আজ একুশে ফেব্রুয়ারি । ভাষা দিবস নিয়ে যথারীতি আরেক দফা ন্যাকামো হবে । তবে প্রশ্নটা ওঠা খুব স্বাভাবিক যে যদি শুধু বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করেই বাঙালি আইডেন্টিটি রক্ষা করার জন্যই পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানের আদর্শগত লড়াই হত তাহলে বাংলাদেশ আজ আর একটি আরবিস্থান হওয়ার দৌড়ে পাকিস্তানের সঙ্গে পাল্লা দিত না ।
এই আশঙ্কা অনেক আগে করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ । বঙ্গভঙ্গের ( ১৯০৫ ) বিরোধীতা প্রসঙ্গে তাঁর ‘ ভাষার কথা’ প্রবন্ধে উনি লিখছেন —
’ যখন বঙ্গবিভাগের বিভীষিকায় আমাদের গায়ে কাঁটা দিয়েছিল তখন আমাদের ভয়ের একটি প্রধান কারণ ছিল , এই যে এটা রাজনৈতিক ভূগোলের ভাগ নয় , ভাষার ভাগকে আশ্রয় করিয়া বাংলার পূর্ব-পশ্চিম একটি চিত্তের ভাগ হইবে । ’ ১
প্রথমদিকে না হলেও পরে কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হয়েছিল । যদিও রবীন্দ্রযুগে অনেক মুসলিম কবি সাহিত্যকরা রবীন্দ্র সান্নিধ্যে এসে সমৃদ্ধ হয়েছিলেন । কিন্তু পাকিস্তান জন্মের পর থেকে তো বটেই এবং নবগঠিত পূর্ব বাংলাদেশেও তাঁদের অনেকেই রবীন্দ্রবর্জনের বা আরও ভালো করে বললে হিন্দু বাঙালী সাহিত্যকদের লেখা বর্জনের পক্ষেই ছিলেন । হবিবুল্লাহ বাহার , শামসুন্নাহার মাহমুদ থেকে সঙ্গীত শিল্পী ওস্তাদ আয়েত আলি খান , ফুলঝুরি খান — রবীন্দ্ররচনা থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত বর্জনের পক্ষে ছিলেন সবাই ।
বাংলা ভাষার ইসলামীকরনের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ । ১৯৩৪ সালের ২৭শে মার্চ ( ১১ই চৈত্র ১৩৪০ ) রবীন্দ্রনাথ , এম এ আজানকে এক পত্রে লেখেন — ’ বাংলা ভাষায় সহজেই হাজার হাজার পারসী আরবী শব্দ চলে গেছে । তার মধ্যে আড়াআড়ি বা কৃত্রিম জেদের কোন লক্ষণ নেই । কিন্তু যে সব পারসী , আরবী শব্দ সাধারণ্যে অপ্রচলিত অথবা হয়ত কোন এক শ্রেণীর মধ্যেই বদ্ধ , তাকে বাংলা ভাষার মধ্যে প্রক্ষেপ করাকে জবরদস্তি বলতেই হবে । হত্যা অর্থে খুন ব্যবহার করলে সেটি বেখাপ হয় না , বাংলায় সর্বজনের ভাষায় সেটা বেমালুম চলে গেছে । কিন্তু রক্ত অর্থে খুন চলেনি , তা নিয়ে তর্ক করা নিষ্ফল ’— ২
১৯৩৬ সাল মুসলিম লীগের বয়স তিরিশ পূর্ণ হয়েছে । মৌলানা আক্রাম খান তখন যৌবনের মধ্যগগনে । তিনি মুসলিম নবজাগরণের বার্তা প্রকাশ করছিলেন তাঁর সম্পাদিত ’ মোহাম্মদী ’ পত্রিকায় । এই পত্রিকা তখন শিক্ষিত মুসলিমদের ঘরে ঘরে । রবীন্দ্রনাথের ’ পুজারিনী’ ও ’ গান্ধারীর আবেদন ’ কবিতা দুটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য তালিকায়
অন্তর্ভুক্ত । এর প্রতিবাদস্বরূপ মৌলানা আক্রাম খান ’ মোহাম্মদী ’ পত্রিকায় জ্যৈষ্ঠ, ১৩৪৩ ( মে -জুন , ১৯৩৬ ) সংখ্যা বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যারূপে প্রকাশ করে উপরিউক্ত কবিতা দুটির তীব্র সমালোচনা করে লেখেন —- ’ স্কুল কলেজের পাঠ্য পুস্তকগুলির এক বিরাট অংশ পরিপূর্ণ করিয়া দেওয়া হইয়াছে , নরপূজার , জড়পূজার , প্রকৃতি -পূজার কুশিক্ষায় এবং আদিম যুগের অসভ্য মানুষের পৌরাণিক অন্ধ-বিশ্বাস ও কুসংস্কারের মহিমা প্রচারে । অন্যদিকে মুসলিমকে নিতান্ত হেয় , নিতান্ত নগন্য , এমনকি একটা নিতান্ত জঘন্য জাতিরূপে প্রতিপন্ন করিবার জন্যও ঐ সমস্ত পাঠ্য ও ইতিহাস পুস্তকে নীচতা ও নিষ্ঠুরতার পরকাষ্ঠা প্রদর্শন করা হইয়া থাকে । “ ৩
এই মৌলানা আক্রাম খান দেশভাগ অবধি কলকাতায় ছিলেন , তারপর ঢাকায় গিয়ে হয়েছিলেন দৈনিক ’ আজাদ ’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক । দৈনিক ’ আজাদ ’ পত্রিকাও সবসময় সরব ছিল রবীন্দ্র নিন্দায় । পূর্ব পাকিস্তানে যখন সরকারী পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করার পিছনে ’ আজাদ ’ পত্রিকা অগ্রনী ভূমিকা নিয়েছিল ।
পাকিস্তান আন্দোলনের প্রত্যক্ষ প্রভব সাহিত্য সংস্কৃতির অঙ্গনও অধিকার করেছিল । ১৯৪২ সালে মুসলিম চিন্তাবিদদের জন্য যথাক্রমে কলকাতা আর ঢাকায় গড়ে উঠেছিল পূর্ব পাকিস্তান রেঁনেসা সোসাইটি এবং পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ ।
১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে কলকাতায় অনুষ্ঠিত রেঁনেসা সোসাইটির প্রথম অধিবেশনে আবুল মনসুর আহমেদ বলেন —–
১) “ রাজনীতির বিচারে পাকিস্তানের অর্থ যাই হোক না কেন , সাহিত্যিকের কাছে তার অর্থ তমুদ্দনী আজাদী , সাংস্কৃতিক স্বরাজ , কালচারাল অটোনমী ।
২) একথা মানি যে , হিন্দুর সংস্কৃতিতে ও মুসলমানের তমুদ্দনের মধ্যে ১০১টি মিল রয়েছে । কিন্তু এটাও মানতে হবে যে তাদের মধ্যে গরমিলও আছে প্রচুর ।
৩) ধর্ম ও সংস্কৃতি এক জিনিস নয় । ধর্ম ভুগোলের সীমা ছাপিয়ে উঠতে পারে । কিন্তু তমুদ্দন ভুগোলের সীমা এড়াতে পারে না । বরঞ্চ সেই সীমাকে আশ্রয় করেই সংস্কৃতির পয়দায়েশ ও সমৃদ্ধি ।
৪) পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলা ও আসামের সাহিত্য বলতে আমরা যা বুঝি তা বিদ্যাসাগর -বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রন -শরৎচন্দ্র যুগের সাহিত্যকদের সাহিত্য । এটা খুব উন্নত সাহিত্য । তবুও এ সাহিত্য পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য নয় । কারন এটা বাংলার মুসলমানের সাহিত্য নয় । এ সাহিত্য থেকে মুসলিম সমাজ কোন প্রেরণা পায় নি এবং পাচ্ছে না , এর কারন আছে । সে কারন এই যে , এই সাহিত্যের স্রষ্টাও মুসলমান নয় । এর বিষয়বস্তু মুসলমানী নয় , এর স্পিরিটও মুসলমানী নয় , এর ভাষাও মুসলমানের ভাষা নয় ।
৫) বস্তুত , বাংলার মুসলমানের যেমন একটি নিজস্ব সংস্কৃতি আছে , তেমনি তাদের একটি নিজস্ব সাহিত্যও আছে । সে সাহিত্যের নাম মুসলমানী বাংলা সাহিত্য বা পুঁথি সাহিত্য । পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য রচিত হবে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর মুখের ভাষায় , হিন্দুর ভাষায় নয় । সে ভাষা সংস্কৃত বা তথাকথিত বাংলা ব্যাকরনের তোয়াক্কা করে না । বাংলা ভাষায় কথা বলতে গেলেই হরফের কথাও এসে পড়ে । আমি শুধু এইটুকু বলে রাখছি যে বাংলার বর্তমান বর্ণমালার আবর্জনা আমরা রাখবো না । “ ৪
ঐ একই সমাবেশে আবুল কালাম শামসুদ্দীন বলেন —
“ এতে অনাবশ্যক অক্ষর বাংলা বর্ণমালায় ভিড় করে আছে । সংস্কৃত ভাষার প্রতি অতিরিক্ত মোহবশত স্বভাবতই রক্ষণশীল হিন্দু সাহিত্যিকদের এ ব্যাপারে কুন্ঠা হয়ত স্বাভাবিক । কিন্তু মুসলিম সাহিত্যিক জানেন বাংলা ভাষা একটি মিশ্র ভাষা — সংস্কৃতের সাথে এর কোন যোগ নেই । শুধু তাই নয় , পরোক্ষ যোগও অত্যন্ত ক্ষীণ । কাজেই অনাবশ্যক অক্ষরের মোহ তার থাকতে পারে না । “ ৫
মনসুর আহমেদ কিংবা শামসুদ্দীন সাহেবের বক্তব্য কিন্তু শুধু রেঁনেসা সোসাইটির কথা ছিল না , তা ছিল আপামর পাকিস্তানপন্থী শিক্ষিত বাঙালি মুসলিমদের মানস চেতনা । মনসুর আহমেদ শুধু খ্যাতনামা সাংবাদিক -সাহিত্যিকই ছিলেন , তিনি স্বাধীনোত্তর পাকিস্তানে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ভূমিকাও পালন করেছিলেন । পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ ও রবীন্দ্রবর্জন আন্দোলনে অন্যতম প্রধান ভূমিকাও পালন করেছিলেন ।
পূর্ব পাকিস্তান অধুনা বাংলাদেশ থেকে ভারতে বিতাড়িত হয়ে আসা অধিকাংশ কমিউনিস্টদের একসময়কার নয়নের মনি ছিলেন কবি গোলাম মোস্তাফা , তা এহেন ভদ্রলোক ১৯৫০ সালে লিখছেন —
” Not only Bengali Literature even the Bengali alphabet is full of idolatry . Each Bengali letter is associated with this or that God or Goddess of Hindu Pantheon . The Arabic language and the script must be the best language and the best script in the world. ‘ ৬
১৯৬০ সালে গোলাম মোস্তাফা আবার লিখলেন —
“ উর্দু ও বাংলা যে আজ এত প্রগতিশীল ও জীবন্ত তাহার কারণ যে উহারা আর্যভাষা নহে । অন্যকথায় সংস্কৃত হইতে উহাদের জন্ম হয় নাই । সংস্কৃত হইতে যে ভাষা যত দূর রহিয়াছে , সে ভাষা আজ তত জীবন্ত , তত প্রগতিশীল । ’ ৭
স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হওয়ার পরেও এই প্রবণতা কমার বদলে উত্তরোত্তর বেড়েছে । ‘ আমার সোনার বাংলা ’ কে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে বর্জনের প্রথম দাবী উঠেছিল ৭ই মার্চ, ১৯৭৬ সালে সোহরাবর্দী উদ্যানের জনসমাগমে যার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন জিয়াউর রহমানের ঘনিষ্ঠ সামরিক আইন প্রশাসক বিমান বাহিনী প্রধান এম, জি, তাওয়াব । আর এই ট্র্যাডিশন বেড়েই চলেছে ।
বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের তাত্ত্বিক প্রবক্তা বলে পরিচিত খোন্দকার আব্দুল হামিদের বক্তব্য শুনলে ব্যাপারটি আরও পরিষ্কার হয় । উনি বলছেন —
“রাজবাড়ী বহর ’ নামে একটি জায়গা আছে , যেখানে পদ্মা ও মেঘনা মিশেছে কিন্তু এক দেহে লীন হয় নাই । হাজারো বছর পাশাপাশি প্রবাহিত হওয়া সত্ত্বেও না । মেঘনার পানি কিচকিচা কালো । পদ্মার পানি সাদা ঘোলাটে । এপার বাংলা ওপার বাংলার মধ্যে তেমনি চিরন্তন তফাৎ । সে তফাৎ রংয়ের , খুনের, মানসের , আবেগের , অনুভূতির , ধর্মের , কর্মের , এবাদৎ-বন্দেগির , নামের , নিশানের , ঐতিহ্যের , উত্তরাধিকারের , খোরাকের , পোশাকের ,আদাবের , লেহাজের , কায়দা-কানুনের , জীবনবোধের , জীবনধারার , জীবন -দর্শনের এবং জীবন – সাধনার । হৃদয়ানুভূতির নিবিড় বন্ধন দুয়ের মধ্যে চিরকাল অবর্তমান । এমনকি উভয় বাংলার ভাষা মূলত একটা হলেও বড়লোকের বৈঠকখানা , বিদগ্ধদের সাহিত্য অঙ্গনের বাইরে জনগণের যে ভাষা তা যবানে- লিসানে-মুখরেজে- তালাফফুজে পর্যন্ত আলাদা । ’ ৮
ওপরে আব্দুল হামিদ যে শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন তা পাকিস্তানে যুগে বাংলা ভাষার ইসলামিকরনের কথা মনে করিয়ে দেয় । আসলে খোন্দকার আব্দুল হামিদের “ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী ’ দর্শনের নমুনা ছড়িয়ে গিয়েছে বাংলাদেশের সর্বত্র যার নাম এককথায় আরবীকরন ।
ওপার বাংলায় বাংলাভাষার আরবীকরন দীর্ঘকাল ধরে শুরু হলেও এপার বাংলায় তার ছাপ পড়েনি এতকাল — সুচারুভাবে এই প্রচেষ্টা শুরু হল ২০১১ সালে তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর থেকে — রামধনুকে রংধনু বা আকাশীকে আশমানি শব্দ হিসেবে সরকারী পাঠ্যপুস্তকে ব্যবহার করা আসলে এক সুবিশাল চক্রান্তের অংশমাত্র বা হিমশৈলর চূড়ামাত্র ।
আমাদের নিজেদেরই সুনিশ্চিত করতে হবে যাতে কোন অবস্থাতেই আমাদের সাধের বাংলা যেন উর্দু , পারসী বা আরবীর গহ্বরে তলিয়ে না যায়, আমরা যেন আমাদের গৌরবময় অতীত এবং শক্তিসাধনার উত্তরাধিকার ভুলে ইসলামের পদতলে আত্মসন্মান খুইয়ে না বসে , সত্যিকারের বাঙালি হয়ে উঠতে পারি ।
সুত্র —
১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – ’ ভাষার কথা ’ , শব্দতত্ত্ব পৃ ১৩
২) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – ’ ভাষা শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা ’ , শব্দতত্ত্ব পৃ ১৩৫-১৩৬
৩) নেপাল মজুমদার — ’ ভারতে জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ – চতুর্থ খন্ড , পৃ ৫৭-৫৮
৪) তারাপদ লাহিড়ী – ‘ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি , নিতাই দাশ – ’ পাকিস্তান আন্দোলন ও বাংলা কবিতা গ্রন্থে উদ্ধৃত , পৃ ৪৬
৫) সর্দার ফজলুল করিম – ’ পাকিস্তান আন্দোলন ও বাংলা সাহিত্য ’ , পৃ ১২৬
৬) Gholam Mustafa – ‘ Arabic and Bengali Scripts’
৭) গোলাম মোস্তফার প্রবন্ধ সংকলন, সম্পাদনা , মাহফুজা খানম , পৃ ২৩১
৮) খোন্দকার আব্দুল হামিদ – ‘ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ’ ( গ্রন্থ : জাতীয়তাবাদ বিতর্ক , সম্পাদনা — মুহম্মদ জাহাঙ্গীর )