সাধারণ নির্বাচন আসন্ন। অগোছালো কিংবা সাজানো গোছানো পারস্পরিক অভিঘাতময় এই সময়ের ক্যানভাসে কেন্দ্রীয় বিত্তমন্ত্রীর বাজেট পেশ একটা খুব বড়োসড়ো ব্যাপার। সর্বস্তরের মানুষের তুমুল আগ্রহ ছিল এই বাজেট নিয়ে। বিশেষত এই বিশাল দেশের বিপুল সংখ্যক দরিদ্র এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা তাদের বেদনা-অধ্যুষিত অনিরাপদ অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসবার দিশা রূপে এই বাজেটের দিকেই দীর্ঘকাল তাকিয়ে ছিলেন। এরকম বহু জনের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, সংসদের রঙ্গমঞ্চে একটার পর একটা প্রস্তাব যখন উচ্চারিত হয়েছে, তারা খুশি হয়েছেন এবং নীরবে তাদের দ্বারা নিবিড়ভাবে অভিনন্দিত হয়েছে এই জীবনমুখী বাজেট প্রস্তাব। কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত বিত্তমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল যে দৃঢ়তা ও কৌশলের সঙ্গে বাজেট ভাষণ সমাপ্ত করেন, ভাবে ও ধারে তা বেশ শাণিত, বুদ্ধিদীপ্ত এবং সংসদীয় বনেদিয়ানার নজির। স্পষ্টই প্রতিভাত যে এই অন্তর্বর্তী বাজেট তথা ভোট অন অ্যাকাউন্ট স্বস্তির অন্তর্গূঢ় বাঁধনে বেঁধে ফেলতে পেরেছে তিন ধাপের নাগরিকদের মধ্যবিত্ত, দরিদ্র কিষাণ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্মরত জোয়ানরা। তাদের বহুদিনের দাবি কিংবা প্রত্যাশাকে এবারের বাজেটীয় সাম-আপে বাস্তবায়িত হতে দেখলেন। টিভির স্ক্রিনে চোখ রেখে সজাগ কানকে পেতে আদ্যোপান্ত শুনেছি কেতাদুরস্ত ইংরেজি ও হিন্দিতে মিঃ পীযূষ গোয়েলের উচ্চারিত প্রতিটি প্রসঙ্গ এবং তার তুলনামূলক ব্যাখ্যা। অর্থনীতির নগণ্য ছাত্র রূপে আমার কিন্তু বারেকের জন্যও মনে হয়নি, তিনি কেবল নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন বাস্তব প্রতিবন্ধকতাগুলিকে। তাই এই বাজেটকে ঠিক ঠিক বিশ্লেষণ না করেই যেভাবে একাধিক বিরোধী নেতা-নেত্রী শুধুমাত্র কতগুলি নেগেটিভ বিশেষণ আওড়াতে থাকলেন, আমার তখন মনে হলো, এঁরা আদতে একেবারে হেঁদো যুক্তিহীন প্রতারণামূলক রাজনীতিতেই অভ্যস্থ এবং বেপরোয়া রেকলেসনেস নিয়েই তাদের রাজনৈতিক দর্শন। লাগামছাড়া মন্তব্য করেই নির্বাচনী বৈতরণী পার হবার স্বপ্ন দেখেন। হিসেবপত্তরে তাদের প্রচুর ভুলচুক। প্রতিশ্রুতিতেও তাই থাকে প্রভূত অনিশ্চয়তা। একজন রাজনীতি নিরপেক্ষ নাগরিক হিসেবে আমি কিন্তু ওই বাজেটে বহু ইতিবাচক পদধ্বনি শুনতে পেয়েছি এবং মনে হয়েছে, সংসদে যে দল হঠকারিতা দেখিয়ে এই প্রস্তাবগুলির বিরোধিতা করবে, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের বিচারে সেই দল অবিবেচক ক্ষতিকারক রূপেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে পরবর্তী দিনগুলিতে। ওই ধরনের রাজনৈতিক কুশীলবরা যে প্রত্যাশাই করে থাকুন, আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতা কিন্তু নিম্নোক্ত প্রস্তাবগুলির স্বপক্ষে নির্দ্বিধায় সোচ্চার হয়েই থাকব :
(১) ৫ লক্ষ টাকা অবধি আয়ে কোনও আয়কর ধার্য হবে না।
(২) অসংগঠিত ক্ষেত্রে যে সকল কর্মী এ যাবৎ অবসরভাতা পেতেন না, অতঃপর তাদের মাসিক পেনশন হবে ন্যূনতম ৩ হাজার টাকা।
(৩) প্রত্যেক দরিদ্র কৃষিজীবীর যেন নিজের নামে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকে, যে অ্যাকাউন্টে কেন্দ্রীয় সরকার ২ হাজার টাকা করে ৩ বারে মোট ৬ হাজার টাকা অনুদান হিসেবে জমা করে দেবেন প্রতি বৎসর।
(৪) গ্র্যাচুইটির ঊর্ধ্বসীমা এতদিন ছিল ১০ লক্ষ টাকা। এই বাজেট প্রস্তাব সংসদে অনুমোদিত হলে গ্র্যাচুইটির পরিমাণ ৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে গিয়ে দাঁড়াবে ৩০ লক্ষ টাকা। ভবিষ্যতে যাঁরা অবসর নেবেন, তারা নিশ্চয় কুর্নিশ করবেন বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারকে।
(৫) দেশের সৈনিকদের বহু বছরের আন্তরিক প্রত্যাশা ‘এক পদ, এক ‘পেনশন’। কংগ্রেসি জমানায় এই দাবির যৌক্তিকতা স্বীকৃতি পায়নি। বর্তমান বিজেপি সরকার কিন্তু তাদের বাজেট প্রস্তাবে জওয়ানদের এমনতর প্রত্যাশাকে মান্যতা দিলেন।
(৬) প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘উজ্জ্বলা প্রকল্প’-এর কল্যাণে এদেশে এ অবধি ৬ কোটি দরিদ্র পরিবার নিখরচায় পেয়ে আসছেন রান্নার জন্য গ্যাস সিলিন্ডার। এই বাজেট প্রস্তাব সংসদে গৃহীত হলে উক্ত সুবিধাভোগী পরিবারের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ৮ কোটি।
(৭) ২০২০ সন অবধি তাবৎ গৃহ ক্রয়/নির্মাণের ক্ষেত্রে আয়করের ছাড় পাবেন সংশ্লিষ্ট করদাতা।
(৮) পশ্চিমবঙ্গের বরানগর-দক্ষিণেশ্বর থেকে নোয়াপাড়া-বারাসত অবধি প্রস্তাবিত মেট্রোরেল প্রকল্পে কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ দ্বিগুণ করা হতে পারে।
(৯) যে কোনও ধরনের পশুপালনে সরকারি সহায়তা মিলবে কেন্দ্রের কাছ থেকে। এই বাবদ বরাদ্দ করা হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
(১০) রেলের যাত্রীভাড়া ও পণ্যমাশুল অপরিবর্ধিত থাকছে।
(১১) ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে সরকার তার বরাদ্দের পরিমাণ অনেকটা বাড়িয়ে করবেন ৬০ হাজার কোটি টাকা।
(১২) বাড়ি ভাড়ার ক্ষেত্রে ২ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা অবধি টিডিএস নিপ্রোয়জন।
(১৩) ব্যাঙ্ক ও পোস্টঅফিসে প্রাপ্ত সুদের ৪০ হাজার টাকা অবধি থাকবে করমুক্ত।
ইত্যাকার হরেক কিসিমের সুবিধা ও নিষ্কৃতি দেবে যে বাজেট, তা গণঅভিনন্দিত যে হবে, তার বেশ কিছু সবুদ আমি নিজেই পেয়েছি। তবুও বিরোধী পক্ষীয় নেতা-নেত্রীরা তো নিশ্চল, স্থবির হয়ে থাকতে পারেন না। তারা এখন চেষ্টা করছেন বিচিত্র এবং আনফোরসিন বিপর্যয়ের কিছু টুকরো টুকরো ছবি দেখিয়ে নাগরিকদের বিভ্রান্ত করতে। এই বঙ্গে প্রায় সব চ্যানেলেই ব্রেকিং নিউজে স্থান পেতে তাদের জান কবুল। দরকার মতো খবরও বানাতে হয় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ চাপে। আমরা, সাধারণ মানুষরা এটা ঠিক বুঝতে পারি। প্লিজ, আর বোকা বানাবার চেষ্টা করবেন না।
এই আলোচনাকে সার্বিক করতে গেলে একটা গোটা বই লিখে ফেলতে হয়। সেই অবকাশ এই মুহূর্তে নাস্তি। পরবর্তীকালে পৃথক পৃথকভাবে বিভিন্ন স্তম্ভে বিশ্লেষণের বাসনা রইল।
শেখর সেনগুপ্ত