“পুজো নিয়ে বাড়াবাড়ি কিসের! আত্মিক সমর্পনটাই তো মুখ্য!“ এটাই যেন এই মুহূর্তের মনের কথা সংবেদনশীল মানুষের। যদিও যে কোনও শিরোনামের মত বিতর্ক চলছে এ নিয়েও। কিন্তু পাল্লা অনেক ভারি একটি বিশেষ দিকেই।
উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক তথা বিজেপি সাংসদ সুকান্ত মজুমদার মনে করেন, “পুজো নিয়ে বাড়াবাড়ি কিসের! আত্মিক সমর্পনটাই তো মুখ্য! পুজোর অন্তর্নিহিত বিষয় ভুলে ক্রমেই যেন আমরা বেশি করে বাইরের চাকচিক্যের দিকে ঝুঁকছি। ভক্তির বদলে প্রাধান্য পাচ্ছে ব্যবসা। আর, করোনার জন্য এবারের পরিস্থিতি তো একেবারেই অন্য রকম।“
এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, এই ক’দিন আগে দিলীপ ঘোষ আবেদন করেছেন “এবার দুর্গাপুজো হোক, দুর্গোৎসব নয়“। স্বার্থান্বেষি মহল এবং রাজ্য সরকারের পদলেহনকারী প্রচারমাধ্যম কথাটাকে নিয়ে হইচই শুরু করে। কিন্তু কথাটা তো ১০০ শতাংশ সঠিক! মন্ত্রী-নেতাদের মন্ডপে ফিতে কাটার প্রয়োজনটা কোথায়? ঘটের মাধ্যমেই তো ভক্তি নিবেদন করা যায়! মহারাষ্ট্রের গণেশপুজোয় যদি লাগাম দেওয়া যায়, পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুজোয় নয় কেন? দক্ষিণ ভারতের ওনমের পরিস্থিতির পরেও কেন আমরা যথেষ্ঠ সতর্ক হব না?“
বাম নেত্রী অল ইন্ডিয়া মহিলা সাংস্কৃতিক সংগঠনের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদিকা কল্পনা দত্তর কথায়, “দুর্গাপূজো বা শারদোৎসব বাঙ্গালীর সবচেয়ে সেরা অনুষ্ঠান। হিন্দু ছাড়াও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষই এই উৎসবের জোয়ারে ভেসে যায়। কিন্তু এ বছরের পরিস্থিতিটা ভিন্ন। সারা পৃথিবীর সাথে ভারতবর্ষও করোনা আক্রান্ত এবং এদেশের পরিস্থিতি ক্রমাগত জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে। রাজ্যের অবস্থাও উত্তরোত্তর অবনতির দিকে চলেছে সংক্রমণের পারদ ঊর্ধ্বমুখী। মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। এই পরিস্থিতি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে সারা দেশের মতো এ রাজ্যেও চিকিৎসা পরিকাঠামো কতটা নড়বড়ে এবং ডাক্তার-নার্স সহ চিকিৎসা কর্মীর সংখ্যা কত অপ্রতুল। এই প্রেক্ষিতে পুজো নিয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন প্রত্যাশিত ছিল। ভাবা উচিত ছিল, অন্য বছরের মতো উৎসবের মাতামাতিতে অনুমোদন দেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে, নাকি ধর্ম বিশ্বাসী মানুষের ধর্মাচরণের জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুর মধ্যেই অনুষ্ঠানকে সীমাবদ্ধ রাখা হবে। কিন্তু রাজ্য সরকার যেভাবে উৎসবে মেতে ওঠার জন্য উৎসাহ দিচ্ছেন, সরকারি তহবিল থেকে প্রত্যেক পূজো কমিটিকে ৫০,০০০ টাকা করে অনুদান দিচ্ছেন, নানা পরামর্শ দিয়ে দুর্গাপূজোকে কার্যতঃ অন্য বছরের মতই উৎসবে পরিণত করতে উৎসাহ দিচ্ছেন, তা রাজ্যে চিন্তাশীল মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। এই দিনগুলোতে শারীরিক দূরত্ববিধি, স্বাস্থ্যবিধি যে মাথায় উঠবে উৎসব পরবর্তীতে সংক্রমণ যে ব্যাপক রূপ নেবে তা বুঝতে কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সম্প্রতি দক্ষিণ ভারতের কোন কোন রাজ্য যারা কোভিডকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছিল, সাম্প্রতিক এক ধর্মীয় উৎসবের তা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ফলে রাজ্যের মানুষ সত্যিই আশংকায় রয়েছেন। রাজ্য সরকার তা বোঝেন না তা ভাবতে অসুবিধা হয়। যেখানে ৬ মাসের উপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, ট্রেন চালু করা যাচ্ছে না, মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চূড়ান্তভাবে ব্যহত, সেখানে উৎসবে এমনভাবে উৎসাহ দেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত? কিন্তু সরকারের যে ভোটের জন্য অন্য বাধ্যবাধকতা রয়েছে তা স্পষ্ট। আর কে না জানে যে ভোট বড় বালাই!“সার্ভে পার্ক নিবাসী অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার এবং শিক্ষক অলোক সরকারের মতে, “এবার দুর্গাপুজো সম্বন্ধে নানা রকম কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। কেউ বলছেন পুজো হওয়া উচিত, কেউ বলছেন, না! আবার অনেকে বলছেন এবছর উৎসব নয়, নিছকই পুজো হওয়া উচিত। নানা মুনির নানা মত শোনা যাচ্ছে। এবিষয়ে সংক্ষেপে আমার মতামত জানাচ্ছি। আমার মনে হয় আজ অনেক বাঙালি পুজো বলতে কি বোঝায় সেটাই জানেন না। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, পুজোর দুটি রূপ আছে- অন্তরঙ্গ এবং বহিরঙ্গ। মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি, ধ্যান, ধারণা যখন কম থাকে, তখন বহিরঙ্গ পুজোই প্রশস্ত। মানুষ যখন তার অন্তর নিহিত আত্মশক্তি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকে না, তখন তার জন্য বাইরের পুজোই বিধেয়। সেই সব মানুষের কথা ভেবে শাস্ত্রকাররা মূর্তি, ঘট, ফল, ফুল, বেলপাতা, ধূপ, দীপ, মিষ্টি সহযোগে পুজোর নিদান দিয়েছিলেন। এই রকম ভাবে পুজো করার উদ্দেশ্য দেবতা আছেন সেই বিশ্বাসকে নিজের অন্তরে প্রতিষ্ঠা করা, তাঁর কাছে অবনত হওয়া, তাঁকে ভক্তি করা, এবং নিজের পাশবিক ভাবকে তাঁর পায়ে জলাঞ্জলি দেওয়া। এই ধরনের পুজোর জন্য বাইরের জাঁকজমকের চেয়ে অন্তরের ভক্তি, শ্রদ্ধার গুরুত্ব অনেক বেশি। কিন্তু, হায়! আজকে ক’জন এইসব কথা জানেন, মানেন? সমাজের মাথা যখন পচে যায়, তারপর সমাজের শরীরটা পচতে বেশি সময় লাগে না। আজকে সমাজের মাথার পচন শুরু হয়েছে, সুতরাং শুভবুদ্ধি সম্পন্ন যে দু’একজন বেঁচে আছেন, তাদের কথা কে শোনে? আমি নিঃসন্দেহে জাঁকজমক, উৎসব, হৈ হুল্লোড়ের বিপক্ষে। বিশেষ করে আজকের দিনে করোনা মহামারী থেকে বাঁচতে হলে এর কোনও বিকল্প নেই।“
পঞ্চসায়র শিক্ষানিকেতনেরসহ প্রধান শিক্ষিকা সুপর্ণা চক্রবর্তী এই প্রতিবেদককে বলেন, “দুর্গাপূজা আ বিশ্ব বাঙালির প্রাণের উৎসব। নতুন বছরের ক্যালেন্ডারটা এলেই প্রথমে ঝাঁপিয়ে পড়ে খুঁজি এবারের পুজো টা কবে? ওই ক’টা দিনের জন্য প্রবাসী বাড়ি ফেরেন, দৈনন্দিনতার সব গ্লানি মুছে যায় কোন সে ঐন্দ্রজালিকের অলীক মায়ায়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এটাই যে, এই বছরটা আমরা এক বিশ্বব্যাপী মহামারীর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি।সে মহামারী এত টাই মারাত্মক যে, নিমেষে তা ছড়িয়ে পড়ে কাছাকাছি আসা মানুষ থেকে মানুষে।একে লঘু করে দেখতে গিয়ে ভয়ঙ্কর মূল্য দিতে হয়েছে প্রথম বিশ্বের দেশ গুলিকে। সারা পৃথিবীকে কার্যত স্তব্ধ করে দিয়ে পেন্টিয়াম ফাইভ যুগের মানব সভ্যতাকে সে এক বিরাট চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এই আবহে আমাদের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের প্রাণের উৎসব। সেক্ষেত্রে আমাদের খুব সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।এবারের পুজোকে আসুন না আমরা সবাই একটু অন্য রকম ভাবে পালন করি। পালন করি আবহমান কালের দেবী আরাধনার আঙ্গীকে। দেবীর বোধন সেতো আসলে আমাদের চৈতন্যের উদ্বোধন। দেবীর অঞ্জলির মধ্যে তো নিহিত আছে আমাদের অন্তরের অশুভ শক্তির বিনাশ সাধন করে শুভ শক্তির জাগরণ ‘রূপং দেহি,জয়ং দেহি, যশো দেহি— দ্বিশো জহি !’সেই কামনা তো আমরা নিজেদের ঘরে বসেই ঠাকুরের আসনে অঞ্জলি দিয়ে জানাতে পারি। আর উৎসব ! সেটাও হোক না বাড়ির মানুষ দের নিয়েই । ওই চারটি দিন আমরা নিজেরাই ভালো মন্দ রান্না করি সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া করি, একসঙ্গে গল্প গুজব করতে করতে। স্মৃতিচারণ করি স্মরণীয় পুজোগুলি নিয়ে। এই অতিমারীর পরিস্থিতিতে আমরা নিজেরা সংযত থেকে মহামারীকে প্রতিহত করি। সেটাই বর্তমানে আমাদের কাছে সবচাইতে গুরুত্ব পূর্ণ চ্যালেঞ্জ!!