করোনা ভাইরাসের জীবাণু ছাড়াও এর সঙ্গী অস্ত্র আর একটি রয়েছে। এর নাম করোনা সম্পর্কে অজ্ঞতা। আমাদের পশ্চিমবঙ্গে দুটিই সমান সক্রিয়। আগামী বছরগুলিতে যখন আশা করা যায় এই ভাইরাস আক্রমণের ঘটনা অতীত হয়ে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেবে। তখন কিন্তু গবেষকরা এটাও একইভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন যে এই মহামারী বাড়িয়ে তোলার। ক্ষেত্রে কোভিড-মূর্খদের অবদান কতটা ছিল। আমি সঠিক সময়ে বিশ্ববাসীকে যথাযথভাবে সচেতন করার ক্ষেত্রে হু অর্থাৎ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঢিলেমি যা চীনকে না। চটানোর পন্থা অবলম্ব করা হয়েছিল শুধু, সে প্রসঙ্গে বলছি না। এই মহামারীর। ভয়ংকরতা প্রকাশ্যে আসার বেশ কিছু পরেও এই সংক্রান্ত মূখরা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাতে মাঠে নামে। ভারতের ক্ষেত্রে দিল্লিতে তবলিগি জামাতের নিজামুদ্দিনে জমায়েতের ঘটনা সারা দেশে এই মারাত্মক জীবাণু ছড়িয়ে দিতে বড়ো ভূমিকা নেয়। এর ফলে নাগরিক মনে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়, এমনকী এর রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও নজরে আসতে শুরু করে। ১৪ এপ্রিল অবধি করা সমীক্ষায় দেখা যায় সেই সময় গোটা দেশের করোনা আক্রান্তের সংখ্যার সূচকে তবলিগি মরকজের সুত্রে জড়িত ছিল ৩৪ শতাংশ। রোগী। এই সূত্রে রাজস্থানের জয়পুরের উল্লেখ জরুরি। এখানকার এক কোভিড-মূখ সদ্য ওমান থেকে সংক্রামিত হয়ে ফেরার পর সমস্ত স্বাস্থ্য বিধি সম্পর্কিত বিধিনিষেধ অমান্য করে একার কৃতিত্বে ২৩২ জন মানুষকে এই ব্যাধির শিকার করে ফেলেন। মনে হয় আগামীদিনগুলিতে কোভিডমূর্খদের এই ধরনের স্বেচ্ছাচারী কার্যকলাপের আরও নিদর্শন সামনে আসবে। মনে রাখা দরকার, এই কোভিড মূখর্তা শুধুমাত্র অতি গোঁড়া রক্ষণশীল গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ইজরায়েলের মতো উন্নত দেশেও রাজধানী শহর জেরুজালেম এই ধরনের কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। ভারতে এই জীবাণু আক্রমণের ফলে এবং বিশাল দেশ হওয়ার কারণে জাতীয় পরিকল্পনা ও নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে উপযুক্ত দায়িত্ব পালনের প্রয়াস চলছে।
সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করে দেশের নানা রাজ্যে কোটি কোটি মানুষ নিদারুণ কৃচ্ছু সাধন করে দীর্ঘ দিন গৃহবন্দি অবস্থায় দিন যাপন করছেন। কিন্তু তাদের এই কষ্টসাধন বিফল করতে কয়েকটি অভিশপ্ত রাজ্য সরকার লকডাউন অমান্য করার স্পর্ধা দেখাচ্ছেন। এই সূত্রে আতঙ্কের কেন্দ্রস্থল পশ্চিমবঙ্গ। এই রাজ্যে বাস্তব পরিস্থিতিকে অস্বীকার করে স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক ফয়দা তোলার ফলে পরিস্থিতি ভয়ংকর হয়ে উঠছে, আর তা হঠাৎ করে হাতের বাইরে চলে যেতে পারে। বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে এই সংক্রান্ত নানান প্রামাণ্য তথ্যাদি উঠে আসছে। শুরুতেই উদাহরণ হিসেবে ১৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় দেওয়া পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে ঘোষিত আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৪৪ জন। ১৭ এপ্রিল সকালবেলায় কেন্দ্রীয় সরকারের হিসেব অনুযায়ী (যা সারা দেশের ক্ষেত্রে গ্রাহ্য হচ্ছে। এই সংখ্যা ছিল ২০৪। এই দুটি পরিসংখ্যানই কিন্তু সম্ভাব্য আক্রান্তের সংখ্যার অনুপাতে কিছুটা কম মনে হতে পারে। কেননা প্রথমত রাজ্যের তরফে কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগার (আইসিএমআর)-এর পাঠানো নমুনার সংখ্যা অত্যন্ত কম এবং রাজ্যে সামগ্রিক পরীক্ষার সংখ্যাও লক্ষণীয়ভাবে কম। অত্যন্ত উদ্বেগজনকভাবে লক্ষণীয় যে রাজ্যের অন্তর্দেশীয় সীমানা সংলগ্ন জেলাগুলি যেমন, মালদা, মুর্শিদাবাদ , উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর থেকে কোনো বিশ্বাসযোগ্য তথ্যই হাতে আসছে না। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ওই তারিখে দেওয়া মৃতের সংখ্যা যা অত্যন্ত নগণ্য। মাত্র ১০। এদিকে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রোগীর আত্মীয় পরিজনদের অজ্ঞাতে বহু দেহ পুড়িয়ে বা কবরস্থ করার প্রত্যক্ষ প্রমাণ-সহ নানা খবর প্রচারিত হচ্ছে। ফলে রাজ্যের পক্ষে দেওয়া পরিসংখ্যান মানুষের কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকছে। আলোচ্য সময়ে রাজ্যের বাঁকুড়া জেলা থেকে এক চাঞ্চল্যকর অভিযোগ উঠে এসেছে। রাতের অন্ধকারে সেখানে শাসকদলের কর্মীদের তত্ত্বাবধানে অত্যন্ত গোপনে ২টি মরদেহ সৎকারের সময় ব্যাপক শোরগোল বেঁধে যায়। এই সূত্রে স্থানীয় সাংসদের বিরুদ্ধে এই গোপন অন্যায্য অন্তিম সংস্কারে বাধা দেওয়ার জন্য মামলা দায়ের করা হয়েছে। এরই মধ্যে রাজ্য সরকার করোনা আক্রান্তের মৃত্যু করোনাতেই হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করে ঘোষণা করার জন্য ৫ জন চিকিৎসককে নিয়ে একটি বিশেষ কমিটি তৈরি করেছে। রাজ্যের এই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি চিকিৎসক মহল মোটেই সুনজরে দেখছেন না। অথচ কেউই এই ধরনের মহামারীর প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে দায়ী করেননি। সে কারণেই এই ধরনের তথ্যের কারচুপি করার যে অভিযোগ উঠেছে তার কারণ দুর্বোধ্য। কিন্তু করোনা প্রতিরোধে অন্যান্য জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
প্রথমত, জরুরি বিধিনিষেধের মধ্যে সামাজিক দুরত্ব বা সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং অত্যন্ত দায়সারা ভাবে পালিত হচ্ছে। এই সূত্রে মুসলমান মহল্লাগুলিতে লকডাউনের কোনো প্রভাব লক্ষ্য করা যায়নি। সেখানে জীবনযাত্রা প্রায় স্বাভাবিক। এর ফলে সংক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। এই নিয়ে কেন্দ্র সরকার রাজ্যকে এক ধরনের সাম্প্রদায়িক মনোভাব বজায় রাখার জন্য। অভিযুক্ত করেছে। এ যাবৎ প্রাপ্ত সমস্ত হিসেব থেকে দেখা যাচ্ছে এই রাজ্য থেকে যে ৩০০ জন লোক দিল্লিতে তবলিগি মরকজ জমায়েতে অংশ নিয়েছিল সরকার তাদের কোনো অনুসন্ধান, পরীক্ষা বা নিভৃতকরণ সম্পর্কে কোনো তথ্য সামনে আনেনি। বাস্তবে বিষয়টিকে প্রাপ্য গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনাই করা হয়নি।
দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তার জন্য 637 Personal Protective Equipment (PPT) কেন্দ্রীয় সকরারের তরফে পাঠানো হয় তার রং হলুদাভ হওয়ায় তিনি এর মধ্যে শাসকদলের রাজনীতির গন্ধ পেয়ে এগুলিকে গ্রহণে অস্বীকার করেন। জনস্বাস্থ্য দপ্তর মহামারী মোকাবিলায় খেয়ালখুশি মতো কাজকর্ম শুরু করে। এইভাবে ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত পোশাকগুলিকে বাতিল করায় বহু স্বাস্থ্যকর্মীই নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন। পরিণতিতে আক্রান্ত রোগীদের সঙ্গে উপযুক্ত বর্মবস্ত্র ছাড়াই কাজ করতে বাধ্য হওয়ার কারণে অনেক স্বাস্থ্যকর্মী রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। হাসপাতালগুলিকে সংক্রমণমুক্ত করতে ও অসুস্থ স্বাস্থ্যকর্মীদের নিভৃতাবাসে পাঠানোর জন্য অনেক হাসপাতাল বন্ধ করে দিতে হয়। সেখানকার রোগীদের অন্যত্র স্থানান্তরিত করা হয়। এর আর একটি কারণ করোনা আক্ৰন্তের প্রকৃত সংখ্যাকে অস্বীকার করে আক্রান্ত ও সাধারণ রোগীকে একই সঙ্গে রাখা। এই সূত্রে কলকাতার বাঙুর হাসপাতালের বিরুদ্ধে অঘোষিতভাবে মৃত করোনা রোগীদের দেহ পচন ধরার অভিযোগ উঠেছে। হাসপাতালের জেনারেল ওয়ার্ডের মধ্যে এই ঘটনার হদিশ মেলেছে। এই সূত্রে চিকিৎসকদের ভীতি প্রদর্শন ও তাদের কর্মক্ষেত্রে আতঙ্কগ্রস্ততার কারণে রাজ্যের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ার পর্যায়ে। স্থানীয় প্রচার মাধ্যমগুলিতে এই ধরনের। খবর এখন কেবলমাত্র দায়সারা ভাবে নামমাত্র পরিবেশিত হয় মাত্র।
ভয়ের কারণ হলো যদি হটস্পট এলাকাগুলিতে গোষ্ঠী সংক্রমণ ঘটে যায় তাহলে পরিস্থিতি ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। যে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। রাজ্যের অভ্যন্তরে যে আতঙ্ক দানা পাকিয়ে উঠছে তার পরিণতিতে সামাজিক অস্থিরতাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় রেশন। দোকানগুলিতে খাদ্য বটন নিয়ে রাজনীতিকরণ হওয়ায় মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ধূমায়িত হচ্ছে। দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে রাজ্যগুলির এই মহামারী মোকবিলায় ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু যদি দেখা যায় কোনো রাজ্য এই ধরনের জাতীয় বিপর্যয় সামলাতে ব্যর্থ হচ্ছে এবং কেন্দ্রীয় নির্দেশাবলীকে হেলায় অস্বীকার করছে। সেক্ষেত্রে কেন্দ্রের তরফে কেবল নির্দেশ দিয়েই বসে থাকলে দায়িত্ব পালন হবে না। এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজা জরুরি।
স্বপন দাশগুপ্ত
(লেখক বিশিষ্ট স্তম্ভলেখক এবং রাজ্য সভার সাংসদ)