নির্ভয়ার অপরাধীদের ফাঁসি তো হয়েছে, কিন্তু ঝুলে আছে অনেক প্যাঁচ

নির্ভয়া গণধর্ষণ মামলার (Nirbhaya gang rape case) অপরাধীদের অবশেষে ফাঁসি তো হয়েছে, নির্ভয়ার সঙ্গে অত্যচার এবং খুনের মামলায় দোষী মুকেশ সিং (Mukesh Singh), পবন গুপ্তা (Pawan Gupta), বিনয় শর্মা (Vinay Sharma) এবং অক্ষয় ঠাকুরকে (Akshay Thakur) প্রথমবার এই মামলায় ২০১৩ সালে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়েছিল| এরপর এই মামলা বিভিন্ন আদালতে অযৌক্তিকভাবে ঘুরতে থাকে| তবে, এত বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ মামলায় দোষীদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে বিলম্ব হওয়া বিচার ব্যবস্থা এবং আইনজীবীদের প্রতি অনেক প্রশ্ন উত্থাপন করেছে| আদালতে ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বিলম্বের কারণে, এমনকি মৃত্যুদণ্ডের অপেক্ষায় থাকা দোষীদের প্রাণভিক্ষার আবেদনের প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত সময় মতো নেওয়া হয়নি| সুপ্রিম কোর্ট (Supreme Court) ২০১৪ সালে মৃত্যুদণ্ডের অপেক্ষায় থাকা ১৫ জন দোষীকে ফাঁসির সাজার পরিবর্তে যাবজ্জীবন সাজাও দিয়েছিল| মৃত্যুদণ্ডের অপেক্ষায় থাকা বন্দিদের বিষয়ে নজিরবিহীন সিদ্ধান্তে বলা হয়েছিল যে, মৃত্যুদণ্ডের দণ্ডিতদের প্রাণভিক্ষার আবেদন অনির্দিষ্টকালের জন্য বিলম্বিত হতে পারে না| দেরি হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে তাদের সাজা কমানো যেতে পারে| মৃত্যুর থেকেও খারাপ আর কী হতে পারে? সম্ভবত মৃত্যুর অপেক্ষা| বিশেষত অপেক্ষা যখন কয়েক ঘন্টার নয়, বেশ কিছু দিন অথবা মাসের নয়, বরং বছরভরের অপেক্ষা| কিছু মামলার ক্ষেত্রে তো কয়েক দশক ধরেও অপেক্ষা চলতে থাকে| ভারতীয় জেলে বন্দিরা এমনই অপেক্ষায় রয়েছে| কারণ এই ধরনের ভয়ঙ্কর অপরাধীদের নিয়ে কী করা যায়, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়| অথবা সংবিধানে প্রদত্ত ক্ষমার বিধান অনুযায়ী জীবনদান দিয়ে দেওয়া যায়| একটি বিষয় বুঝতে হবে, আসলে সমস্যাটি তাদের ফাঁসিতে ঝোলানো অথবা ক্ষমা করার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়| সমস্যা হল এই দু’টির মধ্যে কোনও কিছু না করে, হাতে হাত ধরে রাখা, এ জন্যই বিলম্ব হয়| যাইহোক, নির্ভয়া কাণ্ড ( Nirbhaya ) এতটাই হৃদয় বিদারক ছিল যে তখন সমগ্র দেশ ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল| নির্ভয়ার অবস্থা দেখে চিকিত্সক এবং মেডিক্যাল টিমও স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল| ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর দক্ষিণ দিল্লির (Delhi) মুনিরকা অবস্থিত একটি বাস স্টপের কাছে নির্ভয়ার সঙ্গে পাশবিক অত্যাচার চালানো হয়েছিল| এই মামলায় বাস চালক-সহ ৬ জনকে গ্রেফতার করেছিল দিল্লি পুলিশ| তাদের মধ্যে একজন নাবালকও ছিল| তাকে তিন বছর ধরে সংশোধনাগারে রাখার পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল| জেলেই আত্মহত্যা করেছিল রাম সিং (Ram Singh) নামে একজন অভিযুক্ত| 


ফাঁসি সাজার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা কি উচিত
ফাঁসি সাজা কি ভারতের মতো দেশে জরুরি? নির্ভয়া ধর্ষণকান্ডের (Nirbhaya rape case) পর এই প্রশ্নটাই দেশের বিভিন্ন মহল থেকে উঠেছে। কয়েক বছর আগে অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একটা সূচী তৈরি করেছিল। যে সকল দেশে ফাঁসি সাজা প্রযোজ্য রয়েছে সে সকল দেশের তালিকার তার মধ্যে ছিল। সেখানে ভারতের (India) নামও ছিল। এই তালিকার শীর্ষ ছিল চিন (China)। সব থেকে বেশি মৃত্যুদণ্ড চিনে (China) দেওয়া হয়। অ্যামেনেস্টির রিপোর্ট অনুযায়ী চিনে প্রতিবছর কয়েক হাজার অপরাধীদের ফাঁসির দণ্ডিত করা হয়। ফাঁসির সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যান্য যে দেশগুলি এগিয়ে রয়েছে তারা হল ইরান (Iran), সৌদি আরব (Saudi Arabia), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (United States), পাকিস্তান (Pakistan) এবং বাংলাদেশ (Bangladesh)। অনেকে বলে থাকেন অপরাধ দমনে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার নীতি ভ্রান্ত। কারণ মৃত্যুদণ্ড দিয়ে অপরাধ কম হয়েছে এমন কোনও প্রমাণ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। নির্ভয়া কাণ্ড থেকে এর কিছুটা প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। কারণ সে জঘন্য ধর্ষণকাণ্ডের পরও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ধর্ষণ সংগঠিত হয়েছে। হয়তো ফাঁসির সিদ্ধান্ত দেরি নেওয়ার কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। স্বাধীন ভারতে সব থেকে বেশি ফাঁসির সাজা দেওয়া হয়েছে উত্তরপ্রদেশে। এর পরে রয়েছে হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশের স্থান। নাথুরাম গোডসে এবং নারায়ণ আপ্তে স্বাধীন ভারতের প্রথম অপরাধী যাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। ১৯৪৯ সালের ১৫ নভেম্বর আম্বালার সেন্ট্রাল জেলে ফাঁসিকাঠে লটকে দেওয়া হয়েছিল। এদের বিরুদ্ধে জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা এবং হত্যা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগ ছিল। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি গান্ধীজিকে দিল্লিতে হত্যা করা হয়েছিল। আর গোডসে এবং আপ্তেকে আম্বালায় নিয়ে গিয়ে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।  অনেক বার আদালতের সিদ্ধান্তকে পাত্তা দেওয়া হয়নি। ১৯৯৩ সালে দিল্লিতে বোমা বিস্ফোরণ কাণ্ডে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই কাণ্ডে আদালত দেবেন্দ্র সিং ভুল্লরকে দোষীকে সাব্যস্ত করেছিল। পরে কয়েক বছর ধরে নগরদায়রা আদালত, হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট সকলেই তাকে ফাঁসির সাজা শুনিয়েছে। তার দায়ের করা ক্ষমা প্রার্থনার আর্জি আদালত ২০১১ সালের মে মাসে খারিজ করে দিয়েছে। কিন্তু এরপরেই মামলা শেষ হয়ে যায়নি। ওই বছর সেপ্টেম্বরে সুপ্রিমকোর্টের কাছে দেবেন্দ্র সিং ভুল্লর আইনজীবী সাজা কমানোর আপিল করেন। দেশের শীর্ষ আদালত সেই আর্জি মেনেও নেয়। যেখানে তাকে বেঁচে থাকার অধিকার দেওয়া হয়।  বর্তমানে এখন কেউ জানে না ভুল্লরের ভবিষ্যৎ কি হবে। ফাঁসির অপরাধীদের দীর্ঘ সময় জেলে রেখে দিলে তার মানে হল দুইবার করে সাজা দেওয়া হচ্ছে। যা ভারতীয় সংবিধানের ২১ নম্বর অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। 


কার সিদ্ধান্ত অন্তিমফাঁসি দেওয়া এবং না দেওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তও চূড়ান্ত বলে মানা যায় না। খ্যাতনামা আইনজীবী মজিদ মেনন (Majid Menon) বলেছিলেন, মন্ত্রিসভার গড়িমসির জন্য ক্ষমাপ্রার্থনার আর্জিগুলির ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়। রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া পরামর্শ দ্রুততার সঙ্গে দিলে এই ক্ষেত্রে গোটা পদ্ধতিটাই তাড়াতাড়ি তরান্বিত হতে পারে। ক্ষমাপ্রার্থনার আর্জিগুলির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি একা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। সংবিধানের ৭৪ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার পরামর্শ মেনেই তাঁকে চলতে হয়। পরামর্শ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেন তিনি। উল্লেখ করা যেতে পারে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যেখানে মন্ত্রিসভার পরামর্শ সত্বেও রাষ্ট্রপতি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সময় নিয়ে নিয়েছেন। নব্বইয়ের দশকে দেখা গিয়েছে ক্ষমাপ্রার্থনার ক্ষেত্রে মন্ত্রিসভার পরামর্শ মেনে সিদ্ধান্ত নিতে অনেকটা সময় নিয়ে নিতেন রাষ্ট্রপতি। ১৯৮০ সালে দুই থেকে তিন বছরের মধ্যেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো। ১৯৯০ সালে সুপ্রিম কোর্টের (Supreme Court) তরফ থেকে বলা হয়েছিল দুই বছরের মধ্যে রাষ্ট্রপতিকে সিদ্ধান্তগ্রহণের জন্য বাধ্য করা উচিত হবে না। স্বর্গে নির্ভয়া এখন শান্তিতে ঘুমচ্ছেন। কিন্তু ফাঁসি নিয়ে এখনও অনেক প্যাচ রয়ে গিয়েছে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.