আজকের লেখাটা শুরু করবো একটি ছোট্ট ঘটনা দিয়ে। 2018 সালের সেপ্টেম্বর মাসে, পূর্ব মেদিনীপুর (East Midnapore) জেলায় এক আত্মীয় বাড়ি আমন্ত্রণ রক্ষায় যাই। আত্মীয়ের বাড়িটি যে গ্রামে, তা বেশ বড়। প্রায় দেড়শোটি মতন পরিবারের বাস। ওই আত্মীয়ের কন্যা নিজের মতে বিয়েথা করে নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে বর্তমানে নিজের মা বাবার সাথেই থাকেন। একদিন সকালে দেখি বাপ মেয়েতে প্রচন্ড বাকবিতণ্ডা চলছে ,ধর্মীয় বিষয় নিয়ে। শুনে অবাক হলাম যে আমার ওই আত্মিয়ের একমাত্র কন্যা বেশ কিছুদিন পূর্বে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছেন।এবং প্রতি রবিবার নিয়মিত প্রার্থনাতে ও অংশগ্রহণ করতে যান। হিন্দু পরিবারে বিশেষত ব্রাহ্মণ পরিবারের এই ধরনের ঘটনা কোন মতেই মেনে নিতে পারছিলেন না আমার ঐ আত্মীয়। পরিবেশ শান্ত হলে যা জানলাম তা রীতিমত ভাববার বিষয়।ওই গ্রামের প্রায় পঞ্চাশটি মতন পরিবারের কোনো একজন বা দুইজন বা পুরো পরিবারই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হয়েছেন গত কয়েক বছরে।এবং এই নিয়ে ঐ পরিবার গুলির মধ্যে প্রায় দিনই অশান্তি ঝগড়াঝাটি ও মারামারি লেগেই থাকে ।যা প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পারিবারিক অশান্তিতে যন্ত্রণায় নিত্যদিন ছটপট করছেন এরকম বহু পরিবার। একই পরিবারের মধ্যে দুই ধরেন উপাসনা পদ্ধতি পালন করা কতটা সুখকর! তা যারা ভুক্তভোগী তারাই জানেন।আমার ঐ আত্মীয়ের কন্যার মুখ থেকে যা শুনলাম তা সত্যিই আমাকে স্তম্ভিত করলো।তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম কেন সে এমন করল? ও বলল – ওর মেয়ে একদিন খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডাক্তার দেখিয়েও জ্বর সারছিল না। তখন এক প্রতিবেশীনীর কথায় ও গ্রামের নিকটস্থ চার্চের ফাদার এর (যাকে ওরা দাদা বলে ডাকে) কাছে যায়।ঐ দাদা কিছু খিষ্টান রীতিনীতি পালন করেন। এবং কয়েক দিনের মধ্যেই তার ছয় বছরের মেয়ে সুস্থ হয়ে যায়। সেই সময়ে ঐ দাদাই ওদের ক্রিস্টান হবার কথা বলে।এবং ওর কথা অনুযায়ী “অনেক দেবদেবীকে ডেখেছি ,কিন্তু কেউ সাড়া দেয়নি। শেষে যীশু সাড়া দিয়েছেন।তাই তাঁকে ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারবোনা।” জিজ্ঞাসা করলাম তোমার মেয়ে তাহলে কোন উপাসনা পদ্ধতি অর্থাৎ ধর্ম অবলম্বন করবে? ওর জবাব – “কেন?ও তো খ্রিস্টানই হবে।” শুধু তাই নয়,ঐ আত্মীয়ের মৃত্যুর পর সমস্ত সম্পত্তি (সমৃদ্ধ বাস্তুভিটা) ও দান করবে বলেও মনস্থির করে ফেলেছে।
আর কথা বাড়ালাম না।বেশ কয়েকদিন থেকে ঐ বাড়িতে যা বুঝলাম-বাড়িটি একটি আস্ত চিড়িয়াখানায় পরিণত হয়ে উঠেছে।কেউ কাউকে সম্মান করছেন না।যখন বাড়িতে পূজো হচ্ছে তখন খ্রিস্টান মেয়ে দূরে চলে যাচ্ছে, আবার যখন সন্ধ্যেবেলায় ওরা (ছোট্ট মেয়ে সহ)বাইবেল পাঠ করছে, তখন হিন্দু বাবা ও মা তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করছেন।দেখে বুঝতে পারলাম। সবথেকে দূরবস্থা ছিল ওই ছোট্ট ফুটফুটে শিশু কন্যাটির। যে কিছু না বোঝার আগেই একই ছাদের তলায় দুই রকম ভিন্ন উপাসনা পদ্ধতির চাপে ন্যুব্জপ্রায় হয়ে উঠেছিল। এই ঘটনা কেবলমাত্র আমার ঐ আত্মীয়ের নয়।অনেক পরিবারের। আমরা খোঁজ রাখি না।বা রাখতে চাই না। কিন্তু এই ধর্মান্তরন চলছেই।আর তার সাথে সাথে পারিবারিক হিংসা ও। হিন্দু থেকে মুসলিম হতে গেলে সাধারণত পুরো পরিবারকে মুসলিম হতে হয়। ফলে উপাসনা পদ্ধতিও একই হয়ে যায়। কিন্তু খ্রিস্টানরা এ বিষয়ে বেশ বুদ্ধিমান। তাঁরা কোন পরিবারের কোনো একজন বা দুইজনকে ধর্মান্তরিত হবার সুযোগ দিয়ে থাকেন। কারণ তাঁরা জানেন আজ নয়তো কাল পুরো পরিবারই একই ছাতার তলায় চলে আসবে।ফল ও হাতেনাতে পাচ্ছেন তাঁরা। সারাবিশ্বে যদি আমরা দেখি তাহলে দেখব যে ধর্মান্তরণে হিন্দুরাই বেশ এগিয়ে। অর্থাৎ হিন্দুরাই তাদের উপাসনা পদ্ধতি পরিবর্তন করে ধর্মান্তরিত হচ্ছেন ।এরমধ্যে আবার আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি। ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যে এমন ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। বহু আদিবাসী ভাই-বোনেরা বর্তমানে নিজের ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান ধর্মে বা মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছেন ও হচ্ছেন।মাদার টেরেসা ও একসময় ভারতবর্ষে বহু মানুষকে রোগমুক্তি ঘটাতে সাহায্য করেছিলেন তাঁর সেবার মাধ্যমে।কিন্তু তিনিও বিনিময়ে গরীব মানুষগুলোকে যীশুর শরণে আশ্রয়ের জন্য পার্মানেন্ট ব্যবস্থা করেছিলেন,তা আমাদের সকলের জানা।কিন্তু ধর্মান্তরণ ও তার পরবর্তী পারিবারিক বীভৎসতা যথেষ্ট চিন্তার ও গবেষণার বিষয়। এই লেখার মাস ছয়েক আগে নিজের জেলার কালেক্টরেট অফিসে একটি ছোট্ট কাজের দরুন যেতে হয়েছিল। ফেরার পথে দেখি কালেক্টরেট অফিসের সামনে ধর্না প্রদর্শন চলছে।দেখলাম -“আদিবাসীরা হিন্দু নয়” এই ব্যানারে বেশ কিছু আদিবাসী ব্যক্তিত্ব তাদের বক্তব্য রাখছেন খোলা আকাশের নীচে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম।প্রায় 10 মিনিট শুনলাম তাঁদের সেই ভাষণ।যা বুঝলাম -পুরো ভাষণটাই হিন্দুদের বিশেষত ব্রাহ্মণদের এবং দেবদেবীদের নিয়ে নানা অশালীন মন্তব্য। এবং তাঁরা যে হিন্দু নয় তা বারবার বলা হচ্ছিল। সময় কম ছিল তাই হাঁটতে শুরু করলাম।এবং দেখলাম যে সমস্ত নেতৃবৃন্দ আছেন ওই মঞ্চে, তাদের মধ্যে একজনকে চিনতে পারলাম।যাকে কিছুদিন পূর্বে আমি সাদা পোশাকে দেখেছি। তাই বুঝতে আর অসুবিধা রইলো না, চক্রান্তটি ঠিক কোথায়। Persecution.org নামক website যারা নিজেদের International Christian Concern বলে দাবী করে তাদের গত ইংরেজি তারিখ 11/04/2020 তে Online edition (India)এ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয় -“Kasturi a Christian women from Tumhara village located in Odisha state,experienced threats first hand after she converted to Christianity in 2019. According to Kasturi ,she converted to Christianity because the Church community helped carry her daily burdens………….her husband would verbally abuse her,call her demeaning names ,curse her,and throw her out of the house for days at a time.During these times she would stay with her cousin………On January 19,2020,Kasturi went to a Sunday worship service while her husband was away.When she returned from the service, her husband was home and welcomed her with a brutal beating, Kasturi’s husband told her he would not let her leave the house unless she renounced her Christian faith………….Currently, Kasturi is rebuilding her life in a new village. “
অর্থাৎ ধর্মান্তরনের ফলে যে পারিবারিক হিংসা ছড়াচ্ছে তা খোদ মিশনারিজ পরিচালিত ম্যাগাজিনেও উল্লেখ করা হচ্ছে। কিন্তু তবুও তাঁরা জেনে বুঝে সেই কাজ সুচারুরূপে করে চলেছেন। প্রলোভনের ফাঁদ পেতে বা সেবার নামে । আর এই ফাঁদে পা দিয়ে গরিব হতদরিদ্র এবং আমাদের আদিবাসী ভাইয়েরা ধর্মান্তরিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। শুধু তাই নয়,সাথে সাথে বেড়ে চলেছে পারিবারিক হিংসা ও। প্রতিটি উপাসনা পদ্ধতির নিজস্ব কিছু নিয়ম রীতি থাকে। কিন্তু একই পরিবারের বিভিন্ন ধরনের উপাসনা পদ্ধতি পালনের ফলে বাস্তবে একটি খিচুড়ি ধর্মের প্রবেশ ঘটে ওই পরিবারে।এইরূপ বহু উদাহরণ আমরা আমাদের আশেপাশে তাকালেই দেখতে পাবো।কিন্তু আমরা এড়িয়ে যাই। এই বলে যে এটা তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যাপার বা ধর্মীয় ব্যাপার বলে। প্রতিনিয়ত শয়ে শয়ে পরিবার ভেঙে খান-খান হয়ে যাচ্ছে। যে কস্তুরীর কথা বলা হয়েছে ঐ ম্যাগাজিনে, তার পরিণতি ও তাই। বর্তমানে সে অন্য একটি গ্রামে নতুন ভাবে নতুন রূপে বাঁচতে শিখেছে। স্বামী-সন্তানকে ছাড়া। সনাতন সংস্কৃতির মূলে এটি কুঠারাঘাত ছাড়া আর কি বা হতে পারে ? যে ঋষি পরম্পরা এবং সংস্কার নিয়ে হিন্দু পরিবার গড়ে ওঠে তা সমগ্র বিশ্বের কাছে ঈর্ষার বিষয়।তাইতো তাকে ভেঙ্গে ফেলার জন্য বিশ্ব প্রচেষ্টা চলছেই।
2007 সালে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল শ্রী দিলীপ সিং জুদেব এর সাথে দেখা করার।কে এই দিলীপ সিং জুদেব ?বর্তমানে ছত্রিশগড় রাজ্যের যশপুর জেলাতে বর্ধিষ্ণু পরিবারে তাঁর জন্ম।অটল বিহারী বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভার মন্ত্রীও ছিলেন। ছত্রিশগড়ে আদিবাসী সম্প্রদায়ের সংখ্যা যথেষ্ট। বাস্তার, দন্তেওয়াড়া সহ বেশকিছু জেলাতে প্রায় 70 শতাংশ বা তারও বেশি আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভাই-বোনেরা বাস করেন।এই সমস্ত জেলাতে আদিবাসী ভাই-বোনদের ব্যাপকভাবে খিষ্টান করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন খ্রিস্টান মিশনারীজরা। তাঁরা সাফল্য ও পান ।বহু আদিবাসীকে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়।অর্থের বিনিময়ে অথবা সেবা-শুশ্রূষার মাধ্যমে আবেগতাড়িত করে তাদেরকে ধর্মান্তরিত করা হয়।একই পরিবারের মধ্যে ভিন্ন উপাসনা পদ্ধতি এবং তার থেকে উদ্ভূত নানা সমস্যার ও সৃষ্টি হয় সেই কারনে। রুখে দাঁড়িয়েছিলেন শ্রী দিলীপ সিং জুদেব। তিনি একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।তিনি নিজে প্রতিটি ধর্মান্তরিত আদিবাসী ভাই বোনকে পুনরায় সনাতন উপাসনা পদ্ধতি বা হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনতে ‘শুদ্ধিকরণ’ শুরু করেন। এর জন্য তিনি সেই সমস্ত ধর্মান্তরিত আদিবাসী ভাই বোনেদের পা নিজের হাতে ধুয়িয়ে দিয়ে পুনরায় স্বধর্মে ফিরিয়ে আনেন। আর এই কার্যের নাম দেন ‘ঘরওয়াপসি’। সারাদেশে সাড়া পড়ে যায় এই ঘটনায়।ধর্মনিরপক্ষেতার ধ্বজাধারীরা রে রে করে ওঠে। অথচ যখন আদিবাসী ভাইয়েরা পাইকারি হারে ধর্মান্তরিত হচ্ছিলেন তখন তাঁরা স্বভাববশত শীত ঘুমে ঘুমিয়ে ছিলেন।শুরু হয় দিলীপ সিং জুদেবের নামে নানা কুৎসা প্রচার। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি। তিনি নিজের এই কাজের জন্য এক ছোট্ট বাহিনীও তৈরি করেন।যার নাম দেন ‘জুদেব সেনা’। যারা সমস্ত খোঁজখবর জোগাড় করত।অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর জনপ্রিয়তা প্রভুত বৃদ্ধি পায়। যা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ঈর্ষার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষত মিশনারীজরা তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আনতে থাকেন। তিনি সেসব তুচ্ছ মনে করেন। এবং নিজের কাজ করতে থাকেন। এমন 58 বছরের দীর্ঘদেহী যুবকের দর্শন পেয়ে আমি ধন্য হয়েছিলাম। আজ তিনি নেই। কিন্তু তাঁর একটি কথা সব সময় মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন- “সব সে পেহেলে আপনা ধর্ম কো বাঁচানা হ্যায়”।
বর্তমান সময়ে তাঁর কথা ভীষণ ভাবে মনে পড়ে। হয়তো তিনি আবার আসবেন।ধর্মান্তরনের সমস্ত চক্রান্ত ব্যর্থ করবেন। এবং ভেঙে যাওয়া পরিবারগুলোকে আবার জোড়া লাগাবেন। তাদের পা ধুয়ে স্বধর্মে ফিরিয়ে আনবেন এই আশায় রইলাম। ।
ড. সুমন পানিগ্রাহী (Dr. Suman Panigrahi)
চিত্রঋন:গুগুল ইমেজ।