পাঠ্যসূচি: প্রতিবাদ ও প্ররোচনা

সংখ্যাটা এখনও পর্যন্ত পাওয়া খবরে ছেচল্লিশ। যেখানে প্রায় দু’শো আহত এবং নিখোঁজ তিন শতাধিক, সেখানে এই লেখা প্রকাশ পেতে পেতে হাফ সেঞ্চুরি ছাড়াবে অনুমান করাই যায়। অঙ্কিত শর্মার ৪০০টি ছুরিকাঘাত ও স্থানে স্থানে অ্যাসিড-দগ্ধ দেহের সঙ্গে একই নালা থেকে এক তরুণীর নগ্ন অর্ধদগ্ধ ধর্ষিত দেহ আবিষ্কৃত হয়েই যখন থেমে থাকেনি, উত্তরপূর্ব দিল্লীর খালগুলো থেকে একেএকে গলাপচা দেহ উদ্ধার হয়ে চলেছে, তখন নিখোঁজদের পরিণতি অনুমান করা কষ্টের হলেও কঠিন নয়।
দিল্লিতে বিদ্যুত ফ্রী, শিক্ষা ফ্রী, মহিলাদের বাসভাড়া ফ্রী, বাসে নির্ভয়া কাণ্ড ঘটালেও ছেলেছোকরা ফ্রী। আর সম্প্রদায় বিশেষের ধারাবাহিক অবরোধ দ্বারা জনজীবনকে বিধ্বস্ত করে রাখার অধিকার, অস্ত্রশস্ত্র অ্যাসিড পেট্রোল ইত্যাদি মজুদ ও যথাসময় প্রয়োগ করার অধিকার, প্রতিবাদের নামে ভাঙচুর অগ্নি সংযোগ দ্বারা জনতার সম্পত্তি ধ্বংস করার অধিকার, নৃশংস একক বা দলবদ্ধ ধর্ষণ খুন করার অধিকার – এসব সুবিধা তো সারা দেশেই ফোকটে বিলোনোর প্রতিযোগিতা চলছে।
ফ্রী বিদ্যুত, বাসভাড়া, অনুপ্রবেশ এগুলো আশা করছি দেশের জিডিপি বৃদ্ধির সহায়ক হবে। তবে সেইসব সুবিধার লোভে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট দলের বদলে ধর্মনিরপেক্ষ দলের জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচিত করার পুরস্কার দিল্লীবাসী হাতে গরম পেয়ে গেল। মিডিয়া, বিরোধীরা বা বুদ্ধি জামিনজীবীরা যাই প্রচার করুক, দাঙ্গার প্রস্তুতি কারা নিয়েছিল, আর সূত্রপাত কারা করেছে, দিল্লীবাসী তো বটেই সারা দেশবাসীর কাছেই ব্যাপারটা পরিষ্কার। যারা উল্টো গাইছে তারা হয় অনুপ্রবেশকারী, নয় পেট্রোডলার পুষ্ট, অথবা মিডিয়ায় কেরিয়ার গড়তে মরিয়া কিংবা বিশুদ্ধ উন্মাদ। অবশ্য দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী সেনা নামানোর আবেদন করার পরেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক তৎক্ষণাৎ কেন কড়া পদক্ষেপ নেয়নি, সে নিয়ে প্রশ্ন তোলা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার, যদিও নিতে গেলেও গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ বলে চেঁচানোর রেকর্ড আমরাই দেখেছি। ধুস! এসব তো অশিক্ষিত চাড্ডিদের আইটি সেলের ব্রেন ওয়াশ করার মন্ত্র। প্রকৃত শিক্ষাটা ঝালিয়ে নেওয়া যাক।

প্রথম পাঠ: “তুমি আসবে বলে দেশটা এখনও গুজরাট হয়ে যায়নি।” ঠিকই তো। গুজরাট কেন হবে? আদর্শ তো নোয়াখালী, বরিশাল – সত্তর বছরে ২৯%-কে পিষে ৫%-এ নামিয়ে আনা এবং সেই জ্যামিতিক প্রগতি অব্যাহত রাখা। মডেল তো পাকিস্তান – ২৩%-কে মেরে ২% করার ঈর্ষণীয় সাফল্য। এই দুই বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যায়ে যখন আমাদের এলিট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অ্যাফিলিয়েশন, তখন নোটার চেয়ে কম বলে একদম খোঁটা দেওয়া বৃথা। ঐ দিয়েই যে সারা দেশে বিপ্লবের আগুন জ্বালানো যায় তা তো প্রমাণিত।
দ্বিতীয় পাঠ: ছোটবেলায় ‘নাম ডাকাডাকি’ খেলতাম মনে আছে? বিপক্ষ দলের বন্ধুর চোখ টিপে নিজের দলের কাউকে ছদ্মনামে ডাকা – “আয় তো আমার গাঁদা ফুল।” গাঁদাফুল নাম দেওয়া ছেলেটা চোখ বাঁধা মেয়াটির মাথায় চাঁটি কষিয়ে যাওয়ার পর চোখ ছেড়ে দিতাম। চোখ খোলার পর তাকে বলতে হবে কে মারল। খুনি ধর্ষক দাঙ্গাবাজ ও মৃতের নাম পরিচয়গুলো নিয়েও তেমন নাম ডাকাডাকি খেলতে শিখছি। যেমন পিস্তল উঁচিয়ে পুলিসের দিকে ধাওয়া করে আসা সুদর্শন নায়কটির নাম শাহরুখ মহম্মদ বা শাহরুক পাঠানের বদলে দিয়ে দাও ‘শাহরুখ চন্দ্রাল শুক্লা’। বেশ কয়েকটি হিন্দু নাম নিয়ে নাড়া বাছার পর এই নামটাই আধিকাংশ সেকুলারের পছন্দ। ঠিক যেমন ধর্ষক খুনিদের আসল আরবি নামের বদলে প্রায়ই প্রতীকী সনাতন ভারতীয় নাম দেওয়া হয়ে থাকে। হয়তো শুনব UUP নেতা তাহির হুসেন আসলে UP ব্রাহ্মণ। নামটা এখনও ঠিক করা হয়নি? অসুবিধা নেই। হলেই নতুন নতুন website তৈরি করে তার লিংক পাঠিও, দেদার শেয়ার করব। ফাটাফাটি! এই না হলে গবেষণা? তবে চোখ ঢাকা বাচ্চাটা মাথায় কে মেরেছে বলতে পারলে সে জিতে যেত। কিন্তু তোমার দেওয়া উচ্চশিক্ষায় চোখ খুলেও ক্ষেত্রবিশেষ বেছে ছদ্মনামটাই আওড়াতে হবে। এই না হলে শিক্ষানবিশী?
তৃতীয় পাঠ: নাম করণের মতই কাহিনী নির্মাণ অত্যাবশ্যক। যেমন দিল্লীর মুসলমান অধ্যুসিত এত জায়গা এমনকি খোদ শাহিনবাগ থাকতে দাঙ্গা পূর্ব দিল্লীর উত্তরপ্রদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় হওয়ার কারণ দর্শাতে সামাজিক মাধ্যমে জনৈক সেকুলার সাংবাদিক লিখিত একটা মজাদার গল্প ঘুরপাক খাচ্ছে। ঐসব এলাকার বাসীন্দাদের ২২ শতাংশই বাঙালি ও প্রধানত মুসলিম বাঙালি যারা পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে গিয়ে পোশাক কারখানা ও সোনা রূপোর গয়না নির্মাণ শিল্পে ছোট বড়ো কারিগরের কাজ করে কয়েক বছরের মধ্যে অবস্থা ফিরিয়ে ফেলে। বৈধ ভোটার, রেশন, প্যান কার্ডও জুটিয়ে ফেলে। দিল্লীতে দাঙ্গার ভয় দেখিয়ে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে খমতা দখল করতে চায় গেরুয়া শিবির। তাছাড়া দাঙ্গা করে পার্শ্ববর্তী রাজ্যে পলায়নের সুবিধাও আছে। যা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট দৃশ্যমান, তা তো অশিক্ষিত জনসাধারণ ও সাম্প্রদায়িক শক্তির ব্যাখ্যা। সৃজনশীলতা তো এমন কষ্টকল্পিত জটিল কাহিনী নির্মাণ করতে পারার মধ্যেই। দিল্লীতে দাঙ্গা বাধিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ভোটযুদ্ধ জেতার গৈরিক ষড়যন্ত্রটা বোধগম্য না হলেও দাঙ্গায় ব্যবহৃত শত সহস্র অম্ল থলিকার উৎস কী, তা বোধহয় এই গল্পটিই জলবৎ পরিষ্কার করে দিয়েছে। কে না জানে গয়না নির্মাণে সর্বাধিক ঘন ও শক্তিশালী অ্যাসিড বহুল ব্যবহৃত হয়। আর পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাওয়া মুসলিম বাঙালিরাও অধিকাংশ বাংলাদেশী হয়ে থাকতেই পারে; কারণ পোশাক তৈরিতে বাংলাদেশী দর্জিদের সুনাম বিশ্বজোড়া। উপরন্তু ভোটার আধার রেশন কার্ড যে সহজলভ্য সেটাও এই কাহিনী থেকেই উঠে এসেছে। কিন্তু এসব বুঝে ফেলা বা প্রশ্ন তোলা অনুচিত। ততটুকুই বুঝতে হবে যতটুকু বোঝানোর চেষ্টা এইসব গবেষকরা করছেন।
তাছাড়া বিগত কয়েক বছরের সিলেবাস অনুযায়ী: ভাঙচুর অগ্নিকাণ্ড বাধানো দাঙ্গাবাজদের ছেড়ে কথা বলা হবে না, তারা মরণের পানে ছুটলে বাঁচানো সম্ভব নয় – প্রশাসক হিসাবে এই সতর্কবাণী দেওয়া হল ফ্যাসিবাদ; পোশাক দেখে দাঙ্গাকারীদের চিনতে পারা মানে চরম সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ (যদিও পোশাক খুলে দেখলে সনাক্তকরণ সহজতর হয়ে যায়); দেশের বিশ্বাসঘাতকদের গুলি মারা উচিত বলা মানে মানবাধিকার হনন, সাম্প্রদায়িক হামলার প্রস্তুতি; এমনকি ৩৫ লক্ষ মানুষের জনজীবন স্তব্ধ করে পয়সার বিনিময়ে করা ইঁট-পাটকেল সমন্বিত অবরোধ তুলে দেওয়ার জন্য পুলিসের কাছে দাবি জানানোও হল দাঙ্গায় প্ররোচনা। আর অবশ্যই ক্লাস নেওয়ার সময় বাক্যের গুরুত্ব বুঝে কিছুটা কেটে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করাটা শিক্ষক শিক্ষণের অন্যতম নির্দেশিকা। যেমন ‘দেশ কী গদ্দারোঁ কো’ অংশটা বাদ দিয়ে শুধু ‘গোলি মারো’ বাক্যাংশটি বারবার মুখস্থ করাতে হবে, যেহেতু গদ্দারদের নিয়ে সমস্যা নেই। অন্যদিকে ভারতকে আল্লার নাম করে টুরো টুকরো করার হুংকার হল বাক-স্বাধীনতা, ‘হিন্দুয়োঁ সে আজ়াদি’ চাওয়া হল গণতান্ত্রিক অধিকার, হিন্দুদের কবর খোঁড়ার ইচ্ছা প্রকাশের নাম ধর্মনিরপেক্ষতা, সংখ্যাগুরুত্ব পাওয়া মাত্র হিন্দুদের রাস্তায় আছড়ে আছড়ে মেরে ফেলা হল সেকুলারিজ়ম প্রতিষ্ঠার উপায়, ১৫ মিনিটের জন্য পুলিস সরালে পুরো শহর হিন্দুশূন্য করতে পারার আস্ফালন হল গণতন্ত্রের অঙ্গীকার। ১৫ কোটি মুসলিম দ্বারা ১০০ কোটি হিন্দুর নিকেশ করার হুমকি হল নির্দোষ রসিকতা। আর খুনি ধর্ষক দাঙ্গাবাজ গদ্দারদের গুলি মারার কথাটা কেন সাম্প্রদায়িক উস্কানি মনে হয়, যেখানে অপরাধী মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের নাকি কোনও ধর্মই হয় না? ‘… কালো হাত গুঁড়িয়ে দাও ভেঙে দাও’, ‘… মুর্দাবাদ’, ‘বন্দুকের নলই হল শক্তির উৎস’ – এই ইতিহাস প্রসিদ্ধ ধ্রূপদী স্লোগানগুলো কেন হিংসাত্মক বা ‘অমুকের গালে গালে জুতো মারো তালে তালে’ কেন বিতর্কিত নয়? – ইত্যকার বেয়াড়া প্রশ্ন তোলা মানে ডাঁহা ফেল। কারণ সব খুনি দাঙ্গাবাজদের মৃত্যুদণ্ড দিতে হলে দেশের মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবী সমাজে মড়ক লেগে যাবে।
তবে অভিনন্দন! কারা দায়ী অপপ্রচারে তা হয়তো একদিন ভুলে যাব। শুধু মনে থাকবে কার আমলে। রাজ়িয়া সুলতানের রাজ্যেও লাগাতার বিদ্রোহ চলেছিল। তবে ইতিহাস সাক্ষী তাঁর দোষ ছিল না। কিন্তু তোমাদের অভাবনীয় সাফল্য ইতিহাসকেও মিথ্যে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করতে পেরেছ। উইকিপিডিয়ার মতো মান্য তথ্যভাণ্ডারও তোমাদের স্থির করা পাঠ্যসূচি, তথ্যসূত্র ও নির্দেশিকা অনুযায়ীই লেখা হচ্ছে। যার ডালে তোমরাও বসে, সেই বৃক্ষকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলার উদ্দেশ্য যদি জ্বালানি ব্যবসা হয়, আশা করছি পরিণামটা যে তোমাদের পক্ষেও আত্মঘাতী সেটা নিশ্চয়ই বুঝেই এই মহান ব্রতে শামিল হয়েছ।

দর্পণা রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.