রবীন্দ্রনাথ শিশু-কিশোরদের খুব ভালোবাসতেন। শান্তিকেতনে যখন থাকতেন, সন্ধে হলেই বসতেন কচিকাঁচাদের নিয়ে। এখনকার মতো বেশি ছাত্রছাত্রী তখন সেখানে ছিল না। পড়াশোনা দিনের বেলা ক্লাসেই হয়ে যেত। পড়ুয়ারা অপেক্ষায় থাকত, কখন সন্ধে হবে আর কখন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ আসবেন। গুরুদেবেরও সেই সভায় আসার জন্য মন আনচান করত। বড়ো সভা-সমিতি, আমন্ত্রণ ইত্যাদিতে না গিয়েও তিনি কখনও কখনও শিশুদের কাছে হাজির হতেন, গল্প বলতেন। ভূতের গল্প, বাঘ-ভাল্লুকের গল্প – আরও কত কী। পড়ে শোনাতেন নিজের লেখা গল্প অথবা নাটক। পড়ুয়ারাও গল্প শোনাত, তাতে রবি ঠাকুর উৎসাহ দিতেন। মাঝে মাঝে নাটক লিখে অভিনয় করাতেন ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে। এরকমই এক সন্ধেবেলা শিশুদের সভায় রবীন্দ্রনাথ গায়ে কাঁটা দেওয়া একটি গল্প শোনালেন – 

একবার শিলাইদহে যাচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কোনো কারণে সন্ধের ট্রেন মিস হয়ে যায়। রাতের ট্রেনে গিয়ে নামলেন কুষ্টিয়া। তখন অনেক রাত। শিলাইদহ যেতে পদ্মা নদী পেরোতে হবে। কিন্তু তখন নদীতে কোনো নৌকোই নেই। অগত্যা একা নদীর তীরেই অপেক্ষা করতে থাকলেন রবি ঠাকুর।

এক সময়ে তিনি দেখলেন, একটা ছোট্ট নৌকো আসছে তাঁর দিকে। নৌকোর মাঝিকে তিনি চেনেন, তাঁদের জমিদারিরই এক পুরোনো প্রজা। রবীন্দ্রনাথকে সেলাম করে সে বলল, “আসুন কর্তা, আমার নৌকোয়; আপনাকে পৌঁছে দেব”। রবীন্দ্রনাথ বললেন, “আমার বড়ো বোটটা কোথায় গেল?”  সে উত্তর দেয়, “সেটা বোধ হয় আপনাকে না পেয়ে ফিরে গেছে”।

তখন রবীন্দ্রনাথ সেই নৌকোতে উঠলেন। মাঝি বিছানাপত্র গুছিয়ে দিল। শুয়ে পড়লেন রবি ঠাকুর। নৌকো ধীরে ধীরে চলছে। চারদিক অন্ধকার, শুনশান। লগির শব্দ আর জলের ছপছপ – আর সব নিস্তব্ধ। সম্ভবত নদীর জলও স্থির। মাঝি এগিয়ে নিয়ে চলেছে নৌকো। এভাবেই গোটা রাত কেটে গেল।

ধীরে ধীরে ভোর হল। মুরগির ডাক শোনা গেল। আর নৌকো গিয়ে লাগল তীরে। মাঝি নেমে বলল, “বাবু, একটু আসছি”। সেই যে গেল, আর ফেরে না। এদিকে বেলা ক্রমশ বাড়ছে। নৌকোতেই বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ। ঘাটে লোকজন এল। রবীন্দ্রনাথকে বসে থাকতে দেখে তারা অবাক। রাতে যে কোনো নৌকোই ছিল না ঘাটে।

রবীন্দ্রনাথ সব কথা খুলে বললেন, এক প্রজা তাঁকে কীভাবে নৌকোয় চড়িয়ে পার করে দিয়েছে। তাতে সবার বিস্ময় আরো বেড়ে গেল। তারা জানাল, কয়েক মাস আগে মারা গিয়েছে সেই প্রজা। চমকে উঠলেন রবীন্দ্রনাথ। অন্য নৌকো আনা হল। তাতে রবীন্দ্রনাথ চড়ে বসলেন। পিছন ফিরে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন তিনি। যে ছোটো নৌকো করে এসেছিলেন, তা আর নেই। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে।

এই গল্প রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন কচিকাঁচাদের। ঘটনাটি বাস্তবে ঘটেছিল কিনা তা জানার কোনো উপায় নেই। কিন্তু এই গল্প শুনে সবার গা ছমছম করে উঠেছিল। 

তথ্যসূত্র – ‘শিশুদের আসরে রবীন্দ্রনাথ’, সুব্রত কর, যুগান্তর, ২৫ বৈশাখ, ১৩৫৮। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.