পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে কিছু অপ্রিয় অথচ ন্যায়সঙ্গত প্রশ্নের উত্থাপন করেছেন। যে প্রশ্নগুলি রাজ্যপাল উত্থাপন করেছেন, সেই প্রশ্নগুলি রাজ্যের আপামর জনসাধারণের মনেও তোলপাড় করছে এবং রাজ্যের মানুষও এ নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলতেও শুর করেছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রীসভার কোনো সদস্য। অথবা রাজ্য সরকারের উচ্চপদস্থ কোনো আমলা এই প্রশ্নগুলি একবারের জন্যও উত্থাপন করেননি। একবারও মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁর ভুল আচরণ এবং ভুল পদক্ষেপের জন্য। সতর্ক করেননি। বরং, নিজ নিজ স্বার্থে মুখ্যমন্ত্রীর মনোতুষ্টির জন্য তারাও মুখ্যমন্ত্রীর দৈনন্দিন কীর্তনে ধুয়ো দিয়ে যাচ্ছেন। রাজ্যপাল তাঁর চিঠিতে কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন? রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছেন, এমন একটা সংকটের সময়ও কেন মুখ্যমন্ত্রী এবং তার সরকার সংখ্যালঘু তোষণের নগ্ন রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসছেন না। খুবই সঙ্গত প্রশ্ন। সম্প্রতি হাওড়ার টিকিয়াপাড়ায় যেভাবে লকডাউন অমান্য করে সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের এক শ্রেণীর উন্মত্ত মানুষ পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে, তাতে রাজ্যপালের এই প্রশ্নের যথার্থতাই প্রমাণিত হয়েছে। রাজ্যের মানুষ দেখেছেন, লকডাউন ঘোষিত হওয়ার প্রথম দিন থেকেই কলকাতা-সহ রাজ্যের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে লকডাউনকে অমান্য করার মানসিকতাই প্রকট হয়েছে। এই সংখ্যালঘু এলাকাগুলিতে কঠোরভাবে লকডাউন কার্যকর করার বিষয়ে রাজ্য সরকারের এক ধরনের উদাসীন্যই চোখে পড়েছে। লকডাউন শুরু হওয়ার প্রথম দু-একদিন পুলিশ একটু সক্রিয় হলেও পরে তাদের রাশ টেনে ধরা হয়েছে। ফলত, এইসব এলাকার মানুষরা মনে করেছেন, লকডাউন অমান্য করে যা ইচ্ছা তাই করার অধিকার তাদের উপর বর্তেছে। সরকারের ঔদাসীন্য তাদের এই মানসিকতায় পরোক্ষভাবে ইন্ধন জুগিয়েছে। তোষণের এই নগ্ন নক্কারজনক রাজনীতিটি করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এটুকু বোঝেননি যে, বর্তমান সংকটটি হিন্দু-মুসলমান সবারই। হিন্দুর করোনা হবে আর মুসলমানের হবে না—এ যুক্তি এক্ষেত্রে খাটে না। বরং, সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় যদি লকডাউন পালনে কঠোরতা অবলম্বন করানো না যায়, তাহলে গোষ্ঠী সংক্রমণের সম্ভাবনা যে থেকেই যায়— এই আশঙ্কা অস্বীকার করা যায়। এই সহজ সত্যটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করালেই মুখ্যমন্ত্রী বিরক্ত হচ্ছেন, ক্ষুব্ধ হচ্ছে। বলছেন—“কমিউনাল ভাইরাস ছড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। কে মুখ্যমন্ত্রীকে বোঝাবে এই সংকটের সময়ে ‘কমিউনাল ভাইরাস’ যদি কেউ ছড়ানোর চেষ্টা করে, সে আপনি স্বয়ং। সংকটের সময়ও সংখ্যালঘু তোষণের রাজনীতিতে ব্যস্ত থেকে আপনিই কমিউনাল ভাইরাস ছড়াচ্ছেন।
রাজ্যপাল আর একটি অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত প্রশ্ন তুলেছেন। বলেছেন—করোনা সংক্রান্ত ডেথ অডিট কমিটি গঠন করার যৌক্তিকতা কী? সত্যিই, এই কমিটি গঠনের যৌক্তিকতা কী তা রাজ্য সরকার এখনো পরিষ্কার করতে পারেনি। বরং, এই কমিটি এবং কমিটির কার্যকলাপ ঘিরে নানাবিধ অস্বচ্ছতা সৃষ্টি হয়েছে। রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধেও তথ্য গোপনের অভিযোগ উঠেছে। প্রথমত, কোনো রাজ্যেই এমন ডেথ অডিট কমিটি গঠন করা হয়নি। সব রাজ্যেই করোনায় মৃতদের ডেথ সার্টিফিকেট দিচ্ছেন চিকিৎসারত চিকিৎসকরা। এই রাজ্যেই শুধু ডেথ অডিট কমিটি গঠন করে চিকিৎসকদের হাত থেকে সেই ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এখানেই শুধু ডেথ অডিট কমিটি ঠিক করছে, কে করোনায় মারা গিয়েছে কে নয়। আর এজন্য এই ডেথ অডিট কমিটি একটি অদ্ভুত তত্ত্ব খাড়া করেছে। কী সেই তত্ত্ব? সম্প্রতি রাজ্যের মুখ্যসচিব ঘোষণা করলেন— এ রাজ্যে ৫৭ জন মারা গিয়েছেন। এদের প্রত্যেকেই করোনা পজিটিভ। কিন্তু এদের মধ্যে ১৮ জন মারা গিয়েছেন করোনায়। বাকিদের মৃত্যুর কারণ অন্য। ডেথ অডিট কমিটি একে কো-মবিডিটি বলে চালানোর চেষ্টা করছে। ডেথ অডিট কমিটির এই প্রচেষ্টা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। যে ব্যক্তি কিডনির অসুখে আক্রান্ত, যার কিডনির চিকিৎসা চলছে, চিকিৎসায় যিনি সাড়া দিচ্ছেন, করোনা পজিটিভ হয়ে পড়ার ফলে তার দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ফলত তিনি মারা যাচ্ছেন। তাকে কেন কিডনির অসুখেও মৃত বলে চালানো হবে? করোনা পজিটিভ হলে তো তিনি আরও বেশ কিছুদিন বাঁচতেন। কো-মবিডিটির এই অদ্ভুত তত্ত্ব কোনো রাজ্যেই চালু করা হয়নি। চালু করা হয়েছে। শুধুমাত্র এই রাজ্যেই। অন্য সব রাজ্যেই অন্য অসুখের জন্য চিকিৎসাধীন কোনো ব্যক্তি যদি করোনা পজিটিভ হয়ে মারা যান—তাকে করোনায় মৃত বলেই গণ্য করা হচ্ছে। তাহলে রাজ্য সরকার ডেথ অডিট কমিটি গঠন করে এই কাজটি করছে কেন? তা কি কোনো সত্য চাপা দিতে? এই সঙ্গত প্রশ্নটিই রাজ্যপাল করেছেন। এভাবে সত্য চাপা দেওয়ার প্রচেষ্টা রাজ্য সরকার এর পূর্বেও দেখিয়েছে। এর আগে যখন এই রাজ্যে ডেঙ্গি মহামারীর রূপ নেয় তখনো রাজ্য সরকার তথ্য গোপন করে রাজ্যকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দিয়েছিল। এক্ষেত্রেও রাজ্য সরকারের আচরণ যে স্বচ্ছ নয়, তথ্য গোপনের একটি প্রচেষ্টা যে রাজ্য সরকার করেই চলেছে— সে বিষয়ে বিভিন্ন মহল থেকেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। আসলে মূখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্য সরকারের আচরণই তাদের সম্বন্ধে যাবতীয় সন্দেহের সূত্রপাত ঘটিয়েছে। তদুপরি, কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক দলের পশ্চিমবঙ্গ সফর নিয়ে যেভাবে মুখ্যমন্ত্রী, মুখ্যসচিব এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বিরোধিতা করতে শুরু করেছেন, তাতেও পরিষ্কার হয়েছে, কিছু গোপন করার প্রচেষ্টায় তারা মরিয়া। কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক দল শুধু পশ্চিমবঙ্গে আসেনি। অন্য আরও। কয়েকটি রাজ্যেও গেছে। সেইসব রাজ্য। সরকার এই দলকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি। তাহলে পশ্চিমবঙ্গের এত আপত্তি কেন? সন্দেহটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।
রাজ্যপালের তৃতীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি এই সংকটের সময় রাজ্যে রেশন কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র করে। রাজ্যের রেশন কেলেঙ্কারিটি এখন দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। রেশনে পর্যাপ্ত পরিমাণে চাল, গম মিলছে না—এ অভিযোগে ইতিমধ্যেই বহু জায়গায় রেশন দোকানে হামলা হয়েছে। তদুপরি, রেশন দোকান থেকে তৃণমূল কংগ্রেস নেতাদের মাল তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও এখন প্রকাশ্যে এসেছে। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিয়োতে দেখা গিয়েছে, খোদ রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী তাঁরই দলের এক নেতাকে রেশন দোকান থেকে মাল তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভৎসনা করছেন। যত দিন যাচ্ছে, রেশন ব্যবস্থা নিয়ে রাজ্যের মানুষেরও ক্ষোভ আরও বাড়ছে। মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করেছিলেন, রাজ্যে কোনো খাদ্যসংকট নেই। তারপরও কিন্তু রেশনে পর্যাপ্ত জিনিস মানুষ পাচ্ছেন না। রেশনের এই দুর্নীতি রোধ করতে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপও এখনো পর্যন্ত চোখে পড়েনি।
রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান হিসাবে রাজ্যপাল যথার্থভাবেই এই প্রশ্নগুলি তুলেছেন। তাতে মুখ্যমন্ত্রীর গোঁসা হতেই পারে। নিজের ব্যর্থতার ছবি মুখ্যমন্ত্রী দেখতে চান না। দেখতে চান না বলেই তিনি রাজ্যপালের সাংবিধানিক এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। আমি নির্বাচিত আপনি মনোনীত—এহেন কথা বলে রাজ্যপালের সাংবিধানিক পদটিকে অপমান করার চেষ্টাও করছেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী ভুলে যাচ্ছেন, রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান হিসাবে রাজ্যপালের এই প্রশ্ন করার সম্পূর্ণ এক্তিয়ার রয়েছে। তেমনই মুখ্যমন্ত্রীও বাধ্য এইসব প্রশ্নের জবাব দিতে। আসলে মুখ্যমন্ত্রী ভাবতেই পারেননি, শ্রী জগদীপ ধনখড় রাজভবনের ঠাণ্ডা ঘরে বাধ্যছেলে হয়ে দিন কাটাতে আসেননি। তিনি এসেছেন রাজ্যপাল হিসেবে তার যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে।
রন্তিদেব সেনগুপ্ত