অসমে চূড়ান্ত নাগরিকত্ব তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পর বিজেপির মধ্যেই কিছুটা অসন্তোষ উঁকি মারছে। পুষ্করে সদ্য শেষ হওয়া আর এস এস কার্যকর্তাদের বৈঠকে আপনি এ নিয়ে বলেছেন।
রামমাধব : হ্যা, চূড়ান্ত নথিবদ্ধ নাগরিক তালিকা দিন দশেক আগে প্রকাশিত হয়েছে, এর সমস্ত খুঁটিনাটি কিন্তু এখনও সরকারের হাতে আসেনি। এগুলি এখনও সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের জিম্মায় রয়েছে। তারা সবকিছুই সর্বোচ্চ আদালতের হাতে তুলে দেবেন। বিষয়টার সম্পূর্ণরূপে আমাদের হাতে আসার পর যা করণীয় থাকবে সেগুলি এ বিষয়ে যুক্ত থাকা ব্যক্তিরাই ঠিক করবেন। অবশ্যই এ নিয়ে নাগরিকদের কিছু কিছু অংশের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। তারা এই প্রক্রিয়ার পুনর্নিরীক্ষণ চাইছেন।
বাস্তবে রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার উভয়ের তরফ থেকেই অসমের সীমান্তবর্তী জেলাগুলির ক্ষেত্রে অন্তত ২০ শতাংশ এবং অন্যান্য অঞ্চলগুলিতে ১০ শতাংশ নাগরিকদের চূড়ান্ত তালিকা থেকে বেছে নিয়ে পুনঃপর্যালোচনা করার অনুমতির জন্য সর্বোচ্চ আদালতের কাছে আবেদন জানানো হয়। মানুষের মধ্যে এমন একটা ধারণা দানা বাধছে যে। অনুপ্রবেশকারীদের একটা বড়ো অংশ এন আর সি-তে নিজেদের নাম নথিভুক্ত করে ফেলেছে। অপরদিকে বৈধ নাগরিকদের বেশ বড়োসড়ো অংশের নাম চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ গেছে। আমাদের করা উল্লেখিত অনুরোধ আদালত গ্রাহ্য করেনি। তবে সবরকম খুঁটিনাটি দেওয়া তালিকা প্রকাশিত হলেই আমরা বিষয়টা নিয়ে আবার এগিয়ে যাব। একজনও বৈধ নাগরিক যাতে তালিকা থেকে বাদ না পড়েন তা নিশ্চিত করতে আমাদের দল ও সরকার দায়বদ্ধ।
অসমে দলের রাজ্য নেতারা তো বেশ মুষড়ে পড়েছেন। তাদের ক্ষোভ প্রশমনের কথা কী ভাবছেন?
রামমাধব : এন আর সি অসমবাসীদের একটি অতি দীর্ঘদিনের দাবি। আমরা দীর্ঘ প্রচেষ্টায় এটিকে সফলতার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। এরপরও যে আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে বেশ কিছুটা ন্যায়সঙ্গত। এই আশঙ্কার প্রত্যেকটিকেই ভিন্নভিন্নভাবে সমাধান করতে হবে।
একটি পথ হচ্ছে সর্বোচ্চ আদালতের কাছে আবার নতুন যুক্তি ও আবেদন নিয়ে ফিরে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, আমরা সমগ্র দেশবাসীকে কথা দিয়েছি যে আমরা সারা দেশেই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল লাগু করব। এই বিল আইনে পরিণত হয়ে গেলেই এই সংক্রান্ত ত্রুটি বিচ্যুতিগুলির দিকে নজর দেওয়া হবে।
তৃতীয়ত, যাদের নাম এন আর সি তালিকায় জায়গা পায়নি তারা অনায়াসে অসমে কার্যকর থাকা কয়েক শো ফরেনার্স ট্রাইবুনালে গিয়ে যোগাযোগ করতে পারেন এর পরও উচ্চ আদালত তো খোলাই আছে।
বৈধ নাগরিকদের নাম এইভাবে বাদ পড়ার জন্য আপনি কাকে দায়ী করবেন?
রামমাধব : এই কারণেই তো সংশ্লিষ্ট কেসগুলির পুনর্নিরীক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হচ্ছে বিশেষ করে সীমান্তবর্তী জেলাগুলির ক্ষেত্রে। এটি নিতান্তই একটি প্রক্রিয়াগত বিষয়। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এ নিয়ে অভিযোগ করা ঠিক নয়। বরঞ্চ আমরা খুশি যে আমরা সমগ্র প্রক্রিয়াটিকে সমাপ্ত করতে পেরেছি। এই গোটা কর্মকাণ্ডটিই কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতের তত্ত্বাবধানে হয়েছে।
আচ্ছা, শেষাবধি যে ফলাফল বেরিয়ে এল তা বিজেপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে কীভাবে প্রভাবিত করবে? অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা যে দেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে চরম ভীতির কারণ একথা তো দল বার বার বলে এসেছে।
রামমাধব : বিষয়টা বিজেপির এজেন্ডা বলে দেগে দেওয়া ঠিক নয়। এটা ঠিকই অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রে আমাদের সহ্যের সীমা শূন্য। ঠিক যেমন সন্ত্রাসবাদ ও দুর্নীতির ক্ষেত্রেও আমাদের সহিষ্ণুতার মাত্রা শূন্য। মনে রাখা দরকার অবৈধ অনুপ্রবেশ জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যেমন বিপদ ঠিক তেমনই দেশের মানুষের জীবন জীবিকার ক্ষেত্রেও সমান বিপজ্জনক। অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত বিপদের সঙ্গে লড়াইয়ের পন্থা নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত স্বচ্ছ। সিপিআই দলের বহুবারের সাংসদ ও পূর্বতন গৃহমন্ত্রী প্রয়াত ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত এক সময় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন অসমে ১ কোটিরও বেশি সংখ্যার বেআইনি অনুপ্রবেশকারী আছে। তাই এটা কখনই একা বিজেপির বিষয় নয়। সমস্ত দলই এই সমস্যার কথা মেনে নিয়েছে। বিশ্বের কোনো দেশই অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের সহ্য করে না।
আপনি কী মনে করেন অন্যান্য অনেক রাজ্যেই এবার এনআরসি-র দাবি উঠতে চলেছে?
রামমাধব : অনেক রাজ্য সরকার ও বহু রাজনৈতিক নেতা তাদের নিজ নিজ রাজ্যে এই প্রক্রিয়া চালু করার কথা বলেছেন। আমি নিশ্চিত কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রী এ সংক্রান্ত বিষয়ে যথাযথ মতামত দেবেন। সব সময় সংখ্যাটাই বড়ো কথা নয় যদি ধরে নেওয়া যায় যে আপনি ১৫ লক্ষ অনুপ্রবেশকারীকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন। সেটা আদৌ খারাপ নয়। নিশ্চয় এক্ষেত্রে হয়তো আপনার মনে হতে পারে সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এটা তো মানতে হবে আপনি ১৫ লক্ষকে অন্তত চিহ্নিত করতে পেরেছেন। অসমে নাগরিক পঞ্জিকরণের কাজ শুরু হয়েছিল সংসদের একটি আইন বলে। এখন সারা দেশের ক্ষেত্রে গৃহমন্ত্রক কী ব্যবস্থা নেয় সেটা আমরা সময়ে দেখতেই পাব।
কাশ্মীরে যে সমস্ত মূলধারার রাজনীতিবিদ উপত্যকায় বরাবর দেশের সংবিধানের রক্ষাকর্তা হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেন তাদের এত দীর্ঘদিন গৃহবন্দি রাখার বিষয়টা আপনি কীভাবে দেখছেন।
রামমাধব : এই প্রশ্নটা কারা আমাদের করছে? রাজনৈতিক নেতাদের কোনো বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে নিবর্তনমূলক আটক করা হয়ে থাকে। এটি সামগ্রিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটা অঙ্গমাত্র। তাছাড়া কাশ্মীরে একটা বিশেষ বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও কোনো অনভিপ্রেত ঘটনা যাতে না ঘটে তা নিশ্চিত করতেই সেখানকার বর্তমান প্রশাসন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে।
মনে রাখতে হবে এমন আগাম সাবধানতামূলক গ্রেপ্তারি অতীতেও হয়েছে। আমি কোনো তুলনা টানছিনা। শুধু মনে করিয়ে দিতে চাই ফারুক আবদুল্লার পিতা পূর্বর্তন মুখ্যমন্ত্রী শেখ আবদুল্লা ১৯৫৩ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার পর দীর্ঘকাল কারাবাস করেছিলেন। যদি বলেন কেন এটা করা হয়েছিল? উত্তর হবে একই—তখনকার পরিস্থিতিতে নিশ্চয় তার প্রয়োজন ছিল।
কিন্তু কাশ্মীরের সমস্ত নেতাই প্রায় ১ মাসের ওপর গৃহবন্দি আছেন। এরকম কতদিন চলবে?
রামমাধব : এটি স্থানীয় প্রশাসনের নেওয়া একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা যাতে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোনো অবনতি না হয়। ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাশ্মীর থেকে লাদাখকে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল ঘোষণা করে আমরা যে সাহসি পদক্ষেপ নিয়েছি তা নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক। এত বড়ো একটা সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় সেখানে যাতে অসন্তোষ বিক্ষোভ শান্তি শৃঙ্খলা বিঘ্নিত না করে তা নিশ্চিত করতেই নেতাদের সাময়িকভাবে গৃহবন্দি রাখা হয়েছে। জীবনযাত্রা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলেই তাদের মুক্ত করে দেওয়া হবে।
একটা কথা আমি পরিষ্কার করে দিতে চাই। সংবিধানের দোহাই দেওয়া বা জাতীয় পতাকা হাতে নেওয়া কোনো দাতব্যমূলক কাজ নয়। যে ব্যক্তি ভারতের রাজনীতিক হিসেবে কোনো দল পরিচালনা করবে দেশের সংবিধান অনুযায়ী উল্লেখিত কাজ দুটি তার অবশ্য কর্তব্য। তাই সংবিধান আর পতাকা ধরলেই যদি কেউ ভেবে থাকে সে এমন দেশসেবা করে ফেলেছে তাকে আর দেশের স্বার্থে কখনই আটকানো যাবে না তা মহা ভুল।
আপনি সদ্য সদ্য আর এস এসের বৈঠক থেকে ফিরেছেন সেখানে অর্থনীতির শ্লথগতি নিয়ে কী উঠে এল ?
রামমাধব : দেখুন সারা বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে তুলনা করলে ৫ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধি মোটেই খারাপ নয়। সারা বিশ্বের জিডিপি ২ শতাংশের আশপাশে ঘোরা ঘুরি করছে। সেই নিরিখে আমরা আমাদের অর্থনীতি পরিচালনা ঠিক লক্ষ্যেই করেছি। এটা বলার পরও আমি কখনওই অর্থনীতির চ্যালেঞ্জকে অস্বীকার করছি না। দেশের অর্থমন্ত্রী ও সরকার এ সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিবহাল ও চ্যালেঞ্জ নিতে তৈরি। গত দু’সপ্তাহে অর্থনীতি সংক্রান্ত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ও পরিমার্জন তারা করেছেন।
(সৌজন্য টাইমস অব ইন্ডিয়া)
2019-09-27