সাম্প্রদায়িক একাত্মতা

হিন্দুদের মধ্যে সবাই না হলেও অনেকেই নিয়মিত পুজোপাঠ করে। নিত্যকর্ম পদ্ধতিতে ঢিল দেয় না। শিবলিঙ্গে দুধ জল ঢালার জন্য পায়ে হেঁটে তারকেশ্বর এমনকি অমরনাথ পর্যন্ত চলে যায়। কিন্তু তাদের কাছে পাকিস্তান বা বাংলাদেশের হিন্দু নির্যাতনের ঘটনাগুলো তুলে ধরো। এক্কেবারে নিরুত্তাপ! কখনও বা ঐসব খবরে রীতিমতো বিরক্ত হয়। তাদের বাড়ি থেকে দু পা দূরত্বে হিন্দু মেয়েদের সর্বনাশ বা পুজোমণ্ডপ ভেঙেচুরে কলুষিত করার খবর পেয়ে জেনেও না জানার ভান করে। জানাতে গেলে বক্তব্য হয়, ‘সব সময় নেগেটিভ কথা ভালো লাগে না।’ অথচ তারা কিন্তু নিয়মিত দুর্গা পুজো, বিজয়া, কালীপুজো, মকর সংক্রান্তি দোল হোলি থেকে শিবরাত্রি রামনবমী রথযাত্রা সব হিন্দু ধর্মীয় উৎসবে নানা ছবি ও ভক্তিমূলক বার্তা পোস্ট করতে অত্যাগ্রহী। আগ্রহ নেই শুধু তাদের নিজের মানুষগুলোর ওপর অপমান অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াটুকু জানাতে। কদাচিত্ দেবতার অসম্মানে যদিও বা জনরোষ দেখা যায়, কিন্তু মানুষ বিশেষত মেয়েদের নির্যাতন ‘অমন তো কতই হয়’ কিংবা ‘শরীর থাকলে অসুখের মতো এমন একটু আধটু দুষ্টুমি হতে পারে’ জাতীয় তত্ত্ব মেনে অতুলনীয় নির্লিপ্ততা বজায় রাখে।
অন্যদিকে আমি অজ্ঞেয়বাদী। যদি ধরেও নিই ঈশ্বর আছেন, তাহলেও একটা ব্যাপারে নিশ্চিত যে আমাদের মঙ্গলামঙ্গলের ব্যাপারে তাঁর কোনও মাথাব্যথা নেই। আমাকে সুবিধাবাদীও বলা যায়। ঠেকায় পড়ে মা কালী বা লোকনাথ বাবাকে মনে মনে ডাকলেও তাঁদের মাহাত্ম্য প্রচার করি না। বোধবুদ্ধি হওয়ার পর জীবনে লিঙ্গ পুজো করিনি, সীতার প্রতি নিষ্ঠুরতার জন্য রামকে মর্যাদা পুরুষোত্তম মনে করি না। শাঁখা সিঁদুরে সাজি একমাত্র শখ করে। এ সমস্ত কারণে আমাকে রামের চরণে বলি দেওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছে কয়েকজন হিন্দুত্ববাদী ছোকরা। আসলে কারণটা হিন্দুত্ববাদ নয়, পুরুষতান্ত্রিকতা। যাইহোক, এই আমিই কিন্তু কোনও হিন্দু পরিবার সাম্প্রদায়িক হানায় বিপন্ন হলে সরোষে খবর ছড়িয়ে দিই। হিন্দু মেয়েদের ওপর অত্যাচার হলে ক্ষোভে ফেটে পড়ি। শিবলিঙ্গের ওপর বিধর্মীরা অপকর্ম করেছে শুনলেও জ্বলতে থাকি। রামনবমীতে অস্ত্রমিছিল নিষিদ্ধ করলে মহরমের তাজিয়া ও লাঠি ছোরার প্রদর্শন নিয়ে প্রশ্ন তুলি। আমি তলোয়ার চালাতে জানি না। আমার অস্ত্র কলম। কিন্তু সেই কলমের ডগায় ‘শ্রীজাত‘ পরিয়ে ফরমায়েসি গপ্প ফাঁদি না।আমি জানতে চাই কারা হিন্দুসমাজের বেশি আপন? তারা, যারা নিয়মিত পুজোপাঠ করে, কিন্তু পুজোর আয়োজন পণ্ড করার খবর শুনলে বলে ‘সাম্প্রদায়িক আলোচনা একদম নয়’? তারা, যারা বিবাহিত মেয়েরা শাঁখা পলা সিঁদুর না পরলে চরিত্র তুলে নিন্দা করে, কিন্তু প্রতিবেশীর মেয়েকে মুসলমানরা তুলে নিয়ে যাওয়ার খবর পেলেও দেখা যায় WhatsAppএ বরেদের গৃহকর্ম নিয়ে চুটকি মিম পোস্ট করছে? নাকি সে, যে রামের ভক্ত না হয়েও সীতাদের অসম্মানে ফসে ওঠে; ঈশ্বর বিশ্বাস পলকা হলেও বিশ্ব মানবতার মঙ্গল কামনায়  প্রতিনিয়ত প্রার্থনা করে “প্রসীদ জগন্মাতা“? আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় বিদ্যাসাগর নিরীশ্বরবাদী ছিলেন, কিন্তু জীবনধারণে নিষ্ঠাবান হিন্দু যিনি হিন্দু-ধর্মের মধ্যে মানবতা আবিষ্কার করে তাকে আইনি প্রতিষ্ঠা দেন এবং বাংলার শেষ নবাব সিরাজ উদ্দৌলার দানবতা সম্পর্কে স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “এই শয়তানের জন্য বাংলার কোন মাতা ভগ্নী আপন সতীত্ব রক্ষা করিতে পারে নাই।” জনসংঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় নিজে অজ্ঞেয়বাদী ছিলেন, কোনও দিন জয় শ্রী রাম বলে উৎসবে নাচেননি। কিন্তু তিনিই ছিলেন ভারতে রাজনৈতিক হিন্দু-সত্তার প্রথম প্রবক্তা, মার খাওয়া বাঙ্গালী হিন্দুর নিজস্ব বাসভূমি পশ্চিমবঙ্গের জনক।তাই কোনও নির্দিষ্ট দেবমূর্তির নামে রেজিমেন্টেশন নয়, বহুত্ববাদী হিন্দু সমাজের আসলে প্রয়োজন সাম্প্রদায়িক একাত্মতা। তুমি নাস্তিক হিন্দু হয়েও যদি একজন আস্তিক হিন্দুর সাম্প্রদায়িক বিপদে ছুটে যাও, তাহলে তুমি প্রকৃত হিন্দু। তুমি শাড়ি পড়ে ঘোমটা টানা হিন্দু বধূ হয়েও যদি জিনস মিনি স্কার্ট পরা হিন্দু মেয়েদের জেহাদি আগ্রাসন থেকে বাঁচাতে মরিয়া হও, তাহলে তুমি সাচ্চা হিন্দু। তুমি মেয়েকে পতি পরমেশ্বর বলে সবকিছু মেনে নেওয়ার শিক্ষা দেওয়ার বদলে যদি রাস্তাঘাটে আত্মরক্ষার কৌশল শেখাও, হিন্দু সমাজের বেশি উপকার হয়। হিন্দুরা নিজেদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলাকে যেখানে ‘সম্প্রদায়হীন দুর্বৃত্তদের কীর্তি’ তত্ত্বের চাদর দিয়ে চাপা দিয়ে রাখতে চায়, সেখানে অনুরূপ খবর মুসলিম সমাজের কারও কানে গেলে সে তার সত্যাসত্য যাচাই না করেই দাবানলের মতো ছড়িয়ে দেয় এবং সম্মিলিত হামলার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। বহু ক্ষেত্রেই হিন্দুদের বিরুদ্ধে মিথ্যে রটনা করেই লোক জড়ো করা হয়। সেই রক্তলোলুপ জটলার অধিকাংশ খবরটা মিথ্যে টের পেয়েও খুনের নেশায় মেতে ওঠে। CAA NRC বিরোধী একটি ভিডিও তে দেখেছিলাম, এক বাগ্মী মুসলিম মহিলা বলছে, “হম বচ্চোঁকো লোরিয়াঁ সুনাকে টুইঙ্কল টুইঙ্কল পঢ়াকে পরভরীশ নহী করতে। বচপন সে কারবালা কী দাস্তাঁ সুনাকে বড়া করতে হ্যায়। কারবালা কী ময়দান পর সির্ফ মরদে নহী, ঔরতেঁ ভী কুরবানীয়াঁ দিই থী, বচ্চে ভী সরকলম করওয়াএ থে। ইস জঙ্গ্ মে ভী ইলশাল্লা হমারী হী জিত হোগী।” যদিও জানে জঙ্গ্ লড়ার মতো কোনও পরিস্থিতিই নয়। ওরা বচ্চাদের শেখায় হিন্দুদের অবিশ্বাস করতে, হিন্দুরা নাকি জলে বিষ মিশিয়ে খেতে দেবে! ওরা খুব ভালো করেই জানে এগুলো মিথ্যে। তবু সেই কাল্পনিক আশঙ্কার বীজ বুনেই কচি মনগুলোকে কাফেরদের প্রতি হিংস্র করে গড়ে তোলে।
ওরা যদি নিজেদের সন্তানদের মনে ছোট থেকে নিজের দেশ ও দেশবাসীর প্রতি এভাবে অকারণ বিষ গুলে কোটি কোটি বিষ-বৃক্ষ তৈরি করতে পারে, তাহলে আমরাও কি দেশের জন্য নিজেদেরই স্বার্থে আমাদের সন্তানদের মনে এতটুকু সাম্প্রদায়িক সচেতনতা গড়ে তুলতে পারি না? ওদের মতো বিধর্মী হত্যার প্ররোচনা আমাদের ধর্মে নেই, কিন্তু সম্ভাব্য খুনি ধর্ষকদের থেকে সতর্ক থাকার, আত্মরক্ষার শিক্ষাও কি দেওয়া যায় না? ‘অপরাধীর বা সন্ত্রাসীর ধর্ম হয় না’, এই মিথ্যে পাঠ দানের বদলে ‘ওদের সঙ্গে স্কুলে কলেজে বন্ধুর মতো মিশলেও বিশ্বাস কোরো না’ — এই সৎ শিক্ষাটুকু কি দিতে পারি না? আমি এক কিশোরীকে চিনি, যে পুরোদস্তুর নাস্তিক। পরীক্ষার সময়ও ভগবানকে ডাকে না। কিন্তু হিন্দু সমাজের প্রতি সে একশো শতাংশ একাত্ম এবং সাম্প্রদায়িক বিপদ সম্পর্কে সচেতন। যদি এই সচেতনতা ঘরে ঘরে তৈরি করতে না পারি, আর তার ফলে আমাদের ছেলেমেয়েরা জেহাদের কারাবন্দী অথবা এক একটা আরবান নকশাল হয়ে ওঠে, তাহলে রোজ তুলসী মঞ্চে প্রদীপ জ্বালিয়ে, রামচরিতমানস বা হনুমান চালিসা পড়েও কিন্তু হিন্দুত্ব রক্ষা করা যাবে না।
একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিই। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পাণ্ডব পক্ষে ছিলেন স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। যিনি দুগ্ধপোষ্য কোলের শিশু অবস্থায় পুতানা রাক্ষুসীর বিষাক্ত স্তন পান করেও পুতানারই প্রাণ নিষ্কাশন করে নিয়েছিলেন, যিনি কড়ি আঙুলের ডগায় করে পুরো গোবর্ধন পর্বত তুলে নিয়ে বৃন্দাবনবাসীকে অতিবৃষ্টির কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন, একের পর এক দুরাচারীর ভবলীলা সাঙ্গ করেছিলেন, তিনি কি কুরুসেনা বিনাশের দায়িত্ব নিজে নিতে পারতেন না? কিন্তু নেননি। বেছে নিয়েছিলেন পার্থর সারথীর ভূমিকা। যুদ্ধক্ষেত্রে স্বজনদের দেখে অর্জুন অস্ত্র ত্য্যাগ করতে চাইলেও কৃষ্ণ নিজে অস্ত্র তুলে নেননি; অর্জুনকেই উপদেশ দিয়ে অনুপ্রাণিত করে যুদ্ধে ফিরিয়ে এনেছিলেন। অর্থাৎ ভগবান থেকে থাকলেও আমাদের কর্ম আমাদেরকেই করতে হবে। ঈশ্বর বিশ্বাস শুধু মনের শক্তি জোগায়। যখন যোদ্ধা ‘হরহর মহাদেব’ কিংবা ‘জয় শ্রী রাম’ বলে ওঠে, তখন মহাদেব বা রাম এসে তার যুদ্ধটা করে দেয় না। নিজের যুদ্ধটা যোদ্ধাকেই করতে হয়। দেবতার নাম তখন war cry। আর বলা বাহুল্য যারা দিনে কম সে কম পাঁচ বার ‘লা ইলাহি ইলল্লা…’ বলে বিষ মন্ত্র জপ করে, যারা ‘আল্লা হো আকবর’ বলে যখন তখন warcry অভ্যাস করে, মানসিক যুদ্ধে তারা অনেকখানি এগিয়ে থেকেই ময়দানে নামে; বা বলা ভালো যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েই আছে। তার ওপর ওরা যুদ্ধের নীতি মানে না– বসত গৃহ থেকে শষ্যক্ষেত্র, বিদ্যায়তন থেকে চিকিৎসালয় — সবকিছুই তাদের ময়দানএ-জঙ্গ্! ধনসম্পদ থেকে নারীদেহ, শিশুর মুণ্ড সবকিছুই যুদ্ধের উপহার গনিমত। এমন নীতি আদর্শহীন অমানুষদের জন্য প্রস্তুতি তো আরও বেশি হতে হবে। যুদ্ধসৃজন ও সভ্যতা বিরোধী। আমরা তো সৃষ্টিকেই ধর্ম মনে করি। আমরা তো পাষাণ প্রতিমায় প্রেয়সীকে ধরতে চাই। আমরা তো মৃন্ময়ীর মার পুজো করার আগে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে চিন্ময়ী করে তুলি। কিন্তু সৃজন খুব কঠিন ও সময় সাপেক্ষ যেখানে ধ্বংস যেমন সহজ তেমনি তাৎক্ষণিক ও অব্যর্থ। তাই সৃষ্টিকে রক্ষা করতে হলে ধ্বংসাত্মক শক্তির হুংকার কান খাড়া করে শুনতে হবে; কানে ধর্মনিরপেক্ষতার তুলো গুঁজে রাখলে চলবে না।
সেকুদের মতো আমিও তো মনে করি ভারতবর্ষে মন্দিরের বদলে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল নির্মাণ বেশি প্রয়োজন। তাই নতুন মন্দির গড়া অনর্থক। কিন্তু এটাও বিশ্বাস করি, মা ভারতীর বুকে যত মন্দির ধূলিসাত্ হয়েছে, সবকটা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে না পারলে ভারতের ঐতিহ্য পুুুনরুুদ্ধধার করা যাবে না, ভারতবাসীর দাসত্ব্বের কলঙ্ক মোচন হবে না।
আমি যেচে বিপদ ডেকে আনি বলে ঘরে বাইরে তিরস্কৃত। কিন্তু ঘরে বাইরে সব হিন্দু মা বাবা ভাই বোনেরাই যদি হিন্দুনিন্দা পারিবারিক কোঁদল বন্ধ করে নিজেদের মধ্যে এইরকম সাম্প্রদায়িক একাত্মবোধ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়, তাহলে রাম থেকে রামেশ্বরী, পশুপতি থেকে সরস্বতী– কোনও দেবতার আরাধনা করার জন্যই সোশাল মিডিয়ায় ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করতে হবে না, পুজো তাঁরা আমাদের কাছে ডেকে চেয়ে নেবেন।
বন্দেমাতরম

দর্পণা রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.