কোভিড-১৯ এবং ২০-র ধরিত্রী দিবসে ব্যতিক্রমী পৃথিবী #SSUB

প্রতি বছর ২২শে এপ্রিল দিনটি মানবজাতি ‘ধরিত্রী দিবস’ হিসেবে পালন করে। ১৯৭০ সাল থেকে এই দিবস পালিত হয়ে আসছে। ২০২০ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৫০ টি বছর অতিক্রান্ত হল। ১৯৭০ সালে মানুষ যখন প্রথম ‘ধরিত্রী দিবস’ পালন করে তখন তার উদ্দেশ্য অবশ্যই ছিল ক্রমবর্ধমান জনবিষ্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশের সুরক্ষা ও সংরক্ষণের ব্যাপারে খেয়াল রাখা এবং তা মানব জাতিকে বারেবারে স্মরণ করিয়ে দেওয়া। কিন্তু বিগত পাঁচ দশক ধরে সভ্যতা বিকাশের ঘোড়-দৌড়ের মাশুল গুনতে হচ্ছে এই পৃথিবীকে। বিকশিত দেশগুলির অপরিসীম ভোগবাদ এবং বিকাশশীল দেশগুলির ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদায় সুন্দর পৃথিবী ক্রমাগত জীর্ণ-দীর্ণ ও দুর্বল হচ্ছে। প্রতি বছর ২২শে এপ্রিল ‘ধরিত্রী দিবস’-এ যে হিসাবনিকেশ হয় তাতে দেখা যায়, পূর্ববর্তী বছরগুলি থেকে আরো তীব্রতর হচ্ছে মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা; তারই কারণে রুগ্ন থেকে রুগ্নতর হচ্ছে এই পৃথিবী।

২০১৯ পর্যন্ত অবস্থাটি এই রকমই চলছিল। কিন্তু গত ডিসেম্বর থেকেই ‘কোভিড-১৯’ ভাইরাস-সৃষ্ট ‘কোরোনা’ মহামারী মানুষকে তার দৌড় বুঝিয়ে দিল। তথাকথিত শক্তিশালী মানুষ আজ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দিনের পর দিন গৃহবন্দী, তার বিকাশ যাত্রার ঘোড়া আজ আস্তাবলে বাঁধা। আর তাতেই হাঁফ ছেড়ে

ছে পৃথিবী; যেন ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে আপন সৌকর্যে হাসতে-খেলতে চাইছে, আমরা তা প্রত‍্যক্ষও করছি অহরহ। বিগত কিছুদিন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রকৃতির কোলে নানান সময় দেখা গিয়েছে অসংখ্য মনমুগ্ধকর রূপ-নিদর্শন। তার-ই কয়েকটি কথা এখানে উপস্থাপিত হল।

১) পুণ্যসলিলা গঙ্গা যেন বিগত চার দশকের থেকেও নির্মল হয়ে উঠেছে এবং হৃষিকেশে গঙ্গাজল পানের যোগ‍্য হয়ে উঠেছে। একটি সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ‘গঙ্গা-সভা’-র সাধারণ সম্পাদক শ্রী তন্ময় বশিষ্ঠ জানান, গঙ্গা যেন ১৯৮৬ সালের (যে সময় প্রথম বার গঙ্গা পরিচ্ছন্নতার জন্য প্রয়াস চালানো হয়েছিল) থেকেও নির্মল হয়ে উঠেছে। (সূত্র: আনন্দ বাজার ই-পত্রিকা, ১৩.০৪.২০২০)
২) ২৩ শে এপ্রিল কোপারনিকাস অ‍্যাটমোসফিয়ার মিটারিং সার্ভিস (CAMS) ঘোষণা করলো উত্তর গোলার্ধে ওজন স্তরের ক্ষতিগ্রস্ত স্থান নিরাময় হয়ে গেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ, চলতি বছরের শুরুতে উত্তরমেরুর ওজন স্তরে নজিরবিহীন ক্ষত দেখা গিয়েছিল। নেটিজেনরা একে লকডাউনের সদর্থক প্রভাব বলে শোরগোল করছেন। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন মেরু ঘূর্ণাবর্ত ভেঙ্গে যাওয়ার কারণেই মেরু অঞ্চলে ওজন সমৃদ্ধ বায়ু এসে সেই ক্ষত নিরাময় হয়েছে। তবে কারণ যাই হোক, ওজন স্তরের ক্ষতিগ্রস্ত স্থান নিরাময় মানব জাতির জন্য এক স্বস্তির খবর। (সূত্র: Gulf Today 02.05.2020 & ABP Ananda 27.04.2020)
৩) নাসা স‍্যাটেলাইট থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এবং মোডিস্ ডাটা অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে যে মার্চ মাসের শেষের দিকে লকডাউনের শুরু থেকে এপ্রিল মাসের প্রথমে মাত্র এক সপ্তাহ পার হতেই উত্তর ভারতের বিভিন্ন শহরের বায়ু দূষণের মাত্রা বিগত বিশ (২০) বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ছিল। (সূত্র: নিউজ উইক)
৪) বিগত পাঁচ বছরের তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে ২০২০ সালের মার্চ মাসের শেষে বায়ু দূষণের পরিমাণ এইরকম (নাসার তথ্য, সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া)
৪৬ শতাংশ কম ছিল ফ্রান্সের প্যারিস শহরে।
৩৫ শতাংশ কম ছিল ভারতের ব‍্যাঙ্গালুরু শহরে।
৩৮ শতাংশ কম ছিল অষ্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরে।
২৯ শতাংশ কম ছিল আমেরিকার লস্ এঞ্জেলেস শহরে।
২৬ শতাংশ কম ছিল ব্রাজিলের রিও-ডি-জেনীরো শহরে।
৯ শতাংশ কম ছিল সাউথ আফ্রিকার ডারবান শহরে।
৫) এপ্রিল মাসের ৩ তারিখ পাঞ্জাবের জলন্ধরবাসী প্রায় একশো মাইল দূরের তুষার-শুভ্র হিমালয় দেখালো প্রায় তিন দশক পর। (সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া ২২.০৪.২০২০)
৬) লকডাউনের কারণে রাস্তা-ঘাট, প্রান্তর, সমুদ্রসৈকত ও পর্যটনস্থল যখন জন-মানব শূণ্য তখন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে দেখা যাচ্ছে বন‍্যপ্রাণীর সাবলীল বিচরণ। এই রকমই কিছু কথা, কিছু ভিডিও সামাজিক-যোগাযোগ-মাধ্যম গুলোতে উঠে এসেছে। কলকাতার কাছে ব‍্যারাকপুর ক‍্যান্টনমেন্টের সবুজ গাছপালা সমৃদ্ধ সুরেন্দ্রনাথ কলেজ, পুর-বিল্ডিং, রাজভবন বিল্ডিং-এর সামনের রাস্তায় ময়ূরের সাবলীল বিচরণ দেখা গেছে। জনৈক সুবীর সাহার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে শেয়ার করা এই ভিডিও মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে পড়ে। (সূত্র: নিউজ ১৮ বাংলা)
থাইল্যান্ডের নির্জন সমুদ্রসৈকতে বিগত বিশ বছরের মধ্যে সর্বাধিক বিরল প্রজাতির কচ্ছপের প্রজনন ও বিচরণ দেখা যাচ্ছে। (সূত্র: দি্ গার্জিয়ান)
প্রায় ২৪০ বছর পরে ইংল্যান্ডের আকাশে ঐতিহাসিক প্রত‍্যাবর্তন হল অতিকায় শ্বেতপুচ্ছ সমুদ্র-ঈগলের। (সূত্র: প্রহর ডেস্ক ৩০.০৪.২০২০)
প্রায় তিন দশক পর কলকাতার বাবুঘাটে গঙ্গার জলে লম্ফ-ঝম্ফ করতে দেখা গেছে ‘গঙ্গার শূশক’-কে যা ‘গ্যাঞ্জেটিক-ডলফিন’ নামেও সুপরিচিত। প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালে ভারত সরকার এই শুশুককে জাতীয় জলজ প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করে। শুশুক-ই হল ডলফিন গোত্রের মধ্যে একমাত্র ডলফিন যারা মিষ্টিজলে বসবাস করে। তবে শুধু কলকাতা নয় কানপুর সহ বিভিন্ন স্থানে গঙ্গা বক্ষে এমন দৃশ্য সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়। (সূত্র: Bengali online india.com ২৪.০৪.২০২০)
‌এবার লকডাউনের মধ্যে মহারাষ্ট্রের সমূদ্র তীরবর্তী রাজধানী শহরে দেখা গেল হাজার-হাজার গোলাপী মরালের ঝাঁক (Flamingos flook)। বম্বে ন‍্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি (BNHS)-র অ‍্যাসিস্টেন্ট ডাইরেক্টর শ্রী রাহুল খত্ বলেন বিগত কয়েক বছর ধরে এত সংখ্যক এই ফ্লেমিংগো পাখী দেখা যায়নি। কিন্তু এবছর লকডাউনের কারণে হাজার হাজার এই পরিযায়ী পাখীর দেখা মিলল। (সূত্র: সি এন এন ডট কম, ০১.০৫.২০২০)

এমন-ই হাজারো মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক ঘটনা সারা পৃথিবীতে সামনে আসছে যা মানব জাতির এই চরম সঙ্কটের মধ্যেও পরিবেশ-প্রেমী মানুষকে স্বস্তি দিচ্ছে। কিন্তু এর জন্য মানবজাতিকে লক্ষ-লক্ষ কোটি ডলারের বিকাশ যাত্রা থামাতে হয়েছে। বিশ্বের বহু মূল্য প্রাণ বলি দিতে হয়েছে, কর্মহীনতা এবং অনাগত দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার বিনিময়ে পেতে হচ্ছে এই প্রকৃতি-সুন্দরকে। ‘কোভিড-১৯’ লকডাউন ‘কোরোনা’ মহামারীর পৃথিবীকে আর একবার নতুন করে ভাবতে শেখাবে, আমরা কি তথাকথিত বিকাশের দৌড়েই থাকবো এবং এই প্রকৃতিকে প্রতি মুহূর্তে ক্ষত-দুর্বল করে চলবো? নাকি ঐশী-সুন্দর ধারায় প্রকৃতি আপন বিকাশ-সুখে সবল-সুন্দর জীবন যাপন করবে!

সুদীপ মিত্র

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.