লক ডাউন (Lock down) , হোম কোয়ারান্টাইন (Home Quarantine), প্যানডেমিক, মহামারী, অতিমারী..
কথাগুলো গত কয়েকদিন শুনতে শুনতে সব্বার কান কটকট মাথা ঝিমঝিম করার জোগাড়। মানুষ আর ভাইরাস -দুজনের মোলাকাত এই প্রথম নয়। সৃষ্টির আদি থেকেই এই বিশ্বে ভাইরাস ছিল। এক অদ্ভুত দ্বৈত সত্তা নিয়ে, শিখণ্ডীর মতো। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, না জীব না জড়- এক অদ্ভুত অস্তিত্ব!
মানুষের জ্ঞানচক্ষু উণ্মীলনের ক্রমবিবর্তনে মানুষ চিনেছে তার আপাত শত্রু মিত্রদের। খালি চোখে ভাইরাস দৃশ্যমান নয়। আক্রান্ত জীবের শরীর, তার জ্যান্তদশার লীলাক্ষেত্র। লক্ষণগুলি চিনতে শেখাতেই কত প্রজন্ম গেছে! গুটিবসন্ত এক কালান্তক বিভীষিকা ছিল এককালে। গ্রামের পর গ্রাম, দেশ মহাদেশ উজাড় হয়ে গেছে তার মারণক্রিয়ায়। ভাইরাল ইনফ্লুয়েঞ্জা, কালাজ্বর, পোলিও পেরিয়ে ইদানীং ইবোলা, জিকা, এইচ ওয়ান এন ওয়ান, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ইত্যাদির বোলবোলাও। কারও আঁতুড়ঘর মূলত আফ্রিকা, কারওবা চীন, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া। কেউ কেউ সারা বিশ্ব জুড়েই খেলেন আপনমনে।
আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা, সংক্রমণের ভৌগলিক ব্যাপ্তি, সংক্রমণের প্রাবল্য ইত্যাদি বিষয় মাথায় রেখে এঁদের স্টেডিয়ামের নামকরণে ভিন্ন ভিন্ন লব্জ ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
যেমন কোনও একটি সংক্রামক ব্যাধির প্রকোপ যদি হঠাৎ করে সাধারণ মাত্রার তুলনায় বেড়ে যায়, আঞ্চলিকভাবে, তবে তাকে বলা হয় ‘আউটব্রেক‘। উত্তর বা দক্ষিণবঙ্গের কোনও জেলা থেকে কলেরা, উদরাময়ের এমন সংক্রমণের খবর আমরা প্রায়শই শুনে থাকি।
‘এপিডেমিক‘ প্রায় সমগোত্রীয়, সমার্থক একটি লব্জ।ফারাক হল ভৌগলিক ব্যাপ্তিতে। এপিডেমিক অনেক অনেক বড় জায়গা জুড়ে সংক্রমণকে বোঝায়।
‘এনডেমিক‘ কিছুটা ভিন্ন। এর সাথে ঐ ‘আকস্মিক‘ ব্যাপারটা নেই। সংক্রামক ব্যাধিটি একটি ভৌগলিক অঞ্চলে বহুকাল ধরে সক্রিয় রয়েছে, এমন বোঝাতে ‘এনডেমিক‘ লব্জটি ব্যবহৃত হয়। যেমন দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া। আফ্রিকার জাইরে অববাহিকার জাইরে ইবোলা ইত্যাদি।
‘প্যানডেমিক‘ বা ‘প্যান-এনডেমিকে’র ক্ষেত্রে এই ভৌগলিক ব্যাপ্তির চূড়ান্ত দশা বোঝায়। একটি সংক্রামক ব্যাধির সংক্রমণক্ষমতা সাংঘাতিক রকমের বেশি হলেই তা সারা পৃথিবী ব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেমন অধুনা ঐতিহাসিক স্মলপক্স বা গুটি বসন্ত কিমবা এখনকার এই নভেল করোনাভাইরাস -১৯, পরিভাষায় SARS-CoV-2। এই ধরনের সংক্রমণ গোটা বিশ্ব জুড়ে ছড়াতে সময় লাগে মোটামুটি তিনমাস মতো।
১. প্রশ্ন হল, করোনাভাইরাস কেন এত সংক্রামক? এটি কি কোনও নতুন ভাইরাস?
এর উত্তরে বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হয়। ছোট করে বলি। করোনাভাইরাসই হোক বা যে কোনও রোগসৃষ্টিকারী তত্ত্ব (ব্যাকটিরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক, কীট, পতঙ্গ) – সবার ক্ষেত্রেই প্রাথমিক মোলাকাতটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অনেক রকমফের আছে, অনেকগুলি স্তর। একেবারে নতুন সংক্রামক বস্তুর বেলায়, (যেমন এক্ষেত্রে করোনাভাইরাস) শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে পড়ে। আগাম পরিচিতি না থাকায় তারা একে রোগসৃষ্টিকারী হিসেবে ধরতেই পারেনা, ধরপাকড়ের প্রশ্নও তাই ওঠে না। নিজের পছন্দসই জায়গা বেছে নিয়ে দিব্যি বসবাস এবং ব্যবসাপাতি শুরু করে দেয় অনুপ্রবেশকারী।
করোনাভাইরাস (Coronavirus) নতুন নয়, কিন্তু এই বিশেষ করোনাভাইরাসের (Coronavirus) স্ট্রেনটি এক্কেবারে নতুন। তাই নামের আগে ‘নভেল’ কথাটি জোড়া হয়েছে। এক পাকের RNA তন্তুর (Single strand positive sense RNA) গঠনে সামান্য কিছু রদবদল হয় প্রাকৃতিকভাবেই, যাকে বলে ‘মিউটেশন‘। এই পরিচয়পত্রের সামান্য এদিকওদিকেই আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষা দপ্তর ঘোল খেয়ে যায়।
করোনাভাইরাসের (Coronavirus) সংক্রমণ ক্ষমতার তীব্রতা এত বেশি, তার কারণ-
এটি শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমেই ছড়াতে পারে। নাক দিয়ে নিয়মিত বাতাস আমরা ফুসফুসে চালান করে থাকি এবং বেরও করে দিই। আক্রান্ত মানুষের শরীর থেকে সুস্থ মানুষের শরীরে যেতে গেলে এই নিশ্বাসের বাতাসটুকুই যথেষ্ট। আক্রান্ত ব্যক্তি হাঁচলে কাশলে তো আর কথাই নেই। আরও কিছুদূর এটি সহজেই ছড়াতে পারে। এটির জিনগত বস্তুটি বেশ ভারী, এযাবৎ যত RNA ভাইরাসের কথা আমরা জানি, তাদের মধ্যে সবচাইতে ভারী। ভারী বলেই এটি বেশিদূর যেতে পারে না, থিতিয়ে পড়ে।
আমাদের শরীর যে জলত্যাগ করে, তার মধ্যে এই নিশ্বাসের বাতাসও একটি মাধ্যম। একে বলে ‘ইনসেন্সিবল ওয়াটার লস‘। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণা নিশ্বাসের সাথে বেরোয়। শীতকালে ভোরের দিকে নাকমুখ দিয়ে ধোঁয়ার মতো যে বাষ্প বেরোতে দেখি, তা আসলে ঐ জলকণাই। হাঁচি কাশির সাথেও এই জলকণা বেরোয়। এদের বলে ‘ড্রপলেট‘। ভাইরাস এই ড্রপলেট আশ্রয় করে বেশকিছু সময় বাতাসে ভেসে থাকতে পারে। সামনের কোনও জায়গায় থিতিয়ে পড়ে থাকে। নভেল করোনাভাইরাস এই জায়গাটাতেও বেশ চালিয়ে খেলতে পারে। শরীর থেকে বেরোনোর পর আর পাঁচটা ভাইরাস বেশিক্ষণ জ্যান্ত থাকতে পারেনা। নভেল করোনাভাইরাস পারে। কার ওপর পড়ল সেটি গুরুত্বপূর্ণ। জায়গাভেদে (যেমন প্লাস্টিক) এটি তিনদিন অব্দি বেঁচে থাকতে পারছে, সংক্রমণক্ষম থাকছে। তাই হাঁচি, কাশি, নিশ্বাস এড়াতে পারলেও স্পর্শের মাধ্যমে সংক্রমণ এড়াতে পারছেন না অনেকে। নিজেদের অজান্তেই।
২. এখন প্রশ্ন হল, এই যে ভারত সরকার ২১-দিন লকডাউন ঘোষণা করেছেন, এটাই কি ভাইরাসের সংক্রমণ এড়ানোর পক্ষে যথেষ্ট?
উত্তর খুব সোজা। লকডাউনের উদ্দেশ্য ভাইরাসের সংক্রমণ আটকানো নয়। ভাইরাসের সংক্রমণ এইভাবে আটকানো যায়না। এটি মূলত ভাইরাস সংক্রমণ হারকে কিছুদিনের জন্য কমিয়ে রাখতে সাহায্য করবে। মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে প্রশ্বাস নিশ্বাসের চক্র সচল রাখতেই হবে। নভেল করোনাভাইরাসের (Novel coronavirus) সংক্রমণ এড়াতে হলে হয় মানুষকে শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ রাখতে হবে নয়তো বিশেষ ধরনের মুখোশ (N-95) এবং বিশেষ ধরনের পোষাক আশাক পরতে হবে (PPE– Personal Protection Equipment)। যা একযোগে নিয়মিতভাবে এই দেশের সবাইকে পরিয়ে রাখা কার্যত অসম্ভব। অযৌক্তিকও।
৩. তবে কেন সরকার এই লকডাউন ঘোষণা করেছেন?
এর উত্তরও সরলসোজা। মূলত সময় কিনতে। সময় এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং চীনের মিলিজুলি লুকোচুরি খেলায় বেশ কিছুটা সময় নষ্ট হলেও, সরকারি তরফে আগাম ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু গাফিলতি থেকে গেছে। সাতই জানুয়ারি যখন প্রথম চীন জানাল যে এটি একটি মানুষ থেকে মানুষ সংক্রমণক্ষম মহামারী, তখনও আমরা কিছুদিন চুপচাপ থেকে গেছি। এখন সময় কিনতে হবে এই কারণেই যে, সম্ভাব্য মহামারী আর সম্ভাবনার স্তরে নেই। এটি ঘোরতর বাস্তব। দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো এর মোকাবিলায় তৈরি নয় মোটেই, কোনও দেশের পক্ষেই এই বিপুল পর্যায়ের সংক্রমণের জন্য পুরোপুরি তৈরি থাকা সম্ভবও নয়। এই তৈরি হতে ন্যূনতম যে সময়টুকু এখন আমরা ব্যয় করতে সক্ষম, সেই সময়টুকুই লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। যাতে সংক্রমণ বেলাগাম দুদ্দুড়িয়ে দৌড়ে সব প্রাচীর বেড়া টপকে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে না যায়। ইতিমধ্যে আমাদের অতিরিক্ত বেড, দরকারি পরীক্ষা নিরীক্ষার কিট, ভেন্টিলেটর, নিরাপদ পোষাকআশাক, প্রশিক্ষিত কর্মী নিয়োগ ইত্যাদির ব্যবস্থা করে ফেলতে হবে। অতি দ্রুত।
৪. সংক্রমণ এড়ানোর তাহলে কি কোনও উপায়ই নেই?
সংক্ষিপ্ত উত্তর হল -না, নেই। যদি না ভাইরাসটি এতগুলি প্রাণীহত্যায় লজ্জিত হয়ে একযোগে গণআত্মহত্যা করে, তবে অন্য কথা। নইলে এটি কমপক্ষে আগামী একটি বছর ছড়াতে থাকবে, রোজ কিছু মানুষ সংক্রামিত হতে থাকবেন। যেদিন থেকে ভাইরাসটি এ্যানথ্রোপোনেটিক (মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণক্ষম) হিসেবে প্রমোশন পেয়েছে, মানুষের ভবিতব্য সেদিনই স্থির হয়ে গেছে।
ভ্যাকসিন অর্থাৎ টিকা বের হলে এই কষ্ট থাকবে না। টিকা তৈরির প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষও। ভাইরাসের জেনেটিক বস্তুটির (যা এক্ষেত্রে পজিটিভ সেন্স সিঙ্গল স্ট্র্যান্ড RNA) একটি ক্ষুদ্র টুকরোকে ল্যাবরটরিতে জিন সিকোয়েন্স মেনে তৈরি করতে হবে, যার এ্যান্টিজেনিসিটি থাকবে কিন্তু প্যাথোজেনিসিটি থাকবে না। অর্থাৎ বাইরের বস্তু হিসেবে শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেয় তা দেবে, কিন্তু ঐ বাইরের বস্তুটির রোগ সৃষ্টির কোনও ক্ষমতা থাকবে না। একটি বাইরের বস্তু (এ্যান্টিজেন) শরীরে ঢুকলে শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হল সেই বস্তুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে সক্ষম একেবারে সুনির্দিষ্ট এ্যান্টিবডি তৈরি। অতএব টিকা শরীরে ঢোকালে মূল ভাইরাসের সংক্রমণে শরীর আর ঐ পূর্বপরিচিতির অভাব অনুভব করবে না। শত্রুকে চিনতে তার আর দেরি হবে না। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি করে উঠতে কমপক্ষে একটি বছর লাগবে। এটিও এক্ষেত্রে কম, কারণ এটি এক পাকের RNA তন্তু। দুই পাকের (ডাবল স্ট্রান্ডেড RNA বা DNA ভাইরাস) হলে টিকা তৈরিতে কমপক্ষে তিনবছর সময় লাগার কথা।
৫. কত মানুষ এই দেশে আক্রান্ত হতে পারেন?
এই ধরনের অনুমান খুবই হতাশাব্যঞ্জক শোনাতে পারে। এই দেশের একশো চল্লিশ কোটির সকলেই এখন এর আওতায় রয়েছে। শুধু এই দেশ কেন, সারা বিশ্বই এর আওতায়। সকলের কাছেই এটি নতুন। ফলে একে মোকাবিলার পূর্বঅভিজ্ঞতা কোনও মনুষ্য শরীরেই নেই। কোনও প্রতিষেধক ব্যবস্থা এই মুহূর্তে নেই, আগামী একবছরের মধ্যে তেমন কিছু কার্যকরী ব্যবস্থা বাজারজাত হবার সম্ভাবনাও নেই। ফলে, সম্ভাব্য আক্রান্তের সংখ্যা অনুমান না করাই ভালো। মৃত্যুর হার এক শতাংশতে আটকে রাখতে পারলেও, তা আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার এক অভাবনীয় সাফল্য হিসেবে গণ্য হবে।
৬. হতাশ হতেই হচ্ছে, তবে কি আমরা এর হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারবো না কোনওভাবেই? সরকারি ব্যবস্থা কি সঠিক পথে এগোচ্ছে?
না, হতাশ হওয়ার কিছু নেই। দেখুন ভাইরাসটি মারাত্মক, যেহেতু সেটি এক্কেবারে নতুন, এবং অতীব সংক্রমণক্ষম। কিন্তু তারও কিছু দুর্বলতা আছে। ভাইরাসটির শরীর যেহেতু স্নেহপদার্থ দিয়ে তৈরি (দয়া মায়া স্নেহ – সেই স্নেহ নয়, নিতান্তই লিপিড), তাই ওটি মামুলি সাবানের স্পর্শেই অক্কা পাবে। ‘ডিসপোজেবল মাস্ক‘ সঠিক বিধি মোতাবেক পরে থাকলে, নিয়মিত ব্যবধানে সাবান দিয়ে কনুই অব্দি হাত ভালো করে ধুতে থাকলে, করমর্দন, চুম্বন ইত্যাদি এড়িয়ে চলতে পারলে – মোটামুটি প্রচলিত স্বাস্থ্যবিধি খানিকটা কঠোরভাবে মেনে চলতে পারলে সংক্রমণ এড়িয়ে থাকা যাবে বৈকি।
সাথে অবশ্যই জীবনশৈলিগত পরিবর্তন আনা জরুরি। ধূমপান ছাড়তে হবে। ফুসফুসকে দুর্বল হতে দিয়ে লাভ নেই। দুর্বল ফুসফুস ভাইরাসের সাথে লড়াইয়ে আপনাকে পিছিয়ে দেবে অনেকটাই। মদ্যপানও নৈব নৈব চ।
এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে রাখতে হবে। বলা সহজ, করা কঠিন। পুষ্টিকর, সুষম আহার, এবং নিয়মিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে অনেক সাধারণ অসুখবিসুখ এড়িয়ে থাকা যায়। এই সাধারণ অসুখবিসুখই আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় অনেকটাই। সেই সময় ভাইরাসের সংক্রমণ প্রাণঘাতী হতে পারে।
ভাইরাসে আক্রান্ত হলেই মৃত্যু, ব্যাপারটি মোটেই এমন নয়। মৃত্যুর হার অন্যান্য মারণ ভাইরাসের তুলনায় নগণ্য। মারবার্গ ভাইরাস আক্রান্তের মৃত্যুহার যেখানে নব্বুই শতাংশ, ইবোলা যেখানে আক্রান্ত মানুষের পঞ্চাশ থেকে সত্তর শতাংশকেই নিকেশ করে, করোনাভাইরাসে মৃত্যুহার সেখানে পাঁচের নীচে এখনও অব্দি। সমস্ত আক্রান্তকে তথ্যের আওতায় আনা গেছে কিনা- এই নিয়ে বিতর্ক চলছে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে করোনাভাইরাসে মৃত্যুহার অনেক অনেক কম হবে।
যাই হোক, কমপক্ষে পঁচানব্বই শতাংশ আক্রান্ত মানুষই সুস্থ হয়ে উঠছেন। বিশ্বের সমস্ত বিজ্ঞানী, বড় বড় প্রতিষ্ঠান যেভাবে রাতদিন এক করে কাজে নেমে পড়েছেন তাতে আজ নয় কাল একটি ফলপ্রসূ চিকিৎসার হদিশ আমরা পেয়ে যেতে পারি। সেক্ষেত্রে এই মৃত্যুহার আরও কমে আসবে নিশ্চিতভাবেই।
দেশের সরকার সামান্য দেরিতে গা ঝাড়া দিয়ে উঠলেও, সঠিক পথেই চলেছে। পদক্ষেপ লঘু কিন্তু পথ সঠিক। এখন প্রতিটি জেলাস্তরে টার্সিয়ারি স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবস্থা অতি দ্রুত করে ফেলতে হবে। স্পেশালিটি হাসপাতাল। মূল সমস্যা, দক্ষ কর্মীর অভাব। স্বাস্থ্য পরিষেবায় বিপুল সংখ্যক কর্মী চাই আগামী একবছর। এবং তার সাথে চাই কর্মী নিরাপত্তা।
তাছাড়া প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি যেমন ভেন্টিলেটর ইত্যাদি, স্বাস্থ্যকর্মীদের উপযুক্ত পোশাকআশাক, টেস্টকিট ইত্যাদি মজুত করে ফেলতে হবে যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। প্রচুর মানুষ আক্রান্ত হবেন, যার উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরি না করে ফেলতে পারলে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারি তৎপরতার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে। মেনে চলতে হবে সরকারি নির্দেশিকা। লড়াইয়ে হারজিত থাকবেই। পরিকল্পনা করে যুদ্ধে নামা যাক, হারলেও ক্ষোভ থাকবে না। আবেগের লড়াই, বুক ঠুকে বড়াইয়ের সময় এ নয়।
৭. চীন সাহায্য করতে চাইছে, আমরা কি ওদের সাহায্য নেব?
চীন (China) সাহায্য করতে চাইছে, ঠিকই আছে। কিন্তু দেখতে হবে ওদের সাহায্য করার ক্ষমতা কতটুকু। ওরা নিজেদের রপ্তানিবাণিজ্যকে টিকিয়ে রাখতে বহু মিথ্যে বকেছে, পরিসংখ্যানে কারচুপি করছে আজও। ওদের বিশ্বাসযোগ্যতা আজ তলানিতে ঠেকেছে।
যতগুলি দেশ এই লড়াইয়ে সামিল হয়েছে, আদর্শ হিসেবে ধরলে, ধরতে হয় জার্মানি এবং দক্ষিণ কোরিয়াকে। প্রথমটি রোগনির্ণয়কে প্রাথমিক গুরুত্ব দিয়েছে। বিপুল সংখ্যায় ওরা পরীক্ষা নিরীক্ষার আওতায় এনেছে দেশের নাগরিকদের। তার সুফল ওরা পেয়েছে। মৃত্যুহার নগণ্য ওদেশে। দক্ষিণ কোরিয়া অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ভাইরাস সংক্রমণের হদিশ করছে। নিবিড় গবেষণা করছে রোগটি নিয়ে।
আমাদের নিজেদের মতো করে গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে। জিন সিকোয়েন্সিং চীনের বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে করে ফেলেছেন, সকলের কাছে সেটি পৌঁছেও গেছে। রোগ প্রতিষেধক এবং রোগের ওষুধ তৈরিই এখন চ্যালেঞ্জ। তার চাইতেও বড় চ্যালেঞ্জ, আসন্ন বিপুল সংখ্যক সম্ভাব্য ফুসফুস সংক্রমণ নিয়ে আসা রুগীকে বাঁচানো। সেই চেষ্টায় যেন কোনও ত্রুটি না থাকে।