দীর্ঘ পাঁচ শতাব্দীর টানাপোড়েনের অবসান| শনিবার, ৯ নভেম্বর বিতর্কিত অযোধ্যা মামলার রায়দান করল সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ| প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ, বিচারপতি শরদ অরবিন্দ বোবদে, বিচারপতি এস আব্দুল নাজির, বিচারপতি অশোক ভূষণ এবং বিচারপতি ধনঞ্জয় ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ জানিয়ে দিল, অযোধ্যার ২.৭৭ একর বিতর্কিত জমিতেই নির্মাণ হবে রাম মন্দির| মুসলিমরা মসজিদ নির্মাণের জন্য অযোধ্যাতেই বিকল্প ৫ একর জমি পাবেন| বিতর্কিত জমিতে রাম মন্দির নির্মাণ করতে তিন থেকে চার মাসের মধ্যে ট্রাস্ট বানাতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে| সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে অন্যত্র ৫ একর বিকল্প জমি দেওয়া হবে| সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে অযোধ্যার মধ্যেই বিকল্প ৫ একর জমি দিতে হবে কেন্দ্রকে| শুনানি চলেছিল লাগাতার ৪০ দিন| শুনানি শেষে রায় সংরক্ষিত করে রেখেছিল শীর্ষ আদালত| শুক্রবারই উত্তর প্রদেশ পুলিশ-প্রশাসনের শীর্ষ আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ| ওই বৈঠককে ঘিরেই জোর জল্পনা শুরু হয়েছিল, তাহলে কি দু’-এক দিনের মধ্যেই অযোধ্যা মামলার রায় দেবে সুপ্রিম কোর্ট| সেই জল্পনাই সত্যি হল| শনিবার সকাল ১০.৩০ মিনিট নাগাদ অযোধ্যা মামলার রায়দান করল সুপ্রিম কোর্ট| প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ অযোধ্যা মামলার রায়দান করার সময় বলেছেন, ১৯৪৬ সালে ফৈজাবাদ আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে শিয়া ওয়াকফ বোর্ড যে স্পেশ্যাল লিভ পিটিশন (এসএলপি)-এর আর্জি জানিয়েছিল, আমরা তা খারিজ করছি| অর্থাত্ সর্বসম্মতিক্রমে খারিজ হয়ে গেল শিয়া ওয়াকফ বোর্ডের আর্জি| প্রধান বিচারপতির কথায়, বাবরের সহযোগী মির বাকি মসজিদ তৈরি করেছিলেন| আদালতের পক্ষে অনুচিত ধর্মতত্ত্বের বিষয়ে প্রবেশ করা| ভারসাম্য বজায় রাখা উচিত আদালতের| নির্মোহী আখড়ার দাবিও খারিজ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট| সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, নির্মোহী আখড়ার দাবি শুধুমাত্র ম্যানেজমেন্ট| নির্মোহী আখড়া কোনও ‘শাবাইত’ নয়| প্রত্নতত্ত্ব রিপোর্টের উপর যাবতীয় তর্ক-বিতর্ক হয়েছে| আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্ট নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই এবং অনুসন্ধানকে অবহেলা করা যায় না| সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, ‘হিন্দুদের বিশ্বাস অযোধ্যা ভগবান রামের জন্মস্থান, তাঁদের ধর্মীয় আবেগ রয়েছে| মুসলিমরা এটিকে বাবরি মসজিদ বলছেন| হিন্দুদের বিশ্বাস ভগবান রাম বিতর্কিত জমিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন| আবেগ ও বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না| ইতিহাসের বিবরণ অনুযায়ী অযোধ্যা ভগবান রামের জন্মস্থান| ব্রিটিশরা আসার আগেও অযোধ্যার বিতর্কিত জমিতে হিন্দুরা রাম ছাবুত্রা, সীতা রাসোইয়ের পুজো করত, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে|’ সর্বোচ্চ আদালতের সাংবিধানিক বেঞ্চ জানিয়েছে, ব্রিটিশরা আসার আগেও অযোধ্যার বিতর্কিত জমিতে যে হিন্দুরা পুজো করত, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে| সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, হিন্দুরা বিশ্বাস করেন অযোধ্যায় রাম জন্মভূমি রয়েছে| আবার মুসলিমরাও এখানে নমাজ পড়েন| জমির অধিকার কার, তা শুধুমাত্র আইন ঠিক করবে|’ আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্টকেও মান্যতা দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট| খালি জমিতে মসজিদ তৈরি হয়নি| মসজিদের নীচে কাঠামো পাওয়া গিয়েছে| খননে যা পাওয়া গিয়েছে তা ইসলামিক চিহ্ন বহন করে না, মন্দিরের প্রমাণও পাওয়া যায়নি| সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যা মামলার রায়দান করে জানিয়েছে, আইনি ভিত্তিতেই জমির মালিকানা স্থির করা উচিত| সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড অধিকার দাবি করতে পারে না| শর্তসাপেক্ষে মূল বিতর্কিত জমি পাবে হিন্দুরা| ওই জমি পাবে ‘রাম জন্মভূমি ন্যাস’| কেন্দ্রকে তিন থেকে চার মাসের মধ্যে ট্রাস্ট গঠনের নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট| বিতর্কিত জমি তুলে দেওয়া হবে বোর্ড অফ ট্রাস্টের হাতে| ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানেই বিতর্কিত জমিতে রাম মন্দির নির্মাণ হবে| বিকল্প ৫ একর জমি পাবে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড| সুপ্রিম রায়ের পরই নির্মোহী আখড়ার মুখপাত্র কার্তিক চোপড়া জানিয়েছেন, ‘দীর্ঘ ১৫০ বছর ধরে চলতে থাকা আমাদের লড়াইকে মান্যতা দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট, এ জন্য নির্মোহী আখড়া কৃতজ্ঞ|’ অযোধ্যা মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রেক্ষিতে সর্বভারতীয় মুসলিম পার্সোনাল আইন বোর্ডের পক্ষ থেকে জাফারিয়াব জিলানি জানিয়েছেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের রায়কে সম্মান জানাচ্ছি, কিন্তু রায়দান সন্তোষজনক নয়| কোথাও কোনও ধরনের প্রদর্শন করা উচিত নয়| আমাদের কমিটি সম্মত হলে রিভিউ পিটিশন দাখিল করব| এটি আমাদের অধিকার এবং সুপ্রিম কোর্টের বিধিও|’ অযোধ্যা মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়কে ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী আখ্যা দিয়ে কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছেন, ‘ঐতিহাসিক এবং যুগান্তকারী রায়|’ কেন্দ্রীয় সড়ক ও পরিবহণ মন্ত্রী নীতীন গড়কড়ি বলেছেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের রায়কে প্রত্যেকের মেনে নেওয়া উচিত এবং শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা উচিত|’ বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের কথায়, ‘সুপ্রিম কোর্টের রায়কে প্রত্যেকেরই স্বাগত জানান উচিত, সামাজিক সম্প্রীতির জন্য এটাই দরকার| এই ইস্যুতে আর কোনও বিরোধ হওয়া অনুচিত, জনগণের কাছে এটাই আমার আবেদন|’ হিন্দু মহাসভার আইনজীবী বরুণ কুমার সিনহা জানিয়েছেন, ‘ঐতিহাসিক রায়, এই রায়ের মাধ্যমে বৈচিত্যের মধ্যে ঐক্যের বার্তা দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট|’ কংগ্রেস নেতা রণদীপ সুরেজওয়ালা বলেছেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যা মামলার রায়দান করেছে, কংগ্রেস রাম মন্দির নির্মাণের পক্ষে| এই রায়ের ফলে শুধুমাত্র রাম মন্দির নির্মাণের দরজাই খুলে গেল না, রাম মন্দির নির্মাণ ইস্যুতে বিজেপি এবং অন্যান্যদের রাজনীতি করার দরজা বন্ধ হয়ে গেল|’ আধ্যাত্মিক গুরু শ্রী শ্রী রবিশঙ্কর বলেছেন, ‘ঐতিহাসিক রায়দান, আমি এই রায়কে স্বাগত জানাচ্ছি| এই বিষয়টি দীর্ঘকার ধরে চলে আসছিল, অবশেষে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে| শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে|’
2019-11-09