হঠাৎ করেই চর্চায় চলে এলেন লোকশিল্পী রতন কাহার (Ratan Kahar)। সারাজীবনে এতগুলো বিখ্যাত সৃষ্টি করেও উপেক্ষিত থেকে গেছিলেন ভদ্রলোক। লোকে তাঁর গানই শুধু চিনল, মানুষটাকে চিনল না। লোকগীতি যে আকাশ থেকে পড়ে না, লোকগীতিরও যে গীতিকার-সুরকার এসব থাকে; এই জিনিসগুলো বাঙালিরা এখনো বুঝে উঠতে পারল না। স্বজাতির কাছ থেকে এই ধরণের অবহেলা মেনে নেওয়া বেশ অপমান জনক। এরকম অবস্থায় পড়লে আর পাঁচটা বাঙালির যেমন হয়, তেমনভাবেই অভিমানে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন ভদ্রলোক।
এদিকে তার গান যথেচ্ছ ভাবে সিনেমায় ব্যবহার হচ্ছে, গানের ক্যাসেট বেরোচ্ছে। তা থেকে প্রযোজক, গায়ক, নির্মাতা, পরিচালক সকলেই বেশ দু পয়সা কামিয়ে নিচ্ছে। লাভ পাচ্ছেন না শুধু রতন কাহার (Ratan Kahar) , মূল স্রষ্টা এবং শিল্পী। দেশে শিল্পীস্বত্ব আইন আছে, বৌদ্ধিক সম্পদের ব্যবহার নিয়ে নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। কিন্তু তার সুফল গরিব লোকশিল্পীদের কাছে পৌঁছচ্ছে না।
এই লকডাউনের বাজারে বাদশা (Badsa) -র “গেন্দা ফুল” গানটা যখন বেরোয়, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ভারত জুড়ে জনপ্রিয় হয়ে যায়। তবে খ্যাতি থাকলে সমালোচনাও আসবে। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই বিস্মৃতির ধুলো ঝেড়ে উঠে আসে রতন কাহারের (Ratan Kahar) নাম। বাংলা ফেসবুক পেজগুলোর ভূমিকা এই ক্ষেত্রে অনস্বীকার্য। আইনি পদক্ষেপ নেবার কথাও উঠতে থাকে। বঙ্গ নারী ও সংস্কৃতিকে অশালীনভাবে চিত্রায়িত করার জন্য আত্মদীপ “গেন্দা ফুল” অ্যালবামের প্রযোজক, পরিচালক, সোনি মিউজিক ইন্ডিয়া ও বাদশার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। আত্মদীপ-এর মত আরও একটা দুটো সংগঠন এগিয়ে আসে রতন কাহারকে (Ratan Kahar) আইনি সহায়তা দেবার ব্যাপারে।
বৌদ্ধিক সম্পদ এবং শিল্পীস্বত্ব; এই দুটো আমার বিশেষ রকম আগ্রহের জায়গা। তাই মুম্বাইতে (Mumbai) আইনগত সাহায্য দেবার জন্য আমি নিজেও রতন বাবুর ছেলে শ্রী শিবনাথ কাহারের (Shri Shivnath Kahar) সাথে কথা বলি। ওনার সাথে কথা বলে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল। কিছু মানুষ যে এই যুগেও এত সরল, নির্লোভ এবং অভিমানী হয়ে থেকে যেতে পারেন; এটা নিজের কানে শুনতেও ভীষণ অবিশ্বাস্য লাগে। বা হয়তো কলকাতার লোকেরাই তুলনায় জটিল।
বাংলা জুড়ে এই বিরাট তোলপাড়ের কিছু কিছু বাদশার (Badsa) কানেও পৌঁছায়। বাদশা (Badsa) ক্ষমা চেয়ে ফেসবুকে live করেন। রতন কাহারের (Ratan Kahar) নাম উল্লেখ করেন। এই ঘটনার পর জাতীয় মিডিয়াতেও সাড়া পড়ে যায়। ফেসবুকের বড় বড় ইংরেজি এবং হিন্দি পেজগুলোতেও বেশ ফলাও করে ভিডিও এবং পোস্ট আসতে থাকে এই বিষয়ে। সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় হল, প্রায় সবকটাতেই কোন না কোন ভাবে একটাই ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। পাশাপাশি রাখা হুডি-জ্যাকেট-সানগ্লাসের বাদশা (Badsa) আর ছোট্ট চন্দনের টিপ পরা রতন কাহার। একটা তেল চুকচুকে গাবদা গোব্দা মুখশ্রীর পাশে একজন কালোকোলো বয়স্ক মানুষের মুখ। দুজনের অবস্থার এই সীমাহীন বৈপরীত্যটাই চোখ টানে। এবং এতটাই যে, এসব বিষয়ে একদম কিচ্ছু না জানা কোন মানুষের সহানুভূতিটাও কেড়ে নেবেন শ্রী রতন কাহারই (Ratan Kahar)।
জনমানুষের সমবেদনা পাওয়া অনেক ভাগ্যের ব্যাপার। শেষ বয়সে এসে শিল্পী তাঁর যোগ্য সমাদর পেলেন। এই ঘরবন্দি অবস্থাতেও তার কাছে পৌঁছল একটা প্রাথমিক সাম্মানিক। “গেন্দা ফুল” গানটা যে পরিমাণ জনপ্রিয় হয়েছে, সেটার কাছে ৫ লক্ষ টাকা খুবই কম। তবে এখন রয়্যালটি দেবার কথাও উঠছে। আশা করছি ধীরে ধীরে সবই পাবেন। ঘটনা-প্রবাহ যেভাবে বইছে, তাতে করে বাদশার (Badsa) সদিচ্ছা রয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। এবারে কলকাতার যেসব প্রযোজক-নির্মাতা শ্রী রতন কাহারকে (Ratan Kahar) ভাঙিয়ে খেয়েছেন, তাঁরাও এগিয়ে আসুন। কোন গুণী শিল্পীকে তাঁর ন্যায্য পাওনা আদায় করতে যেন ছুটোছুটি না করতে হয়।
আরো একটা ব্যাপারের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন রতন বাবু (Ratan Kahar)। শিল্পীস্বত্বকে ভারতের গণমানুষের আলোচনায় প্রথমবারের জন্য উঠিয়ে আনার কৃতিত্বটাও তাঁর। কারুর লেখা, গান বা ছবি যে তাঁর অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যায় না এবং সেসব সৃষ্টি ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার করলে তার যথাযথ মূল্য দিতে হয়। এই বিতর্কটা না হলে একটা বিশাল সংখ্যক ভারতবাসী সেটা জানতেও পারতেন না। রতন কাহারকে (Ratan Kahar) অভিনন্দন। বিনা যুদ্ধে জিতে নিলেন এত বড় একটা লড়াই। বাকি লড়াই গুলোও হেসেখেলেই জিতবেন, শুভ কামনা রইল।
স্মৃতিলেখা চক্রবর্তী