ভিটামিন ও খনিজ উপাদানে সমৃদ্ধ হবে, রক্তাল্পতা ঠেকাতে চালের পুষ্টিগুণ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত মোদী সরকারের

ভিটামিনে ভরপুর হবে চাল। থাকবে প্রয়োজন মতো খনিজ উপাদানও। সাধারণ চালের থেকে পুষ্টিগুণ বাড়বে অনেক বেশি। অপুষ্টি ও রক্তাল্পতায় ভোগা দেশের অধিকাংশ মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যের উন্নতির কথা মাথায় রেখেই চালের গুণমান বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বাধ্যতামূলকভাবে আগামী তিন বছরের জন্য চালের পুষ্টিগুণ বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলবে দেশে।

কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের অধীনস্থ ‘ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি অব ইন্ডিয়া’ (এফএসএসএআই) ইতিমধ্যেই এই প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। এর জন্য বছরে খরচ হবে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা।

চালের পুষ্টিগুণ বাড়ানোর পদ্ধতিকে বলা হয় রাইস ফর্টিফিকেশন। সেটা কী? এমন এক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি যার মাধ্যমে চাল বা দানাশস্যের পুষ্টি উপাদান বাড়ানো হয়। এই পুষ্টি উপাদান হল ‘এসেনসিয়াল মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস।’ যার মধ্যে পড়ে ভিটামিন ও বিভিন্ন রকম খনিজ বা মিনারেলস। ভিটামিন শরীরে শক্তি জোগায়, রোগ প্রতিরোধ করে, রক্ত সঞ্চালন সঠিক রাখে, রক্ত জমাট বাঁধতে বাধা দেয়, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করে। আর খনিজ উপাদানের কাজ হল বৃদ্ধি, হাড়ের পুষ্টি, বলি ফ্লুইডের ভারসাম্য রক্ষা করা। তাছাড়া ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে তোলার কাজও করে বিভিন্ন খনিজ উপাদান। সহজ কথায় বলতে গেলে, শরীরের বৃদ্ধি ও পুষ্টির জন্য ভিটামিন ও খনিজ উপাদান অপরিহার্য। খাবারে যদি এই দুই উপাদানের পরিমাণ বাড়ানো যায়, তাহলে অপুষ্টি, রক্তাল্পতার মতো ব্যধি দূর করা সম্ভব।

চালের পুষ্টিগুণ বাড়ানোর জন্য কী কী উপাদান যোগ করা হচ্ছে? ভারতের মতো দেশে জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশই ভাতের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে বেশিরভাগেরই দু’বেলা পেট ভরা খাবার মেলে না। সবজি বা অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার সেখানে বিলাসিতা। তাই চালের গুণমান বাড়ালে একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সেখান থেকেই পাওয়া যাবে। কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনামাফিক, চালে আয়রন বা লোহা, ফোলিক অ্যাসিড এবং ভিটামিন বি-১২ এর পরিমাণ বাড়ানোর কাজ শুরু করেছে এফএসএসএআই।

ফর্টিফায়েড রাইস বা পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ চালের দাম বাড়বে প্রতি কেজিতে ৬০-৭০ পয়সা। এই হিসেবে প্রতি বছরে আড়াই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করছে কেন্দ্রীয় সরকার। মিড-ডে মিলে এই চাল দিয়ে রান্না করা ভাতই খাওয়ানো হবে শিশুদের।

রক্তাল্পতা দূর করাই লক্ষ্য

রক্তে লোহিত কণিকার (Red Blood Cells)পরিমাণ যদি কমতে থাকে তাহলে তাকে অ্যানিমিয়া বা রক্তল্পতা বলে। রক্তাল্পতা মানে রক্তের পরিমাণ কমে যাওয়া নয়, বরং লোহিত রক্তকণিকার মধ্যে যে প্রোটিন থাকে যাকে আমরা বলি হিমোগ্লোবিন, সেই প্রোটিনের পরিমাণ স্বাভাবিক মাত্রার থেকে কমে যাওয়া। এই হিমোগ্লোবিন প্রোটিনের মধ্যে থাকে আয়রন এবং ট্রান্সপোর্ট অক্সিজেন। হিমোগ্লোবিন কমে গেলে শরীরে আয়রনের অভাব হয়, যার কারণে নানা রোগ বাসা বাঁধে। সাধারণত পুরুষ ও নারীর শরীরে এই হিমোগ্লোবিনের একটা স্বাভাবিক মাত্রা আছে, পুরুষদের ক্ষেত্রে ১৩.৮ থেকে ১৭.২ গ্রাম/ ডেসিলিটার, আর মহিলাদের ১২.১ থেকে ১৫.১ গ্রাম/ ডেসিলিটার। হিমোগ্লোবিনের মাত্রা যদি এই পরিমাণের থেকে কমে যায় তাহলেই রক্তল্পতা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়।

গর্ভবতী মহিলারা রক্তাল্পতায় বেশি ভোগেন। গর্ভস্থ ভ্রূণের বিকাশের জন্য বেশি মাত্রায় আয়রন প্রয়োজন। তাই এই সময় শরীরে আয়রনের স্বাভাবিক মাত্রা কমে গেলে ভ্রূণের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। সময়ের আগেই প্রসব, গর্ভপাত বা গর্ভের মধ্যে ভ্রূণের মৃত্যু অবধি ঘটতে পারে। আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল অনেক মা এবং তাঁদের পরিবার পরিজনেরা রক্তাল্পতার ভয়াবহতা সম্পর্কে উদাসীন। প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে অশিক্ষা, ভ্রান্ত ধারণা, কুসংস্কারও রয়েছে এর পিছনে। আগে গর্ভাবস্থায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে রাজি হতেন না মহিলারা, আয়রন ট্যাবলেট খাওয়াতেও অনীহা ছিল। তাই প্রসবকালীন সময় অনেক মায়েরই মৃত্যু হত। অপুষ্টিও একটা বড় কারণ। সমীক্ষা বলছে ভারতেই ৮০ শতাংশ গর্ভবতী মহিলা, ৫২ শতাংশ মহিলা (যাঁরা গর্ভবতী নন), ৭৪ শতাংশ শিশু (বয়স ৬-৩৫ মাস) রক্তাল্পতায় ভোগে। বয়স পাঁচ বছরের নীচে এমন ৫২ শতাংশেরও বেশি বাচ্চা ভোগে জিঙ্কের ঘাটতিতে। ২০০৫-০৬ সালে দেশের ৫ বছরের কমবয়সী শিশুর ৭০ শতাংশ ছিল অপুষ্টিজনিত রোগের শিকার। ২০১৫-১৬ সালে দেশের ১৭টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে এই হার ৩৮-৭৮ শতাংশের মধ্যে। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষাও বলছে, দেশে পাঁচ বছরের নীচে থাকা প্রায় ৫৮ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় সাড়ে সাত কোটি শিশু রক্তাল্পতায় ভোগে। বয়সের তুলনায় ওজন কম সাড়ে চার কোটি শিশুর। যার মূল কারণ অপুষ্টি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.