পেছন দিকে কেউ লাফ মারে না। লাফ দিতে হলে সামনেই দিতে হবে। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, হংকং-এর মতো দেশ জাতীয় বৃদ্ধির অবিশ্বাস্য সীমা যখন স্পর্শ করেছিল তখন সকলেরই কিন্তু শ্রম বাজার ছিল নিতান্তই উন্নয়নের পক্ষে সহায়ক। কোনো কঠিন আইনের নিগড়ে বাঁধা নয়, এই দেশগুলি যখন বিশ্বের কাছে তাদের অর্থনীতিকে খুলে দেয় সে সময় তাদের শ্রম বাজারের নিয়ম কানুনের নমনীয়তার ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কম খরচে অতিকায় সব উৎপাদন কেন্দ্রে অত্যন্ত শ্রমনিবিড় সব উৎপাদন যেমন— জামাকাপড়, জুতো আসবাবপত্র ও অন্যান্য হালকা জিনিসপত্র বিপুল পরিমাণে তৈরি করে বিদেশে রপ্তানি করতে থাকে।
এর ফলস্বরূপ দেশের অভ্যন্তরে প্রচুর চাকরির সৃষ্টি হয়, যেখানে মাইনেপত্তরও মোটেই খারাপ ছিল না। মাত্র দু’ তিনটি দশকের মধ্যেই এই দেশগুলির নিঃসীম দারিদ্র্য সম্পূর্ণ দূরীভূত হয়।
ভারতও তার অর্থনীতিকে ৯০-এর দশকের সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বিশ্ব বাজারের কাছে খুলে দিয়েছে। কিন্তু ভারতে বহাল থাকা অনড় কিছু শ্রম আইনের দাপটে বড়ো বড়ো শিল্পের দেশে উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর ফলে প্রচুর লোক লাগে এবং ভালো মাইনে পাওয়া যায় এমন সব ক্ষেত্রগুলিতে কোনো বিনিয়োগই হচ্ছে না। শিল্প ক্ষেত্রে সফল হওয়া তথ্য প্রযুক্তি, ওষুধ, যন্ত্রপাতি, গাড়ি ও তৈল সংশোধনাগারগুলিতে বড়ো আকারের পুঁজি ও কেবলমাত্র উচ্চ প্রশিক্ষিত লোকজনই নিয়োজিত হয়।
এই পরিস্থিতি কিন্তু ভারতের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার রূপকার প্রয়াত প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশ অনেক আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। সেই কবে ১৯৬১ সালে ভারতীয় শ্রম আইন সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন ভারতের আইনগুলি “Probably the most highly protective of labour interests in the narrowest sense, in the whole world’তিনি আরও লেখেন ভারতবর্ষের বর্তমানে প্রচলিত আইন সংগঠিত শ্রমিকশ্রেণীকে (যারা সমগ্র জনসংখ্যার ৫-৬ শতাংশ মাত্র) নিরাপত্তা দিতে দেশের সামগ্রিক বৃদ্ধির পথকে রুদ্ধ করেছে। নিদিষ্ট সময়ের ব্যবধানে শ্রমিক শ্রেণীর সংখ্যার ওপর যে সমীক্ষা চালানো হয় তার অন্তর্গত ২০১৭-১৮ সালের পরিসংখ্যানগুলি দেখলে বোঝা যায় মহলানবিশ কী অভ্রান্ত বিশ্লেষক ছিলেন। তথ্যে উঠে এসেছে ভারতের শ্রমজীবী মানুষের ৪৪ শতাংশ নিযুক্ত আছে কৃষিতে, ৪২ শতাংশ আছে এমন ছোটো কলকারখানা বা উদ্যোগে যেখানে শ্রমিকদের সংখ্যা ২০-র বেশি নয়। পেশাদারিত্বের অভাব ও নীচু মানের উৎপাদনশীলতা এই সমস্ত উদ্যোগের বিশেষত্ব।
এই পরিপ্রেক্ষিতে শ্রম আইন সংস্কারে যে চারটি ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা একান্ত জরুরি। (১) বেতন, (২) সামাজিক নিরাপত্তা, (৩) শিল্পক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্পর্ক, (৪) কর্মীদের নিরাপত্তা- এই চারটি ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনতে পারলে আমাদের শ্রম বাজার নিশ্চিত নিয়োগের উপযুক্ত হয়ে উঠবে। কিন্তু এই কাজ সফল করতে গেলে চালু আইনকে কেবল পর্যালোচনা করলে হবে না। উল্লেখিত চারটি ক্ষেত্রে পুরোপুরি খোলনলচে বদলাতে হবে।
উদাহরণ দেওয়া যায় খসড়া বেতন কোড নিয়ে। সংবাদ সূত্রের খবর অনুযায়ী বর্তমানে প্রচলিত বহু সংখ্যক বেতন সংক্রান্ত আইনকে একটি ছাতার তলায় আনার প্রস্তাব রয়েছে। অর্থাৎ পুরনো সবই এক জায়গায়। এসে জড়ো হলো। এতে হবেনা। শ্রমিকদের কাজ দিতে নিয়োগকর্তাকে যেন পাঁচবার না ভাবতে হয় এমন নিয়োগ-বন্ধু আইন আনতে হবে। প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী উচ্চ প্রশিক্ষণ প্রাপ্তরাই কেবল ন্যূনতম বাড়তি বেতনক্রমের অধীনে আসবে। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এমন ব্যবস্থা চালু নেই। যে দেশের সমাজে বাঁচার পক্ষে যে ন্যূনতম ভদ্রজনোচিত জীবন যাত্রার মান বলবৎ আছে সমস্ত শ্রমিকেরই সেই জীবন যাপনের উপযুক্ত বেতন সুনিশ্চিত করাই একমাত্র নৈতিক যুক্তি। জীবনযাত্রার এই ন্যূনতম প্রচলিত মান অনুযায়ী বেতন পেতে গেলে উচ্চ প্রশিক্ষণের মানদণ্ড বেঁধে দেওয়া যায় না।
একটি সর্বনিম্ন ও সর্বজনগ্রাহ্য বেতন স্তর নির্ধারিত করে দেওয়ার পর বেতন বাজারের শক্তির ওপর নির্ভর করবে। এর মধ্যে কার কি উচ্চ প্রশিক্ষণ আছে সেই ভিত্তিতে শুধু তার মাইনে বাড়িয়ে দিলে হতাশার পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে শিল্পদ্যোগের বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এর ফলে উদ্যোগপতি কেবলমাত্র অধিক পুঁজির ও বাড়তি দক্ষতা লাগে এমন শিল্পের দিকেই সরে যাবে, ফলে সাধারণ চাকরির বাজার মার খাবে।
সূত্র অনুযায়ী খসড়া বেতন প্রস্তাবে দেশব্যাপী একটি ন্যূনতম বেতনের কথা বলা হয়েছে। এটা পরিষ্কার হয়নি ন্যূনতম বেতন কি মেট্রো শহরে বসবাস করার খরচ নির্ভর, যেমন দিল্লি মুম্বাই নাকি বিহার ওড়িশার প্রত্যন্ত অঞ্চলের খরচ নির্ভর। যদি প্রথম শহর দুটিকে মাপকাঠি ধরে ন্যূনতম বেতন ঠিক করা হয় তা হলে কিছুটা বড়ো আকারের যে শ্রমনিবিড় পোশাকপরিচ্ছদ ও জুতো তৈরির উদ্যোগগুলি রয়েছে সেগুলির বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
এই দুটি শিল্পদ্যোগের ক্ষেত্রে লাভের মাত্রা খুবই কম। মেট্রো শহরে বসবাসের উপযোগী ন্যূনতম বেতন দেওয়ার বাধ্যবাধকতা এদের ওপর চাপানো হলে এদের অস্তিত্বই সঙ্কটের মুখে পড়বে। উল্টো দিকে যদি বিহার ওড়িশার প্রত্যন্ত প্রদেশের নিতান্ত গরিব শ্রমিকদের দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে সারাদেশের শ্রমিকের মজুরি নির্ধারিত হয় সেক্ষেত্রে অন্য বিপদ। সংগঠিত ক্ষেত্রের উচ্চ বেতনের শ্রমিকরা এতে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠবে। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনগুলি যেমন International labour organisation-গুলির তরফে কেবলমাত্র বিক্ষোভ জানাবে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক শ্রম আইন ভাঙার অভিযোগও আসবে।
সারাদেশে একটি মাত্র ন্যূনতম বেতন হার ঠিক করার সপক্ষে কয়েকটি অযৌক্তিকতানজরে পড়ে। একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে বিশ্বের বেশ কয়েকটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত অর্থনীতিতে এই নিয়ম অনুসরণ করা হয়। অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলে ন্যূনতম জীবনযাপনের খরচের ভিত্তিতে যদি পরিপূরক বেতন নির্ধারণ করতে হয়। সেক্ষেত্রে সেখানকার রাজ্য সরকারগুলিই একাজে উপযুক্ত বলে মানতে হবে। একটি রাজ্য সরকার তার ও তার পূর্বের সরকারগুলির অভিজ্ঞতার সূত্রে রাজ্যবাসীর খেয়ে পরে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে বেতনের ন্যূনতম সীমা যা জীবনযাত্রার মানও অক্ষুন্ন । রাখতে পারে তা নির্ধারণ করতে সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত একথা নিশ্চিত। তাই আমার বিবেচনায় এ কাজটা রাজ্যগুলির হাতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত যেমন পৃথিবীর গরিষ্ঠাংশ দেশে আছে।
প্রস্তাবিত খসড়া বেতন নির্ধারণ সূত্রটিতে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে রেল ও খনি শিল্পেরও বেতন কাঠামো সংস্কারের প্রসঙ্গ রয়েছে। একই সঙ্গে এই দুটি ক্ষেত্রকে পরিধির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার যৌক্তিকতা বোঝা বেশ মুশকিল। পূর্বে আলোচিত রাজ্যগুলির হাতে যদি সেখানকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ অনুযায়ী কর্মীদের ন্যূনতম বেতন নির্ধারণের পূর্ণ অধিকার দেওয়া হয় সেক্ষেত্রে সেই রাজ্যের সমস্ত ধরনের (সরকারি-বেসরকারি) নিয়োগকর্তারা সেই বেতনই কর্মীদের দিতে বাধ্য থাকবেন। সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য জীবনযাপনের পক্ষে ন্যূনতম বেতন কি পোশাক তৈরি করা শ্রমিকদের ক্ষেত্রে রেলে বা খনিতে কাজ করা শ্রমিকদের থেকে বেশি বা কম হওয়া উচিত!
ভালো চাকরি, জীবনযাপনের ক্রম উন্নতমানের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো চাকরি তৈরি করতে শ্রম আইন যা শ্রমিক মালিক সম্পর্কের মধ্যে সেতু তৈরি করে তার দিকে নজর দিতেই হবে। বৃহত্তর জন পরিসরে ন্যূনতম বেতন কাঠামো নিয়ে নীতি পরিমার্জন ও নির্ধারণ নিয়ে তেমন কোনো আলোচনাই হয়নি। প্রস্তাবের অন্তবস্তু সম্পর্কে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী আদৌ ওয়াকিবহাল নয়।
তাই পর্যাপ্ত মত বিনিময় ও ভাবনার আদানপ্রদান ছাড়া এত বড়ো সংশোধনী যদি হঠাৎ মন্ত্রীসভায় পৌঁছে যায় ও তাদের অনুমোদন নিয়ে সংসদ ভূমিতে ঢুকে পড়ে তাহলে সেটা উদ্বেগজনক। কেননা বর্তমানে চালু থাকা বেতনক্রম সংক্রান্ত আইনকানুনগুলিতে কাম্য সংস্কারগুলি যদি অধরাই থাকে বা এমন কিছু নতুন তৈরি হয় যেগুলি হয়তো পক্ষান্তরে চালু থাকা আইনের হাতকেই অজান্তে শক্ত করে ফেলবে, সেক্ষেত্রে বিপদ বাড়বে।
অরবিন্দ পানাগড়িয়া
2019-08-02