৩০ই এপ্রিল, ১৯৮২, ১৭ জন গেরুয়াধারী সাধু সন্ন্যাসিনী কে লাঠিপেটা করার পর জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, কলকাতার প্রকাশ্য রাজপথে কয়েক হাজার মানুষের সামনে দিনের আলোয়। বিকৃতির কদর্যতায় স্তম্ভিত হয়েছিল মানবতা। হতবাক হয়েছিল দুনিয়ার মানুষ। পুরুলিয়ার গড়জয়পুরের মহারানী প্রফুল্ল কুমারী দেবী (Prafulla Kumari Devi) আনন্দমার্গ আশ্রমের জন্য জমিদান করেছিলেন ১৯৬২ সালে। পুরুলিয়াতেই আনন্দমার্গীদের উপর ১৯৬৭ সাল থেকে ধারাবাহিক আক্রমণের সূচনা হয় ও তার চোরাস্রোত চলতেই থাকে। ৫ জন সন্ন্যাসীকে হত্যা করা দিয়ে শুরু হয় এই নরমেধ যজ্ঞ। হত্যা ও নোংরা বিরোধিতা করেও সাধুদের নিরন্তর সমাজ সেবা থেকে বিরত করা গেলনা। ১৯৭৮ এ আনন্দমার্গ আশ্রমের প্রধান কার্যালয় হিসাবে কোলকাতার তিলজলায় শুরু হয় নির্মাণ কার্য। অনেক ভাবে বাধা এল, কিন্তু সংসার ত্যাগী গেরুয়াবসন এগিয়ে চলার পথে অবিচল। ১০ই জুন, ১৯৭৯ সিপিআইএম এর তৎকালীন চেয়ারম্যান প্রমোদ দাশগুপ্ত লিখলেন, এই বিপদ রুখতে হবে। উনি আনন্দমার্গীদের বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ও আধা ফ্যাসিস্ত বলে উল্লেখ করলেন। ১৯৮২ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি, শনিবার বিকাল ৫ টার সময় তিলজলার পিকনিক গার্ডেন রোডে আনন্দ আরতি হলে সিপিআইএমের তরফে ডাকা হল নাগরিক কনভেনশন। প্রচার পত্রে বামেদের সেই চিরাচরিত ধাপ্পাবাজি ও বিকৃতি তুলে ধরা হল। লেখা হল বৈদেশিক শক্তির সহায়তায় দেশীয় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে চরম অস্থিরতা সৃষ্টির অপচেষ্টায় রত, প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের মধ্যে আনন্দমার্গ অন্যতম। আমরা মনে করি সাধারন মানুষের সামগ্রিক স্বার্থে, আনন্দমার্গীদের এই সন্ত্রাস সৃষ্টির অপচেষ্টার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ প্রয়োজন। এই প্রচার পত্রে ১১৭ জন আবেদনকারীর মধ্যে ছিলেন সোমনাথ চ্যাটার্জ্জী, সত্যসাধন চক্রবর্ত্তী, স্থানীয় বিধায়ক শচীন সেন, কান্তি গাঙ্গুলি, সাধন গুপ্ত প্রমুখ। প্রচার পত্রটি প্রকাশিত হয়েছিল কমঃ বাবলু চক্রবর্ত্তীর নামে। ৮ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৮২, গণশক্তিতে এই কনভেনশনের ছবি রিপোর্ট সহকারে ছাপা হল। রিপোর্টে লেখা হয়েছিল, কনভেনশন থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে আনন্দমার্গের ক্রমবর্ধমান অশুভ ও সন্ত্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রয়োজনে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
কিন্তু অজ্ঞাতেই থেকে গেল প্রতিরোধের রূপরেখা।
৩০ই এপ্রিল, ১৯৮২, তিলজলার প্রধান আশ্রমে আনন্দমার্গীদের বাৎসরিক ধর্ম সম্মেলন। দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাধু সন্ন্যাসীরা আসছিলেন আশ্রম প্রাঙ্গনে। অন্যদিকে আর এক প্রস্তুতি চলছিল সবার অলক্ষ্যে। ২৯ই এপ্রিল, নৃশংস ঘটনার ঠিক আগের দিন সন্ধ্যে বেলায় পার্টির ক্যাডাররা তিলজলা এলাকা জুড়ে মিছিল করল ছেলেধরা ছেলেধরা বলে চেঁচিয়ে। অনেকদিন ধরে একটু একটু করে সযত্নে ক্ষেত্র তৈরির কাজ সম্পূর্ণ হল।
তখনও ই এম বাইপাস তৈরি হয়নি। হাওড়া থেকে হতভাগ্য কিছু সাধু সন্ন্যাসিনী সদ্য সকালের আলোয় তিলজলার উদ্দেশ্যে ট্যাক্সিতে চাপলেন। এর কিছুক্ষণ পর এল সেই অশুভক্ষণ, যেই অশুভ মুহূর্তে সারা বিশ্ব দেখেছিল প্রাচ্যের ঐতিহ্য, ভারতীয় সংস্কৃতিকে ভুলুন্ঠিত হতে, দেখেছিল হ্রীংস্র শ্বাপদের তীক্ষ্ণ দাঁতনখ সম্বলিত ভয়ংকর কদর্য রূপ কিভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে ১৭ জন সংসার ত্যাগী গেরুয়াধারী সাধু সন্ন্যাসিনীদের পিটিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিল।
‘বন্দুকের নল ক্ষমতার উৎস’ এই বিকৃতির সার্থক রূপায়ণ ঘটে, যখন বামেদের জুতোয় পা গলাতে অস্বীকৃত তিলজলা থানার তৎকালীন ওসি গুণধর ভট্টাচার্যকে আততায়ীর হাতে গুলি খেয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়।
আগামী ৩০ই এপ্রিল, ২০২০ এই নরমেধ যজ্ঞের ৩৮ বছর পূর্ণ হবে অথচ আজও বিচারের বাণী নিভৃতে কেঁদে চলেছে। জ্যোতিবসুর প্রশাসনের চুড়ান্ত অসহযোগিতার কারনে ১৯৯৬ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এই বর্বরোচিত ঘটনার তদন্তে নেমেও এগোতে পারেনি। ঐতিহাসিক নরসিংহ শীলের মতে, এই অমানুষিক ঘটনার প্রতি সরকারের উদাসীনতা এটাই বলতে চায় যে ঐ হতভাগ্য সাধু সন্ন্যাসিনীরা নিজেরাই নিজেদের হত্যা করেছিলেন! এই নৃশংস গণহত্যালীলা চালানোর অপরাধে আজ পর্যন্ত একজনও গ্রেপ্তার হল না। অথচ ঐসব রক্তলোলুপ নরপিশাচরা আজও তাদের বিকৃত দর্শন নিয়ে বহাল তবিয়তে রাজনীতির ঘোলা জলে মাছ ধরতে উদগ্রীব। চুড়ান্ত হতাশা গ্রাস করলেও, দীর্ঘ ৪৫ বছর পর বঙ্গবন্ধুর খুনী আবদুল মাজেদের গ্রেপ্তারি ও ফাঁসি, এই বাংলার আপামর গনতন্ত্রপ্রেমী মানুষের মনে আশার প্রদীপ জ্বালিয়েছে।
ডঃ তরুণ মজুমদার (Dr. Tarun Majumdar)