সিপিএম এর মত তৃণমূলও তাদের বাচার রাস্তা হিসেবে কেন্দ্রের বঞ্চনাকে হাতিয়ার করেছে l তাই একবার দেনা পাওনার হিসেব নিয়ে বসা যাক l দেখাযাক নরেন্দ্র মোদী সত্যিই বাংলা বিরোধী নাকি যা দিয়েছে তা আমরা নিতে পারিনি আমাদের দুর্বলতায় l বঞ্চনা রাজনীতি এর আগে এই রাজ্যের শাসক দলকে অনেক ডিভিডেণ্ড দিয়েছে l 1985-86 তে তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী পি ভি নরসিমা রাও সারা দেশে নবোদয় শিক্ষা ব্যাবস্থা চালু করলেন l জ্যোতি বাবু এই ব্যাবস্থাকে বুর্জোয়া শিক্ষা ব্যাবস্থা বলে পত্রপাঠ প্রত্যাখ্যান করলেন l বদলে বঙ্গেশ্বর চালু করলেন শিক্ষায় গণতন্ত্র l স্কুল স্তরে ভোট চালু করলেন স্কুল কমিটি নির্বাচনের লক্ষ্যে l বাংলা মিডিয়াম সরকারি স্কুল পরিণত হল লোকাল কমিটির অফিসে l সঙ্গে বিদায় করলেন ইংরেজি l গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষ খুশি হয়ে আরও বেশি ভোট দিয়ে ফিরিয়ে আনল উন্নততর বামফ্রন্ট সরকারকে l এরপর কেন্দ্রীয় প্রকল্প ও নীতি প্রত্যাখ্যানের একটা ধারাবাহিক প্রবণতা শুরু হল আর এই প্রত্যাখানের ডিভিডেন্ড পুরোটাই তুলেছেন জ্যোতি বাবুরা l আর মানুষ আরও খুশি হয়ে আরও উন্নততর বামফ্রণ্টের সন্ধান পেতে লাগলো l যে লাইসেন্স রাজ, কোটা রাজ, মাসুল সমীকরণের চিরজীবন বিরোধিতা করে এসেছে বামফ্রন্ট, সেই নীতির আমূল পরিবর্তনেও তারা কেন্দ্রের নরসিমা রাও সরকারের বিরোধিতা করে l কিন্তু বাঙলি বামেদের অতীতের ইস্তেহার ভুলে, আরও আরও উন্নততর বামফ্রন্ট গড়ার স্বপ্নে 34 বছর নিজের জীবনের উপর পরীক্ষা নিরীক্ষা করে গেছে l এরপরও JNNURM, NGRBA থেকে বহু ক্ষেত্রে বামেরা একই নীতি নিয়ে ভোটের বাজারের সাফল্য পেয়েছে l
তৃণমূল কংগ্রেসও সেই কেন্দ্রের বঞ্চনার রাজনীতির রাস্তাই নিয়েছেন l তাই এখানে গত ছয় বছরে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্পের বর্ণনা ও তাদের প্রতি রাজ্যে সরকারের ব্যাবহারকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করে একটা আলোচনা করা যাক l
এক, সর্বভারতীয় প্রকল্প, যা তিনি হয় সরাসরি গ্রহণ করেন নি, নয় ঘুরিয়ে না করেছেন l উদাহরণ :
- জনধন প্রকল্প
- প্রধানমন্ত্রী বীমা প্রকল্প
- প্রধানমন্ত্রী দুর্ঘটনা প্রকল্প
- আয়ুষ্মান ভারত
- এক দেশ এক রেশন কার্ড
দুই, কিছু কেন্দ্রীয় প্রকল্প যাকে নিজের নামে চালিয়েছেন
- নির্মল ভারত
- প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা
- প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা
ইত্যাদি
তিন, কিন্তু যা সবচেয়ে আশ্চর্যের তা হল কিছু বড় প্রকল্প যা এই রাজ্যকে গত 43 বছরের অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে পারতো এবং পরিযায়ী সমস্যা থেকে শহর থেকে গ্রাম সবাইকে মুক্তি দিতে পারতো, তার প্রত্যাখ্যান l গত ছয় বছরের এতো প্রকল্প সম্ভবত আর কোন রাজ্য পায় নি l সংসদে সৌগত রায়ের একটি প্রশ্নের উত্তরে নীতিন গতকারী বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ জমি দিলে রাজ্যের সব জাতীয় ও রাজ্য সড়ককে উনি সম্প্রসারণের সব টাকা দেবেন l কিন্তু সৌগতবাবু এর কোন উত্তর দিতে পারেন নি l যে প্রকল্পগুলি মোদী সরকার রাজ্যকে দিয়েছে এবং রাজ্য তা প্রত্যাখ্যান করে বঞ্চনার গল্প বলছে, তা হল,
- সাগরের গভীর সমুদ্র বন্দর
- মুম্বাই কলকাতা ফ্রেট করিডোর
- অমৃতসর কলকাতা ফ্রেট করিডোর
- ইস্টকোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোরিডোর
- লুধিয়ানা ডানকুনি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোরিডোর
- NH 34
- NH 35
- কলকাতা ও বাগডোগরা বিমানবন্দর সম্প্রসারণ
- কলকাতা কল্যাণী মেট্রো সহ আরও পাঁচটি মেট্রো প্রকল্প
এছাড়া কেন্দ্র যে কোন রাজ্য সড়কের সম্প্রসারণের জন্য অর্থ দিতে রাজি যা আগেই বললাম l কিন্তু সড়ক নির্মাণের ডিপিআর তো রাজ্য পূর্ত দপ্তরকেই কেন্দ্র সরকারের কাছে জমা করতে হবে l জমির সংস্থান করতে হবে রাজ্যকেই l
এছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারি নিজে বিশ্বব্যাংকের থেকে টাকা ধার করে প্রয়াগ থেকে বারাণসী হয়ে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত জাতীয় জলপথ -1 তথা গঙ্গা জলপথ তৈরি করে দিচ্ছে, যা এই রাজ্যের শিল্প, বাণিজ্য ও অর্থনীতির কাছে এক মৃতসঞ্জীবনী সুধা l
তাহলে রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল কেন কেন্দ্রের বঞ্চনার অভিযোগ নিয়ে সেই পুরোনো রাজনীতিকে কবর থেকে তুলে আনছে?
এক, কারণ ব্যর্থতা ঢেকে রাজনৈতিক ফায়দা কিভাবে এই কেন্দ্রের বঞ্চনাকে ঢাল বানিয়ে তোলা যায়, সেই রাস্তা সিপিএম এর মধ্যেই দেখিয়ে গেছে l একসময় বিধান রায়, প্রফুল্ল সেনরা আন্তর্জাতিক আইন ভেঙে যে রাজ্যকে ফারাক্কা, তিস্তার মত প্রকল্প নিয়ে আসার পরও তাদের বাঙালী বিরোধী বলে 34 বছরের ব্যর্থতা ঢাকতেন জ্যোতিবাবুরা l
দুই, উপরোক্ত প্রকল্পগুলিতে কেন্দ্রের অনুদানের সঙ্গে রাজ্যকেও একটা ম্যাচিং গ্রান্ট দিতে হয় l যেকোন রাজ্য সরকার তার অপ্রত্যক্ষ কর থেকে যে আয় করে তা খরচ করে কর্মীদের মূলতঃ সরকারি কর্মী শিক্ষক ডাক্তারদের বেতন, সামাজিক প্রকল্প, কিছু ভর্তুকি এবং পরিকাঠামো উন্নয়নে l চতুর্থটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য করা হয় l এতে কোন ভোট আসে না l কিন্তু সব রাজ্যই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আয়ের একটা বিপুল অংশ এই খাতে খরচ করে l. একমাত্র এই রাজ্য বাদে l তাই কেন্দ্রের প্রকল্পকে প্রত্যাখ্যান করে রাজ্য ‘কেন্দ্রের বঞ্চনা’ রাজনীতিকে সামনে এনেছে রাজনৈতিক ডিভিডেন্ড পেতে l
তিন, রাজ্যের জমি নীতি l অন্যান্য রাজ্য যেখানে উন্নয়নের জন্য শহরাঞ্চলে জমি / বাড়ির মূল্যের দ্বিগুন ও গ্রামে চার গুন খরচ করে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গ শুধুমাত্র বাজারমূল্য দেয় l ফলে জমি পাওয়া অসম্ভব l সব রাজ্য যেখানে এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা সেখানে অন্য রাজ্যে কাজে গিয়ে নিজের উপার্জনের বেশিরভাগ টাকা সেই রাজ্যে খরচ করে আসছি l
পশ্চিমবঙ্গের (West Bengal) রাজনীতিতে বিধান রায়, প্রফুল্ল সেনের মত রাজনৈতিক সন্যাসী এর আগে বঞ্চনার রাজনীতির স্বীকার হয়েছে আর পশ্চিমবঙ্গের সর্বনাশ করে গেছে কুৎসা রটনাকারীরা l আমাদের ঠিক করতে হবে আমরা সত্যের সামনে দাঁড়াবো না, আবার সেই পুরোনো ফাঁদে পা দেব l
সুদীপ্ত গুহ (Sudipta Guha)