মার্ক্সবাদী দৃষ্টিতে রামায়ণ পর্যালোচনা : প্রতিবাদে তারাশঙ্কর

রামায়ণ মহাকাব্যের রাম, রাবণ, সীতা এই তিন চরিত্রই আমাদের কাছে সর্বাধিক আলোচিত ও সমালোচিত হয়ে থাকে। তার মধ্যে সীতা কিংবদন্তীমূলক পঞ্চসতীর এক উজ্জ্বল উদাহরণ। আর বহুগুণের অধিকারী হয়েও রাবণ আমাদের কাছে এক আতঙ্কের চরিত্র হিসেবেই পরিচিত। লঙ্কেশ্বর রাবণ যেন ভারতীয় সংস্কৃতির এক বিখ্যাত খল নায়ক। বহু বিবাহিত পুরুষ হয়েও নারী হরণ ও ধর্ষণ যেন তার নিত্য কর্ম হিসেবেই সর্বজনবিদিত। সেই জন্যই বোধহয় সীতাকে চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময়ে রাবণের কথায় মধুকবির কথা—‘কার ঘর আঁধারিলি এবে নিবাইয়া প্রেমদীপ/এই তোর নিত্য কর্ম জানি। রামায়ণের রাবণ ও সীতা সম্পর্কে এমন ধারণা মানুষের কল্পনা প্রসূত নয়; মহাকবি বাল্মীকির চরিত্র-চিত্রণের সূত্র ধরেই আমাদের এমন ধারণা সম্ভব হয়ে উঠেছে। সেই সূত্র থেকেই যুগ যুগ ধরে প্রচলিত হয়ে রয়েছে—ধরিত্রী কন্যা সীতা—সর্বংসহা; সীতা অপহৃতা হয়েও সতী। মহাকবি বাল্মীকি ভারতীয় নারী ঐতিহ্যের আদর্শকে সীতা চরিত্রে মহিমান্বিত করেছেন। এমন প্রবাদপ্রতীম প্রামাণিক সত্যকে বিকৃত ব্যাখ্যায় কলঙ্কিত করতে চেয়েছিলেন কিছু বস্তুতান্ত্রিক পণ্ডিত। ভারতীয় সংস্কৃতির এক সাধক এবং পরবর্তীকালে জ্ঞানপীঠ পুরস্কারপ্রাপ্ত মহান কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নজরে এসেছিল তেমন এক কলঙ্কিত আলোচনা। তিনি তার তীব্র প্রতিবাদে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিলেন সেই বিকৃত আলোচনাকে। আমাদের কথা নামক আত্মজীবনীর পাতায় তারাশঙ্কর তার জীবনের তেমন এক চরম অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে লিখেছেন—

মার্ক্সবাদীদের অনেকগুলি কাগজ তখন ছিল—তার মধ্যে প্রধান একখানি মাসিক পত্রের পৃষ্ঠায় প্রথম প্রবন্ধ হিসেবে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল—যাঁর লেখক ছিলেন একজন ইংরেজি সাহিত্যের খ্যাতনামা অধ্যাপক। প্রবন্ধটিতে রামায়ণ কাহিনী বর্ণনার ক্ষেত্রে মহাকবি বাল্মীকি এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তের তুলনামূলক সমালোচনা করেছিলেন। তাতে একস্থানে বলেছিলেন বাল্মীকি আশ্চর্যভাবে মধুসূদন অপেক্ষা অধিকতর মার্ক্সবাদী।

এহ বাহ্য, তিনি এতে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে অরণ্যকাণ্ডে রাবণ যখন সীতাকে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছিলেন লঙ্কার দিকে, তখন পথে বিহঙ্গরাজ জটায়ুর সঙ্গে যুদ্ধের পরই তিনি বনমধ্যে সীতাকে ধর্ষণ অর্থাৎ দেহগত ভাবে তাকে ভোগ করেছিলেন। মূল বাল্মীকি রামায়ণের অরণ্যকাণ্ড ৫২ সর্গ থেকে কয়েকটি শ্লোকও তিনি উদ্ধৃত করে তার এই চমকপ্রদ গবেষণাকে অকাট্য ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন।

তারাশঙ্কর রামায়ণের এক একনিষ্ঠ নিবিড় পাঠক ছিলেন। বালক বয়সেই তিনি তাঁর পিতার পুস্তকভাণ্ডার থেকে কৃত্তিবাসী রামায়ণ প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। সংস্কৃত রামায়ণ পাঠ করেছিলেন অনেক পরে। তারাশঙ্করের মতে ভারতীয় সাহিত্যের এক মহান সৃষ্টি মহামুনি বাল্মীকি বিরচিত রামায়ণ মহাকাব্য অখণ্ড ভারতের সমাজ-সংস্কৃতি থেকে ধর্ম-দর্শন-আধ্যাত্মিকতা সমস্ত কিছুরই এক। অক্ষয় ভাণ্ডার এবং সর্বকালের সর্বমানবের এক অবিস্মরণীয় গ্রন্থ। এই গ্রন্থের কোনোরূপ বিকৃত ব্যাখ্যা ভারতীয় ঐতিহ্যের অপমান বলেই মনে করতেন তিনি। এই মানসিকতা থেকেই ইংরেজি সাহিত্যের ওই অধ্যাপকের এই প্রবন্ধ পাঠে শিউরে উঠেছিলেন এবং তাকে এই বিষয়ে এক দীর্ঘ চিঠিও লিখেছিলেন তারাশঙ্কর। অধ্যাপক প্রাবন্ধিক সহস্র বছর পরে অভিনব সত্যকে আবিষ্কার করার গৌরবে খুব সপ্রতিভ। অহংকারে উত্তর দিয়েছিলেন তারাশঙ্করকে। বিষয়টি নিয়ে তারাশঙ্কর বিধানসভাতেও আলোকপাত করেন। ফলে ওই অধ্যাপক তার সেই প্রবন্ধটি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। এই নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তারাশঙ্করের মতবিরোধও হয়। বিধানসভা সংক্রান্ত ঘটনাটির কথা জানতে পারি তারাশঙ্কর পৌত্র অমলাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের কাছে।

ওই প্রাবন্ধিকের অভিনব আবিষ্কারের অভিমতগুলি বাল্মীকি রামায়ণ পাঠেই ভ্রান্ত প্রমাণ করেছিলেন তারাশঙ্কর। তিনি নিজেই জানিয়েছেন–আমি মূল সংস্কৃত রামায়ণ দেখবার জন্য ব্যাগ্র হয়ে ঠিক সেই রামায়ণখানিই সংগ্রহ করেছিলাম যেখানি এই অধ্যাপক মহাশয় পড়েছিলেন এবং যা থেকে তিনি এই সত্য আবিষ্কার করেছিলেন।

এর আগে তারাশঙ্কর রামায়ণের কেবলমাত্র একজন তত্ত্বদর্শী পাঠক ছিলেন। রামায়ণে দস্যু রত্নাকরের বাল্মীকি হয়ে ওঠার তত্ত্বটি তিনি তাঁর ‘কবি’ উপন্যাস ও ‘যুগবিপ্লব’ নাটকে নায়ক চরিত্রের উত্তরণে প্রয়োগ করেছেন। আর এই ঘটনার সময় থেকে তিনি হয়ে উঠলেন তথ্য-অনুসন্ধানী এক গবেষক। একেবারে তথ্যনিষ্ঠ দৃষ্টিতে বাল্মীকির কবিত্ব এবং সীতা সম্পর্কে মহাকবির অভিমত উদ্বাটনই তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি পাওয়ার জন্য নয়, বিকৃত ব্যাখ্যার হাত থেকে ভারতীয় আদর্শের ঐতিহ্যকে অম্লান রাখতেই তারাশঙ্কর রামায়ণ গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। একজন গবেষকের ন্যায় অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে মহামুনি বাল্মীকি বিরচিত সুবিশাল সংস্কৃত রামায়ণের প্রতিটি পঙক্তি একেবারে শব্দ ধরে ধরে সমগ্র একবার বা দু’বার নয় একেবারে তিন তিন বার পাঠ করেন তারাশঙ্কর। কেবলমাত্র ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েই তাঁর রামায়ণ পাঠের এই দৃষ্টান্ত আমাদের কাছে অবিস্মরণীয়।

প্রথমবার রামায়ণ অনুসন্ধানে তারাশঙ্কর দেখেন অরণ্যকাণ্ডের ৫১ সর্গে জটায়ুর মৃত্যুর পর ৫২ সর্গের শুরুতেই বাল্মীকি বলেছেন—“রাবণ সীতার দিকে তাকালেন এবার’। দেখলেন জটায়ুর মৃত্যুতে সীতা বিলাপ করছেন। রাবণ সীতাকে পুনরায় আয়ত্ত করার জন্য অগ্রসর হলেন। আর সীতা বনের মধ্যে গাছের আড়ালে আত্মরক্ষার জন্য চেষ্টা করছিলেন। তখন রাবণ তাঁকে জোর করে গাছের আড়াল থেকে টেনে আনেন। সেই সময় বাল্মীকি একটি শ্লোকে বলেছেন—“প্রধর্ষিতায়াং বৈদেহ্যাং বভুব সচরাচরম্। তারাশঙ্করের মন্তব্য—এই ‘প্রধাৰ্ষিত বৈদেহী’শব্দ দুটিতেই ব্যাখ্যার যত জটিলতা। এই শব্দদুটির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেই ব্যাখ্যাকার এই ব্যাখ্যা করেন যে-সীতাকে রাবণ বনমধ্যে দেহগতভাবে ভোগ করেছেন, এই কথাই বাল্মীকি লিখেছেন। তার সঙ্গে লিখেছেন—এখানেই মার্কসবাদীদের দৃষ্টিতে বাল্মীকি চরম প্রগতিশীল। মার্কসবাদীর তত্ত্ব এর মধ্যে পরিস্ফুট। প্রথমবার রামায়ণ পাঠে তারাশঙ্কর দেখেন উক্ত অধ্যাপক মহাশয় উদ্ধৃতি উদ্ধারে কোনো ভুল করেননি। তাই তাৎক্ষণিক প্রতিবাদের কোনো সূত্র তিনি পাননি—অথচ মহামুনি বাল্মীকি সীতা সম্পর্কে এমন কথা লিখতে পারেন বলে বিশ্বাসও করতে পারলেন না। তাই, তিনি কেবলমাত্র অরণ্যকাণ্ডের উপর নির্ভর করে নিশ্চিত হতে পারলেন না। সমগ্র রামায়ণের নিরিখে ওই শ্লোক ও শ্লোকের শব্দগত তাৎপর্য অনুসন্ধানে সচেষ্ট হলেন।

দ্বিতীয়বারে সত্যানুসন্ধিৎসু পাঠক তারাশঙ্কর গভীর নিষ্ঠা সহ সযত্নে সমগ্র রামায়ণখানির প্রতিশ্লোকের প্রতি-ছত্রের পাঠ গ্রহণ করলেন। পড়তে পড়তে তিনি দেখেন—“কর্মর্ণা মনসা বাচা’ইত্যাদি শ্লোকে সীতার অগ্নিপরীক্ষার চিত্র অঙ্কিত রয়েছে। তারপর লঙ্কাকাণ্ডের ১১৮ সর্গের একটি শ্লোকে তিনি পড়েন—পরাধীনেষু গাত্রে কিং করিষ্যাম্যনীশ্বরা’ইত্যাদি। যেখানে সীতা বলেছেন পরাধীন দেহের উপর তার কোনো হাত ছিল না। প্রথমবারের পাঠে তারাশঙ্কর বিস্মিত ও স্তম্ভিত হয়েছিলেন আর দ্বিতীয়বারের পাঠে পেলেন আঘাত। তথাপি তখনও পর্যন্ত তিনি উক্ত অধ্যাপক মহাশয়কৃত রামায়ণের সহজ ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারলেন না। আরও অগ্রসর হলেন তিনি। লঙ্কাকাণ্ড বা যুদ্ধকাণ্ডের ১২শ ও ১৩শ সর্গে দেখলেন, রাবণ সভা ডেকে পারিষদবর্গকে সীতা হরণের বৃত্তান্ত প্রকাশ করছেন। বলেছেন, ‘দণ্ডকারণ্য থেকে আমি তাকে হরণ করে এনেছি কিন্তু সে আজও আমার শয্যাভাগিনী হয়নি। বলেছেন, “এই নারীর জন্য আমি কামার্ততায় বহ্নিজ্বালার মতো দাহ অনুভব করছি সর্বদেহে সর্বক্ষণ। সে আমার কাছে এক বৎসর সময় প্রার্থনা করেছে। সে প্রতীক্ষা করছে রামের”। অন্য এক জায়গায় সীতাকে ভয় দেখিয়ে তিনি বলছেন—“বৎসরান্তে আমার অনুগামিনী না হলে তোমাকে কেটে তোমার মাংস আমি প্রাতঃরাশের সঙ্গে গ্রহণ করব”। ১৩শ সর্গে মহাপার্শ্ব নামক পরিষদ রাবণকে অনুযোগ করে বলেছেন, “বলপূর্বক কুকুটেরা যেমন রমণ করে—সেইভাবে ‘প্রবর্তস্ব মহাবল। সীতাকে বার বার আক্রমণ করে ‘ভুব চ রমস্ব চ।” তাছাড়া, সীতাকে হরণ করে দেগত ভাবে বলপূর্বক ভোগ না করা নিজের মুখতা বলেই জানিয়েছেন রাবণ।

কৌতূহল জাগে, তাহলে কি ধীশক্তি তথা চারিত্রিক স্থিতিশীলতার গুনেই রাবণের পক্ষে এমন ধৈর্যধারণ সম্ভব হয়েছিল! একেবারে উদাহরণ উদ্ধার করে তারাশঙ্কর জানিয়েছেন, সীতার সামনে রাবণের এই স্থিতিশীলতা রাবণ চরিত্রের কোনো মহত্ত্ব নয়, এ এক চরম অভিশাপের ভয়। পূর্বে একদিন রাবণ পুঞ্জিকস্থলী নামে এক অপ্সরাকে আকাশলোকে জোরপূর্বক ভোগ করেন। এই ঘটনার জন্য ব্রহ্মা তাঁকে অভিশাপ দেন যে—রাবণ বলপূর্বক কোনো নারীকে ভোগ করলে তার দশমুণ্ড একশত ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে। সেই শাপের ভয়ে রাবণ সীতার উপর বলপ্রয়োগ করেননি। আর সীতার যে কথা, ‘দেহ আমার পরাধীন ছিল’—তার অর্থ এই যে, বলপূর্বক অপহরণকালে রাবণ তার হাত ধরেছিল, জটায়ুর সঙ্গে যুদ্ধকালে রথ চূর্ণ হলে রাবণ সীতাকে বাঁ কাঁধের উপর ফেলে ডান হাতে যুদ্ধ করেছিল। এখানে এই অঙ্গস্পর্শের কথা বলা হয়েছে। এখানেও ক্ষান্ত হননি তিনি, এরপর আরও কী আছে এবং প্রধর্ষিতায়াং ও ‘বৈদেহী’শব্দদুটিকে মহাকবি কোন অর্থে ব্যবহার করেছেন তা জানার জন্য তারাশঙ্কর আবার নবউদ্যমে নব নিরিখে রামায়ণ পাঠে মনোনিবেশ করেন। তৃতীয়বার রামায়ণ পাঠ প্রসঙ্গে তারাশঙ্কর জানিয়েছেন—

গোটা রামায়ণখানির প্রতি পঙক্তি খুঁজে দেখছিলাম কোথায় ধর্ষিত, ধর্ষণ শব্দ আছে। এবং কী অর্থে ব্যবহার করেছেন মহাকবি। বলপূর্বক নারীদেহ ভোগের কথা কয়েকবারই আছে, সেখানে একস্থানেও বাল্মীকি ‘ধর্ষণ’শব্দ ব্যবহার করেননি সেটি আমার চোখে পড়েছিল। রম্ ধাতু এবং ভু ধাতুর ব্যবহার দেখেছি। কুকুটবৃত্তেন ভুক্ষচ রমশ। রাবণ পুঞ্জিকস্থলী প্রসঙ্গে বলেছেন—“ময়াভুজা। রাবণকে অভিশাপ প্রসঙ্গে ব্রহ্মা একবার বলেন, ‘বলান্নারী গমিষ্যসি’। ধর্ষণশব্দই নেই। আমার সন্দেহ হয়েছিল বাল্মীকি ধর্ষণ শব্দ এই অর্থে ব্যবহারই করেননি। তাই কোথায় কোন পঙক্তিতে ধর্ষণ শব্দ আছে খুঁজে বের করে একটি তালিকা প্রস্তুত করেছিলাম। দেখেছিলাম, আমার অনুমানই সত্য। শতাধিকবার (বোধ হয় ১২৭ বার) ধর্ষণ শব্দের ব্যবহার আছে রামায়ণে। সর্বত্রই এক অর্থ—সে অর্থ জোরপূর্বক বিপর্যস্ত বা লাঞ্ছিত করা। রাবণ স্বৰ্গজয় করেছে, হনুমান লঙ্কা দগ্ধ করেছে, বানরকটক সুগ্রীবের মধুবন লণ্ডভণ্ড করেছে—সবই ‘ধর্ষিত হয়েছে; এবং এই অর্থেই ধর্ষণ শব্দ ব্যবহার হয়েছে রামায়ণে। দেহভোগ অর্থে রম্ এবং ভুঙ ধাতু ব্যবহার করা হয়েছে।

আমরা জানি, সীতার অগ্নি পরীক্ষা এর আর এক অকাট্য যুক্তি। বর্তমান কালের মতো সেযুগে চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নত হলে প্রজানুর ঞ্জনের জন্য স্বয়ং রামচন্দ্রও হয়তো-বা সীতার সতীত্ব পরীক্ষায় সে পথও অবলম্বন করতেন। কিন্তু স্মরণীয় যে ডাক্তারি পরীক্ষা অপেক্ষাও অগ্নি পরীক্ষার ন্যায় এক ভয়ংকরতম পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছিল সীতাকে। সীতার অগ্নিপরীক্ষা রামচন্দ্রের চরিত্রকে কিছুটা কলুষিত করলেও–সীতা যে রাবণ কর্তৃক ধর্ষিত হননি সে কথা মহাকবি বাল্মীকি কেবলমাত্র রাবণের কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে রাখেননি। লঙ্কার অরণ্যের অন্ধকারে লোকচক্ষুর অগোচরে রাবণের মতো ভয়ংকর মানুষের কবলেও যে সীতা চরিত্র নিষ্কলুষতায় অম্লান আলোকে উজ্জ্বল ছিল—সে কথা অযোধ্যায় সর্বজন সমক্ষে প্রমাণ করতেই সীতার অগ্নি পরীক্ষার ব্যবস্থা করেন। মহাকবির বর্ণনা থেকেই আমরা জানি– সীতা অগ্নিতে প্রবেশ করলেন। সীতার নিস্পাপ দেহের বিন্দুমাত্রও দগ্ধ করতে পারলেন না; বরং অগ্নিদেব তাকে কোলে করে নিয়ে উঠে আসেন এবং সেই জনসমক্ষেই চিরায়ত নারী আদর্শ সীতাকে রামের হাতে তুলে দেন। অগ্নিদেব রামচন্দ্রকে বলেন–

রাম! তোমার সীতাকে তুমি গ্রহণ কর। সীতা মনে-প্রাণে পাপহীনা বিশুদ্ধচিত্তের নারী। তাঁর অন্তরে ক্ষণিকের জন্যও রাম ভিন্ন রাবণের কথা অঙ্কুরিত হয়নি। সীতাকে বিন্দুমাত্র পাপস্পর্শ সম্ভব হয়নি। সীতা অনলেও নির্মল।

এ সম্পর্কে তারাশঙ্করের অভিমত—সীতা ভারত সংস্কৃতির যজ্ঞকুণ্ড থেকে যজ্ঞফলের মতো উত্থিতা এক নারী আদর্শ—নারী মহিমা।তিনি অম্লান দীপ্তিময়ী, যার মহিমার কাছে দেবীমহিমাও ম্লান হয়। সেই সীতার দেহ রাবণের দ্বারা কলুষিত হলে তিনি তৎক্ষণাৎ বিগতজীবন হয়ে লুটিয়ে পড়তেন এবং রামের সম্মুখীন হয়ে কলুষিত দেহ ভস্মীভূত হওয়ার আবেদন জানাতেন। ওই অধ্যাপক সমালোচক প্রাবন্ধিকের গবেষণালব্ধ তথ্যকে প্রামাণিক তথ্য দ্বারা ভ্রান্ত প্রমাণ করে তারাশঙ্কর জানিয়েছেন, যে সীতা সহস্র সহস্র বৎসর ধরে দু-দুবার মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এক অনুপম স্ফটিক প্রতিমার মতো কোটি কোটি মানুষের অন্তলোকে মণিবেদীর উপর অধিষ্ঠিতা রয়েছেন, মহাকবি বাল্মীকি যাঁকে কলুষহীন। প্রদীপ্ত বহ্নির মতো নির্মাণ করেছেন তাঁকে অপব্যাখ্যায় কলুষিত করা সঙ্গত নয়।

দেবাশিস মুখোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.