দীপ জ্বেলে যাই

বেশিরভাগ পূর্ব বঙ্গীয় পরিবারই জানে না, ভিটে ছাড়া হবার আসল কারণ। পারিবারিক ভাবে কোথা থেকে এলাম, কতদিন আগে এলাম ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলেও; “কেন এলাম”, সেই প্রশ্নটা সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া হয়। ছোটবেলাতেই সঠিক ইতিহাস না জানানোর ফলে বাঙালি শিশু বড় হয় অপরিণত ইতিহাস বোধ নিয়ে। নিজেদের অতীত না জানলে বর্তমানের সঠিক বিচার করা যায় না। ইতিহাস একটা গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। এর সঠিক প্রয়োগ আমাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে। ইতিহাস শিক্ষার আসল সময় হল শৈশব। তবে ছোটদেরকে দিয়ে ইতিহাস চর্চা করাতে গেলে তাদের মধ্যে সে বিষয়ে আগ্রহ জাগানোটা খুব জরুরি। আর সেই আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে গেলে হাতেকলমে কাজের কোন বিকল্প নেই। কাজ করতে করতে বিষয়টা নিয়ে কৌতূহল তৈরি হয়। কৌতূহল থেকে আসে প্রশ্ন। প্রশ্নের উত্তর শুনতে শুনতেই মাথায় গেঁথে যায় লুকিয়ে রাখা আসল ইতিহাস। ইতিহাস সচেতন শিশুই ভবিষ্যতের কারিগর।

তাই গতবারে কালী পুজোয়, পারিবারিক থিম ছিল নোয়াখালী স্মরণ। কালী পুজোয় নিয়ম মাফিক বাজি ফাটানো, ফানুস ওড়ানো, পাঁঠা দিয়ে মহাভোজের সাথে সাথে নিজেদের ইতিহাস ফিরে দেখা। ছোট ছোট ভাইবোনেরা যখন সবাই এসে পৌঁছুল, তখন অমাবস্যা পড়ে গেছে। ছাদে মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রদীপ সাজানো শুরু করলাম। প্রায় দেড়শ প্রদীপ সাজাতে হবে “নোয়াখালী”-র আকারে। একেকজন একেকটা অক্ষরের দায়িত্ব নিয়ে নিল। কেউ সাজাচ্চে “ন”, কেউ “য়”, কেউ “খ”, কেউ “ল”! আমি পড়লাম আকার ইকার গুলো নিয়ে। প্রায় দেড় ঘন্টার সম্মিলিত চেষ্টায় প্রদীপের মালায় সেজে পরিষ্কার ভাবে ফুটে উঠল “নোয়াখালী”! এতক্ষণ কেউ কোন কথা বলেনি। প্রদীপ সাজানো শেষ হবার পর, ধীরে ধীরে প্রশ্নগুলো বেরোতে শুরু করল। “নোয়াখালী কোথায় ছিল”? “নোয়াখালীতে কি হয়েছিল”? উত্তর দিতে তৈরি ছিলাম, উত্তর দিতেই এত আয়োজন। যে নোয়াখালী আমাদের দুঃস্বপ্ন, ঢাকা আমাদের দুঃস্বপ্ন, শ্রীহট্ট-কুষ্টিয়া-পাবনা-কুমিল্লা গোটা পূর্ব বঙ্গটাই আমাদের কাছে দুঃস্বপ্ন। তবু এতগুলো ছোট ছোট ভাইবোনের মধ্যে উত্তর দিতে বাঁধো বাঁধো ঠেকছিল। মনে ভিড় বাড়াচ্ছিল অনেক রকম প্রশ্ন।

একটা নির্মম রূঢ় বাস্তবকে বিস্মৃতির ধুলো ঝেড়ে ছোটদের সামনে তুলে ধরা কি উচিত কাজ? তারা যখন বুঝবে, তারা একটা পরাজিত, লুন্ঠিত, অত্যাচারিত জাতির উত্তরাধিকারী, তাদের প্রতিক্রিয়া কি হবে? ধাক্কাটা কি তারা সামলে উঠতে পারবে? ছোটদের ইতিহাস চেনাতে গিয়ে আমি নিজেই অনুভব করলাম কেন আমাদের পালিয়ে আসা পূর্বপুরুষরা আসল ইতিহাস গুলো চেপে গেছিলেন। লজ্জার ইতিহাসগুলো পাঁচকান করতে চাননি। হয়তো তারা চেয়েছিলেন তাদের সন্তান আর পাঁচটা জাতির মতই জাতিগত অস্মিতা নিয়ে বেড়ে উঠুক। হেরে যাবার লজ্জা নিয়ে নয়।

দেড়শ প্রদীপে দেশলাই জ্বালাতে গিয়ে বিপদে পড়লাম। দমকা হাওয়ায় বারবার নিভে যাচ্ছিল প্রদীপের আগুন। তেল বাড়িয়ে, সলতে ডুবিয়েও বিশেষ লাভ হচ্ছিল না। প্রদীপের দুরবস্থা দেখে, প্রদীপের একদম সামনে এসে বাবু হয়ে বসে পড়ল আমাদের মধ্যে সবচে ছোট জন। এতে কাজ হল। একটা আড়াল পেয়ে পটাপট জ্বলে উঠল প্রতিটা প্রদীপ। আঁধার কালো রাতে দেড়শ প্রদীপের আভায় গোটা ছাদটাকে অন্যরকম দেখাচ্ছিল। বৈপরীত্যের সৌন্দর্য অতুলনীয়। তাই এক রাশ আলোর সামনে বসা ছোট ভায়ের ছায়াময় মুখটা ঠিক বাঁধিয়ে রাখার মত হয়েছিল। আর সেই ছবিটাই বহুদিন যাবৎ ভাইয়ের প্রোফাইল ছবি হিসেবে ছিল। যতজন লোকে ছবিটা দেখেছে, প্রশংসা করেছে, ভাইটিকে জিজ্ঞেস করেছে, ওই একই প্রশ্ন। নোয়াখালী কি, নোয়াখালী কোথায়, নোয়াখালী কেন? প্রতিটা প্রশ্ন একেকটা সুযোগ। উত্তর দেবার, ইতিহাস জানাবার, সত্যিটা ছড়াবার। একজনকে জানালে অনেককে জানানোর পথ তৈরি হয়।

কদিন আগে একবার পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য পতাকা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করছিলাম। পরামর্শের জন্য ডেকেছিলাম সেই ভাই বোনদের। পতাকার রং, নকশা সমস্ত বিষয় নিয়ে তাদের উৎসাহ আমাকেও ছাপিয়ে যায়। পরীক্ষার মধ্যেও সময় বের করে, তারা বানিয়ে ফেলল পশ্চিমবঙ্গের ডিজিটাল পতাকা। উদ্যোগটা আমার হলেও পরিশ্রমটা তাদের। জোড়া খড়্গের মাঝে গৌড়ীয় বৈষ্ণব তিলক- এটাই ছিল রাজ্য পতাকা নিয়ে আমার মূল ভাবনা। শাক্তের খড়্গ যতদিন জেগে থাকবে, বৈষ্ণবের তিলক ততদিন সুরক্ষিত থাকবে। ওদের হাতে রাজ্য পতাকার নতুন রূপ দেখে তৃপ্তি হল। আমি পেরেছি। আমাদের ইতিহাস চেতনাকে ওদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছি।

হয়তো এভাবেই বেঁচে ওঠে অতীত। জীবন্ত হয়ে ওঠে নতুন থেকে নতুনতর প্রজন্মের হাত ধরে। আমাদের ইতিহাসকে, আমাদের আগামীর পরিকল্পনাতে ছোটদের অবশ্যই জায়গা দিতে হবে। আমরা বর্তমান হলে ওরাই ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যতের প্রদীপ অবশ্যই জ্বলে উঠবে, যদি আগুন টুকু আমরা দিয়ে যাই।

স্মৃতিলেখা চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.