পক্ষপাত দুষ্ট আমলাগণ দেশের সার্বিক উন্নতির পথে প্রধান অন্তরায়।

তথাকথিত পুঁথিগত বিদ্যা কখনোই সর্বোচ্চ শিক্ষা হতে পারে না। উপযুক্ত চলার পথ এবং তা থেকে অর্জিত মূল্যবান অভিজ্ঞতাই মানুষকে সুশিক্ষিত করে তোলে। এই আপ্তবাক্য কে সামনে রেখেই মূলতঃ সর্ব ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় কৃতকার্য দের বিভিন্ন দপ্তরের উচ্চপদে কাজের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ করে দেওয়া হয় এবং পক্ষান্তরে এটা ধরে নেওয়া হয় যে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করার ফলে অভিজ্ঞ সিভিল সার্ভেন্টরা খোলা মনে দক্ষতার সাথে সমাজের সার্বিক কল্যাণে ব্রতী হতে পারবেন। কিন্তু সমাজের এই ধারণা এবং একই সাথে আকাঙ্ক্ষার মূলে কুঠারাঘাত করল ষাট জন অবসরপ্রাপ্ত সিভিল সার্ভেন্টের একটি খোলা চিঠি, যেখানে প্রেক্ষিত, সঠিক তথ্য এবং বাস্তবতাকে কার্যত অস্বীকার করে পরিবেশ মন্ত্রকের দু’জন প্রাক্তন সচিবসহ ষাট জন প্রাক্তন আমলা মোদী সরকার কে কেন্দ্রীয় ভিস্তা প্রকল্প বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েই শুধুমাত্র ক্ষান্ত হননি, বরং এই প্রকল্পের পরিকল্পনায় বড়োসড়ো ত্রুটির কথাও তারা বলেছেন, কিন্তু বিস্ময়কর ভাবে তারা ত্রুটির বিস্তারিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। উল্টে তারা লিখেছেন যে এই প্রকল্পে অনুমোদন দেওয়ার পেছনে একটি নির্দিষ্ট সরকার ও তার নেতাদের স্মৃতিবিজড়িত বর্তমান পরিকাঠামো ছেড়ে যাওয়ার তাগিদ কাজ করেছে। এছাড়াও তারা বলেছেন যে একটি কুসংস্কার দ্বারা পরিচালিত হয়ে মোদী সরকার এই প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছেন কারণ বিশ্বাস করা হয় বর্তমান সংসদ ভবনটি মোদী সরকারের কাছে না-কি অত্যন্ত অশুভ!

এই প্রকল্পের বাস্তব প্রেক্ষিতের দিকে এবার একটু চোখ ফেরানো যাক। সংসদ ভবনের কাঠামোগত নির্মাণশৈলী এবং সুযোগ-সুবিধা বর্তমান সময়ের চাহিদা মেটাতে সম্পূর্ণ অপারগ। বেশিরভাগ বিল্ডিং তাদের স্ট্রাকচারাল লাইফ হয় শেষ করে ফেলেছে নতুবা শেষের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। ৯৩ বছর আগে যখন সংসদ ভবন নির্মিত হয়েছিল তখন দিল্লি ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল সিসমিক জোন-২ এ অবস্থান করতো, বর্তমানে তা সিসমিক জোন-৪ এ অবস্থান করে। ফলতঃ এই মেয়াদ উত্তীর্ণ নড়বড়ে স্ট্রাকচার ভূমিকম্পের সামনে যে অত্যন্ত অসহায় তা বলাই বাহুল্য। আমাদের দেশে স্বাধীনতার সময় গড়ে পাঁচ লক্ষ জনসাধারণ পিছু একজন করে সাংসদ নির্বাচিত হতেন। বর্তমানে একজন সাংসদ গড়ে ২৫ লক্ষ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের অভাব, অভিযোগ ও সমস্যার কথা একজন সাংসদের পক্ষে দক্ষতার সহিত পর্যালোচনা করা এবং সংসদে উত্থাপন করা আক্ষরিক অর্থেই অসম্ভব হয়ে উঠেছে। ২০২৬ সালে পার্লামেন্টে সংসদ সংখ্যা বৃদ্ধির ওপর স্থিতাবস্থা উঠে যাওয়ার সাথে সাথেই গুড গভর্নেন্সের স্বার্থে সংসদীয় এলাকা গুলির ডি-লিমিটেশনের মাধ্যমে সাংসদ সংখ্যা বৃদ্ধি করা আশু কর্তব্য। সেক্ষেত্রে বর্তমান সংসদ ভবনের অপ্রতুল স্থান এই কাজে যে বাধা সৃষ্টি করবে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। ঠিক এই কারণেই মাননীয়া শ্রীমতি মীরা কুমার লোকসভার স্পিকার পদে থাকাকালীন ১৩/০৭/২০১২ তারিখে ভারত সরকারকে চিঠিতে নতুন পার্লামেন্ট ভবন নির্মাণের অনুরোধ করেন। একই কারণে প্রাক্তন স্পিকার মাননীয়া শ্রীমতি সুমিত্রা মহজন এবং বর্তমান স্পিকার মাননীয় শ্রী ওম বিড়লা মহাশয় যথাক্রমে ০৯/১২/২০১৫ এবং ০২/০৮/২০১৯ তারিখে ভারত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চিঠি লেখেন। ল্যুটিয়েন দিল্লির এই চত্বরে বর্তমানে যে সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংগুলো রয়েছে তাতে ৫১ টি দপ্তরের মধ্যে মাত্র ২২ টি দপ্তরকে জায়গা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। বাকি ২৯ টি দপ্তর সমগ্র দিল্লিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এর ফলে ভারত সরকারকে প্রতিবছর এক হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ রাজকোষ থেকে ভাড়া বাবদ এবং কর্মীদের আন্তঃবিভাগীয় যাতায়াতের জন্য বাধ্যতামূলক খরচ করতে হয়। এতে রাজধানী শহরে আবশ্যিকভাবেই নিত্যনৈমিত্তিক যানজট ও দূষণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।

প্রেক্ষিত, বাস্তবতা ও সঠিক তথ্য কে না জেনে বা সুচারুভাবে অস্বীকার করে শুধুমাত্র একটি প্রতিবেদন কে হাতিয়ার বানিয়ে কিছু অভিজ্ঞ প্রাক্তন আমলা সমাজকে বিপথে চালনা করতে যে নোংরা খেলায় মেতে উঠেছেন তা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও ধিক্কারজনক। কেন্দ্রীয় আবাসন ও নগর বিষয়ক মন্ত্রী শ্রী হরদীপ সিংহ পুরী এই বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে জহর সরকার সহ ওই ষাট জন প্রাক্তন আমলা সম্বন্ধে বলেছেন, “এরা শুধুমাত্র পড়াশোনা জানা মূর্খই নয়, এরা দেশের পক্ষে অপমান”। তিনি তাদের মস্তিষ্কের চিকিৎসা করানোর পরামর্শও দিয়েছেন। সমগ্র বিষয় টি পর্যালোচনা করলে সমাজের সমস্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষই তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক মতাদর্শ কে দূরে রেখে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর এই মন্তব্য কে সমর্থন করবেন। বস্তুত কতিপয় প্রাক্তন আমলার এইরূপ বোধহীন কাজ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে অর্ধ শিক্ষা এবং সমস্ত বিষয়ে ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে চলা বুরোক্রাটিক সিস্টেম দিয়ে সমাজের সার্বিক কল্যাণে ব্রতী হওয়া চলে না। ল্যাটেরাল এন্ট্রির মাধ্যমে আরও বেশি সংখ্যায় লিবারেল প্রফেশনের জ্ঞানী মানুষেরা এবং টেকনোক্রাটরা যতদিন না প্রশাসনের উচ্চপদে আসীন হচ্ছেন ততদিন সমাজের চিন্তা চেতনার বিকাশ ও সামাজিক উন্নয়নের ধারা শম্বুক গতিতেই যে চলবে- তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

ডঃ তরুণ মজুমদার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.