এলগিন রোডের বাড়ি থেকে অন্তর্ধানের পর আফগানিস্তান, জার্মানি হয়ে সব শেষে জাপানে গিয়ে একের পর এক চমক সৃষ্টি করে বিশ্বকে যিনি তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু।
ঋষি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর স্নেহের সুভাষকে দেশনায়ক পদে অভিষিক্ত করে বলেছিলেন- ‘দুঃখকে তুমি করে তুলেছ সুযোগ, বিদ্যুকে করেছ সোপান। সে সম্ভব হয়েছে। যেহেতু কোনও পরাভবকেতুমি একান্ত সত্য বলে মাননি। তারপর তিনি আহ্বান করেছিলেন তাঁর পাশে সমস্ত দেশবাসীকে দাঁড়াতে। সে অবকাশ ভারতবাসী না পেলেও দেশান্তরী নেতাজী সুভাষের পাশে দাঁড়িয়েছিল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রবাসী লক্ষ লক্ষ ভারতবাসী। সেদিন পাশে থেকে সমর্থন জানিয়েছিল বিশ্বের এগারটি স্বাধীন দেশ।
বিশ্বের এগারোটি রাষ্ট্রপ্রধানের স্বীকৃতি নিয়ে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনে প্রবাসে গড়ে উঠল আজাদ হিন্দ সরকার। ১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর হাজার হাজার জনতার সামনে ঈশ্বরের নামে শপথ নেন যে, তিনি চিরকাল ভারতের সেবক হয়ে আটত্রিশ কোটি ভাই-বোনের কল্যাণ সাধনে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। সংগ্রাম করবেন। সেদিন সিঙ্গাপুরের স্থানীয় সময় ছিল বেলা সাড়ে ১০টা। তার দেড়ঘণ্টার প্রাণস্পর্শী বক্তৃতায় পূর্ব এশিয়ার ভারতীয়দের ঘুম ভাঙিয়েছিলেন তিনি।
নেতাজী আজাদ হিন্দ ফৌজ নিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যখন একের পর এক সাফল্য অর্জন করে চলেছেন, তখন নেতাজীর বিরদ্ধে তৎকালীন কমিউনিস্টরা যে ন্যক্কারজনক আচরণ করেছে। তা অকল্পনীয়। বিশেষ করে সিপিআই-এর মুখপত্র “পিপলস ওয়ার’-এ লেখা হয়েছিল— ‘বিশ্বাসঘাতক বোস কোনওদিন বাংলার সোনার মাটি স্পর্শ করতে পারবে না।…আগস্টের ৯ তারিখ উদ্যাপন করার অর্থই হলো পঞ্চমবাহিনীকে উৎসাহ দেওয়া। সিপি যোশী লিখেছিলেন—‘ভারতের স্বাধীনতার এক নম্বর বিশ্বাসঘাতক। তিনি তোজোর আশীর্বাদ নিয়ে ভারতকে আক্রমণ করে স্বাধীনতা চান। আরও আছে—‘বোস এখন আপনি ফ্যাসিস্তদের ছুটন্ত কুকুর (running dog), তিনি ফ্রান্সের পার্টেন, নর ওয়ের কুইসলিং, চীনের ওয়াং চিয়াংওয়েই-এর মতো বিশ্বাসঘাতক। কোনও ফ্রন্টেই বিশ্বাসঘাতকরা থেমে থাকেনি। এছাড়া পিপলস ওয়ারের বহু সংখায় নেতাজী সম্পর্কে কুৎসিত কার্টুন আঁকা হয়েছে।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে কংগ্রেস কোনও ধারাকেই স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু আজাদ হিন্দ ফৌজের সংগ্রামের বিষয়ে বিস্তারিত জানার পর নেতাজী সম্বন্ধে গান্ধীজী বলেন, “সুভাষ ইতিহাস পুরুষ, তার কথা ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে।” “His unique achievements would Surely immortalize him in the page of History.” তিনি আরও বলেন, “The Hyprotism of the INA has cast its spell upon us.” ত্রিপুরি কংগ্রেসের পর সুভাষের এক পত্রের উত্তরে গান্ধীজী লেখেন— “তুমি সুস্থ থাকো আর অসুস্থই থাকো, তুমি অপ্রতিরোধ্য”।
নেতাজী যখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আজাদ হিন্দ ফৌজের জন্য অর্থ সাহায্য চেয়েছেন, তখন প্রবাসী বাঙ্গালিরা কোটি কোটি টাকা, মেয়েরা গায়ের অলঙ্কার খুলে দিয়েছিলেন। সেগুলি রাখা ছিল ১৮টি বড়ো বড়ো ট্রাঙ্কে। শোনা যায়, তাঁর তথাকথিত মৃত্যুর ঘটনা সাজিয়ে পরে সেই বিপুল অর্থ নাকি ভাগাভাগি হয় ব্রিটিশ সরকার ও নেহরুর মধ্যে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান আত্মসমর্পণ করলে নেতাজী বিমান দুর্ঘটনার কথা জাপানের এক সংবাদমাধ্যমকে দিয়ে ঘোষণা করিয়ে। আত্মগোপন করেন। তখন থেকেই চলছে রহস্য।
প্রখ্যাত নেতাজী গবেষিকা পূরবী রায় বলেছেন, “বিভিন্ন সময়ের ক্ষমতাসীন সরকার নেজাতীর অন্তর্ধান নিয়ে গত ছয় দশক ধরে প্রহেলিকা করে চলেছে। বিশেষত নেহরুর উত্তরাধিকারীরা এবং তাদের পোষ্যপুত্ররা নেতাজীর বিষয়ে কোনও তথ্য প্রকাশ করতে চান না। কারণ তাহলে তাঁদের স্থান হবে আস্তাকুড়ে।
২০০৩ সালেমুখার্জি কমিশনকে তাইওয়ান সরকার সরাসরি জানিয়েছে, বিমানবন্দরের রেকর্ড অনুযায়ী তাইহোকুতে ওই দিন কোনও বিমান দুর্ঘটনাই হয়নি। ফলে সেখানে নেতাজীর মৃত্যুর প্রশ্নই নেই।
২৭ ডিসেম্বর, ১৯৪৫ সালে এটলিকে লেখা চিঠিতে নেতাজী সম্পর্কে জওহরলাল নেহরু লিখেছেন— “আপনাদের যুদ্ধাপরাধী। এই ভাষাতেই বোঝা যায়, মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী সুভাষ বসু সম্পর্কে পণ্ডিত নেহরু কী মনোভাব পোষণ করতেন। এই শব্দ একজন। স্বাধীনতা সংগ্রামীর কাছে অপমানজনক। হিন্দি পাঞ্চজন্য পত্রিকায় অভিযোগ করা হয়—১৯৬৭ সালে জাপান সরকার নেতাজী অন্তর্ধান নিয়ে যৌথ তদন্তের প্রস্তাব দিলেও তা খারিজ করে দিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। নিবন্ধে বলা হয়েছে, নেতাজী আই এন এ সরকারের প্রধান ছিলেন। তিনি প্রচুর তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন। নেহরু কেন সিঙ্গাপুরে গিয়ে ব্যাঙ্ক আধিকারিকদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, তার তদন্ত হওয়া দরকার। পাঞ্চজন্যের প্রশ্ন, নেহরু কি আই এন এ-র তহবিল আত্মসাতের উদ্দেশ্যেই সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন?
১৯৪৬ সালে ভারতীয় আইন সভার নির্বাচনে জনগণের সমর্থন পেতে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ উভয়েই আজাদ হিন্দ ফৌজের বন্দিদের মুক্তির চাবিতে বক্তৃতার তুফান তুলেছিলেন। নেহরু নিজে কালো গাউন পরে ‘লালকেল্লা বিচার’ পর্বের বিচার সভায় হাজির হয়েছিলেন। অথচ, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি সে কথা বলতে পেরেছিলেন অর্থাৎ আজাদ হিন্দ সরকার, আজাদ হিন্দ ফৌজ এবং যুদ্ধবন্দি আজাদ হিন্দ বাহিনীর ‘লালকেল্লা বিচার’কে কেন্দ্র করে সারা দেশের ব্রিটিশ ভারতীয় ফৌজ, রাজকীয় নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে যে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর ছাড়া বিকল্প ছিল না। পণ্ডিত নেহরু তা বলতে পারেননি।
‘ক্ষমতা হস্তান্তর’সম্পর্কিত দলিলের ৬নং ভমে সে কথা নির্দ্বিধায় বলা আছে তার সার সত্য হলো, আজাদ হিন্দ ফৌজের সংগ্রামের ফলেই তারা ঔপনিবেশিক শাসনের হাত থেকে ভারতকে মুক্ত করতে বাধ্য হয়েছে।
এই কথার আরও প্রমাণ পাওয়া যায়— ১৯৫৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের অস্থায়ী রাজ্যপাল কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ফণীভষণ চক্রবর্তীকে ব্রিটিশ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি বলেছিলেন, একমাত্র নেতাজীর জন্য তারা ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। এটলিকে তখন প্রশ্ন করা হয়। এক্ষেত্রে গান্ধীজীর ভূমিকাকে আপনি কী মনে করেন? এর উত্তরে এটলি অবজ্ঞার সুরে বলেছিলেন— M-I-N-I-M-A-L.
নেতাজীর রাজনৈতিক উচ্চতা অনেক বেশি ছিল। তার সঙ্গে ছিল নৈতিক উচ্চতাও। এ প্রসঙ্গে জানা যায়— নেতাজী যখন আজাদহিন্দ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক, সেই সময় তিনি অতিরিক্ত পরিশ্রমে খুব দুর্বল হয়ে পড়েন। ডাক্তাররা তাকে বলেন, আপনি রোজ একটা করে ডিম খাবেন। নেতাজীর উত্তর, যেদিন আমার আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রত্যেক সৈনিককে ডিম খাওয়াতে পারব, সেদিন খাব। পক্ষান্তরে রাজভবনে নেহরু কীরকম খাবার খেতেন তারও বিবরণ খবরের কাগজ থেকে জানা যায়। নেহরু খেতেন—‘মুরগির দুটো ডিম সিদ্ধ আর মাখন ও মধু মাখানো দুটি রুটি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারতেন। এরপরই ধোঁয়া ওঠা কফি চাই। গরম একটু কম হলেই ছুঁড়ে ফেলে দিতেন। লাঞ্চ টাইমে তিনি প্রথমে খেতেন এক প্লেট স্যুপ। তারপর দু-চারখানা মাছের ফ্রাই। ভেটকি মাছের টুকরো লেবুর রস ও ডিমে ভিজিয়ে সামান্য নুন দিয়ে ভেজে দেওয়া হতো। এরপর চিকেন রয়্যাল। এই চিকেন রয়্যাল বানাতে তখনকার দিনে লাগত দুটি বড়ো মুরগি। একটি দিয়ে হতো কিমা। তারপর মাখন ও যাবতীয় মশালাপাতি দিয়ে ভাজা হতো। ভাজা ঠিক হয়েছে কিনা বুঝতে জলে ফেলে দেখা হতো, ভাসছে কিনা। ওই ভাজা কিমা মশলা সহযোগে আর একটি বড়ো মুরগির নাড়িভুড়ি বের করে ঢুকিয়ে সেলাই করে দেওয়া হতো। যখন আস্ত মুরগিটির লোমকুপ দিয়ে মাখন গড়িয়ে পড়ত, তখন সেটিকে নেহরুজীর প্লেটে পরিবেশন করা হতো। রাতেও ছিল নাকি একই মেনু। ডিনার শেষে রাতে যখন কাজ করতেন, তখন বিভিন্ন ধরনের ফলের রসে একটু একটু করে সিপ দিতেন।
অনেকেই মনে করতেন, নেতাজী ফিরে এলে নেহরুর গদি নিয়ে টানাটানি পড়ে যেত। ২০১৩ সালের প্রথমের দিকে মস্কোর রামকৃষ্ণ মিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত মহারাজ স্বামী। জ্যোতিরূপানন্দ (রথীন মহারাজ) বলেছিলেন, নেতাজীকে শেষবারের মত দেখা গিয়েছিল সাইবেরিয়ার কারাগারে। রথীন মহারাজের এই মন্তব্যে খুবই বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু কখনই নিজের মত বদলাননি। তিনি আরও বলেছিলেন, মস্কোতে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রদূত, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর বোন বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতও সাইবেরিয়ার ও মস্কো শহরের কারাগারে নেতাজীকে দেখতে গিয়েছিলেন। মুখোমুখি দেখা করার অনুমতি তিনি পাননি। তবে একটি ছোটো জানালা দিয়ে দূর থেকে তিনি সুভাষকে দেখেছিলেন। রথীনবাবু শুনেছেন, তখন উদ্ভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছিল নেতাজীকে। তিনি বলেন, ২১ বছর ধরে মস্কোয় থাকাকালীন তিনি এসব তথ্য জেনেছেন।
কংগ্রেস এবং তাদের দরবারি ইতিহাসবিদরা নেতাজীর অবদান অস্বীকার করলেও ইংরেজ ঐতিহাসিকরা নেতাজীকে সবচেয়ে বেশি স্বীকৃতি দিয়েছেন। তার সংগ্রামের ফলেই ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে চলে গিয়েছে। মাইকেল এডোয়ার্ডস সেই কথাটাই একটি মাত্র বাক্যে তুলে ধরেছেন— The Ghost of Subhash Bose, like Hamlet’s father walked the battlements of Redfort and his Suddenly amplied figure over awed the conferences that were to lead to Independence.’ মাইকেল এডোয়ার্ডস পরিষ্কার করে বলেছেন, ভারতবাসী নেতাজীর কাছেই সবচেয়ে বেশি ঋণী।
নেতাজীর মতো নেতা ভারতবর্ষে তৈরি হয়নি। তিনি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। কিন্তু সেই নেতার অন্তর্ধান রহস্য আজও উন্মোচন হলো না। তার নেতৃত্বেই ১৯৪৭ সালের আগে জাপানের মাটিতে অখণ্ড ভারতের প্রথম স্বাধীন সরকার গঠন হয়। আর তিনিই ছিলেন সেই স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। ইতিহাসের পাতায় তাকে এই স্বীকৃতি দিতে হবে।
মণীন্দ্রনাথ সাহা