গুরু গ্রন্থসাহেব: একটি পর্যালোচনা

বিশ্বের মহান গ্রন্থ গুলির মধ্যে গুরু গ্রন্থ সাহেবজী অনন্য। গুরুগ্রন্থ-সাহেবজী গুরু-বাণী হিসাবে পরিচিত। এর অর্থ, ‘গুরুর মুখ থেকে ‘স্বরের শব্দ’ হিসাবে বিবেচিত হয়। ঈশ্বরের মুখ থেকে নিঃসৃত শব্দই গুরুমুখী বিদ্যা হিসাবে পরিচিত। গুরু গ্রন্থসাহেবজী ১,৪৩০ পৃষ্ঠা সম্বলিত। যার প্রতিটি পৃষ্ঠার, প্রতিটি অনুলিপি তে গুরুর দ্বারা কথিত শব্দ রয়েছে। গুরুগ্রন্থ সাহেবজি শুধুমাত্র শিখ-গুরু দের নয় বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির বিদ্যানদের বহু স্তব, কবিতা ও অন্যান্য রচনা সংকলন। কোন জীবিত ব্যক্তির চেয়ে সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক কর্তৃত্ব এবং শিখ ধর্মের প্রধান হিসাবে পাঞ্জাবি ভাষায় রচিত গুরু গ্রন্থসাহেব কে বিবেচনা করা হয়। এটি এমন একটি গ্রন্থ যা কেবলমাত্র তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কথা নয়, তাদের বিশ্বাসের সাথে জড়িত লোকদের কথাও বলা হয়েছে। অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে বইটিকে রেখেছেন। শ্রীগুরু গ্রন্থসাহেবজীর প্রকাশ উৎসব পাঞ্জাবি বর্ষপঞ্জির ষষ্ঠ মাস, ভাদনের ১৫ তম (অমাবস্যা)-য় অনুষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ পশ্চিমা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী আগস্ট বা সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়।
পঞ্চম শিখ গুরু অর্জুনদেবজী অনুভব করেছিলেন যে, শিখ গুরু দের স্তব-গুলো যথাযথভাবে সংকলন করা প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্যে তিনি সমস্ত গুরুদের শ্লোক গুলি সংগ্রহ করতে শুরু করেন। আসল পান্ডুলিপি গুলির সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তিনি ভাই পাইয়ারজী, ভাই গুরুদাসজী এবং বাবা বুদ্ধ বৌদ্ধজীয়ের মত শিখদের সারা দেশজুড়ে প্রেরণ করেছিলেন। গুরু অর্জুনদেবজী স্বয়ং পূর্ববর্তী গুরুদের পরিবারকে দর্শন করার জন্য গোয়িন্দওয়াল, খাদুর এবং করতারপুরে ভ্রমণ করেছিলেন। গুরু অর্জুন গুরুদের পান্ডুলিপি গুলি মোহনজী (গুরু অমরদাশজীর পুত্র), দাদুজী (গুরু অঙ্গদজীর পুত্র), শ্রী চাঁদ (গুরু নানকের পুত্র) থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। এইভাবে হয়েছিল গুরুগ্রন্থ সাহেবজীর মূল সংস্করনের সংকলন।
গুরু নানকজীর অনেক স্তোত্র এবং প্রার্থনা গুলি গুরু অঙ্গদজী এবং গুরু অর্জুনদেবজীর দ্বারা রক্ষিত এবং অনুসরণ করা হয়েছিল এই সংগ্রহটি আদিগ্রন্থ নামে পরিচিত। আদি গ্রন্থটি ১৬০৪ সালে সমাপ্ত হয়েছিল এবং স্বর্ণমন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আদিগন্ত গ্রন্থে কবির, রবিদাস, নাম দেব এবং শেখ ফরিদ সহ ৩৬ জন হিন্দু ও মুসলিম লেখক এর নাম আছে। আদিগ্রন্থের আসল অনুলিপিটি বিভিন্ন ভাষায় এবং বিভিন্ন লেখকের এর দ্বারা প্রতিফলিত হয়েছে। গুরু গ্রন্থসাহেবজীর মূল সংস্করণ পাওয়া যাবে মহারাষ্ট্রের নন্দন শহরে। ১৭০৮ সালে, আদি গ্রন্থ শ্রী গুরুগ্রন্থ সাহেবজীতে পরিণত হয়েছিল। ঘোষণা করেছিলেন গুরু গোবিন্দ সিংজী। এরপর গুরুগ্রন্থ সাহেবজী সিকদের চিরন্তন গুরু হয়ে ওঠে। ১৭০৮ সালে গুরু গোবিন্দ সিংহের শাহাদতের পরে, বাবা দীপ সিংহ এবং ভাই মনি সিংহ বিতরণের জন্য শ্রী গুরু গ্রন্থ সাহেবের বহু কপি প্রস্তুত করে ছিলেন। মহারাষ্ট্রের নন্দেদ শহর ছাড়াও শ্রী গুরু গ্রন্থ সাহেবজীর সংস্করনের অনুলিপি গুলি পাওয়া যায়।
গুরুগ্রন্থ সাহেবজীর প্রথম শব্দ হলো “মন্ত্র”। এটি শিখ ধর্মের স্বীকৃতির বিবৃতি। এই গ্রন্থটিতে একেশ্বরবাদ –এর কথা বলা হয়েছে। গুরু গোবিন্দ সিংজী শ্রী গুরু গ্রন্থসাহেব কে স্থায়ী গুরুর মর্যাদা মর্যাদা উপস্থাপন করেছিলেন এবং ১৭০৮ এটিকে “শিখদের গুরু” উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। গুরু গ্রন্থসাহেবজী কে গুরু গোবিন্দ সিংজী তার পরবর্তী গুরু হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন এবং শিখদের আদেশ করেছিলেন গুরুগ্রন্থ সাহেব কে তাদের পরবর্তী এবং চিরস্থায়ী গুরু হিসাবে বিবেচনা করতে। তিনি বলেছিলেন, “সব শিখন কো হুকুমহই গুরু মুনিও গ্রন্থজী”। অর্থাৎ সব শিখকে গুরু হিসেবে গ্রন্থকে বিবেচনা করার আদেশ দেওয়া হয়েছে।
গুরু গোবিন্দ সিংহ নিম্নলিখিত শব্দ গুলিতে আদেশ করেছিলেন :
অগয়া ভাই আকাল কি তাবি চালাও পন্থ।
অর্থাৎ অমর সত্তার আদেশে পান্থ তৈরি হয়েছিল।
সব শখান কো হুকুম হ্যায় গুরু মুনিও গ্রন্থ।
অর্থাৎ সমস্ত শ্রী গ্রন্থকে তাদের গুরু হিসেবে গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
গুরুগ্রন্থজী মনুও পরগত গুনান হি দেহ।
অর্থাৎ গুরুগ্রন্থ কে গুরুদের প্রতিমূর্তি হিসাবে বিবেচনা করুন।
জো প্রভুকো মিলবো চাহু খোঁজ শব্দ মেইন লে।
অর্থাৎ যারা ঈশ্বরের সাথে দেখা করতে চায়, তার স্তব গুলিতে তাকে খুঁজে পেতে পারে।
রাজ কারেগা খলসা আকি রাহি নাকো।
অর্থাৎ খাঁটি শাসন করবে, আর অশুচি হবে না।
খোয়ার হো সব মিলন কে বাচে স্মরণ জো হো।
অর্থাৎ বিচ্ছিন্ন যারা একত্রিত হবে এবং সমস্ত ভক্তদের রক্ষা করা হবে।

••১৪৩০ পৃষ্ঠা সম্বলিত গুরুগ্রন্থ সাহেব, যার পৃষ্ঠাগুলো দিগন্তের সমান্তরালে লেখা। প্রতি পৃষ্ঠায় সাধারণতঃ ১৯ লাইনের পাঠ্য আছে। শিরোনামঃ যুক্ত পৃষ্ঠাগুলোতে (একটি নতুন সুরের শুরু) ১৯ লাইন এর চেয়ে কম শাড়ির মোট সংখ্যা ২৬৮৫২, মোট শব্দ ৩৯৮৬৯৭। “হরি” শব্দটি ঘন ঘন ব্যবহৃত হয়েছে। কোন বিরাম চিহ্ন ব্যবহৃত হয়নি।
••ছয় শিখ গুরু, প্রথম পাচ গুরু ( গুরু নানক দেবজী, গুরু অঙ্গদ দেবজী, গুরু অমরদাসজী, গুরু রামদাসজী, গুরু অর্জুন দেবজী) এবং গুরু তেগবাহাদুরজী।
••গুরুগ্রন্থ সাহেব এর মধ্যে গুরু নানকদেবজী (৯৭৪ শব্দ এবং শ্লোক), গুরু অঙ্গদদেবজী (৬২ শ্লোক), গুরু অমরদাসজী (৯০৭ শব্দ ও শ্লোক), গুরু রামদাসজী (৬৭৯ শব্দ এবং শ্লোক), ।
ভট্টরা ষোড়শ শতাব্দীতে বসবাসকারী একদল সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। এরা সকলেই ছিলেন আলেম, কবি, ও গায়ক। (ভাট কাল, ভাট কালশেহার, ভাট তাল, ভাট জলুপ, ভাট জল, ভাট কিরাত, ভাট সাল, ভাট বাহিল, ভাট নল, ভাট ভিখা, ভাট জলান, ভাট কাস, ভাট জেন্ড, ভাট সেবক, ভাট মথরা, ভাট বাল ও ভাট হরবানস)।
১৫ ভগবত (কবির, নামদেব, রবিদাস, শেখ ফরিদ, ত্রিলোচন, ধনা, বেনি, শেখ ভিকান, জয়দেব, সুরদাস, পরমানন্দ, পিপ্পা, রামানন্দ, সাধনা ও সায়)
গুরুগ্রন্থ সাহেবজী শুরু জিপসি নামে পরিচিত একটি বাণী দিয়ে। পরে সংগীতের কম্পিজিশান হিসাবে প্রতিটি বিভাগ পুনরায় শুরু করে। এই রাগ গুলির প্রত্যেকটির মধ্যে গুরুদেবের বাণী কালক্রমিক ভাবে উপস্থাপিত হয়। তারপর ভগবতগণ ৩২ ৩২ রাগ অনুসরণ করে। রাগমালা নামে একটি বিভাগ গুরুগ্রন্থ সাহেবজী পূর্ণ করে।
গুরু গ্রন্থসাহেবজী যে সময় লেখা হচ্ছিল, সেই সময় কিছু লোক গুজব ছড়িয়ে ছিলেন এবং মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের কানে তুলেছিলেন যে, গুরু গ্রন্থসাহেবজী এবং গুরু বাণী মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচার করছে। এতে সম্রাট জাহাঙ্গীর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং গুরু অর্জুনদেবকে গুরু গ্রন্থসাহেবজীর পান্ডুলিপির কিছু স্তোত্র মুছে ফেলতে নির্দেশ দেন এবং ২০০,০০০ টাকা জরিমানা জারি করেন। গুরু অর্জুনদেবজী আপত্তিকর পাঠ্য বিলোপ করতে এবং জরিমানা দিতে অস্বীকার করেন। ফল স্বরূপ তাকে শহীদের মৃত্যু বরণ করতে হয়।
গ্রন্থসাহেব প্রথম ইংরেজিতে অনুবাদ হয় ১৮৭৭ সালে। এর্ণস্ট টুম্প এটা অনুবাদ করেন। তবে এই অনুবাদ ধর্মগ্রন্থের প্রকৃত সারবত্তা’কে স্পর্শ করতে পারেনি। ম্যাক্স আর্থার ১৯০৯ সালে তা ‘দি শিখ রিলিজিওন’ নামক গ্রন্থে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। আমাদের বাংলা ভাষায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গুরু নানকের দুটি শ্লোকের অনুবাদ করেন। জ্ঞানেন্দ্রনাথ দত্ত গদ্য এবং কিরণচাঁদ দরবেশ বুদ্ধির মাধ্যমে আরো কয়েকটি অংশে অনুবাদ করেন।
শিখ ধর্ম হল সংস্কৃত ‘শিষ্য’ বা ‘শিক্ষা’ থেকে উৎপন্ন। এই ধর্মের মূলকথা বস্তু হল ’সর্বেশ্বরবাদ’ ; আর এই বিশ্বাস এমন এক বিশ্বাস যা মহাবিশ্বকে ঈশ্বর রুপে গন্য করে। অর্থাৎ আমাদের পারিপার্শ্বিক সমস্ত জড় বা জীবিত যাই উপাদান থাকুক না কেন তারমধ্যে জীবনের অস্তিত্ব বর্তমান। তারা একক ঈশ্বরে এইজন্যই বিশ্বাসী নয়। সেওয়া সিং কনসির মতে-“শিখ ধর্মের কেন্দ্রীয় শিক্ষা হল ঈশ্বরের একত্বের তত্ত্বে বিশ্বাস”। কেবল শিখরা বিশ্বাস করেন-“সকল ধর্মমত সমভাবে সঠিক এবং নিজে নিজ মতাবলম্বীদের আলোকিত করতে সক্ষম”। গুরু নানক- সত্য, বিশ্বাস, আত্মনিয়ন্ত্রণ, ও বিশুদ্ধতায় পরিপূর্ণ সক্রিয়, সৃজনশীল ও ব্যবহারিক জীবনের উপর গুরুত্ব প্রদান করেছেন। তাই তাঁর পথ “সত্য অনুভবের চেয়ে বৃহত্তর কিছুই নেই। সত্যময় জীবন বৃহত্তর নামমাত্র”।-এই ধর্মে কাজ বা লিঙ্গের ভিত্তিতে বৈষম্যের কোন স্থান নেই। ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ, সন্ন্যাস এইচআর প্রথার মধ্যে গার্হস্থ্য জীবন উদযাপনে তারা উৎসাহ প্রদান করেন-আর এ এসমস্ত কথা আমরা গ্রন্থসাহেব-এর মধ্যে পেয়ে থাকি।
ইক ওঙ্কার’ বা ‘এক চিরন্তন’ বা ‘সর্বব্যাপী সত্তা’ তাঁদের ঈশ্বর ধারণা। গুরুগ্রন্থ সাহিবের প্রথম চরণে উল্লিখিত মূল মন্তর এবং তার নির্দিষ্ট রাগ বাংলা করলে দাঁড়ায়:” কেবলমাত্র এক সর্বব্যাপী সত্ত্বা আছে। সত্য হল এঁর নাম। সকল সৃষ্টিতে তিনি বিরাজমান; তাঁর ভয় নেই, তার ঘৃণা নেই; তিনি নামহীন ও সর্বজনীন ও স্বকীয়,জ্ঞান ও শিক্ষার সন্ধান করলে তুমি এঁর সন্ধান পাবে।
গুরু গোবিন্দ সিং মনে করেন মানবজীবন সৌভাগ্যের;তাই এখনও মূল্যবান জীবনকে কাজে লাগানো একান্ত কর্তব্য।আর শিখ ধর্মে কর্ম বলতে বুঝি-“ঈশ্বরের করুণা ধারণার দ্বারা গৃহীত”। ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে তাই মায়া পরিত্যাগ করা বাঞ্ছনীয়, মানবজাতির সেবাই “সৎসঙ্গ” রূপে বর্ণিত। গ্রন্থসাহিবে এইরূপ দার্শনিক উপলব্ধি আমাদের চিত্তকে পবিত্র করে।
এখন তো আমাদের আরও একটি বিষয় স্পষ্ট করে যে-মানব জীবনের লক্ষ্য হলো অকালের সাথে সম্বন্ধ স্থাপন। আর এই যোগ সাধন সম্ভব অহং’কে পরাভূত করে। আর এ অহং এর বিনাশ সাধিত হয় সেবা এবং দাতব্য কার্যের দ্বারা। এই ধর্মে সেবা তিন প্রকার-(১) ‘তন’ বা দৈহিক সেবা। (২) ‘মন’ বা মানসিক সেবা ও (৩) ‘ধন’ বা আর্থিক সেবা। তাই আমরা লক্ষ্য করি শিখ গুরুদ্বার গুলিতে খাবার বন্টন করা হয়, দান করা হয়, সমাজসেবামূলক কাজ ও অন্যান্য সেবার মধ্যে সকলে যুক্ত থাকেন।
পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মগ্রন্থই আমাদের মানুষ হবার মন্ত্রে দীক্ষিত করে তোলে। গ্রন্থসাহিব’ও তার ব্যতিক্রম নয়।

রুদ্রপ্রসাদ (Rudra Prasad)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.