বিষয়: প্রকৃতি – একটি আলোচনা #SSUB

“নমস্তে সদা বৎসলে মাতৃভূমে”— সদা বৎসল মাতৃভূমিকে প্রণাম করি। সমগ্র হিন্দু জাতি এই হিন্দুস্তানকে মাতৃজ্ঞানে পুজো করে। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র ভারত মাতাকে ‘দশ প্রহরণধারিনী দুর্গা’-র সঙ্গে তুলনা করেছেন। মা যেমন নিজের স্তন‍্যদুগ্ধ পান করিয়ে তার সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখে, তেমনি এই হিন্দুভূমি তাঁর অগণিত সন্তানকে আপন প্রকৃতির ভান্ডার উজাড় করে দিয়েছে, যাতে তারা সুখবর্ধিত হতে পারে। এখানেই আসে প্রকৃতির কথা। সন্তানের সঙ্গে মায়ের যে বাৎসল্য-প্রেম, তেমনি প্রকৃতির সঙ্গে তার সন্তানরূপী মানব সমাজ বাৎসল্য-প্রেমে আবদ্ধ।

হিন্দু জাতি সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকেই প্রকৃতির পূজারী। তারা জল (গঙ্গা মাতা, বরুণ দেবতা), বায়ু (পবন দেবতা), মাটি (ভূমি পূজা), পাহাড়, পর্বত, শিলা (নারায়ণ বা শিব), সর্বোপরি গাছপালাকে (তুলসী, দূর্বা, বট, কলাগাছ ইত্যাদি) দেব/দেবী রূপে পূজা করে। শুধু তাই নয়, প্রকৃতির এক বিরাট অংশ যেমন পশু,পাখী, কীট, পতঙ্গ, জলচর, স্থলচর সমস্ত কিছুর মধ্যেই ইশ্বরের অবস্থান স্বীকার করে। অর্থাৎ “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”। তাই তারা সাপ (দেবী মনসা), বাঘ (দক্ষিণ রায়), সিংহ, ময়ূর, ইঁদুর, মহিষ, শকুন, পেঁচা (প্যাঁচাই লক্ষ্মী) এবং সর্বোপরি গরু (গো-মাতা) তারা পূজা করে।

প্রকৃতির সর্বশ্রেষ্ঠ উপাদান হলো গাছপালা, বনজঙ্গল, এক কথায় উদ্ভিদ জগৎ। উদ্ভিদ জগৎ না থাকলে মানব জাতির পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব হতো না। কেন? এবার তা দেখা যাক। আমরা সবাই জানি যে, সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদ প্রকৃতি থেকে কার্বনডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে খাদ্য তৈরি করে। সুক্রোজ (আখ), ফুক্টোজ (ফল), স্টার্চ (আলু, চাল, গম), তরিতরকারি ইত্যাদি যা খেয়ে আমরা বেঁচে থাকি। প্রাণী জগৎ কিন্তু খাদ্য তৈরি করতে পারে না। উদ্ভিদ বিষাক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ‍্যাস গ্রহণ করে বায়ু মণ্ডলকে নির্মল করে এবং অক্সিজেন ত‍্যাগ করে বায়ু মণ্ডলকে সমৃদ্ধ করে। উদ্ভিদ-ই বায়ু মন্ডলে অক্সিজেন গ‍্যাসের একমাত্র উৎস। তৃতীয়ত, রোগব্যাধি থেকে বাঁচার জন্য আমরা যে ঔষধ খাই তার সিংহভাগই উদ্ভিদ থেকে তৈরি হয়। উপরন্তু বনাঞ্চলের কারণে বৃষ্টিপাত ঘটায় ফলে জলবায়ু মনুষ‍্য বসবাসের উপযোগী থাকে। বৃষ্টিপাতের ফলে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয়। এছাড়া গাছপালা ভূমিক্ষয় ও নদীভাঙ্গন রোধ করে; ঝড়ের প্রাবল্য আটকায়।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই, মানব জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু উদ্ভিদ জগৎকে আজ নির্মমহস্তে ধ্বংস করা হচ্ছে। এর পিছনে কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায় যে, পাশ্চাত্যের ভোগবাদী মানসিকতার ব‍্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটেছে এশিয়া তথা ভারতীয় উপমহাদেশে। লোভের বশে উন্মত্ত হয়ে নির্বিচারে বনভূমির নিধন যজ্ঞ চলছে আজ।

আমরা সবাই জানি যে সারা পৃথিবীতে যে লোক সংখ্যা তার অর্ধেক বাস করে এশিয়াতে। আবার সারা পৃথিবীতে যত বনাঞ্চল আছে তার তিন চতুর্থাংশ রয়েছে হাতে গোনা কয়েকটি দেশের অধীনে। যেমন রাশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চল, ব্রাজিলের আমাজন অববাহিকা, আফ্রিকা, কানাডা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশে। অতি সম্প্রতি আমাজন অববাহিকার অগ্নিকাণ্ড মানুষের দুর্দম লোভের-ই পরিণতি। উন্নত যন্ত্রপাতির সাহায্যে অতিদ্রুত অল্প সময়ে গাছ কেটে বনাঞ্চল সাফ করতে পারে এমন কোম্পানি গুলোকে বলাহয় “লগিং” কোম্পানি। বনাঞ্চল ধ্বংস করার ইজারা পেতে মরিয়া “লগিং” কোম্পানিগুলির মধ্যে রেষারেষির পরিণাম হলো অগ্নিসংযোগ। যার ফলে শুধু যে গাছপালা, বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে তাই নয়, ধ্বংস হচ্ছে অসংখ্য প্রজাতির বন্যপ্রাণী সহ কোটি কোটি বনবাসী মানুষ।

জানলে অবাক হবেন যে, গত ৫০ বছরে বিশ্বের ৫০ শতাংশের বেশি বনাঞ্চল মানুষের দ্বারা ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছে। পৃথিবীর প্রায় ৭৬ টি দেশের বনাঞ্চল সম্পূর্ণ ভাবে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। ভারত সহ ১১টি দেশের বনাঞ্চল নিঃশেষিত হবার মুখে। এশিয়ার মানুষও যে প্রকৃতিকে লুন্ঠন করতে শুরু করেছে এটা তারই জলজ‍্যান্ত প্রমাণ। কিন্তু লাখ টাকার প্রশ্ন হলো এই যে, ভোগবাদের দৌড়ে এশিয়া কি কোনো দিন পাশ্চাত্যকে ধরতে পারবে? একটি তথ্যই এ প্রশ্নের সঠিক জবাব পেতে সাহায্য করবে, আর তা হলো, সারা পৃথিবীর মাত্র ৪ শতাংশ লোক আমেরিকায় বাস করে কিন্তু আমেরিকা ভোগ করে সমগ্র পৃথিবীর সম্পদের প্রায় ২৫ শতাংশ। হায় রে লোভ! হায়রে ভোগবাদ! শোষণ ও বঞ্চনার উপর ভিত্তি করে কিছু সংখ্যক মানুষের সুখ সমৃদ্ধির ব‍্যবস্থা করা যায়, কিন্তু সমগ্র মানব সমাজের জন্য চিরস্থায়ী মঙ্গল সাধন করা পাশ্চাত্যের উন্মত্ত ভোগবাদের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। তাহলে উপায়?

বস্তুবাদী ভাবধারা এ ব‍্যাপারে সম্পূর্ণ ব‍্যর্থ; সারা পৃথিবী থেকে তাদের নির্বাসনই এর সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ। তাছাড়া বস্তুবাদী দিগগজরা যে সম্পদের সমবন্টনের কথা বলেন, আসলে তা এক চরম মিথ্যাচার। গরীব খেটেখাওয়া মানুষ গুলোকে রুটির লোভ দেখিয়ে তারা জড়ো করে, আর তাদের রক্ত শোষণ করে বস্তুবাদের মহান নেতারা সম্পদের পর্বত চূড়ায় অবস্থান

ক’রে ভোগবিলাসের আড়ম্বরপূর্ণ-জীবন যাপন করে। এই বাস্তব ব‍্যাপারটা কাউকে আর বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। সবাই তা স্বচক্ষে অবলোকন করছে। আর তাই দ্বি-চারী এই দিগগজদের পৃথিবীর মানুষ আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছে। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন পনেরো-ষোল টুকরো হয়েছে। নাটের গুরু মিখাইল গর্বাচেভ পালিয়ে আমেরিকাবাসী হয়েছে। চীন ওয়ার্ল্ড-লিডার হবার লালসায় কোরোনা ভাইরাস উৎপন্ন করে সমগ্র মানব জাতিকে মৃত‍্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে করোনা সংক্রান্ত চিকিৎসা-সরঞ্জাম বিক্রি করে মুনাফা লুটছে বলে বিশ্ব-বিশ্বাস। হায়রে বস্তুবাদ!

তাহলে কি মুক্তির পথ নেই? অবশ্যই আছে, আর তা হলো হিন্দু জাতির জীবনচর্যা ও মানসচর্চা; হিন্দু-সংস্কৃতি অর্থাৎ হিন্দুত্ব বাদ। একমাত্র হিন্দু-সংস্কৃতিতে বলে প্রকৃতি সকলেরই জন্মদাত্রী মা। তাই প্রকৃতিকে পুজো করতে হবে, পীড়ন বা আঘাত করা যাবে না, ‘দেবতার এই কাব্য’-কে ধ্বংস করা যাবে না। একমাত্র হিন্দুই মাভৈঃ রবে জগদ্বিতায়ঃ মন্ত্র উচ্চারণ করে; বিশ্বের সমগ্র মানব সমাজের হিত কামনা করে। এ জগতে একমাত্র হিন্দুই বলে প্রকৃতিকে দোহন করো, শোষণ কোরো না। অর্থাৎ প্রকৃতি মায়ের ক্ষতি না করে নিজের প্রয়োজনানুযায়ী জন্য সামান্য গ্রহণ করো। যেমন দুগ্ধবতী গাভীকে আমরা দোহন করি। কিন্তু শোষণ হচ্ছে অস্তিত্ব বিপন্ন করে নিংড়ে নেওয়া যা হিন্দু চিন্তার পরিপন্থী। হিন্দু ‘তেন তক্তেন ভুঞ্জীথা’ মন্ত্রে উজ্জীবিত, ত‍্যাগের মাধ্যমে ভোগ করায় বিশ্বাসী। শিবজ্ঞানে জীবসেবাই তার আদর্শ। তাই তো সর্বত‍্যাগী শঙ্কর তার উপাস্য দেবতা। প্রকৃতি মা রক্ষা পেলে আমরাও সুরক্ষিত থাকবো, নচেৎ রুষ্ট প্রকৃতি কিভাবে জীবনের উপর থাবা বসাবে, তা তো কোরোনা মহামারী আমাদের দেখাচ্ছে আজ!

ডঃ এন জি চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.