1826 সালের 10 ই মার্চ, মাদ্রাসের গভর্নর থমাস মুনরো ব্রিটিশ সরকারকে একটি জনগণনা ও সার্ভে রিপোর্ট জমা করলেন। এই রিপোর্ট শুধুমাত্র ভারতের ব্রিটিশ সরকারের মধ্যেই আলোড়ন তৈরি করেনি , ইংল্যান্ডের উচ্চ নেতৃত্বের কপালেও চিন্তার ভাঁজ ফেলেছিল।কি ছিল সেই রিপোর্টে? সেই রিপোর্টে ভারতবর্ষের বিষয়ে এমন কি তথ্য ছিল যা আগে জানা ছিল না?
মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির ভৌগোলিক সীমা উত্তরে উড়িষ্যার গঞ্জাম জেলা (Ganjam district) থেকে দক্ষিণে তামিলনাড়ুর তিন্নেভেলী(বর্তমানে নেল্লাই) এবং পশ্চিমে মালাবার(কেরালা ও কর্ণাটকের সংকীর্ণ উপকূলীয় সমভূমি) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই অংশের মোট জনসংখ্যা ছিল ১,২৮,৫০,৯৪১।১২,৪৯৮ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। যদিও এই পরিসংখ্যান এর মধ্যে ম্যাঙ্গালোর এর তথ্য অন্তর্ভুক্ত হয় নি কারন ওই জেলার কালেক্টর কোন কারনে তথ্য জমা করেননি এবং আরো কিছু পার্বত্য অঞ্চল বাদ ছিল।
রিপোর্ট অনুসারে, প্রতি ১০০০ জনে একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল , যেখানে ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে এই হার যথেষ্ট হতাশাব্যঞ্জক ছিল। বস্তুত ইংল্যান্ডের তখন কোন শিক্ষানীতি ছিলই না। আরেকটি তথ্য যা সম্পর্কে ভারতীয়রা এখনো অজ্ঞাত যে , এই বিদ্যালয়গুলিতে মাত্র ২৪% শিক্ষার্থীরা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য সম্প্রদায় ভুক্ত ছিল।শুদ্র সম্প্রদায় ভুক্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যাই অধিক ছিল, শতাংশের হিসেবে যা ছিল প্রায় ৬৫%।
‘The beautiful Tree‘ নামক বই এর তথ্যের ভিত্তিতে প্রাপ্ত এই পরিসংখ্যান আমাদের সেই বহু পুরনো ধারণা থেকে বের হতে সাহায্য করবে যে ব্রাহ্মণরাই তখন শিক্ষাক্ষেত্রের বড় অংশীদার ছিল, যদিও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রগুলোতে তারাই সংখ্যাধিক ছিল।
এখানে একটা প্রশ্ন উঠে আসে যে , যে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে লুটতরাজ করতে এসেছিল তারা বাংলা , বিহার,পাঞ্জাব,বম্বে ও মাদ্রাস প্রেসিডেন্সি সহ সারা ভারতব্যাপী এই সার্ভে কেন করিয়েছিল?
উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের বেশিরভাগ অংশেই নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল। তারা এখন সেসব অঞ্চল থেকে আরো বেশি রাজস্ব আদায়ের আশা করছিল। কিন্তু ভারতবর্ষের সমস্ত অংশ থেকে রাজস্ব আদায়ের জন্য প্রয়োজনীয় ইংরেজ কর্মচারীর সংখ্যা অনেক কম ছিল। আর বেশি সংখ্যায় ব্রিটিশ আধিকারিক নিয়োগ অত্যন্ত ব্যয়বহুল হতো। তাই তারা চেয়েছিল এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা, যার সাহায্যে তারা ‘তাদের মত করে শিক্ষিত’ ও ‘সস্তা’ কেরানী পাবে যাদের দিয়ে ব্রিটিশদের প্রশাসনিক কাজ সামলানো যাবে। তারা বুঝেছিল এই ‘ইংরেজি বলা মানুষ‘গুলো তাদের প্রতি অনুগত থাকবে এবং একইসাথে ভারতবর্ষে সমাজের দুটো অংশ তৈরি হয়ে যাবে , এক যারা ‘ইংরেজী বলতে পারে’ এবং অন্যরা।
এছাড়াও, ইংরেজদের উদ্দ্যেশ্য ছিল ভারতীয়দের খ্রীষ্টান ধর্মের দিকে নিয়ে যাওয়া , যাতে করে বিজয়ী ও বিজিত , শাসক ও শাসিতের মধ্যে দূরত্ব কমে।এইজন্যে , তাদের প্রয়োজন ছিল নতুন এক শিক্ষাব্যবস্থার। কিন্তু যে কোনও নতুন নীতি নির্ধারণের আগে, বিদ্যমান অবস্থানটি আরও ভালভাবে জানা দরকার।
ভারতবর্ষের দেশীয় শিক্ষার সীমা ও প্রকৃতি সম্পর্কিত সার্ভের জন্য ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশাবলী ১৮১৩ সালে’হাউস অফ কমনস্‘ এর দীর্ঘ বিতর্কের পরিণতি ছিল।এই বিতর্কটির মূল বিষয় ছিল ‘ভারতে ধর্মীয় এবং নৈতিক উন্নতির প্রচারে গতি আনা’।
এই সার্ভের রিপোর্ট ব্রিটিশদের অবাক করেছিল যে ভারতবর্ষ, এতবার বৈদেশিক আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত হয়েও ; ভারতবর্ষের সংস্কৃতি, ধন-সম্পদ এত ক্ষত বহন করেও এরকম একটি শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো টিকে আছে কেমন করে?
প্রত্যেক গ্রামে একটি করে ‘মঠ’ , ‘পাঠশালা’ বা ‘গুরুকুল’ ছিলো যা ঐ গ্রামেরই একটি মন্দির দ্বারা পরিচালিত হতো। গ্রামের মোট জমির প্রায় ৩৫% রাজস্বমুক্ত এবং মন্দিরের সম্পত্তির অংশ ছিল। মন্দিরের তত্ত্বাবধানেই সমস্ত উৎসব, অনুষ্ঠান হতো এবং মন্দিরের জমির আয় থেকেই শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হতো।
ছাত্রদের পঞ্চম বছরের, পঞ্চম মাসের, পঞ্চম দিনে শিক্ষার জন্য বিদ্যালয়ে পাঠানো শুভ বলে মনে করা হতো। শিক্ষার এই পবিত্রতা আজো আমরা বহন করে চলেছি সরস্বতী পূজার দিন ‘হাতেখড়ি’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।দক্ষিণ ভারতে এই অনুষ্ঠানকেই ‘বিদ্যারম্ভ’ বলা হয় ।প্রত্যেক পরিবার কমপক্ষে তিন বছরের জন্য ছেলেদের বিদ্যালয় পাঠাতো যাতে তারা পড়তে , লিখতে ও সাধারণ গণনা করতে শিখতে পারে।
পরবর্তীকালে সে তার পরিবারের ঐতিহ্য মেনে ও পারিবারিক কোন ব্যবসার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতো। মেয়েদের সাধারণত বাড়িতেই শিক্ষা দেয়া হতো।
এছাড়াও , গ্রামীণ মন্দিরগুলো সামাজিক অর্থনৈতিক , বৌদ্ধিক ক্ষেত্রেও অংশ নিতো। মন্দিরগুলি বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ, বেদ, উপনিষদ এবং আঞ্চলিক সাহিত্যের পাঠাগার হিসেবেও কাজ করতো যা সমাজে ‘সরস্বতী ভান্ডার‘ নামে সুপরিচিত ছিল।মন্দিরে একজন বৈদ্য ,একজন জ্যোতিষী এবং একজন সেবিকা কে নিয়োগ করা হতো এবং তাদের পারিশ্রমিক মন্দিরের আয় থেকেই আসতো। মন্দির ভ্রমণকারী এবং তীর্থযাত্রীদের জন্য খাদ্য ও বাসস্থানের ব্যবস্থাও করতো।
এই সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী, মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির মন্দিরগুলি বিভিন্ন আঞ্চলিক উন্নয়ন যেমন জলসেচ, গৃহনির্মাণ, জলাধারের ও খালের রক্ষণাবেক্ষণ এবং দুর্যোগ-পরবর্তী ত্রাণ ও পুনর্বাসনে যুক্ত ছিল। এই সমস্ত কাজের জন্য অর্থের জোগান আসতো গ্রামবাসী ও তীর্থযাত্রীদের দান থেকে। সুতরাং মন্দিরগুলি প্রাথমিক শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল।
অন্যদিকে ইংল্যান্ডে, কারখানার শ্রমিকরা কাজে যাওয়ার আগে তাদের সন্তানকে যে ঘরে রেখে যেতেন, তারা তাকে ‘স্কুল‘ বলতেন।’স্কুল’ শব্দটির উৎপত্তি এই ভাবেই হয়েছিল। শিশুদের কিছু প্রাথমিক জ্ঞান দেওয়ার জন্য কারখানার কাজে অক্ষম শ্রমিকদের কাজে লাগানো হতো। সমাজের অবস্থাপন্ন শ্রেণীর জন্য কিছু ‘গ্ৰামার স্কুল‘ (Grammer School) ছিল , যার খরচ অত্যন্ত ব্যয়বহুল হতো। সর্বসাধারণের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা ১৮০০ সাল নাগাদ এক অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল।এই হল ইংল্যান্ডের সেইসময়ের শিক্ষাব্যবস্থা।
দশম শতাব্দীর শেষে প্রতিষ্ঠিত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে,উনিশ শতকের শুরুতে ১৯ টি কলেজ এবং ৫ টি হল ছিল। কলেজগুলিতে প্রায় ৫০০ জন ফেলো ছিল, যাদের মধ্যে কয়েকজন প্রতিটি কলেজে শিক্ষকতায় নিযুক্ত ছিলেন। এছাড়াও, ১৮০০ সালে ১৯ জন অধ্যাপক ছিলেন যা ১৮৫৪ তে গিয়ে ২৫ এ দাঁড়ায়।
৭০০ খ্রীষ্টাব্দের দিকে চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এর ভ্রমণ কালে ,গুপ্ত সাম্রাজ্যের পৃষ্ঠপোষকতায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় যখন খ্যাতির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছায় , তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ২০০০ জন শিক্ষক , প্রায় ১০০০০ জন শিক্ষার্থী কে পড়াতেন।
শুধুমাত্র এই পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট, ১৮০০ সালের অক্সফোর্ডের থেকে , ৭০০ সালের নালন্দা কতটা এগিয়ে ছিল।
বর্তমান পাকিস্তানের (Pakistan) রাওয়ালপিন্ডিতে খননকার্যে আবিষ্কৃত ষষ্ঠ শতাব্দীর তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস আরো পুরোনো।
সনাতন ভারতবর্ষের শিক্ষার এই ব্যাপকতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শিক্ষার স্বাঙ্গীকরণ‘ প্রবন্ধের একটি অংশ থেকে স্পষ্ট হয়…
“আমার বক্তব্য এই যে, এ দেশে একদা বিদ্যার যে ধারা সাধনার দুর্গম তুঙ্গ শৃঙ্গ থেকে নির্ঝরিত হত সেই একই ধারা সংস্কৃতিরূপে দেশকে সকল স্তরেই অভিষিক্ত করেছে। এজন্যে যান্ত্রিক নিয়মে এডুকেশন ডিপার্টমেণ্টের কারখানা-ঘর বানাতে হয় নি; দেহে যেমন প্রাণশক্তির প্রেরণায় মোটা ধমনীর রক্তধারা নানা আয়তনের বহুসংখ্যক শিরা-উপশিরা-যোগে সমস্ত দেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গে প্রবাহিত হতে থাকে তেমনি ক’রেই আমাদের দেশের সমস্ত সমাজদেহে একই শিক্ষা স্বাভাবিক প্রাণপ্রক্রিয়ায় নিরন্তর সঞ্চারিত হয়েছে–নাড়ীর বাহনগুলি কোনোটা-বা স্থূল কোনোটা-বা অতি সূক্ষ্ম, কিন্তু তবু তারা এক কলেবর-ভুক্ত নাড়ী, এবং রক্তও একই প্রাণ-ভরা রক্ত।”
খুব স্বাভাবিকভাবেই ইংরেজদের জাত্যাভিমানের পক্ষে এই ব্যাপারটি হজম করা অস্বাভাবিক ছিল যে তাদের দ্বারা বিজিত একটি জাতির এত সুগঠিত শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল কোন সরকারি সাহায্য ও অনুমোদন ছাড়াই। তাই তারা মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির রিপোর্ট টি লুকানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলো।
এরপর খ্রীষ্টান ধর্ম প্রচারক উইলিয়াম এডাম ১৮৩৫-৩৮ সালে বিহার ও বাংলায় অনুরূপ একটি সার্ভে করেন , যেখানে উনি এক লক্ষ গ্ৰামীন বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন।তার মতে ,প্রতিটি জেলায় গড়ে প্রায় ১০০ টি উচ্চতর শিক্ষার প্রতিষ্ঠান ছিল। ফলস্বরূপ, তিনি উপসংহারে পৌঁছেছিলেন যে বাংলার ১৮ টি জেলায় প্রায় ১৮০০ টির মতো প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ও বিহার প্রেসিডেন্সিতে প্রাক্তন খ্রীষ্টান ধর্মপ্রচারক উইলিয়াম এডামের করা এই সার্ভে প্রসঙ্গে “শিক্ষার স্বাঙ্গীকরণ” প্রবন্ধে বলেছেন……
“রামমোহন রায়ের বন্ধু পাদ্রি এডাম সাহেব বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার যে রিপোর্ট প্রকাশ করেন তাতে দেখা যায় বাংলা-বিহারে এক লক্ষের উপর পাঠশালা ছিল, দেখা যায় প্রায় প্রত্যেক গ্রামেই ছিল জনসাধারণকে অন্তত ন্যূনতম শিক্ষাদানের ব্যবস্থা। এ ছাড়া প্রায় তখনকার ধনী মাত্রেই আপন চণ্ডীমণ্ডপে সামাজিক কর্তব্যের অঙ্গরূপে পাঠশালা রাখতেন, গুরুমশায় বৃত্তি ও বাসা পেতেন তাঁরই কাছ থেকে। আমার প্রথম অক্ষরপরিচয় আমাদেরই বাড়ির দালানে, প্রতিবেশী পোড়োদের সঙ্গে। মনে আছে এই দালানের নিভৃত খ্যাতিহীনতা ছেড়ে আমার সতীর্থ আত্মীয় দুজন যখন অশ্বরথযোগে সরকারি বিদ্যালয়ে প্রবেশাধিকার পেলেন তখন মানহানির দুঃসহ দুঃখে অশ্রুপাত করেছি এবং গুরুমশায় আশ্চর্য ভবিষ্যৎদৃষ্টির প্রভাবে বলেছিলেন, ঐখান থেকে ফিরে আসবার ব্যর্থ প্রয়াসে আরো অনেক বেশি অশ্রু আমাকে ফেলতে হবে। তখনকার প্রথম শিক্ষার জন্য শিশুশিক্ষা প্রভৃতি যে-সকল পাঠ্যপুস্তক ছিল, মনে আছে, আবকাশকালেও বার বার তার পাতা উল্টিয়েছি। এখনকার ছেলেদের কাছে তার প্রত্যক্ষ পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত হব, কিন্তু সমস্ত দেশের শিক্ষা-পরিবেশনের স্বাভাবিক ইচ্ছা ঐ অত্যন্ত গরিব-ভাবে-ছাপানো বইগুলির পত্রপুটে রক্ষিত ছিল–এই মহৎ গৌরব এখনকার কোনো শিশুপাঠ্য বইয়ে পাওয়া যাবে না। দেশের খাল-বিল-নদী-নালায় আজ জল শুকিয়ে এল, তেমনি রাজার অনাদরে আধমরা হয়ে এল সর্বসাধারণের নিরক্ষরতা দূর করবার স্বাদেশিক ব্যবস্থা।”
১৮২০ সালে বম্বে প্রেসিডেন্সিতে করা সার্ভের ভিত্তিতে জানা যায় , সেখানে এমন কোনো গ্ৰাম ছিল না যেখানে বিদ্যালয় ছিল না এবং বড় গ্ৰামগুলিতে একের বেশি বিদ্যালয় ছিল।
পরবর্তী সময়ে ১৮৮২ সালে ডঃ লিটনার এর পাঞ্জাবে তার নিজের করা সার্ভে ও সরকারের পুরোনো কিছু তথ্য ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও শিক্ষার এই বিস্তৃতি প্রমাণ করে।লিটনার খুব স্পষ্টভাবে ব্রিটিশ নীতির সমালোচনা করেছিলেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে ,লিটনার ব্রিটিশ-আধিকারিক হলেও ইংরেজ ছিলেন না।
ইংরেজরা আরো বেশি অর্থের লোভে রাজস্ব মুক্ত মন্দিরের জমি ৩৫% থেকে ৫% তে নামিয়ে আনলো যাতে করে মন্দির এর সাহায্যে গড়ে ওঠা শিক্ষাব্যবস্থার শিরদাঁড়া ভেঙে যায়। হলোও তাই। প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে গুরুকুল ও পাঠশালা গুলি ধুঁকতে থাকলো।
এরপরে ভারতবর্ষের ভাগ্যাকাশে প্রবেশ ঘটলো থমাস ব্যাবিংটন এডওয়ার্ড মেকলে(Thomas Babington Macaulay)এর, যাকে সনাতন ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের প্রধান স্থপতি বলা যায়।
মেকলে ,ছিলেন উইলিয়াম বেন্টিং এর আইনসচিব। ১৮৩৫ এর ফেব্রুয়ারি তে মেকলে , গভর্নর উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক (William Bentinck) কে সনাতন ধারার ভারতীয় শিক্ষা পদ্ধতি বাতিল করে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষা দানের পক্ষে প্রস্তাব পেশ করেন।
মেকলে প্রস্তাবে বলেন, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া সংস্থার পক্ষে এত বিপুল সংখ্যক জনগণকে শিক্ষিত করার প্রচেষ্টা অসম্ভব ।
মেকলে চেয়েছিলেন সমাজের উচ্চবর্গের ভারতীয়দের মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষা নিম্নবর্গের মানুষের মধ্য চুঁইয়ে পড়বে(Infiltration Theory) আর এমন এক শ্রেণীর ভারতীয় তৈরি হবে যারা বর্ণে ও রক্তে হবে ভারতীয় , কিন্তু ভাবনা ও রুচি তে হবে ইউরোপীয় (‘Indian in blood & colour,but English in tastes, in opinions,and in morals and intellect’)
ভারতীয় ভাষা না জেনে,ভারতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও দেশের সাধারণ মানুষের সমস্যাবলির সঙ্গে পরিচিত না হয়েই মেকলে বলেছিলেন
“ইউরোপের একটি ভালো গ্রন্থাগারের একটি বই ভর্তি তাকই ভারত ও আরবের সমগ্র সাহিত্যের সমান“।
মেকলে জানতেন যে তার বৌদ্ধিক উপনিবেশিকতার এই নীতিটি এক ঢিলে দুই পাখি মেরে ফেলবে। একদিকে ভারতীয় উপমহাদেশের লোকেরা তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য এবং ধার্মিক অনুশীলনকে অবজ্ঞার চোখে দেখবে এবং খুব সহজেই ইংরাজী এবং ব্রিটিশদের আধিপত্য তাদের মনে প্রতিষ্ঠিত হবে আর নিজেরা তাদের সস্তা কেরানিতে পরিণত হবে।
মেকলের প্রস্তাব মেনে বেন্টিঙ্ক ১০ ই জুলাই,১৮৩৫ এ ‘English Education Act‘ এর মাধ্যমে ইংরেজি শিক্ষাকে সরকারি নীতি রূপে ঘোষণা করেন।
এমনিতেই যখন ভারতবর্ষের ঐতিহ্যশালী শিক্ষাব্যবস্থা অর্থ ও বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির চাপে ক্ষীয়মান ছিলো, তখন ইংরেজরা সুকৌশলে ‘ইংরেজি শিক্ষা ব্যবস্থা‘ চালু করলো।
এই শিক্ষার ব্যয় ভার বহন করা কিছু অবস্থাপন্ন পরিবার ছাড়া সাধারণের পক্ষে সম্ভব ছিল না।এই ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা , ভারতবর্ষের সাক্ষরতার হার কমিয়ে দিল।
গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিতে গিয়ে ১৯৩১ সালের , ২০ অক্টোবর লন্ডনের 'Royal Institute of International affairs' এ গান্ধীজী 'The future of India' নামক নিজের বক্তৃতায় বলেন.....
That does not finish the picture. We have the education of this future state. I say without fear of my figures being challenged successfully, that today India is more illiterate than it was fifty or a hundred years ago, and so is Burma, because the British administrators, when they came to India, instead of taking hold of things as they were, began to root them out. They scratched the soil and began to look at the root, and left the root like that, and the beautiful tree perished. The village schools were not good enough for the British administrator, so he came out with his programme. Every school must have so much paraphernalia, building, and so forth. Well, there were no such schools at all. There are statistics left by a British administrator which show that, in places where they have carried out a survey, ancient schools have gone by the board, because there was no recognition for these schools, and the schools established after the European pattern were too expensive for the people, and therefore they could not possibly overtake the thing. I defy anybody to fulfill a programme of compulsory primary education of these masses inside of a century. This very poor country of mine is ill able to sustain such an expensive method of education. Our state would revive the old village schoolmaster and dot every village with a school both for boys and girls. (MAHATMA GANDHI AT CHATHAM HOUSE, LONDON)
গান্ধিজী , সনাতন ভারতবর্ষের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এক সুন্দর বৃক্ষের সাথে তুলনা করেন এবং আশার বাণী শোনান যে ,পরবর্তীকালে আমরা সেই শিক্ষাব্যবস্থা কেই পুনরুদ্ধার করবো।
কিন্তু স্বাধীন ভারতবর্ষে আমরা পেলাম এমন এক প্রধানমন্ত্রী যিনি ভারতবর্ষের সনাতন ঐতিহ্যের সঙ্গে নিজেকে এক করে দেখতে লজ্জাবোধ করতেন।ফলে , গান্ধীজীর নাম ৭০ বছর ধরে শুধুই ভোট বৈতরণী পার হওয়ার কাজে লাগলো কিন্তু শিক্ষা নিয়ে গান্ধীজীর পরিকল্পনা প্রাধান্য পেল না।
১৯৩১ সালে , গান্ধীজী শিক্ষার বিষয়টি উত্থাপন করে , ব্রিটিশ সরকারকে ভারতবর্ষের শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য দায়ী করেছিলেন। ব্রিটিশরা গান্ধীজীর অভিযোগ স্বীকার করেনি এবং প্রমাণের দাবি করে। গান্ধীজী ১৮২৬ সালে করা সেই সার্ভের কথা জানতেন যা ইংরেজরা ব্রিটিশ লাইব্রেরির আর্কাইভে যক্ষের ধনের মতই আগলে রেখেছিল।
পরবর্তীকালে এটি আবিষ্কার করেন ধর্মপাল নামে এক ব্যক্তি এবং তিনি এই তথ্যগুলো ‘The beautiful Tree‘ নামক একটি বই এ প্রকাশ করেন।শ্রী ধর্মপাল (Shri Dharmapal) এই তথ্যগুলি জনসমক্ষে আনার জন্যই ব্রিটিশ লাইব্রেরীতে কাজে যোগদান করেন এবং রিপোর্ট পাওয়ার পরে লাইব্রেরীতে বসে দীর্ঘ সময় ধরে এই রিপোর্ট টুকে নিয়ে আসেন এবং পরবর্তীকালে বই আকারে প্রকাশ করেন। শ্রী ধর্মপাল ১৯২২ সালের ১৯ শে ফেব্রুয়ারি উত্তরপ্রদেশের মুজফ্ফরনগরে জন্মগ্ৰহন করেছিলেন এবং ২৪ অক্টোবর, ২০০৬ এ মহারাষ্ট্রের সেবাগ্ৰামে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জয়প্রকাশ নারায়ন সহ বেশ কিছু স্বনামধন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। সর্বদা সাধারণ খাদি পরিহিত, গান্ধীভক্ত এই মানুষটিকে ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধের সময় প্রধানমন্ত্রী নেহেরু কে একটি ‘খোলা চিঠি’ লেখার জন্য জেলে যেতে হয়েছিল।
এন-ডি-এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওনাকে ‘Cattle Commission’ এর চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়।উনি সারাজীবন ভারতবর্ষের ঐতিহ্যশালী শিক্ষা ব্যবস্থার পুনরুদ্ধারের জন্য কাজ করে গিয়েছেন।
ভারতবর্ষের শিক্ষা ব্যবস্থা যে প্রকৃতপক্ষেই ‘একটি সুন্দর বৃক্ষ‘ (The Beautiful Tree) ইংরেজরা তা বুঝতে পেরেছিল। আর তারা এই বৃক্ষের মূল খুঁজে তাকে উপড়ে ফেলেছিল।একটি জাতির পরাজয়ের ফলে , বিজিত জাতির মধ্যে যে শুধুমাত্র বিভাজন ঘটে তা নয় , সেই জাতির জ্ঞানের ভান্ডার টিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইংরেজ রা এই দুটি কাজই সুনিপুণভাবে করেছিল।
ভারতবর্ষের বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকালে মেকলে কতটা সফল হয়েছিলেন বোঝা যায়। সত্যিই ভারতবর্ষে এমন এক শ্রেণী তৈরি হয়ে গিয়েছে যারা দেশীয় সংস্কৃতি ,বিজ্ঞান ,ইতিহাসকে মনে রাখেনি।
ভারতবর্ষের মেকলের মানসপুত্ররা লাল চশমার ওপার থেকে কখনোও কি সনাতন ভারতবর্ষের ঐতিহ্যশালী শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছেন?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘শিক্ষার স্বাঙ্গীকরণ‘ প্রবন্ধে ‘পাশ্চাত্য শিক্ষার‘ অসাড়তা নিয়ে বলেছেন……
“আজ দেশে যে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তিত হয়েছে মাটিকে সে দান করেছে অতি সামান্য; ভূমিকে সে আপন উপাদানে উর্বরা করে তুলছে না। জাপান প্রভৃতি দেশের সঙ্গে আমাদের এই প্রভেদটাই লজ্জাজনক এবং শোকাবহ। আমাদের দেশ আপন শিক্ষার ভূমিকা সৃষ্টি সম্বন্ধে উদাসীন। এখানে দেশের শিক্ষা এবং দেশের বৃহৎ মন পরস্পরবিচ্ছিন্ন। সেকালে আমাদের দেশের মস্ত মস্ত শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতের সঙ্গে নিরক্ষর গ্রামবাসীরা মনঃপ্রকৃতির বৈপরীত্য ছিল না। সেই শাস্ত্রজ্ঞানের প্রতি তাদের মনের অভিমুখিতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল।”
বর্তমানের তথ্য অনুযায়ী, ভারতবর্ষে ৫,৯৭,৪৮৩ টি গ্ৰাম , প্রায় ৭৯৩৩ টি শহর আছে। যদি প্রত্যেক গ্রামে একটি করে মোট প্রায় 6 লক্ষ মন্দির থাকতো এবং সেই মন্দিরগুলি প্রাক-ব্রিটিশ যুগের মতোই স্বনিয়ন্ত্রিত হতো , তাহলে সেই সুন্দর বৃক্ষটি আজও আমাদের কয়েকহাজার বছরের সংস্কৃতির ছায়া তলে জ্ঞানের ফল দিয়ে সমৃদ্ধশালী করতো।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মেকলীয় বিষ আজও আমাদের জাতিকে ‘ভারতীয়ত্ব‘ থেকে ক্রমশঃ দূরে নিয়ে যাচ্ছে।একটি জাতি দুর্বল হয়ে পড়ে যখন তাদের নিজস্ব শিকড় সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতা বৃদ্ধি পায় বা যখন তারা নিজের বা পূর্বপুরুষদের জন্য লজ্জিত হয়।একটি জাতি তখনই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় , যখন তাঁরা তাদের নিজস্ব জীবনযাপন, তাদের দর্শন, নীতি, তাদের চিন্তা স্রোত ইত্যাদির প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে।
গ্ৰিক, রোমান এর মতো প্রাচীন সভ্যতাগুলি নিজস্ব জীবনযাত্রায়, নিজস্ব প্রজ্ঞায় বিশ্বাস হারিয়ে তাদের জীবনে সম্পূর্ণ ভিন্ন দর্শন গ্রহণ করে আজ স্মৃতিসৌধে পরিনত হয়েছে।
যদি আমরা সত্যিই একটি জাতি হিসাবে নিজেকে দুর্বল করতে না চাই, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এর মেকলীয় বৈশিষ্ট্য থেকে বের করে সেই সুন্দর বৃক্ষটি কে আবার ফূলে-ফলে সমদ্ধ করতে হবে।
তথ্যসূত্র : ১)’The beautiful Tree‘ by Dhrmapal
২)The educational Heritage of ancient india by Sahana Sing
পিন্টু সান্যাল (Pintu Sanyal)