীকগুলিকে অত্যাচারিত, শোষিত, নিপীড়িত মানুষের করের টাকায় রক্ষা ও শোভাবৃদ্ধি করা হয়। আমরা ভুলে গিয়েছি সেই মহরৌলীর যুদ্ধের কথা, যখন কুতুবুদ্দিন আইবকের সেনাপতি হিন্দু ও জৈনদের ২২ টি মন্দির ধ্বংস করছিল এবং অত্যাচারিত হিন্দু ও জৈনদের স্ত্রী ও শিশুদের আর্তনাদে আকাশ পর্যন্ত কেঁদে উঠেছিল। সেই সব মন্দিরের মালমশলায় তৈরি কুতুবমিনার স্বাধীন ভারত সরকার ও দিল্লি প্রশাসনের মর্যাদার প্রতীক রূপে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যেখানে কুতুব উৎসব হয় সেখানে পুরাতাত্ত্বিক বিভাগের প্রায় আবছা হয়ে যাওয়া নীল-সাদা পাথরে কিছু লেখা ভয়ে ভয়ে জানান দিচ্ছে যে, এই মিনার ২২ টি মন্দির ধ্বংস করে তার মশলায় তৈরি করা হয়েছে।
হিন্দুদের শুধু ভারত থেকে বিতাড়িত করা হচ্ছে না, আফগানিস্তান, বালুচিস্তান, মুলতান, পেশোয়ার, করাচী, লাহোর বন্নু, বহাবলপুর, রাওয়ালপিণ্ডি, কর্তারপুর, সিলেট, ঢাকা এবং চমন (যেখানকার আঙুর আজও দিল্লির বাজারে বিক্রি হয়) থেকে হিন্দুদের মেরেধরে, মহিলাদের বলাৎকার ও ধর্মান্তরিত করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আফগানিস্তানের নাম ছিল উপগণস্থান এবং সূর্য মন্দির ও সূর্যপূজার জন্য মুলতানের নাম ছিল মূলস্থান। বাপ্পা রাওলের নামে রাওয়ালপিণ্ডি। আজও পাকিস্তানের পর্যটন বিভাগের প্রচার পত্রিকায় লাহোর ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের পুত্র লবের প্রতিষ্ঠিত বলে উল্লেখ করা হয়। কাবুলের কুভা নদীর তীরে অসংখ্য শিব মন্দির ছিল। আফগান হিন্দুরা পরাক্রম ও বীরত্বের জন্য বিশ্ববিখ্যাত ছিলেন। বালুচ ও পাঠান হিন্দুদের পরাক্রম আজও সেখানকার লোককথার বিষয়। কিন্তু কারণ অন্য কিছু ছিল। বহু বছর পরাক্রমের সঙ্গে মুসলমান আক্রমণকারীদের ঠেকিয়ে রাখা সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ কলহে হিন্দুরা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পরাজিত হয়। তখনই হিন্দুর সংখ্যা কমে যায় ও উৎখাত হয়। আফগানিস্তানের পাহাড়ের নাম হিন্দুদের বীরত্বের নামে না হয়ে হিন্দুদের পরাজয়ের প্রতীক স্বরূপ হিন্দুকুশ রাখা হয়েছে।
নাগরিকত্ব আইন কোনো দৃষ্টিতেই কোনো ভারতীয়ের অধিকারকে খর্ব করবে না বা প্রভাবিত করবে না। লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি মুসলমান অসমে হিন্দুদের সংখ্যালঘু করে অসম বিভাজনের একশো বছরের পুরনো ষড়যন্ত্রের অঙ্গস্বরূপ অসম, পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা দেশে বসে গেলেও সেকুলার বন্ধুদের তাতে কোনো চিন্তা হয় না। অর্থনেতিক কারণে তারা দেশে এসেছে বলে তারা মড়াকান্না করে চলেছেন। কিন্তু ভীষণ ইসলামি অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে হিন্দুরা যখন নিজের প্রাণ ও স্ত্রী-কন্যার সম্মান বাঁচাতে এদেশে শরণ নেয় তখন তার বিরোধিতায় সেকুলার হিন্দুরা শুধু একপায়ে খাড়া হয়েই যান না, বরং অনুপ্রবেশকারী মুসলমানদের হিন্দুদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিতে থাকেন।
এ কীরকম দেশভক্তি, ধর্মভক্তি ও মানবতা? ভারতে অনুপ্রবেশকারী ফিলিস্তিনি, তিব্বতি, রোহিঙ্গিয়া মুসলমান, বাংলাদেশি মুসলমানদের স্বাগত জানিয়ে আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু শরণার্থী হিন্দুদের জন্য দরজা বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। ভারতের সেকুলার হিন্দুরাই একথা বলছে, তাই এর থেকে বড়ো দুর্ভাগ্যের কথা আর কিছু হতে পারে না।
তরুণ বিজয়
(লেখক রাজ্যসভার পূর্বতন সাংসদ)