“এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়
আমার মুক্তি ধূলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে
এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয়, আলোয়।”
আকাশের বুকে কিংবা ধূলার পরে বা নদীর বাঁকে বাঁকে জীবনের পরম মুক্তিকে সন্ধান করে ফিরেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঠাকুরবাড়ির কঠোর অনুশাসন, শ্যাম নামের চাকরের চোখরাঙানির মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের কেটেছে ছেলেবেলা। কিন্তু জীবনস্মৃতি থেকে জানা যায়, এই কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে থেকেই কখন যেন বাইরের প্রকৃতিকে দু’হাত ভরে তিনি পেতে চেয়েছিলেন। সেদিন ছোট রবীন্দ্রনাথ জানালা দিয়ে দু’চোখ ভরে দেখেছিলেন নির্জন পুকুরকে বা তার খুব প্রিয় বটগাছটিকে। ছোট্ট রবির যেন কত কথা হতো সেই বটগাছ আর পুকুরের সঙ্গে। পরবর্তীকালে পরিণত বয়সে সেই ছেলেবেলার বটগাছটিকে কেন্দ্র করে তিনি শিশু’ কাব্যে লিখেছিলেন,
“নিশিদিশি দাঁড়িয়ে আছো
মাথায় লয়ে জট,
ছোটো ছেলেটিকে মনে কি পড়ে
ওগো প্রাচীন বট।”
সুতরাং রবীন্দ্রনাথের মধ্যে প্রকৃতির আসা-যাওয়া বা তাঁর হৃদয়ে প্রকৃতির অমোঘ ভাবসম্মেলন সেই ছোটবেলা থেকেই। এরপর জমিদারি পরিদর্শন করতে রবীন্দ্রনাথকে বোটে করে ভেসে বেড়াতে হয়েছিল কখনও সাজাদপুর, কখনও শিলাইদহে। পদ্মার বুকে ভাসতে ভাসতে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক কত নিবিড়। ছিন্নপত্রাবলী’র পত্রগুলি থেকে জানা যায়, তাঁর ছোট গল্পগুলি বা তাঁর চরিত্ররা এক অর্থে প্রকৃতিজাত।
“এক সময় ঘুরে বেড়িয়েছি বাংলার নদীতে নদীতে। দেখেছি পল্লীবাংলার বিচিত্র জীবনযাত্রা…. একটা পাগলাটে মেয়ে নৌকা করে শ্বশুরবাড়ি চলে গেল… কিংবা যে খ্যাপাটে ছেলে (ছুটি গল্পের ফটিক) দুষ্টুমির চোটে সারা গ্রাম মাতিয়ে বেড়ায় একদিন তাকে যেতে হল শহরে। এইটুকু দেখেছি, বাকিটা নিয়েছি কল্পনা করে। (চিঠিপত্র)
স্বাভাবিক অর্থেরবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির প্রেক্ষাপট থেকেই প্রকৃতির পুত্র-কন্যাদের নক্লপে আবিষ্কার করে তাদের স্থান দিলেন প্রকৃতিরই মাঝে। তাই হয়তো সুভা গল্পের সুভাষিণী শ্বশুরবাড়িতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারল না, সে আবার ফিরে এলো প্রকৃতির কোলে তার বাবার কাছে। অতিথি’ গল্পের তারাপদ যেন প্রকৃতির মাঝে শুনতে পেত তার মুক্তির স্বাদ। তাই যখনই তাকে দাম্পত্য জীবনের শৃঙ্খলে বাঁধার আয়োজন হলো, তখনই সে এক বার রাতে সকলকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গেল সেই প্রকৃতির কাছে। ছুটি’ গঙ্গো ফটিক- এক অর্থে সে তো প্রকৃতিরই সন্তান। ফটিকের সঙ্গে ‘পল এ ভারজিনি’ গল্পের মুখ্য চরিত্র ভারজিনি-র সাদৃশ্য আছে। ভারজিনিও ফটিকের মতো প্রকৃতি সন্তান, যখনই ভারজিনিকে শহরে গণ্ডীবদ্ধ জীবনে আবদ্ধ রাখা হলো, তখনই ফটিকের মতোই সে-ও মৃত্যুর মধ্যেই লাভ করল পরম মুক্তি।
রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি চিন্তা তার ছোট গল্পগুলিতে বিশেষভাবে ধরা পড়ে। এক এক সময় মনে হয়, প্রকৃতির সান্নিধ্য ছাড়া তাঁর গল্পগুলি বা চরিত্রগুলি যেন সর্বাত্মক নয়। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে ‘বলাই’-এর কথা। প্রবাসী পত্রিকাতে গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল। যদিও বনবাণী’ কাব্যটির মূল ভাবনার সঙ্গে বলাই’-এ ভাবগত সাযুজ্য লক্ষ্যণীয়। বলাই একটি ছোট ছেলে। মা-মরা এই ছেলেটি কাকা ও কাকীর বাৎসল্যের আধারে লালিত। কিন্তু গাছেদের সঙ্গে তার সখ্যতা সেই ছোটবেলা থেকেই। কেউ যদি আমলকি গাছের ডালটা ভেঙে দিত বা ঘাসিয়ারা যদি ঘাস কাটতে আসত, তবে বলাইয়ের ভিতরে ধ্বনিত হতো প্রচণ্ড কষ্টের একটা ব্যথাতুর সুরের অনুরণন। তাই, বলাই যেন প্রকৃতিরই দোসর। আমাদের মনে হতেই পারে, বলাই শুধু প্রকৃতির নয়, রবীন্দ্র-প্রীতিরও এক সত্ত্বা।
রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিচিন্তা বা তাঁর প্রকৃতি প্রেম তাঁর রচিত অজস্র সঙ্গীতে বিশেষভাবে নিহিত আছে। রবীন্দ্রনাথের গানগুলিকে যতগুলি পর্যায়ে ভাগ করা যায়, তার ভিতরে প্রকৃতি পর্যায় অন্যতম। আর রবীন্দ্রসঙ্গীতে প্রকৃতি মানেই সবচেয়ে বেশি মন টানে বর্ষা প্রকৃতি সান্নিধ্যে রচিত গানগুলি। এগুলি গান নয়, যেন বর্ষার এক একটি পরিপূর্ণ ছবি। একটু বিস্তারিত আলোচনায় তা বোঝা যাবে।
(১) ছায়া ঘনাইছে বনে বনে— গানটিতে বর্ষার পূর্ব মুহূর্তের এক অসাধারণ ছবি আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। (২) নীল অঞ্জন ঘন পুঞ্জ / ছায়ায় সম্বত অম্বর / হে গম্ভীর, হে গম্ভীর— বর্ষাকে এই গানটিতে তিনি গম্ভীর’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ-ও এক অর্থেবর্ষার আগমনের পূর্ব অবস্থাকে ছবির মতো ফুটিয়ে তোলে।রবীন্দ্রনাথের ক্ষণিকা’কাব্যের অন্তর্গত নববর্ষা’কবিতাটিবর্ষার সমস্ত রূপকে চিত্রায়িত করে। যেমন— গুরু গুরু মেঘ গুমরি গুমরি । গরজে গগনে গগনে— এই অংশটি বষা আগমনের মুহূর্তটিকে চিহ্নিত করে, তারপরই ধেয়ে চলে আসে বাদলের ধারা নবীন ধান্য দুলে দুলে সারা। — যা বর্ষার অঝোর শ্রাবণধারাকে আমাদের সামনে ছবির মতো ফুটিয়ে তোলে। ব্যার রূপকে আঁকতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বা প্রকৃতির বিশেষ কয়েকটি ফুলকে তাঁর গানে, কবিতায় বারে বারে ব্যবহার করেছেন।
যেমন- কদম, বকুল, কেয়া, চম্পা, যুথী (যুঁই), মালতী ইত্যাদি। শুধু বষাই নয়, রবীন্দ্রসঙ্গীতে বসন্ত ও তার প্রকৃতি একটা আলাদা জায়গা করে নিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের গানে তাঁর প্রকৃতি ভাবনা সহজাতভাবেই যেন এসেছে। যেমন বসন্তের আগমনে প্রকৃতিতে যে সাড়া জাগে, তা কবির ভাষায়- ‘ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে / ডালে ডালে, ফুলে ফুলে, পাতায় পাতায় / আড়ালে আড়ালে কোণে কোণে।আবার বসন্তের পাশাপাশি শীতের শুষ্ক নির্জন প্রকৃতির রূপটি ধরা পড়ে তাঁর বিভিন্ন গানে। যেমন— শীতের বনে কোন সে কঠিন আসবে বলে / শিউলিগুলি ভয়ে মলিন বনের কোলে।
রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিচিন্তা তাঁর কবিতা ও নাটকেও বিশেষ ভাবে ফুটে ওঠে।‘সোনার তরী’ কাব্যের প্রথম কবিতাটিতে বর্ষা প্রেক্ষাপটে প্রকৃতির অন্যান্য বর্ণনাও রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক চিন্তার প্রতিফলন, যা আমাদের মুগ্ধ করে। গগনে গরজে মেঘ, ঘন বর্যা / কুলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা / রাশি রাশি ভারা ভারা ধান-কাটা হল সারা / ভরা নদী ক্ষুরধারা খর পরশা। সোনারতরী ছাড়াও কল্পনা’ কাব্যের বর্ষশেয’ ও ‘নৈবেদ্য কাব্যের ‘কোপাই’, ‘ক্ষণিকা’ কাব্যের নববর্যা’ প্রভৃতি কবিতাগুলি যেন কবির অন্তরের প্রকৃতিপ্রেমের রম্য বিগ্রহটিকে বারেবারে উন্মোচিত করে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের অন্তরের গ্লানিকে স্ফুলিঙ্গ’কাব্যের অকপটে স্বীকার করেছেন। এই স্বীকারোক্তিতে ধ্বনিত হয়ে ফেরে তিনি প্রকৃতিকে আরও আরও নিবিড়ভাবে পেতে চেয়েছিলেন। তাই কবির ভাষায় দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া / ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শিসের উপর / একটি শিশিরবিন্দু।
প্রকৃতিকে ভালোবেসে, বৈচিত্র্যের রং মাখিয়ে, আপন মনের মাধুরী মিশায়ে’রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির মাঝেই তাঁর সারস্বত সত্তার সন্ধান করেছিলেন। কখনও কাব্যের ছন্দোময়তায়, কখনও ছোট গল্পের ঝিলিকে, কিংবা কখনও সঙ্গীতের মধুর অনুরণনে।
সুভাষ দত্ত
(লেখক একজন পরিবেশবিদ)