রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ(RSS)-কে নিয়ে কল্পিত গল্পের যেন শেষ নেই ! প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই এই গালগল্পের শুরু।যা সমান তালে ২০২০-তে এসেও চলেছে! সঙ্ঘ বরাবরই প্রচারবিমুখ।এই বিমুখিতার জন্যই নানা জনে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সঙ্ঘ সম্পর্কে অনেক কুকাহিনি ছড়িয়েছেন! অনেক স্বয়ংসেবকগণ কৌতুক করে বলেন,” নিন্দুকরা আছেন বলেই আমরা নীরবে দেশসেবা করে চলি“।কথাটা একশ শতাংশই সঠিক!
R.S.S. বা Ready for Selfless Service--আত্মস্বার্থ শূন্য হয়ে দেশ ও দশের সেবা করে যাওয়া—এটাই সঙ্ঘের জপমন্ত্র।সঙ্ঘ এই মহামন্ত্র থেকে কোনোদিনই সরেনি।সরবেও না।অথচ সঙ্ঘকে নিয়ে কুকাহিনির শেষ নেই!
সম্প্রতি এমনই আরেকটি গল্প সামনে এসেছে।তাতে বলা হয়েছে,ডঃ ভীমরাও রামজী আম্বেদকর (Dr. Bhimrao Ramji Ambedkar) সঙ্ঘকে ভাল দৃষ্টিতে দেখতেন না!জনৈক স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবী অরুণ আনন্দ এই তথ্য সামনে এনেছেন।


সত্য ঘটনা হল আম্বেদকরজী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘকে খুবই শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন।এমন-কি তাঁর নির্বাচনী প্রতিনিধিও একজন স্বয়ংসেবক ছিলেন!এবং স্বয়ং দত্তপন্থ ঠেংড়িজী !তাঁদের দু’জনের মধ্যে খুবই হৃদ্যতা তো ছিলই বলা চলা হরিহর আত্মা ছিলেন।
বাবাসাহেব ১৯৩৯ সালে স্বয়ংসেবকদের একটি প্রশিক্ষণ বর্গও দেখতে গিয়েছিলেন।স্বয়ংসেবকদের দেশপ্রেম,সংস্কৃতি,সমরসতা দেখে ভীষণই মুগ্ধ হয়েছিলেন।
শ্রী আনন্দ ঐতিহাসিক ঘটনা ও তথ্যাদি সুকৌশলে এড়িয়ে গিয়েছেন।শ্রী হরি নারকে (Mr. Hari Narke) আনন্দের মত খন্ডন করেছেন।যা “The Print“-এ প্রকাশিত হয়েছে।শ্রী নারকে জানাচ্ছেন,আম্বেদকর ও সঙ্ঘের একটা আত্মীক সম্পর্ক ছিল।


শ্রী আনন্দ বাবা সাহেবের ১৯৫১ সালের ১৪-মে’র একটি বৌদ্ধিকের উল্লেখ করে বলেছেন যে,সঙ্ঘের প্রতি আম্বেদকরের সহমর্মী দৃষ্টি ছিল না।নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার জন্য আম্বেদকরজী “সিডিউলড কাস্ট ফেডারেসন” নামে একটি দল গঠন করেন।এই ফেডারেসন ও ভারতীয় জনসঙ্ঘের মধ্যে,প্রাক-নির্বাচনের সময় ১৯৫২ সালে মৈত্রীবন্ধন ঘটে।নির্বাচনী ইস্তেহারে ফেডারেসনের এই মৈত্রীর বিষয় উল্লেখ না-থাকায়,নারকে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন হিন্দু মহাসভা বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের মধ্যে কোনো গঠবন্ধন হয়নি।


শ্রী আনন্দ তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন যে,ফেডারেসন ও সঙ্ঘের মধ্যে কোনো মৈত্রীচুক্তি হয়নি।তিনি শুধু ভারতীয় জনসঙ্ঘের বিষয়টাই উল্লেখ করেছেন।ঘটনাক্রমে,আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ কোনো রাজনৈতিক কর্মকান্ডে নিজেকে কখনও জড়ায়নি।প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই আর.এস.এস. (RSS) নিজেকে দেশব্রতী সমাজসেবী প্রতিষ্ঠানরূপেই নিয়োজিত রেখেছে।তার থেকে পথভ্রষ্ট হয়নি।শ্রীনারকে তাঁর রচনায় বিতর্কিত বিষয়গুলিকে পাশ কাটিয়ে গিয়েছেন।

যখন বাবাসাহেব কংগ্রেস থেকে সরে যেতে বাধ্য হলেন,তখন কী হয়েছিল ? বিষয়টির পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা আছে শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা “Transfer of Power and the Crisis of Dalit Politics in India,1945-47” বইটিতে।বইটি প্রকাশ করে “ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি,ওয়েলিংটন।


আম্বেদকরজী, দলিতদের নিয়ে নিজস্ব রাজনৈতিক কর্মকান্ড শুরু করতেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের থেকে তিনি ক্রমশই দূরে সরে যেতে থাকেন।এমন-কি গান্ধী ঘরানা থেকেও।ফলে,দলিতদের নিয়ে বাবাসাহেবের একটি আলাদা রাজনৈতিক পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হয়।ফলশ্রুতিতে,১৯৪২ সালেই “অল ইন্ডিয়া সিডিউলড কাস্ট ফেডারেসন” গড়ে ওঠে।কংগ্রেস ও গান্ধীজি কী করতে চাইতেন দলিতদের নিয়ে,দলিতদের সার্বিক অবস্থার তথ্য সম্বলিত বিবরণ দিয়েই আম্বেদকর তাঁর সুখপাঠ্য “অস্পৃশ্য” বইটি প্রকাশ করেন।এটি ১৯৪৫-এ প্রকাশিত হয়।


তবুও,আমরা দেখি যে,এর দু’বছরের মধ্যেই ১৯৪৭-এর জুলাই মাসে কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে তিনি বিধানসভা আসনের জন্য নমিনেসন পেলেন!এর কয়েক মাস পরেই স্বাধীন ভারতের নেহেরু-মন্ত্রীসভার ক্যাবিনেট মন্ত্রী হিসেবে তিনি অভিষিক্ত হলেন!এর পিছনে গান্ধীজির প্রত্যক্ষ সুপারিশ ছিল।১৯৫০ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন বোম্বে অল ইন্ডিয়া সিডিউল কাস্ট ফেডারেসনের পক্ষ একটি জনসভার আয়োজন করা হয়।সেখানে আম্বেদকরজী দলিতদের পরামর্শ দেন কংগ্রেসকে সহযোগিতার করার জন্য।কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই বাবাসাহেবের স্বপ্ন ভঙ্গ হল।কংগ্রেস “হিন্দু সংহতি বিল”-এ বাবাসাহেবকে সমর্থন করল না।তিনি অপমানিত হয়ে নেহেরু-ক্যাবিনেট থেকে পদত্যাগ করলেন ১৯৫১ সালে।পরের বছরই বোম্বে সাংসদ কেন্দ্র থেকে নির্বাচনে তিনি কংগ্রেস প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন।তাঁর নির্বাচনী প্রতিনিধি কমলাকান্ত ছেত্রী আম্বেদকরের পরাজয়কে “বিপর্যয়” বলে বর্ণনা করেছিলেন!
রাজনীতিতে এক বছর সময় অনেকটাই।কিন্তু কেউ ভোলেন নি যে,এক বছর আগেও আম্বেদকর কংগ্রেসে ছিলেন !
এরপর,ভারতীয় জনসঙ্ঘ,সোশ্যালিস্ট পার্টি ও সিডিউল কাস্ট ফেডারেসন যৌথ ভাবে “সেন্ট্রাল প্রোভিন্স“-এ নির্বাচনে লড়ে।
( সূত্র :Dr Ambedkar aur Samajik Kranti ki Yatra by Dattopant Thengadi; page-169, Lokhit Prakashan)
দত্তপন্থজী ও আম্বেদকরজী এই ঘটনার পরপরই পরস্পরের সান্নিধ্যে আসতে লাগলেন।সম্পর্ক এমন আত্মীক পর্যায়ে পৌঁছল যে,ভান্ডারা কেন্দ্রের নির্বাচনে বাবাসাহের পন্থজীকেই তাঁর নির্বাচনী প্রতিনিধি করলেন!রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রতি গভীর অনুরাগ না-থাকলে একজন কার্যকর্তার ওপর বাবাসাহেব নির্বাচনী প্রতিনিধিত্বের মতো গুরু দায়িত্ব অর্পণ করতেন না।


ঠেংড়িজী আম্বেদকরের বর্ণময় কর্মজীবনের উপর অনেকগুলি তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থ রচনা করেছেন।যেগুলি অনেক ভাষায় অনুদিত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে।এই ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলিকে এতদিন বামপন্থী ইতিহাসবিদরা প্রচারের আলোয় আসতে দেয় নি।সুখের বিষয় হল সেগুলি এখন মানুষের হাতের কাছে এসেছে।আসছে।
১৩ নভেম্বর,২০১৯ তারিখে ‘অর্গানাইজার’ পত্রে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।তাতে উল্লেখ করা হয় যে, “বাবাসাহেব প্রতিষ্ঠিত সিডিউল কাস্ট ফেডারেসনের কয়েকজন দলিত নেতা আম্বেদকরের কাছে জানতে চান যে,তিনি পন্থজীর মতো একজন ব্রাহ্মণকে ফেডারেসনের সাধারণ সম্পাদকের পদে বসিয়েছেন কেন।এটা শুনে,বাবাসাহেব তাঁদের বলেন,তোমাদের মধ্যে ঠেংড়িজীর চেয়ে বড় দলিত কে আছো বলো।আমি আজই তাঁকে সম্পাদকের দায়িত্ব দেব”!
এটা তাঁর শুধু মুখের কথাই ছিল না।ঠেংড়ীজির প্রতি তাঁর গভীর আত্মবিশ্বাস ছিল,একথা তারই প্রতিফলন।দু’জনে খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে ১৯৫২-৫৬ পর্যন্ত একসাথে কাজ করেছেন।
এই ঘটনার ঠেংড়ীজী নিজেই জানিয়েছিলেন ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ (BMS) প্রাক্তন কার্যকরী সম্পাদক
শ্রীকৃষ্ণ চন্দ্র মিশ্রকে।ভুবনেশ্বর বিমান বন্দরে।শ্রী হরিদাস বাবু আভালে,শ্রী রাজাবাবু খোবড়াগেড়ে,আর.এস.গড়াই ও শ্রী হরভা গনড়ানের মাধ্যমে ঠেংড়িজী বাবাসাহেবের সংস্পর্শে আসেন।

       ভাষান্তর : সুজিত চক্রবর্তী   

       ঋণ স্বীকার: "দ্য প্রিন্ট"

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.