পশ্চিমবঙ্গ থেকে জাতীয় তদন্ত সংস্থা(NIA) কর্তৃক নয়জন আল কায়দা জঙ্গি গ্রেপ্তার,কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো(CBI) কর্তৃক গরু পাচারকারীদের সন্ধানে ধরপাকড়,মহারাষ্ট্রে একযোগে ইডি,এনসিবি ও সিবিআই-এর তদন্ত–এসব কিছু দেখে অনেকেই ধরে নিয়েছেন যে,’মোদী সরকার’-এর প্রতিশ্রুতি মতো “স্বচ্ছ ভারত অভিযান” বুঝি শুরু হয়েছে।তাঁদের ধারণা হয়ত একবারে অমূলক নয়।ইতিমধ্যেই হাজারেরও বেশি অসরকারি সংস্থা(NGO) বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।যারা সমাজসেবা আড়ালে নানা অনৈতিক ও দেশবিরোধি কার্যকলাপ চালাচ্ছিল।স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর দীর্ঘকাল অ-বিজেপি রাজনৈতিক দল দেশ শাসন করেছে।যাদের কিনা দেশের প্রতি কোনোরূপ মমত্ববোধই ছিল না।ফলে প্রশাসন হোক,সামাজিক হোক বা রাজনৈতিকই হোক সর্বত্রই দুর্নীতি শিকড় ছড়িয়েছে গভীর পর্যন্ত।এসবই “স্বচ্ছ ভারত অভিযান”-এ দূর করা হবে–দেশবাসী বর্তমান জাতীয় সরকারের প্রতি এই ভরসা রাখে।
“স্বচ্ছ ভারত অভিযান”-এর অঙ্গ হিসেবে গত ১০ সেপ্টেম্বর আরেকটি পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।সেটা হল “আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভারতীয় শাখার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে যাবতীয় লেনদেন বন্ধ করে দিল সরকার।শুধু তাই নয়,ওই সংস্থার ভারতীয় শাখার সব কর্মিদের ব্যাঙ্ক লেনদেনের হিসেবও পরীক্ষা করা হবে।দুটি বিষয়ই উক্ত সংস্থার ভারতীয় মুখপাত্র স্বীকার করে নিয়েছেন।শুধু তাই নয়,এই সংস্থার প্রচার ও গবেষণামূলক সকল কর্মসূচি সরকারের পক্ষ থেকে বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।
সংস্থার ভারতীয় শাখা এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ সম্পূর্ণ ‘ভিত্তিহীন’ ও ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’!সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গিয়েছে,ভারতীয় শাখা এর বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে আদালতে যাবে।কিন্তু তারা চিন্তিত এই ভেবে যে,’এই অতিমারীর আবহে কবে শুনানির জন্য সময় পাবে!’
সংস্থা জানিয়েছে যে,তারা বিশ্বব্যাপী কাজ করলেও প্রত্যেক দেশের আইন মেনেই তা করে থাকে।ভারতের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়।ভারতবাসীর সম্মতিতেই তারা এখানে কাজ করে বলে সংস্থার দাবি।এবং তাদের আর্থিক জোগান দেশের মধ্যে থেকে সংগ্রহ করা হয়।কোনো বিদেশী সাহায্য নেওয়া হলেও তা আইন মেনেই নেওয়া হয় বলেও সংস্থার বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।ভারত সরকার তাদের বিরুদ্ধে আর্থিক বিষয়ক ভুয়ো অভিযোগ এনেছে বলে তারা জানিয়েছে।
সংস্থাসূত্রে জানানো হয়েছে যে,এই মানবাধিকার সংগঠনটি ভারতীয় শাখার এক ভারতীয় আধিকারীকের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে তদন্ত চালায় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেট।সেই থেকে ওই আধিকারীকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ‘ফ্রিজ’ বা লেনদেনের উপর স্থগিতাদেশ জারি রয়েছে।ফলে ভারতের প্রান্তবাসী মানুষের উন্নয়নের কাজ থমকে গিয়েছে বলে সংস্থার দাবি।উল্লেখ্য যে,দেশে আর্থিক বিষয় সংক্রান্ত গুরুতর অভিযোগ বা দুর্নীতির তদন্ত করে কেন্দ্র সরকারের অধীন স্বাধীনতা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেট।অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিধি অনুসারে,তারা কর্মিদের আগাম তিন মাসের বেতন দিতে পারে।২০১৮ সালেও তাই করেছিল।সেই ঘটনার কথা মাথায় রেখেই এবার সংস্থার অ্যাকাউন্ট ‘ফ্রিজ’ হতেই বেশির ভাগ কর্মিরাই স্বেচ্ছায় কাজ ছেড়ে দেবার আবেদন করেছে বলে সংবাদমাধ্যম-সূত্রে জানা গিয়েছে।
সংস্থা,তার নিজস্ব বিবৃতি জানিয়েছে যে,ইডির তদন্তে যে-সব তথ্যপ্রমাণাদি সংগ্রহ করেছে,তা কিছু নির্দিষ্ট সংবাদমাধ্যমের কাছে পৌঁছে গিয়েছে।সেগুলি সরকার-পন্থী গণমাধ্যম লাগাতর ভাবে প্রচার করে চলেছে।যে-কারণে ইডি অভিযোগ-নামা জমা পড়ার আগেই মানুষের কাছে সংস্থার ভাবমূর্তি খারাপ হচ্ছে।তারা বিস্ময় প্রকাশ করে প্রশ্ন তুলেছে যে,ইডি-র তদন্ত সংক্রান্ত তথ্যাদি কীভাবে বাইরে ফাঁস হল!
সংস্থাসূত্রে জানা গিয়েছে ২০১৮ সালে জনৈক আধিকারীকের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে কিছু দাতাদের স্বল্প পরিমাণ আর্থিক সাহায্যে সংস্থার দৈনন্দিন কার্যাদি চালাতে হচ্ছিল।কিন্তু ২০১৯ সাল থেকে সেই সকল দাতাদের আয়কর দপ্তর থেকে চিঠি দিয়ে তাঁদের আয়ের উৎস জানতে চেয়ে বলেও সংস্থার ভারতীয় শাখা তাদের বিবৃতি জানিয়েছে।ফলে সংস্থার কোষ সংগ্রহ প্রায় তলানিতে ঠেকেছে বলে জানা গিয়েছে সংস্থাসূত্রে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার বিরুদ্ধে নানা সময়ে অনেক অভিযোগই কমবেশি সামনে আসে।এমন-কি উন্নত দেশগুলিতে মানব-অধিকার লঙ্ঘিত হলে,সে-সময় তারা ‘শিবনেত্র’ হয়ে থাকে!কিন্তু অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে তারা অতিসক্রিয় হয়ে ওঠে–এমন অভিযোগ ভিন্ন সময়ে সামনে এসেছে।যেমন ভারত সরকার জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ সুবিধা দেওয়া তথা অন্যান্য রাজ্যের সাথে বৈষম্যমূলক ৩৭০ ধারা বাতিল করেছে।এটা সম্পূর্ণভাবেই ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়।অথচ ওই সংস্থার ভারতীয় শাখা জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের মানব-অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে গলা ফাটাচ্ছে।ইতিমধ্যে তারা দুটি বইও ছাপিয়ে বিলি করেছে বলে জানা গিয়েছে।সংস্থার বক্তব্য,এই কারণেই ভারত সরকার তাদের অ্যাকাউন্টে লেনদেন স্থগিত করে দিয়েছে!এমন-কি দিল্লির হিংসা-হত্যা নিয়েও তারা নাক গলিয়েছে।বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।তাদের ষাণ্মাসিক প্রতিবেদনে তারা জম্মু-কাশ্মীর-দিল্লি প্রসঙ্গে বলেছে,”আমাদের নিজস্ব তদন্তে জানা গিয়েছে যে,সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির বাসিন্দারা হয়রানি ও ভীতির শিকার হয়েছে।”ভাবুন বিষয়টি নিয়ে!একটি স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তদন্ত করছে একটি অ-নিরপেক্ষ সংস্থা!
সংস্থার ভারতীয় শাখার নির্বাহী আধিকারীক অভিনাশ কুমার সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে,”ভারত সরকারের এই কঠোর মনোভাব,ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দেওয়া কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়।সরকারি এজেন্সিগুলির লাগাতর হয়রানি তারই ধারাবাহিকতা ছাড়া কিছু নয়।”তিনি আরও বলেন,”ইডি এবং ভারত সরকার এক অসহিষ্ণু পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।তারা যেন সংগঠিত অপরাধীর মতো আচরণ করছে।অতিমারীতেও এখানে মানুষের অধিকার ভূলুন্ঠিত হচ্ছে।ভারত মানবাধিকার সংস্থার সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে নাগরিকদের ভয়হীন বাক স্বাধীনতা দেবে এটাই কাম্য।”
সুজিত চক্রবর্তী
(SUJIT CHAKRABORTY)