দোল পূর্ণিমার সাথে বাঙালির একটা চিরন্তন সম্পর্ক আছে। রাধা-কৃষ্ণের দোলযাত্রা তো এই বাংলায় কিংবদন্তি। আবার, শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুও এ দিনটিতেই নবদ্বীপে জন্ম গ্রহণ করেন। তাই আজ গৌর-পূর্ণিমাও বটে। আবার বলীপুর-এর (বর্তমানে বোলপুর) রাজা সুরথ প্রায় ৫ হাজার বছর আগে, যেই তিথিতে প্রথম দুর্গা প্রতিমা নির্মাণ শুরু করেন, সেটিও ছিল দোল পূর্ণিমা। আজকে সেই দুর্গোৎসব “বাসন্তী দুর্গা পূজা” নামে প্রচলিত। এমন কি, বাঙালির ঘরে ঘরে প্রচলিত মা লক্ষ্মীর পাঁচালীও শুরু হচ্ছে এইভাবে-
“দোল পূর্ণিমার নিশি, নির্মল আকাশ।
মৃদু মৃদু বহিতেছে মলয় বাতাস।।”
দোলের দিনটির সাথে বাংলার এত রথী-মহারথী অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত, যে এই দিনের মাহাত্ম্য বলে শেষ করা যাবে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে যে বসন্ত উৎসবের সূচনা করেন, তারও শিকড় এই দোলযাত্রায়। অথচ এমন পবিত্র একটি দিন যতটা শালীনতা এবং ভাবগাম্ভীর্যের সাথে পালন করা জরুরি ছিল; গত কয়েক বছর ধরেই তাতে খামতি ধরা পড়ছে।
প্রথমে বলিউডের হাতে পড়ে দোল যাত্রা হয়ে উঠল সিদ্ধির ঘোল খেয়ে মাতলামো করার উৎসব। তার সাথে ইতিউতি চলবে মেয়েদের হাত ধরে টান মারা, চটুল নাচ, অশ্লীল ইঙ্গিত ইত্যাদি। হিন্দি সিনেনার প্রভাবে এই “বেলেল্লা দোল”-এর ধারণা দেশ জুড়ে দারুন জনপ্রিয়তা পেল। সেখান থেকেই টুকলি শুরু করল বাংলা। ধীরে ধীরে দোল মানে হয়ে উঠল মদ খাওয়া, প্রেম করা আর ইয়ার্কি-ফাজলামো মারার দিন। শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্যবাহী বসন্ত উৎসব পরিণত হল মেয়ে দেখা, ঝারি মারা আর প্রেম করার ঠেক-এ। হারিয়ে গেল দোলের সকালে স্নান সেরে বিশুদ্ধ হয়ে, শ্রী শ্রী রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ এবং গৌরাঙ্গের মূর্তি নিয়ে নগর কীর্তন করার নিয়ম। কিংবা প্রথমে ঠাকুরের আসনে এবং তারপর গুরুজনদের পায়ে আবীর নিবেদন করে তবেই পাড়ার বন্ধুবান্ধবদের সাথে রং খেলতে যাবার বাঙালি আচার। এখনকার দোল খেলায় কোন আচার নেই, বিচার নেই, নিয়ম নিষ্ঠা কিচ্ছু নেই। শুধু নেশা, শরীরী ভালোবাসা আর ডিজে বাজিয়ে রং মেখে উদ্বাহু নেত্য; এই আমাদের “বেলেল্লা দোল”!
তাই এবারের বসন্ত উৎসবে রোদ্দুর রায়ের অনুপ্রেরণায় যেসব অশ্লীল কথা জামায়, পিঠে আবীর দিয়ে লেখা হয়েছে, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। ভাঙ্গন অনেক আগেই শুরু হয়ে ছিল। আমরা চোখ সরিয়ে রেখেছি, দেখেও না দেখার ভান করেছি। আর আজ পতনের এমন চরম সীমায় আমরা উঠে পড়েছি যে তাকে আর এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। কোন জাতির অবক্ষয়ের চূড়ান্ত চিহ্ন তার মধ্যে অশ্লীলতার বাড়াবাড়ি, অভদ্রতায় আনন্দ খোঁজার চেষ্টা এবং অনুশাসনের প্রতি তীব্র অবজ্ঞা। এই তিনটেরই অভিজ্ঞতা বাঙালি জাতির হয়েছে।
উশৃঙ্খল, বাঁধন ছেঁড়া, দিশাহারা বাঙালি জাতি আজকে রোদ্দুর রায় বা ওই অশ্লীলতা পিঠে লেখা মেয়েগুলোকে দোষ দিয়ে নিজের দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। কিন্তু যে বেনো জল এই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে, সেটা সরানো হবে কিভাবে? এই রোদ্দুর রায় বা ওই মেয়েগুলি তো এই পতিত সমাজেরই ফসল। সামাজিক নিয়ম মানুষকে একটা গন্ডি দেয়, গন্ডি মানুষের জীবনকে শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখে। সমাজ নিজেই যদি শৃঙ্খল ভেঙে বিশৃঙ্খলায় উৎসাহ দেয়, তাহলে এই ছেলেমেয়ে গুলোর দোষ কোথায়? আর বিশৃঙ্খলার কোন এতটা-অতটা হয় না; যে এতটা বিশৃঙ্খলা করতে পারে, সে তার বেশি কিংবা আরো আরো বেশিও করতে পারে। সামাজিক বিশৃঙ্খলা কাটানোর একমাত্র উপায় গন্ডিবদ্ধ জীবনে ফেরত যাওয়া।
বাঙালি জীবনে গন্ডী চিরকাল ছিল। বাঙালির নিজস্ব হিন্দু ধর্মই তৈরি করেছিল সেই গন্ডি। তারই ভিতরে বাঙালি তৈরি করেছিল নিজের সামাজিক পরিসর। ছন্দবদ্ধ জীবন, সুশৃঙ্খল আচরণ। এই পরিমণ্ডলেই তৈরি হয়েছিল বাঙালি কৃষ্টি, সংস্কৃতি, সভ্যতা এবং চেতনার দর্পণ। এসব কিছুকে এক ধাক্কায় ছিটকে দেবার মধ্যে ছেলেমানুষি বিদ্রোহ আছে, কিন্তু গড়বার সংকল্প নেই। কারণ ভাঙা সহজ কিন্তু গড়া কঠিন। পূর্বপুরুষের গড়ে যাওয়া নিয়ম গুলোকে খেয়াল-খুশিমত বাতিল করে দেওয়াই যায়; কিন্তু সেই নিয়ম পালন করতে, তাকে ধরে রাখতে জোর লাগে। বাঙালি সোজা কাজগুলো বেছেছে আর যা কিছু কঠিন, তাকে “সেকেলে কুসংস্কার” নাম দিয়ে ফেলে দিয়েছে।
কোন জায়গা তো আর ফাঁকা থাকে না, এটাই জগতের নিয়ম। সামাজিক শৃঙ্খলাকে “প্রাচীনপন্থা” মনে করে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করলে, সেই শূন্যস্থান বেলেল্লাপনা দিয়েই ভরাট হবে। তাই জাতিটা এখন এমন একটা খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে তার কাছে ঠিক দুটোই রাস্তা আছে। হয় যেমন চলছে চলতে দাও আর কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাও। অথবা গন্ডি ফেরাও, জাতির শক্তি বাড়াও। দ্বিতীয় রাস্তা ধরে হাঁটতে ধৈর্য্য চাই। কিন্তু সাফল্য নিশ্চিত। বাঙালি জাতির সাফল্যের জন্য দোলযাত্রা শুরু হোক গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর নাম কীর্তন দিয়ে।
“গৌরাঙ্গ করুণা করো দীন-হীন জনে।
মোর সম পতিত প্রভু নাহি ত্রিভুবনে।।
দন্তে তৃণ ধরি গৌর ডাকি হে তোমারে।
কৃপা করি এসো আমার হৃদয় মন্দিরে।।
যদি দয়া না করিবে পতিত দেখিয়া।
তবে পতিত-পাবন নাম কিসের লাগিয়া।।
পড়েছি ভব তুফানে নাহিকো নিস্তার।
শ্রী চরণে তরণী দানে দাসে করো পার।।
শ্রী কৃষ্ণ চৈতন্য প্রভু দাসের অনুদাস।
প্রার্থনা করয়ে সদা নরোত্তম দাস।।”
উপরে লেখা বিখ্যাত বাংলা কীর্তনটি শুনুন, সংগীতের সর্বোচ্চ পুরস্কার গ্র্যামি বিজয়ী ইলান চেস্টারের কণ্ঠে। যিনি ইহুদি ঘরে জন্মেও শ্রী মহাপ্রভুর করুণায় হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেন। গানটি শুনুন এখান থেকে-
সকলকে দোলযাত্রার এবং গৌর-পূর্ণিমার শুভেচ্ছা।
স্মৃতিলেখা