করোনা-পরিস্থিতিতে জনজীবন ও পরিবেশ: দেশবাসীর ভূমিকা #SSUB


গত ২৬ শে এপ্রিল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের পরম পূজনীয় সরসঙ্ঘচালক ডাক্তার মোহন ভাগবতজী ‘বর্তমান পরিদৃশ্য এবং হমারী ভূমিকা’ শীর্ষক যে ভাষণ দেন, তার অন্তর্গত পরিবেশ-সচেতনতার বিষয়ে যা যা বলেছেন, তার প্রেক্ষিতেই প্রস্তুত আলোচনা এবং বিচার বিশ্লেষণ। মোহনজীকে বরাবরই তাঁর ভাষণে ভারতীয় সংস্কৃতির নানান প্রেক্ষিত তুলে ধরতে দেখা যায়, সঙ্গে অনবদ্য তাঁর বৈঠকী মেজাজ, গল্পের অবতারণা, যা বক্তব্যকে আরও প্রাঞ্জল করে তোলে। এদিন কিন্তু তিনি যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন, তাতে সমগ্র বিশ্ববাসী স্বীকার করবেন, তিনি কেবল হিন্দু সমাজের নয়, বিশ্বের একটি বৃহত্তম জাতির বৌদ্ধিক-নেতৃত্ব দিলেন। তিনি বলছেন, ভারতের ১৩০ কোটি-র সমাজ ভারতমাতার পুত্র, বিশ্ববাসীর মতো তারাও বিপন্ন, তারা সকলেই আপনার বন্ধু। আরএসএস-এর সেবা যে যে চান, সবার জন্য তার ডালি পৌঁছে দিতে হবে; কোনো ভেদাভেদ করা চলবে না। যেখানে অন্য মুসলিম দেশে পীড়িত-হিন্দুদের করো

না পরিস্থিতিতে দুর্গতির শেষ নেই, সেখানে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া সেই সংগঠনের সর্বোচ্চ কার্যকর্তার বক্তব্য সারাবিশ্বকে নতুনভাবে জানিয়ে দিয়েছে, হিন্দুত্বের আসল রূপ হল “একান্ত মে আত্মসাধনা অউর লোকান্ত মে পরোপকার।” তিনি বলেছেন, নিজের লোকেদের জন্য আমরা কাজ করছি, তাই কাজ যেন প্রেমপূর্বক হয়। বলেছেন, কেউ যদি ক্রোধের বশে কিছু করে, তাহলে সব লোকের উপর তার দোষ চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে বিগত অক্ষয়-তৃতীয়ার দিনটি থেকে ইন্ডিয়ান-নেশন কনসেপ্টের এক মহতী-বোধন হয়ে গেলো করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই। তবে সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকদের তিনি একথা অবশ্যই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, পৃথিবীতে ধূর্ত লোকেরাও থাকে, তারা যেন আমাদের সাহায্য নিয়ে চলে না যায়, যার সাহায্যের দরকার, সে যেন বাদ না পড়ে। মনে করিয়ে দিয়েছেন, নিজেদের স্বার্থের জন্য এবং ভারতকে টুকরো করার জন্য প্রচেষ্টা অনেকের আছে ; এরকম যারা করে তাদের থেকে আপনারা নিজেদের বাঁচাবেন। তারা যাতে আপনাদের কোনো ক্ষতি না করে, এরকম সাবধানতা এবং দৃঢ়তা আপনাদের মধ্যে রাখবেন। জনজীবন নিয়ে শ্রী ভাগবত যা বললেন, তা যেন বিশ্বের অন্যতম সামাজিক এক নেতৃত্বের কথা।

সেদিনের বক্তব্যে আসি; পরিবেশ প্রসঙ্গে তিনি ঠিক কী বলেছেন। “লকডাউনমে পর্যাবরণ শুদ্ধ হো গয়া”। এই পরিস্থিতিতে জলবায়ু অনেকটা শুদ্ধ হয়ে গেছে। কারণ পরিবেশ দূষণকারী কোনো কোনো কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। আবার আমরা যখন পূর্বজীবনে আসবো, তখন ভাবতে হবে, কোন কাজটা আমি না করেও থাকতে পারি। জলের সঠিক উপযোগ, সংরক্ষণ, সংবর্ধন, গোরক্ষা, প্লাস্টিক থেকে মুক্তি, পরিচ্ছন্নতা পালন, জৈবিক ক্ষেতি, জৈবিক প্রথায় গোপালন ইত্যাদির উপর নির্ভর করতে হবে। এখনকার রাসায়নিক কৃষির অভ্যাস আমাদের বদলাতে হবে। সমাজকে বদলাতে হবে,শাসনের নীতিও এইরকম হবে। সমাজকে এই প্রথায় চলতে হবে, নয়তো সঠিক পরিণাম পাওয়া যাবে না। প্রতিবেশীদের মধ্যেও এই প্রথা চালু করতে হবে।
অর্থাৎ সব কৃষককে জৈবচাষের দিকে এগিয়ে যেতে বলেছেন তিনি। পরবর্তী জীবনে আমাদের এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত, যা পরিবেশবান্ধব, চিরায়ত। এরজন্যই জল ও বৃক্ষ সংরক্ষণের কথা এসেছে। ভৌম স্বাদু-জলের ভাণ্ডার যে পৃথিবীতে দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে এবং বৃষ্টির ধারাপাত মাটিতে যে ফিরে আসছে না, তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন তিনি। কৃষিকাজ, দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিকের ব্যবহার একেবারেই কমিয়ে ফেলতে হবে। প্লাস্টিক-বর্জ্য সারা বিশ্বের কাছে একটি মাথাব্যথার কারণ। এই অবস্থায় সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকেরা যে প্লাস্টিক-মুক্তির আন্দোলনে আগামীদিনে সামিল হবেন, তা বলাই বাহুল্য। সঙ্ঘ বিচারধারায় ভারতীয় কিষান সঙ্ঘ বেশ কয়েক বছর ধরে জৈবকৃষির উপর গুরুত্ব বাড়িয়েছে। অখিল-ভারতীয় স্তর থেকে গ্রাম সমিতি পর্যন্ত সংগঠনে ‘জৈবকৃষি-প্রমুখ’ নামক কার্যকর্তারা নিয়োজিত হয়েছেন, এ ব্যাপারে কৃষকদের মনোযোগী করতে। সঙ্ঘের গো-সেবা আয়াম-ও গো-আধারিত কৃষিকাজ ও দেশীয় গো-সংরক্ষণের জন্য কাজ করছে। মোহনজীর এই ভাষণে তাদের কার্যক্রম ও গতিপ্রকৃতি অনেক বেড়ে যাবে বলে তথ্যভিজ্ঞ মহলের ধারণা। ভারতীয় কৃষি যে নতুন পথে এগোচ্ছে, তা কেবল এখন সময়ের অপেক্ষা। সবাই মিলে জৈবচাষে প্রবৃত্ত হলেই দেশের সার্বিক উৎপাদন বাড়বে। টুকরো টুকরো করে নয়, দেশব্যাপী জৈবচাষ এখন আগামীর শপথ।
জনজীবনের মধ্যে আসবে, নতুন ভারত যে বানানো হবে করোনার পরবর্তী পর্বে, তাতে সমাজের সাধারণ-মানুষ, তার প্রতিবেশী, সমাজের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি, শাসকবৃন্দের অবদান কী হবে? কেমন হবে সেই ভবিষ্যৎ কৃষি-পরিকল্পনার রূপরেখা ও শাসনযন্ত্র? ভারতের অধিকাংশ রাজ্যে বিজেপি আজ ক্ষমতায় আছে। ভাগবতজী যে আহ্বান করে গেলেন, রাজনীতির উর্ধে উঠে কাজ করার কথা বলে গেলেন, তা বাস্তবিকপক্ষে সব রাজ্যের মানুষকেই জৈবচাষের আহ্বান করার সমতুল্য এবং কারো কোনোভাবে অস্বীকার করার জায়গা নেই। মোহনজীর সোজাসাপ্টা কথা, ” ইস সংকটসে ভবিষ্য-মে সীখ লেনে কা জরুরত হ্যায়।”। এই সংকটকে একটা ল্যান্ডমার্ক হিসাবে ধরে নিয়ে একটা নতুনভারতের উত্থান চাইলেন তিনি। সেই উত্থানের কাজে জনজীবনের কি ভূমিকা হবে বিস্তারিত বলেছেন তিনি।
প্রতিবেশীরা যাতে সঠিক আচরণ করেন, তারজন্য স্বয়ংসেবকের দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠার কথা বলেছেন বারবার। তাদের আচরণগুলির যথার্থতাকে প্রতিবেশীদের বোঝাতে হবে। আচরণ সামগ্রিক হয়ে না উঠলে কোনো কাজে সর্বাঙ্গীণ সাফল্য আসে না। নাগরিক অনুশাসন পালন করতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি ভগিনী নিবেদিতা এবং ড. বি. আর. আম্বেদকরের কথা স্মরণ করেছেন। অনুশাসন পালন সমাজে শান্তি, সহযোগ ও সদ্ভাবের পরিবেশ আনে। সমাজের গণ্যমাণ্য লোকেদের দিয়ে সমাজ প্রবোধনের কাজ করতে হবে। বলেছেন, নাগরিক অনুশাসনের পালনই হল আসল দেশপ্রেম। কৃষিকাজেও তাই করতে হবে। সার্বিকভাবে বলা কথা হনুমানজীর উদাহরণ সামনে রেখে বলা যায় যে ধৃতি, মতি, দৃষ্টি ও দাক্ষ্য — অর্থাৎ স্থিরচিত্ততা, বুদ্ধি, সংবিৎ এবং দক্ষতাকে অবলম্বন করেই কাজ করা দরকার। তবেই সাফল্য আসে।
পরিশেষে বলা যায়, বাঙালি এবং ভারতবাসী মাত্রেই জানেন কৃষিপণ্যের মূল্য ভারতীয় সমাজে কত গভীর! বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, ” ধান ধন বড় ধন/আর ধন গাই/সোনা-রূপা কিছু কিছু/আর সব ছাই।” করোনা পরিস্থিতিতে মানুষ খাবার খোঁজ করছেন, কৃষিপণ্যের সন্ধানে আছেন, ভোগ্যসামগ্রীতে নয়। যে অন্ন বাঁচবার জন্য অন্নপূর্ণার কৃপা হয়ে আমাদের জঠরের জ্বালা মেটায়, তা সম্পূর্ণ বিষমুক্ত হয়ে আমাদের উদরে নিত্য ভোগ হয়ে কবে উঠবে, তার প্রতীক্ষায় ভারতবাসী।

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.