বাংলায় ডিস্কো জ্যাজ? ধুস্ ওসব আবার হয় না কি! যত্ত সব ঢপের কথা।
গানবাজনা নিয়ে বাঙালির এই ধরনের সনাতনী ভাবমূর্তির জন্যই বোধহয় তাঁরা এখনও জানেন না রূপা বিশ্বাসের নাম। বাংলা ভাষায় ‘বুগি’ জঁরের গানবাজনা হতে পারে একথা এখনও ভাবতে শেখেননি বাঙালিরা, ৮০-র দশকের কথা বাদই দিলাম। কিন্তু, সেই সময়ই অভাবনীয় কাণ্ডটি ঘটিয়েছিলেন রূপা। আড়ালে না চলে গেলে ৮০-র দশকে রূপাই হতে পারতেন বাঙালির ‘পপ ক্যুইন’। মনে রাখতে হবে রূপা বিশ্বাসের এই অ্যালবামটি বাংলায় প্রথম ডিস্কো গানের রেকর্ড।
গুগল বা ইউটিউবে ‘রূপা ডিস্কো জ্যাজ’ খুঁজলেই দেখবেন, উজ্জ্বল লালরঙা লংপ্লেয়িং রেকর্ড আর তাতে গালভরা হাসি মুখে লাল ড্রেস পরা রূপা বিশ্বাসকে। রূপার হাঁটু অবধি লাল পোশাকের সেই ছবিটাই পরে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। বাঙালি তাঁকে চিনুক বা না চিনুক, এই যে আজ তাঁকে আন্তর্জাল মাধ্যমে খুঁজলেই পাওয়া যাচ্ছে, শোনা যাচ্ছে তাঁর গানের অ্যালবাম, সবই হয়েছে তাঁর ছেলে দেবায়ন সেনের জন্য। বেশ কয়েক বছর আগে তাঁদের সল্টলেকের বাড়িতে পুরোনো জিনিস সাফাইয়ের কাজ করছিলেন তিনি, তখনই আবিষ্কার করেন মায়ের এহেন ‘গুপ্তধন’। তার আগে দেবায়নও জানতেন না এই অ্যালবামের বিষয়ে। জানতেন না, আর পাঁচজনের মতো ঘরে বসে রেওয়াজ অথবা টুকটাক গজল-আধুনিক গানের চর্চা করা তাঁর মায়ের গানের ঐতিহাসিক পটুভূমির ব্যাপারে। মূলত দেবায়নের উৎসাহেই ১৯৮২ সালে কানাডায় বসে যে ডিস্কো জ্যাজ অ্যালবামটি রেকর্ড ও প্রকাশ করেছিলেন রূপারা, ৩৭ বছর পরে ২০১৯ সালে সারা পৃথিবীজুড়ে তা আবার মুক্তি পায়। ইউরোপে-আমেরিকায় নতুন করে রিলিজ হয় ‘রূপা ডিস্কো জ্যাজ’। দেবায়নের প্রচেষ্টায় জার্মান সংস্থা ‘ওভিউলার’ সবার আগে গান তিনটি ইউ টিউবে রিলিজ করে। পরে আমেরিকার মর্যাদাসম্পন্ন নিউমেরো গ্রুপের সঙ্গেও চুক্তি হয়। এবং ২০১৯-এর মার্চের শেষে নিউমেরো গ্রুপের রিলিজ়ের দু’ঘণ্টায় হাজারটা এলপি ‘সোল্ড আউট’ হয়ে যায়! লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁর গান শোনেন। বিবিসি’র পডকাস্ট আর্কাইভে তাঁর সাক্ষাৎকার আছে। এখন যাবতীয় অনলাইন স্ট্রিমিং ওয়েব-প্ল্যাটফর্মে শোনা যায় তাঁর অ্যালবাম, কেনাও যায়।
নিজের রেকর্ড হাতে রূপা বিশ্বাস
বেশিরভাগ আধুনিক গান গাইলেও, রূপার গলার ভিত তৈরি হয়েছিল মূলত গীত ও গজল ধাঁচের ওপর। ১৯৮১ সালে কানাডায় বেড়াতে গিয়ে ক্যালগেরি-র বরিস রুবেকাইন হলে এই গীত এবং গজল গানেরই একটি অনুষ্ঠানের পর রূপার জীবনে প্রথম রেকর্ড করার সুযোগ আসে। সেটাই বাংলায় প্রথম ডিস্কো গানের রেকর্ড। কিন্তু, বাঙালি তখন পাকিস্তানের নাজ়িয়া হাসানের সাড়া জাগানো ‘ডিস্কো দিওয়ানে’-তে মজে।
দাদা তিলক বিশ্বাস চাকরির জন্য ক্যালগেরিতে থাকতেন। সেখানে কয়েকদিনের জন্য নেহাতই বেড়াতে গিয়ে রূপা হঠাৎ ক্যালগেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাকিস্তানী ছাত্র সংস্থার কাছ থেকে একটা হালকা চালের ক্লাসিকাল গানের অনুষ্ঠান করার আমন্ত্রণ পান। অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে ছিলেন সরোদ মায়েস্ত্রো আলী আকবর খানের সুযোগ্য সন্তান, গ্র্যামি পুরস্কার প্রাপক সরোদিয়া আশিস খান এবং গুণী তবলা বাদক প্রাণেশ খান। আশিস খানের গানের স্কুল রয়েছে ক্যালিগেরিতেই। রূপার গান পছন্দ হয়ে যায় তাঁর।
তবলায় প্রাণেশ খান, গিটারে ডন পোপ এবং সরোদে আশীস খান, তাঁদের মাঝে হারমোনিয়ামে রূপা বিশ্বাস
১৯৮২ সালে পুজোয় মেগাফোন কোম্পানি তিনটি গান নিয়ে একটা লং-প্লেয়িং রেকর্ড বের করে। সুর দেন আশিস খান, কথা তাঁর স্ত্রী আশিসের সরোজের। প্রথম এবং প্রধান গানটি : এই মরসুমে তুমি আর আমি, শুধু দুজনে। এছাড়াও ছিল ‘মজা ভারি মজা’ ও ‘আজ শনিবার, নাচবে চলো আজ’ (loewe Paula’s Ibiza ২০২০ সালে তাদের ফ্যাশন ভিডিও ক্যাম্পেনে গানটি ব্যবহার করে) গান দুটি। সহযোগে ছিল বিভিন্ন প্রাচ্য ও পশ্চিমী বাদ্যযন্ত্রের মিশ্রণ- সরোদ, টাম্বোরিন, তবলা, গিটার সিনথেসাইজার, ঢোল। চমকে দেওয়া ফিউশন, যা আজ সারা বিশ্বে এই প্রজন্ম তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে। এতদিনে যে গানগুলো প্রচারের আলো পেল ৮০-র দশকে নাজিয়ার লোকপ্রিয়তায় তা অন্ধকারে মিলিয়ে গেছিল।
খুব ছোটোবেলা থেকেই গান করেন রূপা। গায়িকা নয় বরং ডাক্তার হওয়ারই ইচ্ছে ছিল। সরিষা রামকৃষ্ণ মিশন সারদা মন্দিরে স্কুলজীবন এবং বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে বায়ো-সায়েন্স নিয়ে বি এস সি পড়তে শুরু করেন। কিন্তু যখন আবিষ্কার করলেন ডাক্তারি নয়, গানই তাঁকে বেশি করে টানছে, ভর্তি হলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুরু করলেন মিউজিকে এম এ।
সিভিল সার্ভিসে বদলির চাকরি ছিল বাবার। ফলে তাঁকেও বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হত ছোটো থেকে। সেজন্য গানে তালিম নিয়েছেন অনেকের কাছেই। প্রথম হাতেখড়ি হয় মেদিনীপুরে প্রহ্লাদ ঋষির কাছে। পরে মুর্শিদাবাদে আলি মির্জার কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতে, বিশেষত গজলে তালিম নিয়েছেন। কলকাতায় আসার পর প্রথমে সুরকার সুধীন দাশগুপ্তের ছাত্রী ছিলেন। তারপর গান শেখেন সুকুমার মিত্র’র কাছে। গজল ছাড়াও আধুনিক, চটকা তাঁর গলায় ভালো খেলতো।
ডিস্কো জ্যাজ অ্যালবামটির গানগুলোর গায়কীতে যে রূপা আহামরি কিছু ছাপ ফেলেছিলেন, তা নয়। গায়কীতে কিছুটা ‘ঢং’ মিশিয়েছিলেন রাতের পানশালার আবেদনকে ধরতে। অনেকের এই গায়কী পছন্দ নাও হতে পারে, পুরোটাই ছিল পরীক্ষামূলক ভাবে গানের একটি জঁরাকে ভারতীয় ভাষায় ধরতে চাওয়ার ইচ্ছে। অ্যালবামটি যখন বেরচ্ছে, সেই সময় এক সংবাদপত্রকে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন “পরবর্তী জীবনে গায়িকাই হতে চাই। চাই সব ধরনের গান গাইতে। ডিস্কো গাইবার পর একটা বিশেষ ধরনের ইমেজ গড়ে ওঠে। আমি এরকম কোনও ইমেজে আবদ্ধ থাকতে চাই না।”
না, পরবর্তী জীবনে সেভাবে গান গাওয়া হয়ে ওঠেনি আর। গুরু সুধীন দাশগুপ্তের প্রয়াণের পর রূপার ডানা মেলার আর একটা সম্ভাবনাও মুখ থুবড়ে পড়ে। আশিস খানের সঙ্গে রেকর্ডিংয়ের সহ-শিল্পী গিটারিস্ট ডন পোপ, জন জনস্টনেরা কলকাতার বাড়িতে এসে থেকে গিয়েছেন। পারভিন সুলতানা থেকে শুরু করে নামী-দামি বহু শিল্পীর সঙ্গেই যোগাযোগ ছিল। কিন্তু, সম্বন্ধ করে বিয়ে, সন্তান, সংসার নিয়ে অন্য পৃথিবীতে ঢুকে পড়েছিলেন যে! রূপা বিশ্বাস হয়ে ওঠেন রূপা বিশ্বাস সেন। সেসব দিনের গান-চর্চার স্মৃতিও চিরদিনের জন্য মুছে যেত যদি না ছেলে দেবায়ন উদ্যোগ নিত। কিছুদিন বাগুইহাটির একটি স্কুলে শিক্ষকতাও করেছিলেন। ফুসফুসের ক্যান্সারে স্বামী উদয়ন সেন চলে গিয়েছেন অনেক আগেই। তবে, ছেলে, আত্মীয় স্বজন আর বন্ধুদের নিয়ে ভালোই আছেন রূপা। ছোট ভাই চন্দন বিশ্বাসের দুই মেয়ে বিলেত-প্রবাসী অ্যানেকা রিমি বিশ্বাস, সানচিয়া রিমা বিশ্বাসরা দেবায়নের সঙ্গে দেখভাল করছেন তাঁর সোশাল মিডিয়া।
ডিস্কো জ্যাজ অ্যালবামের লাল জামা পরা হাসি মুখের মেয়েটিকে এতদিন পর ভালোভাবে দেখার অবসর পেয়েছেন তিনি। রেসে হেরে যাওয়া ঘোড়া হঠাৎ একদিন কীভাবে জিতে গেল, একথা ভেবে কূল পান না প্রবীণা রূপা। জনপ্রিয়তা পেলেন কী না, এ নিয়ে তখনও তাঁর মাথা ব্যাথা ছিল না, এখনও তাইই। এখন বলেন, ‘‘যা পেয়েছি, সেটাও কম কিছু নয়! জীবন আমায় সত্যিই ভরিয়ে রেখেছে।’’