ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে জাতীয়তার নবজাগরণ শুরু হয়ে রাজনৈতিক দিক থেকে তিলক যুগের আবির্ভাব হয়, তখন বাংলা জাতীয়তার ত্রি যোগের সৃষ্টি হয় বাংলার বুকে। সুরেন্দ্রনাথের কর্মযোগ, বিপিনচন্দ্র ও অরবিন্দের জ্ঞানযোগ এবং রবীন্দ্রনাথের সাধনায় দেশ প্রীতির ভক্তিযোগ। স্বদেশ ভাবনা ছিল তার পারিবারিক অবদান। দেবেন্দ্রনাথ ভারতবর্ষের জীবনাদর্শ ও সংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্বকে অব্যাহত রাখার জন্য তত্ববোধিনী পত্রিকার মাধ্যমে দেশবাসীকে খ্রিস্টান মিশনারীদের ধর্মান্তরণের বিপদ সম্বন্ধে সর্বদা সজাগ রাখার কাৰ্য্যে সচেষ্ট ছিলেন। জাতীয় জীবনের ব্যাপক সমস্যা বিষয়ে ঠাকুর পরিবার ছিল সদা জাগ্রত। এহেন পরিবেশে রবীন্দ্রনাথ যখন বৃদ্ধিলাভ করছিলেন তখন বঙ্গ সাহিত্যের জগতে আবির্ভূত হন বঙ্কিমচন্দ্র যিনি জাতীয়তা ও অধ্যাত্মিকতাকে সমানভাবে উপলব্ধি করেন। স্বদেশকে দশপ্রহরণী দুর্গারূপে বন্দেমাতরম মন্ত্রের মাধ্যমে তিনি দীক্ষিত করেন। হিন্দুত্বের আদর্শে ভবিষ্যৎ ভারত নির্মাণের এক মহান মন্ত্র তিনি প্রচার করেন। এই প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেননি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, তাই ১৮৯৬ সালে কংগ্রেস অধিবেশনে নিজস্ব স্বরলিপিতে তিনি গাইলেন বন্দেমাতরম গান এবং রচনা করলেন ‘অয়ি ভুবন মনমোহিনী। যে ঐতিহাসিক বোধ তার মনের মধ্যে জাগ্রত হয়েছিল তার থেকেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন আমাদের বিদেশি তোষণের কারণ। স্বদেশের গৌরবময় ইতিহাসের অজ্ঞানতা হেতু ভারতবাসীর মনে যে দাসত্ব ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে তা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন সেইজন্য ভারতবর্ষের ইতিহাস’ প্রবন্ধে লিখলেন—“আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা আমাদের চিরন্তন স্বদেশকে আমাদের দেশের ইতিহাসের মধ্যে খুঁজে পাই না। বাল্যকালেই দেশের ইতিহাসের মধ্যেই মানুষ তাদের দেশের পরিচয় পায় আমাদের ঠিক তার উলটো’ জাতীয় ইতিহাসের জ্ঞানের অভাবেই এবং রাজনৈতিক পরাধীনতার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসাবে সুউন্নত হিন্দু জাতি নিজেদের পরিচয় দিতে ভুলে গেছে এবং ভারতে কোনো জাতি নেই এহেন ইংরেজ প্রচারের শিকার হয়ে জাতি তৈরির কথা প্রচার করে আসছিল। মুক্ত চেতনা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ সেদিন ভারতের মূল জাতি যে হিন্দু সেকথা ঘোষণা করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। তিনি বলেছেন—“হিন্দু ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটি জাতিগত পরিণাম। ইহা মানুষের শরীর মন হৃদয়ের নানা বিচিত্র ব্যাপারকে বহু সুদুর শতাব্দী হইতে এক আকাশ, এক আলোক, এক ভৌগোলিক নদনদী অরণ্য পর্বতের মধ্য দিয়া অন্তর ও বাহিরের বহুবিধ ঘাত প্রতিঘাত পরম্পরার একই ইতিহাসের ধারা দিয়া আজ আমাদের মধ্যে আসিয়া উত্তীর্ণ হইয়াছে। (রবীন্দ্র রচনাবলি ১৩শ খণ্ড পৃঃ ১৭৫)
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এই জাতীয় পরিচয় দেবার বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনায় ভারতবাসী মাত্রকেই হিন্দু বলেছেন—হিন্দু খ্রিস্টান, হিন্দু মুসলমান, হিন্দুশাক্ত, হিন্দু ব্রাহ্ম ইত্যাদি নামে বিভিন্ন ধর্মমতাবলম্বী পরিচয় প্রদান করেছেন। হিন্দু পরিচয়কে যাঁরা হীন দৃষ্টিতে দেখেন রবীন্দ্রনাথ তাদের জন্য বলেছেন দেশের ধর্মস্থানকে, বন্ধুস্থানকে, জন্মস্থানকে কৃশ করিয়া কেবল ভোগস্থানকে স্ফীত করিয়া তুলিলে বাহির হইতে মনে হয় যেন দেশের শ্রীবৃদ্ধি হইতে চলিল। সেইজন্য ছদ্মবেশী সর্বনাশই আমাদের পক্ষে অতিশয় ভয়াবহ।
জাতীয় কর্মসূচীতে মুসলমানদের যুক্ত করে তারাও জাতীয় মূলস্রোতের আবির্ভূত এহেন কৃত্রিম ঐক্য তৈরির জন্য জাতীয় নেতৃত্বের অনেকেই নিজেকে হিন্দু বলতে লজ্জা করতেন এবং বর্তমানেও এহেন পরিবেশ বিদ্যমান। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিরোধ বিনষ্ট করার জন্য নিজের হিন্দু পরিচয়কে অস্বীকার করা যে জাতীয় মর্যাদার লক্ষণ নয় সে বিষয়ে কবি সজাগ ছিলেন। তিনি অভিমত প্রকাশ করেছেন—“হিন্দুর সাথে মুসলমানের যদি বিরোধ থাকে, তবে আমি হিন্দু নই বলিয়া সে বিরোধ মিটাইবার ইচ্ছা করাটা যে অত্যন্ত সহজ পরামর্শ বলিয়া শোনায়, তাহা সত্য পরামর্শ নহে। এই জন্যই সে পরামর্শে সত্য ফল পাওয়া যায় না। কারণ আমি হিন্দু নই বলিলে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধটা যেমন তেমনি থাকিয়া যায়, কেবল আমিই তাহা হইতে একলা পাশ কাটাইয়া আসি।
ইতিহাসের মহানস্রোতে হিন্দুত্বের বহুযুগব্যাপী বিভিন্ন ধারা একত্রিত হয়েছে। হিন্দুত্বের সংজ্ঞা তাই সময় ও কালানুযায়ী বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে। হিন্দুত্বের এই সর্বানুভূত স্বরূপ সম্বন্ধে কবির অনুভূতি হল—“জগতে হিন্দু জাতির জাতীয়ত্বের বন্ধন যেমন কঠিন, তেমনি শিথিল, ইহার সীমা যেমন দৃঢ় তেমনি অনির্দিষ্ট।
ইউরোপে জাতিগত উপাদানে রাজনৈতিক ঐক্যই সর্বপ্রধান। হিন্দুদের মধ্যে সেটা কোনোকালই ছিল না বলিয়া যে হিন্দুর৷ জাতিবদ্ধ নহে সেকথা ঠিক নহে। বৈদিক সময় হইতে পৌরানিকযুগ পর্যন্ত সুদীর্ঘকাল ধরেই শাস্ত্র এবং সংস্কার আচার এবং অনুশাসন হিন্দুদিগের জন্য এক বিরাট বিস্তৃত আবাস ভবন নির্মাণ করিয়াছে। কিন্তু কালক্রমে জাতির মধ্যে বিভিন্ন ভেদাভেদ দৃষ্টি হয়েছে এবং বৈদেশিক শাসনে এই জাতিভেদ শাসনের সহযোগিতায় মম্বান্তরে পরিণত হয়েছিল। এই জাতিকে সংঘবদ্ধভাবে পুনর্নির্মাণ করার জন্য তৎকালীন নেতৃত্বের কাছে তাঁর আহ্বান ছিল—‘এক্ষণে যিনি জড়ীভূত হিন্দুজাতির মধ্যে আচারে ব্যবহারে সমাজে ধর্মে অর্ঘ্যভাবের একটি বিশুদ্ধ আদর্শ স্থাপন এবং কৃত্রিম ক্ষুদ্র নিরর্থক বিচ্ছেদগুলি দূর করিয়া সমগ্র লোকস্তুপের মধ্যে একটি সজীব ঐক্য সঞ্চার করিয়া দেবেন তিনিই ভারতবর্ষের বর্তমানকালের মহাপুরুষ।
সুসমৃদ্ধ এক বিশাল জাতীয় জীবন রচনার ক্ষেত্রে তিনি সেজন্য আদর্শ ব্যক্তি হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন শিবাজীকে। তড়িৎ প্রবাহবৎ যে শিবাজীর মস্তিষ্কে দিব্য ভাবনার উদার হয়েছিল যে খণ্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারতকে এক ধর্মরাজ্য পাশে আবদ্ধ করতে হবে। স্বদেশ কাৰ্য্যার্থে শিবাজীর প্রাণোৎসর্গকে সত্য সাধন ও ভারতের শাশ্বত ‘ধর্ম’ বলে অবিহিত করেছেন। শিবাজী মহারাজের পুণ্য নামে শপথ গ্রহণের মাধ্যমেই দেশের সর্বাঙ্গীন উন্নতি হবে এহেন বিশ্বাস তাঁর মনে সুদৃঢ় হয়েছিল তাই তার ভবিষ্যদ্বানী হল—ভারতবর্ষে “এক ধর্ম রাজ্য” স্থাপিত হবে। পরবর্তীকালে কালান্তরে “হিন্দু মুসলমান” প্রবন্ধে ভারতবর্ষের সেই চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন তার আশা–“হিন্দু বৌদ্ধ মুসলমান খ্রীষ্টান ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে পরস্পরে লড়াই করিয়া মরিবে না—এইখানে তাহারা সামঞ্জস্য খুঁজিয়া পাইবে। সেই সামঞ্জস্য অহিন্দু হইবে না। তা ছাড়া বিশেষভাবে হিন্দু তাহার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যতই দেশ বিদেশের হউক তাহার প্রাণ, তাহার আত্মা ভারতবর্ষের।”
সত্যনারায়ণ মজুমদার
(লেখক প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক, শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক)