একদিকে যখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন করোনা-মহামারীর (Corona-epidemic) হিংস্র বিধ্বংসী আক্রমণ থেকে বাঁচার মরিয়া চেষ্টায় নিজেদের সীমানাগুলো বন্ধ করে দিয়েছে তখনই আমরা ইটালি (Italy) ফেরতা এক অল্পবয়সী ছাত্রের মুখে শুনতে পাচ্ছি তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা। জানছি, করোনার আক্রমণে যারপরনাই বিধ্বস্ত সেই দেশে এক টুকরো পাঁউরুটির জন্যও মানুষকে কী লড়াই করতে হচ্ছে! আমেরিকায় (America) বসবাসকারী একটি অনাবাসী ভারতীয় দম্পতি দু মাস এদেশে ছুটি কাটিয়ে এমেরিকা ফিরে পুরো তাজ্জব! সেখানে এক ব্যাগ আটার দাম দশ ডলার থেকে এক লাফে নব্বই ডলারে পৌঁছে গেছে।
সেদেশে আতঙ্কিত সাধারণ খদ্দেরদেরকে পাগলের মতো রাশি রাশি খাবার, টয়লেট পেপার, ও অন্যান্য মুদিখানার পণ্য কিনতে দেখে স্বয়ং রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পকে (Trump) আসরে নেমে বলতে হয়েছে যে, আমেরিকাতে(America) খাদ্যের জোগানে কোনো ভাঁটা পড়েনি এবং আতঙ্কিত হয়ে পাগলের মত কেনাকাটা করার প্রয়োজন নেই।
ভারতে (India) একদিকে যেমন সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে নির্দেশ দিয়েছেন যে বিদ্যালয়গুলি বন্ধ হওয়ার ফলে যেন কোনোভাবেই শিশু এবং স্তন্যদায়িনী মায়েরা পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত না হন, তেমন কেরল (Kerala) সরকার আবার মিড-ডে মিল (Mid-day mill) এর রসদ ছাত্রদের বাড়িতেই পৌঁছে দেয়ার পরিকল্পনা কার্যকর করেছে। ওদিকে, গোটা দেশ থেকে আতঙ্কগ্রস্ত গ্রাহকদের প্রচুর পরিমাণে খাবার ও অন্যান্য নিত্তপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনে জমানোর খবর আসছে। পঞ্জাবের সাপ্তাহিক সব্জির বাজার, “আপনি মান্ডি” বন্ধ হয়ে গেছে এবং, বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন করোনার গণসংক্রমণ আসন্ন। এর অর্থ এটাই দাঁড়ায় যে নিজেদেরকে কোয়ারেন্টিনে রাখাটা খুব তাড়াতাড়ি অনিবার্য হয়ে উঠবে। এসবের ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজনীয় পণ্য কিনে জমানোর তাগিদ মানুষের মধ্যে বাড়ছে। আমার প্রতিবেশীরাই এর মধ্যেই নিজেদের পুরোমাসের ব্যবহার্য আটা, চাল, চিনি, ভোজ্য তেল, পেঁয়াজ, টমেটো ইত্যাদি কিনে বাড়িতে জমিয়ে ফেলেছে।
যদিও সারা পৃথিবীতে বা দেশে খাদ্যের জোগানে কোনো ঘাটতিরই জন্ম হয়নি, তবুও বিপদের সময় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে এরম কেনাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। গম, চাল, চিনি ও ডাল দেশেই যথেষ্ট মজুত আছে। গম আর চাল গুদামে বিপদের সময় যত প্রয়োজন পড়তে পারে তারও অনেক বেশি আছে। বছরের গোড়ায়, অর্থাৎ ১ জ্যানুয়ারি, ২০২০তে গম ও চালের প্রয়োজন ছিল ২১৪ লক্ষ টন আর সেখানে ফুড কর্পোরেশন অভ ইন্ডিয়ার (Food Corporation of India) হাতে ছিল ৫৬৫.১১ লক্ষ টন। অর্থাৎ, জনসাধারণের প্রয়োজনের তুলনায় মোটামুটিভাবে আড়াই গুণ বেশি। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে এর পরের গমের ফলনটা ঢুকে গেলে খাদ্যশস্য নিয়ে ভারতের চিন্তার কোনো কারণই থাকবে না।
তার উপর, ভারতের কাছে এর মধ্যেই চিনির তিন লক্ষ টন বাফার স্টক রয়েছে যেটাকে সরকার পরিকল্পনা করছেন চলতি আর্থিক বছরে ৪০ লক্ষ টনে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার। ওদিকে, খাদ্য ও গ্রাহক মন্ত্রক ডিসেম্বর থেকেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন ডালের বাফার স্টক থেকে উদ্বৃত্ত ৮.৪৭ টন ফাঁকা করতে।
ভারত (India) এই ভয়ঙ্কর খাদ্য সংকটের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল প্রধানত তার কাছে যথেষ্ট খাদ্যসামগ্রী মজুত থাকার কারণে এবং দেশের কৃষিকে কোনোভাবেই আন্তর্জাতিক ফিউচার মার্কেটের সঙ্গে যুক্ত করেনি বলে।
এমন একটা সময়ে, যখন কিনা দেশ থেকে বেরোনো এবং দেশে প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে এবং যেটার প্রভাব আন্তর্জাতিক বাজারেও খুব তাড়াতাড়িই পড়ার সম্ভাবনা, তখন দেশের মধ্যে এই পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুত থাকা অবশ্যই এক বিশাল নিশ্চিন্তির বিষয়। আমার মনে পড়ে যাচ্ছে ২০০৭ এর কথা যখন, আন্তর্জাতিক ভাবেই খাদ্যের দাম প্রচুর বেড়ে গিয়েছিল আর মিশর সহ ৩৭টি দেশে খাদ্যের জন্য দাঙ্গা বেঁধে গিয়েছিল। একদিকে মানুষ ছিল ক্ষুধার্ত, আর অন্যদিকে খাদ্যের ব্যবসায়ী কম্পানিগুলো বিরাট লাভ ঘরে তুলছিল শিকাগো মার্কেন্টাইল এক্সচেঞ্জে, ফলে পৃথিবীর বৃহত্তম পণ্য-বাজারে খাদ্য পণ্যের দাম ভয়ানক রকম বেড়ে যায়। রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিশন এই বিশ্বব্যাপী খাদ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির জন্য প্রাথমিক ভাবে কমোডিটি ফিউচার ট্রেডিংকে দায়ী করেছিল। শতকরা পঁচাত্তর ভাগ দায়ই পড়েছিল প্রচলিত শোষণমূলক দ্রব্যমূল্যের উপর।
কৃষিজাত পণ্যের বাজারকে অতিরিক্ত উদার করে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে চলা মানে ২০০৭ এর খাদ্যসঙ্কটের কারণগুলি থেকে শিক্ষা না নেওয়া। এত বছর ধরে এত পরিশ্রম করে তৈরি খাদ্যসংগ্রহ প্রক্রিয়াতে সামান্য হস্তক্ষেপ করলেই দেখা যাচ্ছে অভূতপূর্ব সব বিপদের সম্মুখীন হতে হচ্ছে! বিশেষ করে এমন এক দেশে যেখানে, শিশুমৃত্যুর হার পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। যেখানে অপুষ্টি ও তজ্জনিত রোগে প্রতি বছর ৮.৮ লক্ষ শিশু প্রাণ হারায়। ইউনিসেফ স্বাভাবিকভাবেই এই সমস্যার নাম দিয়েছে “মৃত্যুর বোঝা“। সমস্যা দেশে কত খাদ্য আছে তা নয়। সমস্যা হল উদ্বৃত্ত খাদ্যের ম্যানেজমেন্ট নিয়ে।বিশেষ করে বর্তমান সময়ে যখন কিনা গ্লোবাল হাঙ্গার ইন্ডেক্সে ১১৭ দেশের মধ্যে এদেশের স্থান ১০২-এ!
জন-স্মৃতি সততই দুর্বল আর তাই এমনটাই মনে হচ্ছে যে, করোনার এই আক্রমণ যেন একদম ঠিক সময়েই এসেছে। গত বেশ কিছু বছর ধরে মূলস্রোতের অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকেরা খাদ্য সংগ্রহ প্রক্রিয়াটিকে – যা প্রাথমিকভাবে অতি জরুরী খাদ্য মজুতের কাজটি করে – বিপরীতমুখী করতে চেষ্টা করে আসছেন। বর্তমানে যখন সবার নজর এগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেট কমিটি অ্যাক্টের (Agricultural Produce Market Committee Act) আওতায় নিয়ন্ত্রিত আড়তসমূহের নেটওয়ার্ক ভেঙে দেওয়ার উপর, তখন সরকারও ধীরে ধীরে গম ও চালের গতানুগতিক সংগ্রহ প্রক্রিয়ার থেকে সরে আসতে আগ্রহী। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এর মধ্যেই পঞ্জাব (Punjab) সরকারকে চিঠি দিয়ে জানতে চেয়েছে, কেন ওপেন এন্ডেড প্রোকিওরমেন্ট সিস্টেমকে (Open ended procurement system) এখনও কমানো হয়নি। এই সিস্টেমের জন্য কৃষকেরা যে পরিমাণ গম আর চালই আড়তে আনুক না কেন তা সরকারকে মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস দিয়ে কিনে নিতেই হবে।
অতএব, নীতিনির্ধারকদের বার বার করে নিজেদের মনে করিয়ে দেওয়া উচিত ডক্টর এম এস স্বামীনাথন যা বলেছিলেনঃ “ভবিষ্যৎ হল শস্যসমৃদ্ধ জাতিদের। শস্ত্রসমৃদ্ধদের নয়।” ভারতের পক্ষে আর কখনোই সেই জাহাজ-থেকে-মুখ যুগে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয় যখন সাগর বয়ে খাবার সোজা ক্ষুধার্তদের কাছে এসে হাজির হত।
মূল লেখা : দেবিন্দর শর্মা (Debinder Sharma) (কৃষি-অর্থনীতিবিদ)
অনুবাদ : চম্পকদ্যুতি মজুমদার (Champakuti Majumdar)