মাতৃ রূপিনী গঙ্গা আজ গভীর সঙ্কটাপন্ন #SSUB

সভ‍্যতার বিকাশ ঘটেছিল নদীকে কেন্দ্র করে। তাতে ক্রমান্বয়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি ঘটলো। ভারতবর্ষের প্রধান নদী গুলির মধ্যে বৃহত্তম ও দীর্ঘতম নদী হলো গঙ্গা। জলপ্রবাহের ক্ষমতা অনুযায়ী এই নদী বিশ্বের প্রথম কুড়িটি নদীর অন‍্যতম। গাঙ্গেয় অববাহিকার জনসংখ্যা চল্লিশ কোটি এবং জন ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৩৯০ হওয়ায় এটি বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল নদী অববাহিকা হিসাবে চিহ্নিত। বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘ কাল ধরে এই নদীকে ব‍্যবহার করায় গঙ্গা নদী তার পরিচ্ছন্নতা ও শুদ্ধতা হারিয়ে দূষিত হয়েছে এবং পরিবেশকে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করছে।

সাধারণ ভাবে আমরা সকলেই গঙ্গা নদীর গতিপথ সম্বন্ধে অবগত। তাই অল্প পরিসরে গতিপথ ও জলপ্রবাহ সম্পর্কে আলোচনায় না গিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিশেষজ্ঞদের মতামত ও বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্ট কে গ্রহণ করে গঙ্গা নদীর দূষণের কারণগুলি অনুসন্ধান করছি।

নদীকে বিভিন্ন ভাবে ব‍্যবহার করার সুবিধা থাকায় নাগরিক জীবনের উন্নয়নের জন্য এই অববাহিকায় গড়ে উঠেছে শিল্প নগরী, তীর্থ নগরী এবং পর্যটন নগরী। গঙ্গার নিকটবর্তী অঞ্চলের নাগরিকরা গঙ্গা দূষণের জন্য মূলত শিল্পকারখানাকেই দায়ী করে স্বস্তি পেতে চান। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে একাধিক সমীক্ষায় গঙ্গা দূষণের কারণ হিসেবে যে তথ্যগুলো পাওয়া গেছে তাতে পরিষ্কার যে, শুধুমাত্র মানুষের সৃষ্ট বর্জ‍্যই গঙ্গা দূষণের জন্য আশি শতাংশ দায়ী। বাকিটা কারখানার শিল্পবর্জ্য, চাষাবাদের জন্য ব‍্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ, নানা কঠিন বর্জ্য, গঙ্গায় ভেসে যাওয়া মানুষ ও বিভিন্ন পশুপাখির শবদেহ থেকে হয় বলে মনে করেন পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান তথা নদী বিশেষজ্ঞ কল‍্যাণ রুদ্র। গঙ্গা নদীর দীর্ঘ প্রবাহে গঙ্গা সবচাইতে বেশি দূষিত হয় গাঙ্গেয় সমভূমিতে। গঙ্গা নদীর তীরবর্তী শহরগুলোর থেকে গঙ্গায় মেশা নাগরিক বর্জ্য তরলের পরিমাণ প্রায় তিনশ’ কোটি লিটার যা প্রতি দশ বছরে এই পরিমাণের দ্বিগুণে পরিণত হয়। আর নগর, শহরের ও কারখানার বর্জ্য নদীর তলদেশে জমা হওয়ায় গঙ্গার নাব‍্যতা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।

এছাড়াও বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব‍্যবহৃত দ্রব‍্য গঙ্গায় ফেলায় গঙ্গা আরও দূষিত হচ্ছে। প্রায় সারা বছরই পুজোর শেষে বিভিন্ন মৃণ্ময়ী মূর্তি গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়। ফলে প্রতিমা তৈরির উপকরণসহ প্রতিমার রঙের সঙ্গে মিশে থাকা বিভিন্ন রাসায়নিক বিশেষ করে সীসা মিশছে গঙ্গার জলে। এতে দূষিত হচ্ছে জল, বিপন্ন হচ্ছে মাছ সহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী। এমনকি গঙ্গার জনপ্রিয় ইলিশ মাছের সংখ্যাও দিন দিন কমছে। মূর্তির রঙে থাকা সীসা, ক‍্যাডমিয়াম ইত্যাদি ক্ষতিকর ধাতু গঙ্গার জলে মিশে মাছের মধ্যে দিয়ে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে। স্নানে ও পানের মাধ্যমে নিয়মিত সীসা মানুষের শরীরে ঢুকলে মানুষের বুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায়, রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যায়, কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়। ক‍্যাডমিয়ামের কারণে বৃক্কে, যকৃতে, অস্থিমজ্জায় দুরারোগ্য ব্যাধি হয়। এই দূষণ প্রতিকারের চেষ্টায় কোলকাতা কর্পোরেশনের উদ‍্যোগে প্রতিমা বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গে মূর্তিগুলি সরিয়ে ফেলার ব‍্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া উওর চব্বিশ পরগনার নৈহাটিতে কালী প্রতিমা গঙ্গায় বিসর্জন না দিয়ে পূজাস্থলেই জলধারার মাধ্যমে গলিয়ে ফেলা হচ্ছে যা ‘নৈহাটি মডেল’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে।

এবার আসি ব‍্যাক্টেরিয়া প্রসঙ্গে। গঙ্গার জলে রয়েছে অত‍্যন্ত ক্ষতিকর ব‍্যাক্টেরিয়া ‘কলিফর্ম’। পরজীবী বিজ্ঞানীরা অবশ‍্য বলেছেন কলিফর্ম কোনো একটি ব‍্যক্টিরিয়া নয় , বেশ কিছু ব‍্যাক্টেরিয়ার সম্মিলিত প্রজাতি। পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গা জলে ‘কলিফর্ম’ ব‍্যাক্টেরিয়ার পরিমাণ প্রতি ১০০ মিলিলিটার জলে ১ লক্ষ ৬০ হাজার। ডায়মন্ড হারবারের জলে ৮০ হাজার এবং দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গায় রয়েছে ১ লক্ষ ১০ হাজার সংখ্যক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে এই সংখ্যা ১ হাজার পর্যন্ত নিরাপদ। এছাড়া গঙ্গা জলে বায়োকমিক‍্যাল অক্সিজেন ডিম‍্যান্ড (BOD) প্রতি লিটার জলে ৬ মিলিগ্রাম। সাধারণ ভাবে এই মাত্রা প্রতি লিটার জলে ৩ মিলিগ্রাম ছাড়ালেই তা স্নানের অযোগ্য বলে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা মনে করেন। ‘কলিফর্ম’ ব‍্যাক্টেরিয়া মূলত বিভিন্ন ভাবে গঙ্গায় ফেলা মল-মূত্রের মাধ্যমে গঙ্গা মিশছে। গঙ্গা জল দূষিত হতে হতে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে জলের ব‍্যাক্টেরিয়ার মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে এক নতুন জিন। দিল্লি IIT ও ব্রিটিশ নিউ ক‍্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌথ গবেষণাপত্র যা ‘জার্নাল অফ এনভায়রনমেন্টল সায়েন্সেস এন্ড টেকনোলজি’-তে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে তারা গঙ্গাজলে ঐ রকম ‘জিন’-এর সন্ধান পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন। পরীক্ষায় দেখা গেছে যে সকল ব‍্যাক্টেরিয়ার জীবন চক্রে এটি প্রবেশ ক’রে অ‍্যান্টিবায়োটিক তাদের কোন ক্ষতি করতে পারে না। এই ধরনের ব‍্যক্টেরিয়া অন্ত্রে প্রবেশ করলে সেখানে বংশ বিস্তার করে ও মলবাহিত হয়ে সহজেই পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেখান থেকে আরো মানুষকে সংক্রমিত করে। এভাবে তারা জিন সঞ্চারিত করে অন্যান্য ব‍্যাক্টেরিয়াকে এবং তারাও অ‍্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধে সক্ষম হয়ে উঠে। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি হবে বলে মনে করেন কলকাতার ‘ন‍্যাশনাল
ইনিস্টিটিউট অব কলেরা এন্ড এন্টেরিক ডিজিজ’-এর গবেষকেরা।

গবেষণায় দেখা গেছে যে গঙ্গা তীরে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে ক‍্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। ভারতীয় জাতীয় ক‍্যান্সর নিবন্ধন কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গের প্লাবন ভূমি ও বিহারের নদী অববাহিকার নিকটবর্তী বসবাসরত মানুষের মধ্যে পৌষ্টিকতন্ত্র, কিডনি, লিভার, মূত্রনালী ও চর্ম-ক‍্যান্সারের প্রবণতা বেশি।

বর্তমানে গঙ্গা দূষণের আর একটা বড়ো কারণ হল, এই নদীতে জল প্রবাহ অত‍্যন্ত ক্ষীণ। নদী বিশেষজ্ঞ কল‍্যাণ রুদ্র বলেছেন, গঙ্গা কানপুরে পৌঁছানোর আগেই ৯০ শতাংশের বেশি জল কৃষি জমিতে সেচের কাজে ব্যবহার করা হয়। এর ফলে নিম্নাঞ্চলে দূষণ ও অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থ অপসারণ করা সম্ভব হয়না। গঙ্গা নদীর উজানে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বাঁধ নির্মাণ করে গঙ্গার স্বাভাবিক প্রবাহকে ব‍্যাহত করা হয়েছে। সমগ্র অবাহিকায় কৃষি জমিতে ব‍্যাপক সেচের ফলে নদীর জলস্তর প্রতিনিয়ত নীচে নেমে যাচ্ছে। কোলকাতা থেকে ভাগীরথী নদীর উজানে গেলে দেখা যায় যে নদীর তীরে অসংখ্য কলাবাগান, ইঁট ভাটা; প্রতিনিয়ত প্রচুর বর্জ্য গঙ্গায় ফেলা হচ্ছে; তাছাড়া তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের বর্জ্যও গঙ্গায় মিশছে। এই নদীর দুই পার থেকে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে প্রচুর বালু উত্তোলনের ফলেও নদীর স্বাভাবিকতা নষ্ট হচ্ছে। এই সমস্যা গুলো থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য এবং গঙ্গাকে আবার স্রোতস্বিনী করবার জন্য নদী বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মেই এই নদীকে বইতে দিতে হবে। নদীর উভয় তীরের প্লাবন ভূমিকে মুক্ত রাখতে হবে। এর ফলে নদীর দুপাশের ভূমিগুলি থেকে প্রাকৃতিক ভাবেই দূষণ দূর হবে। বন‍্যা ও পলি পরিবহনের জন্য নদী তার প্রয়োজনীয় জায়গা পাবে।

পরিশেষে আসি গঙ্গার জল পরিশোধনের বিষয়ে। সর্ব প্রথম ১৯৮৬ সালে ভারত সরকার ‘গঙ্গা অ‍্যাকশন প্ল্যান’ সূচনার দ্বারা এই নদীকে দূষণমুক্ত করার উদ্যোগ নেয়। বর্তমান সরকার ২০১৫ সালে গঙ্গাকে দূষণ মুক্ত করতে ‘নমামী গঙ্গে’ নামক আর একটি সুসংহত গঙ্গা-সংরক্ষণ প্রকল্পের সূচনা করে। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষ পর্যন্ত প্রায় এই প্রকল্পে ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে ভারত সরকার। ‘নমামী গঙ্গে’ প্রকল্পের অন্তর্গত রিভার ফ্রন্ট ম‍্যানেজমেন্টের জন্য দেশের ১১৮ টি শহরকে চিহ্নিত করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ৪৪টি পুর এলাকা এর প্রথম পর্যায়ে আছে; যেমন মুর্শিদাবাদ, বহরমপুর, নবদ্বীপ, কল‍্যাণী, ভাটপাড়া,গাড়ুলিয়া, বরানগর, উত্তরপাড়া ইত্যাদি এলাকা। আশা করা যায়, কেন্দ্রীয় সরকারের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়েই গঙ্গা দূষণমুক্তির দিকে এগিয়ে যাবে।

তথ‍্য সূত্র:
১. pmindia.gov.in
২. bigyan.org.in
৩. সুন্দরবন শ্রমজীবী হাসপাতালের মুখপত্র ‘লোকগাথা’, দ্বিতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা।
৪. এই সময়, ২৫ নভেম্বর ২০১৯
৫. আনন্দ বাজার পত্রিকা, কোলকাতা, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বর্ণালী চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.