প্রশ্ন হল যে মানবাধিকার বা Human Rights নিয়ে সমগ্র পৃথিবী জুড়ে বাদ-বিসংবাদ লেগে থাকে প্রতিনিয়ত তা সর্বশেষে মানুষের উপকারে আসে কতটা। অবশ্যই সমীচীন এই প্রশ্ন, অতীব গুরুত্বপূর্ণও বটে কারণ তা একজন মানুষ ও রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ করে, তার নিজের স্বার্থও। রাষ্ট্রের কতটা অধিকার থাকে একজন মানুষের উপরে তার জীবনধারণ ও মনোবৃত্তি সমেত তাও এক অন্বেষণের বিষয়। এহেন বক্তব্য আলোচনাচক্রে উত্থাপিত হলেই প্রথম উত্তর উপস্থিত হয় এরূপ – তা একান্তভাবেই নির্ভর করে রাষ্ট্রের চরিত্রের উপরে। অবশ্যই এরূপ উত্তর যথার্থ; গণতন্ত্র থেকে একনায়কতন্ত্র, সামরিক প্রভৃতি রাষ্ট্র চরিত্রের মধ্যেই নিহিত থাকে একজন ব্যক্তির অস্তিত্ব ও তার জীবনবোধ। প্রশ্ন – তাহলে একটি কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীন কাঠামোয় মানবাধিকারের স্থান কি; অন্যদিকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কম্যুনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় এলে স্থানীয় অঞ্চলে মানবাধিকারের অবস্থান কি হয়। এ প্রসঙ্গে মাও-সে-তুংয়ের ঐতিহাসিক মন্তব্য “Our principle is that the Party commands the gun, and the gun must never be allowed to command the Party” [Problems of War and Strategy” (November 6, 1938), Selected Works, Vol. II, p. 224.] প্রণিধানযোগ্য। পার্টিই সর্বোচ্চ, ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্ন, তাই party diktat না মানা profanation/অমার্জনীয় অপরাধের মধ্যেই পড়ে, শাস্তিরূপে মৃত্যু অতি সামান্য ব্যাপার। অতএব, কম্যুনিস্ট প্রেক্ষাপটে মানবাধিকার/human rights পার্টির উপরেই তা নির্ভর করে। To overcome our enemies we must have our own socialist militarism. We must carry along with us 90 million out of the 100 million of Soviet Russia’s population. As for the rest, we have nothing to say to them. They must be annihilated.” – Grigory Zinoniev [The Cheka: Lenin’s Political Police by Leggett, George (1986)] এবং জিনোনিয়েভ ১৯৩৬ সালে স্তালিন ও NKVD -এর The Great Purge এ নিহত হন।
দীর্ঘ ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট তথা সিপিআইএমের (CPIM) একচ্ছত্র শাসনে এর অন্যথা দেখা যায়নি। মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ পদদলিত হয়েছে বারংবার, জাতীয়তাবোধে উদ্দীপ্ত প্রত্যেকেই, কি ব্যক্তি বা সংগঠন, ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, ন্যায় থেকে গেছে অধরা। ৩০শে এপ্রিল, ১৯৮২ সালে কলকাতার উপকণ্ঠে সংগঠিত ১৬জন আনন্দমার্গী সন্ন্যাসী ও ১ জন সন্ন্যাসিনীর বর্বরোচিত হত্যা তার শীর্ষতম বললে অত্যুক্তি হয় না।
সভ্য সমাজে এই প্রকার নৃশংসতম হত্যাকান্ড ঘটে কি করে? ১৯৮২ সালের মতো একই প্রশ্ন ২০২০তেও গুঞ্জরিত হয়, ন্যায়ের বাণী নীরবে, নিভৃতে কাঁদে এখনও বিচারের অপেক্ষায়। প্রায় ৪০ বছর পরে কাঙ্খিত বিচার হবে কিনা, কি প্রকারে তাও জানা নেই কিন্তু ক্ষতটি রয়ে গেছে চিরতরে, রক্তক্ষরণ হয় প্রতিনিয়ত।
সেইদিন কি ঘটেছিল? প্রত্যুষ না হলেও প্রভাত তো বটেই। সময় সকাল সাড়ে সাতটা, বালিগঞ্জ অঞ্চলের বিজন সেতুতে ঘটে প্রলয়ংকর কান্ড; অতি সক্রিয় কম্যুনিস্ট হস্তক্ষেপে নিহত হলেন ১৭ জন সন্ন্যাসী, সন্ন্যাসিনী। কিছু বোঝার আগেই একটি ট্যাক্সির ওপর ঝাঁপিয়ে পরে সিপিআইমের কর্মী, সমর্থকবৃন্দ। টেনে-হিঁচড়ে বার করা হয় গৈরিক বস্ত্রধারী একদল মানুষকে। এবং সভ্য জগৎকে স্তম্ভিত করে, জনসমক্ষে তাঁদের উপর চলে পাশবিক অত্যাচার। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, শাবল দিয়ে মাথা ফাটিয়ে, ছোরা দ্ধিকে চোখ উপড়ে তাঁদের জ্বালিয়ে দেওয়া হয় পেট্রল ও অ্যাসিড সহকারে। অবশ্যই ওই বীভৎসতায় আঁতকে উঠে পালিয়ে গিয়েছিলেন বহু মানুষ। কিন্তু বীভৎসতাটি ঘটে এতো দ্রুততা সহকারে যে মানুষ কিছু বোঝার আগেই দেখে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন একপ্রকার।
এটি অবশ্যই মনে রাখতে হবে, কমপক্ষে প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে চলেছিল এই হত্যালীলা কিন্তু তার মধ্যে পুলিশের কোন আধিকারিককে উঁকি মারতেও দেখা যায়নি, প্রশাসনের হস্তক্ষেপ দুরে থাক। শুধুমাত্র স্থানীয় অঞ্চলে ছেলেধরার প্রকোপ উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়ছে আর তা প্রতিহত করার জন্যে কয়েকশ সশস্ত্র জনতা অপেক্ষা করছে একটি ট্যাক্সির আর তারপর সেই ব্যক্তিদের জনসমক্ষে গাড়ি থেকে নামিয়ে তাদের খুন করে দেহে অ্যাসিড ঢেলে দিচ্ছে, এইরকম একটি বক্তব্য যে সর্বভাবেই যুক্তিহীন তা নতুন করে বলে দিতে হয়না। আশ্চর্জনকভাবে, এই গণহত্যা সংক্রান্ত পাঁচটি মামলা হলেও মূল অভিযুক্তদের নাম পুলিশ নথিভুক্তই করেনি। অর্থাৎ lead প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ছিল স্পষ্ট।
যে প্রশ্নের উত্তর এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি তা হল – কেন? কি জন্যে সভ্য সমাজে এই বর্বরোচিত ঘটনা ঘটে? তা কি সাময়িক উত্তেজনার ফল (spontaneous reaction) না যবনিকার অন্তরালে রচিত কোন দীর্ঘস্থায়ী p পরিণতি? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, এর সূত্র পশ্চিমবঙ্গে নয়, ত্রিপুরাতে। ৭০–এর দশকের শেষার্ধেই ত্রিপুরা উপজাতি যুব সমিতির সক্রিয় আন্দোলনের পরেই সরগরম হয়ে ওঠে সে-রাজ্যের রাজনীতি আর তার প্রতিক্রিয়া রূপে দ্রুত আগমন হয় এক নতুন রাজনৈতিক সংগঠন “আমরা বাঙালী’-এর। আনন্দমার্গের (Anandamarg) প্রতিষ্ঠাতা শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকারের Progressive Utilization Theory (PROUT) -এর ভিত্তিমূলে প্রতিষ্ঠিত “আমরা বাঙালী“, যা অভিহিত হয়েছে PROUT-এর নিজস্ব website এ ভারতের জনসাধারণের গণআন্দোলন রূপে। এবং এই দুপক্ষের আন্দোলনে সমস্যায় জর্জরিত হয় সিপিআইএম। যে রাজনৈতিক সংঘৰ্ষ শুরু হয় ত্রিপুরাতে তার বলি হয় ১৯ জন। পরবর্তীকালে বিভিন্ন হিংসাত্মক ঘটনাবলীতে নিহত হন ১৮০০ ব্যক্তি, যাঁদের অধিকাংশই বাঙালী। তৎকালীন ত্রিপুরার এই সংঘর্ষপূর্ণ রাজনীতির কোন প্রতিফলন যাতে আর এক বাঙালী অধ্যুষিত রাজ্য পশ্চিমবাংলায় না হয় তার জন্য অত্যধিক সক্রিয় ছিল সিপিআইএম।
পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা ঠিক কিরকম ছিল? উৎসুক পাঠকের এই সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তর পাওয়া প্রখ্যাত ইংরেজী পত্রিকা “India Today“-এর correspondent শ্রী সুমিত মিত্রর কলমে। ১৫ই জানুয়ারী, ১৯৮০ সালে এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয় শ্রী মিত্রর একটি ইংরেজী প্রবন্ধ – “West Bengal; Marxists on the Wane“….এই নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে তিনি লেখেন, “……However, the people have been alienated from the Marxists for much more than merely overdoing the campaign. The much publicised land reforms have only redistributed rural privileges instead of solving any of the basic problems. The panchayats are associated in the public mind with all kinds of nepotism and corruption.
sThe Marxists maintain that they will be able to garner all the poor men’s votes. But that may be just wishful thinking. Though the CPI-M has a large peasant organisation at Arambagh, its peasant front, Krishak Samiti, is often accused of partisanship. Said Manmatha Patra, a schoolteacher “Here you find two types of poor; the Krishak Samiti- poor, and the non-Krishak Samiti-poor.”…অর্থাৎ প্রথম থেকেই ভূমিসংস্কার ও সংকীর্ণতার হেতু, সরকারে আসীন হওয়া সত্ত্বেও বামফ্রন্ট, বিশেষত সিপিআইএম-র পথ ছিল কন্টকাকীর্ণ। বিরোধী রাজনীতির পারদ ক্রমশ বাড়ায়, ত্রিপুরার মতো পশ্চিমবঙ্গ অর্থাৎ বাঙালীদের বৃহত্তম ভূমি সমগ্র ভারতবর্ষে যাতে কোনভাবেই “আমরা বাঙালী” নামক কোন জাতিসত্তার আন্দোলনের খপ্পরে না পড়ে তাই প্রথমেই তার মূলোচ্ছেদ করতে দ্বিধা করেনি মার্কসবাদী নেতৃত্ব।
আর একটি বিস্ফোরক তথ্য পাওয়া যায় অবিভক্ত চব্বিশ পরগণার তদনীন্তন অতিরিক্ত জেলাশাসক শের সিংয়ের এক অকপট সাক্ষ্যাৎকারের মাধ্যমে, যা বর্ণিত রয়েছে শ্রী তুষার ভট্টাচার্যের “বিজন সেতু ১৯৮২” (Bijan Bridge 1982) নামা গ্রন্থে। তাঁর মতে, রাণী রাসমণির পরিবারের একটি জমির দখল নিতেই সিপিআইএম-এর একাংশের মদতে এই হত্যালীলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই জবরদখলের আইনি পরামর্শদাতা ছিলেন শ্রী সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, ব্যারিস্টার ও পরবর্তীকালে সিপিআইএম-এর শীর্ষ নেতৃত্বের অন্যতম ও লোকসভার স্পীকার। শ্রী সিং-এর মতে, তিনি এই গোপন ষড়যন্ত্রটি বিজন সেতুর হত্যাকাণ্ডের অন্তত তিন মাস আগে জানতে পেরেছিলেন এবং এটিই তাঁর কাল হয়েছিল। শুধু transfer নয়, তাঁকে suspend ও করা হয়েছিল।
……..গ্রন্থে বর্ণিত, “১৬ই জানুয়ারী…আমি উক্তি চিঠি পাই যা বাংলায় লেখা। চিঠিটি মন্ত্রী বিনয় চৌধুরীর ছিল – নির্দেশ ছিল ‘বিক্রি করছে, বন্ধ করতে হবে, নোটিশ দিতে হবে’ – কিন্তু চিঠিতে স্বাক্ষর করেননি। চিঠিটি নিজে হাতে ডিএম আমাকে দেন। ‘আনন্দমাগ্রী ওখানে উৎপাত করছে, জমি কিনছে, unnecessary কব্জা করছে। Please দেখুন।’
আমার প্রথম সন্দেহ শুরু হয় যে, চিঠি বাংলায় লেখা। মন্ত্রী বিনয় চৌধুরীর নামে এসেছে – অথচ মন্ত্রীর স্বাক্ষর নেই চিঠিতে। মন্ত্রী বিনয় চৌধুরী সব থেকে ভদ্রলোক বলে পরিচিত ছিলেন পশ্চিমবাংলায়।
চিঠিতে ছিল ‘বিক্রি করছে’ ‘বন্ধ করতে হবে’, ‘নোটিশ দিতে হবে’ – এটাই ছিল স্বাক্ষরহীন চিঠির নির্দেশের সারমর্ম।
আমি আমার অফিসে আসি – আমার পিএ-কে বলি যে মন্ত্রী বোধহয় চিঠিতে স্বাক্ষর করতে ভুলে গেছেন। কিন্তু জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাণু ঘোষ (Ranu Ghosh) এটা দেখেননি সেটা হতে পারে না। আমি সরকারী প্লিডারের সঙ্গে আলোচনা করি। তিনি তখন বলেন, এই সমস্যা যখন কসবা থানার অধীনে, তখন আপনি কসবা থানার ওসি-র কাছে বিস্তারিত জানতে চান। আমি সঙ্গে সঙ্গেই কসবা থানার ওসি-কে দ্রুত রিপোর্ট দেওয়ার জন্য জানাই। ওসি দুদিনের মধ্যে রিপোর্ট আমাকে পাঠান। তারিখ ছিল ১৮ই জানুয়ারী। রিপোর্টে জানালেন – ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার লোকের দুটো গ্যাং লাঠিসোটা বল্লম নিয়ে জমি দখলের প্রস্তুতি নিচ্ছে। জমি দখলকে কেন্দ্র করে গন্ডগোলের আশংকা রয়েছে। প্রাণহানির সম্ভাবনা আছে, সাময়িকভাবে পুলিশ দিয়ে মোকাবিলা করলেও ওখানে ১৪৪ ধারা জারি করা দরকার।
আমি আমারে সেক্রেটারীর সাথে বিস্তারিত আলোচনা করি এবং সঙ্গে সঙ্গে ১৪৪ ধারা জারির নির্দেশ দিই। তার কপি কসবা থানার ওসির কাছে পাঠাই। তারিখ ছিল ১৯শে জানুয়ারী, এটা ১৮ই হতে পারে। স্পষ্ট নির্দেশ ছিল ওই জমিতে ৪ জনের বেশী কাউকেই প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। এটা ৬০ দিনের জন্য করা হয়েছিল।
জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (রাণু ঘোষ) আমাকে জানালেন – ‘আমার সঙ্গে আলোচনা না করে কি করে আপনি ১৪৪ ধারা জারি করলেন?’ আমি তাঁকে বললাম – ‘আমি আমার পদের অধিকার থেকেই এটা করেছি। কোন জায়গাতে কেউ যদি জীবন ও সম্পত্তি নিয়ে নিরাপত্তার অভাব বোধ করে, যদি তদন্ত করে দেখা যায় ঘটনার সত্যতা রয়েছে, তা সে যে কোন জায়গাতেই হোক না কেন – সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করা যাবে না কেন? আমি এখানে তদন্ত করে দেখেছি, দেখার পরেই ১৪৪ ধারা জারি করেছি। ‘
আমি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রতিনিধি। আমার জনস্বার্থের দিকটাই দেখবার দায়িত্ব, কোন পার্টির বা রাজনীতির স্বার্থ দেখাটা আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। যার ফলে আমাকে ট্রান্সফার করে দেওয়া হয়। আমি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাণু ঘোষের সাথে আলোচনা করি। তাকে জানাই জমি দখলকে কেন্দ্র করে ৫-৬জন লোক খুন হয়ে যেতে পারে। উনি জানালেন — ‘এটা পশ্চিমবঙ্গ, এখানে তেমন কিছু হবেনা। এরপরই তিনি আমাকে ট্রান্সফার অর্ডার ধরিয়ে দেন।
যখন ৩০শে এপ্রিল ঘটনাটা ঘটে যায় এরপর দিন আমি ১লা মে জিজ্ঞেস কর, ‘আমি তো বলেছিলাম ৫-৬ লোক খুন হবে – এখন কি হল, কতজন আমরা গেল?’ তখন আমার কথাকে এড়িয়ে গিয়ে বললেন – ‘ও-সব ছাড়ুন। যান, চা-টা খান।’
১৭ জন মারা গেল। আমার অনুমান যে ১০০ শতাংশ সঠিক ছিল, তা প্রমাণিত হল।
১৯শে জানুয়ারী, ১৯৮২ তে মন্ত্রী বিনয় চৌধুরীর রাইটার্স বিল্ডিংয়ের ঘরে আলোচনা হয়। সেখানে এম এল এ ক্ষুদিরাম ভট্টাচার্য আমাকে হুমকি দিয়ে বলেন, ‘ আমি ১০ হাজার লোক নিয়ে জমি দখল করব। আপনি কি করে সেটা ঠেকান সেটা আমি দেখবো। ‘
আমি তখন মন্ত্রী বিনয় চৌধুরীকে বলি – ‘এটা আলোচনার মিটিং, এখানে এ ধরণের কথাবার্তা বলে সমাধান সূত্র পাওয়া সম্ভব?’ তখন বিনয় চৌধুরী এম এল এ ক্ষুদিরাম ভট্টাচার্যকে বলেন, ‘তুমি বোসো তো। এ রকম কথা বলতে নেই, অসভ্য কথা বলতে নেই।’
আমি রাণু ঘোষকে বলি মন্ত্রীর ঘরে আলোচনার বিষয়বস্তু। একজন অ্যাসেম্বলি সদস্য তিনি বলেছেন – ‘১০ হাজার লোক নিয়ে যাবো – যদি কেউ বাধা দিতে আসে তাকে কচুকাটা করব। ‘ তখন রাণু ঘোষ বলেন, – ‘ ও ওরকমই বলে, হাইপারটেনশন আছে তাই ঐ ভাবে কথা বলেন। হাই ব্লাড প্রেশারের রোগী, আপনি কিছু মনে করবেন না।’
আনন্দমার্গীদের হত্যার পর জ্যোতি বসুকে প্রশ্ন করা হয়েছিল – ‘আপনি ঘটনাস্থলে যাবেন কি না?’ তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ওখানে গিয়ে কি করব?’
আবার এই জ্যোতি বসুই রাইটার্সে সাংবাদিকদের সামনে বলেছিলেন, ‘আনন্দমার্গীরা সিপিআইএম কে দোষী সাব্যস্ত করছে – এম এল এ শচীন সেন যদি ১০ হাজার লোক নিয়ে যায় সেটা কি ভালো হবে?’
এই ‘১০ হাজার লোক’ নিয়ে যাবার কথাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এই কথাটা জ্যোতি বসু, ক্ষুদিরাম ভট্টাচার্য, শচীন সেন – তিনজনেই ব্যবহার করেছেন। …….একটা ঘটনা, আমাকে সরিয়ে দেওয়ার পর সেখানে জহর সরকারকে আনা হয়। রাণু ঘোষ জহর সরকারকে দিয়ে আমার সমস্ত ফাইল ঘেঁটে কাগজপত্র এদিক ওদিক করে দেয়। গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত চিঠিপত্র, দলিল পুড়িয়ে দেয়। ………….
পরবর্তী অধ্যায়? বিজন সেতুর এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে আনন্দমার্গীদের পক্ষ থেকে কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় পথসভার আয়োজন করা হয়৷ কিন্তু সিপিআইএম নেতৃত্ব তথা ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট পুলিশের উপর চাপ সৃষ্টি করে মাইক কেড়ে নিয়ে, জনসভার উপর ঘোড়া ছুটিয়ে, বেপরোয়া লাঠিচার্জ করে তা ভেস্তে দেয়. গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিকে ধ্বংস করে। ৩০শে এপ্রিলের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী সমাজের একাংশ প্রতিবাদও করেছিলেন সোচ্চারে। কলকাতা সহ রাজ্যের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের আহ্বান করেছিলেন তাঁরা এই ডাক দিয়ে – এইবারের ২৫শে বৈশাখ হোক অনুশোচনা ও প্রায়শ্চিত্তের ২৫শে বৈশাখ। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্বে একটি মৌন মিছিল দেশপ্রিয় পার্ক থেকে বিজন সেতুতে হত্যার স্থল পর্যন্ত যান। সেখানে ১৪৪ ধারা বলবৎ থাকায় পুলিশ মিছিলের পথরোধ করে। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আশাপূর্ণা দেবী, মৈত্রেয়ী দেবী, অন্নদাশঙ্কর রায়, অম্লান দত্ত, গৌরকিশোর ঘোষ, সৌমেন বসু, বিনয় দাশগুপ্ত, নির্মল বসু, গৌরী আয়ুব, অধ্যাপক নির্মল ভট্টাচার্য এবং আরও ৫০ জন মহিলা সহ প্রায় ৪০০ লোক। শারীরিক অসুস্থতার জন্য শ্রী সত্যজিৎ রায় উপস্থিত থাকতে পারেননি। বামফ্রন্ট সরকার এই মৌন, ধিক্কার মিছিলে মাইক ব্যবহার করার অনুমতি দেয়নি। বরং তাঁদের কটাক্ষ করে সিপিআইএম সুপ্রিমো প্রমোদ দাশগুপ্ত বলেছিলেন, “আমাদের দুঃখ ও ক্ষোভ হয় যখন দেখি আনন্দমার্গীদের জন্য বুদ্ধিজীবীদের শোক উথলে উঠছে৷” এই কথারই পুনরাবৃত্তি হয়েছিল নন্দীগ্রাম-নেতাই গণহত্যার পর, ন্যূনতম অনুশোচনার পরিবর্তে।
পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অক্টোবর, ২০১৩ সালে জাস্টিস অমিতাভ লালা কমিশন নিযুক্ত করেন ১৯৮২ সালের গণহত্যার তদন্ত করতে। কিন্তু প্রায় ৭ বছর কেটে গেলেও তাতে উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি ঘটেনি।
পরিশেষে, ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে Red Terror বা লাল সন্ত্রাস সৃষ্টি কম্যুনিস্ট শাসনতন্ত্রের এক অপরিহার্য অংশ। অপেক্ষাকৃত অখ্যাত মার্টিন ল্যাস্টিস ছিলেন সোভিয়েত রাজনীতিবিদ ও ইউক্রেইনের Cheka -এর deputy chief। ১৯১৮ সালে Red Terror-এর সমর্থনে ল্যাস্টিস বলেছিলেন, “We are not fighting against single individuals. We are exterminating the bourgeoisie as a class. Do not look in the file of incriminating evidence to see whether or not the accused rose up against the Soviets with arms or words. Ask him instead to which class he belongs, what is his background, his education, his profession. These are the questions that will determine the fate of the accused. That is the meaning and essence of the Red Terror.” (See No Evil: Literary Cover-ups and Discoveries of the Soviet Camp Experience – Dariusz Tolcyzk)..কিন্তু নভেম্বর ২৯, ১৯৩৭ সালে Latvian Operation-এর সময় NKVD দ্বারা প্রতিবিপ্লবী অভিযোগে ল্যাস্টিস গ্রেপ্তার হন; ফায়ারিং স্কোয়াডের গুলিতে নিহত হন ১৯৩৮ সালে। এটি কি ভাগ্যের পরিহাস না কৃতকর্মের ফল?
বলশেভিক বিপ্লবের অন্যতম শীর্ষ ব্যক্তি লিওঁ ট্রটস্কি ১৯৪০ সালে মেক্সিকোতে নিহত হন কম্যুনিস্ট ডিক্টেটর স্তালিন দ্বারা প্রেরিত ও NKVDএর রেমন মার্সেডার দ্বারা। বলা হয় Joseph Stalin was a hangman whose noose could reach across oceans. – কিন্তু সেটি মূলত মার্কসবাদী মতবাদ ও তার স্বৈরতন্ত্রের প্রতীক; এখানে ব্যক্তির পরিবর্তে মতবাদই একমাত্র বিবেচ্য – যেখানে স্বাধীন চিন্তার অর্থ – মৃত্যু।
অনিমিত্র চক্রবর্তী (Animitra Chakraborty) – (একনিষ্ঠ সমাজকর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক)