অবতার-তত্ত্বে মানববিবর্তন ও অভিযোজন #SSUB

ছ’মাস আগে সংবাদ-প্রবাহের অন্যতম শিরোনাম হয়েছিল ভেনিসে — ৬’২” জলোচ্ছ্বাসে বিবিধ ক্ষতি এবং দু-এক জনের জীবনহানি। এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়, অর্ধশতাব্দীব্যাপী বিবিধ পরিবেশ সংগঠনের দ্বারা প্রচারিত ভবিতব্যের আংশিক নমুনা; কারখানা-রূপ কানের চিমনি থেকে জল, বায়ু, মাটির প্রদূষণ; যেন অনেকটা মধু-কৈটভ রূপী ময়লা। ফলে গরমে জলাভাব, বর্ষায় পানীয় জলাভাব, শীতে হিমের জন্য জলাভাব; বন্যা, খরা, দাবানল, এ্যাসিড-বৃষ্টি, কিসের অভাব? হিমবাহে হিম নেই, মাটির নীচে জল নেই, দ্বীপগুলোর স্থল নেই, শরীর মন চরিত্রে বল নেই, শুধু ছল করতে ছল নেই। চিন্তা করবেন না আমাদের আত্মপরিবর্তন হচ্ছে। গুগল ঘাটলেই দেখতে পাবেন হাতে গুচ্ছ মূলের মতো কেউ ৫ এর বদলে ১৬ বা ১৮ আঙ্গুলি নিয়ে জন্মাচ্ছে, কারুর ছোট বড় বেহিসাবি হাত পা। গায়ের রঙ সবুজ হয়ে সালোকসংশ্লেষটাই যা বাকি!

একবার মহামতি মনুর জন্য তাঁর শিষ্যরা পুকুর থেকে মৃৎপাত্র করে জল এনে দেন, হাত মুখ ধোয়ার জন্য। তাতে ছিল ছোট্ট এক মাছ। সে হঠাৎ মনুকে বলে উঠল “আমাকে দয়া করে বাঁচান, আমিও সময় কালে আপনাকে প্রতিদান দেব।” দয়াময় মুনির দয়া হলো। তিনি মাছটিকে একটি বড় পাত্রে রক্ষা করলেন। পরে মাছটি দ্রুত বাড়তে থাকলে মুনিবর মাছটিকে তার অনুরোধ ক্রমে একে একে পুকুর ও নদীতে ছাড়তে থাকলেন। কিন্তু অতি বিশালাকার মাছ যখন নদীতেও থাকতে পারছেনা তখন মুনিবরকে জানাল যে, সে এবার সমুদ্রে যাচ্ছে। কিছু দিন পর সমগ্র মহাপ্রলয় উপস্থিত হলে সমগ্র ভূভাগ জলমগ্ন হয়ে প্লাবিত হবে। তখন সে মুনিবরকে অন্যত্র নিয়ে গিয়ে রক্ষা করবে। এর কিছু দিন পর সত্যিই মহাপ্রলয় উপস্থিত হলে সেই বিশালাকার মাছ একটি ছোট্ট তরী নিয়ে এসে মুনিবর মনুকে সুউচ্চ উত্তর পর্বতের স্থলভাগে রেখে এল। পরে পৃথিবী পুনরায় শান্ত শীতল হলে জল সমুদ্রে ফিরে গেলে মুনিবর মনু নীচে নেমে আসেন ও বংশ বিস্তার করেন। আমরা সেই মনুর সন্তান, মানব। আমাদেরই দানব চরিত্রের বিঘ্নিত উষ্ণায়নে বিভিন্ন পর্বতের হিমবাহ, উভয় মেরুর হিম যেভাবে গলছে তাতে কল্পান্ত নিকটবর্তী মনে হয়। ভগবান বিষ্ণু আবার হয়ত মৎস্যাবতার ধারণ করেছেন। এখন মনে হচ্ছে মনুর সঙ্গে ‘মনুমৎস্যকথা’ চলছে। কবি জয়দেব তাঁর দশাবতার স্তোত্র এ বলেছেন—

प्रलयपयोधिजले कृतवानसि वेदं
विहितवहित्र चरित्रमखेदम्।
केशव ! धृत मीन शरीर
जय जगदीश हरे।।

কি অদ্ভুত ব্যাপার দশাবতারের প্রথম হল মীন বা মৎস্য। আবার মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে মাছ সর্বাগ্রে এসেছে। এই বিবর্তনধারায় জলজ মাছ থেকেই তো কচ্ছপ জাতীয় উভচরের সৃষ্টি। বৈজ্ঞানিক গণও বহু অনুসন্ধানের পর প্রমাণ পেয়েছেন যে ‘ডিপ্লোভার্টিব্রন’ নামক একটি প্রাণীর যার মধ্যে মৎস্য ও উভচরের উভয়পক্ষের গুণ বর্তমান। তেমনি দ্বিতীয় অবতার হলেন কূর্ম বা কচ্ছপ। যিনি এই ধরণীর বিপুলভার নিজপৃষ্ঠে ধারণ করে স্থিত আছেন।—–

क्षितिरतिविपुलतरे तिष्ठति तव पृष्ठे
धरणीधारणकिण चक्र गरिष्ठे।
केशव! धृत कूर्मशरीर
जय जगदीश हरे।।२।।

কূর্মপুরাণ কথিত কাহিনী তে বলা হয়েছে সদা টলমল বিশ্বজগৎ ও পৃথিবীকে ভগবান বিষ্ণু কূর্মাবতারে নিজপৃষ্ঠে চক্রচিহ্নসহ ধারণ করেছেন। এরপর তৃতীয়াবতার বরাহ। প্রসঙ্গতঃ মৎস্য ও

উভচরের পর আসা উচিত উভচর ও সরীসৃপের মধ্যবর্তী স্যামুরিয়ার ক্রমে সরীসৃপাবতার, আর্কিওপ্টেরিক্স,পক্ষাবতার, হংসচঞ্চাবতার প্রাণীদের কথন ।

যাইহোক স্তন্যপায়ী অবতাররূপে প্রথম পেলাম বরাহকে। ইনি নিম্নাংশ মানবের ও ঊর্ধ্বাংশ বরাহের মিশ্রণ। কিন্তু দশাবতারস্তোত্রের এই মিসিং লিঙ্ক বিজ্ঞানেও দেখার আগ্রহ রইল। বর্তমানে চীন ও ইউরোপীয় কিছু বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেছেন যে, মানব শরীরের কোষ ও মাংসের গঠনতন্ত্র সর্বাধিক মেলে বরাহের সঙ্গেই। দৈত্যরাজ হিরণ্যাক্ষ পৃথিবীকে সমুদ্রজলে নিমজ্জিত করলে শ্রী বিষ্ণু বরাহাবতারে পৃথিবীর পুনরুদ্ধার করেন ।

वसति दशनशिखरे धरणी तव लग्ना
शशिनी कलङ्क कलेव निमग्ना।
केशव! धृत शूकररूप
जय जगदीश हरे।।३।।

মনে রাখতে হবে যে বৃক্ষের মধ্যে ম্যানগ্রোভ ও পশুদের মধ্যে শূকরের একটা গুণসমতা আছে, যারা নিজপ্রয়োজনে জলাশয় থেকে ভূমি উদ্ধার করতে পারে।

নৃসিংহাবতারেও দেখি দুই স্তন্যপায়ী প্রাণীর সংমিশ্রণ; মানব ও সিংহ; প্রভূত লোমশ কিন্তু আদিমতাযুক্ত। অর্থাৎ রাজসিক গুণাধিক্য। অহঙ্কার ও দ্বেষ, প্রতিশোধস্পৃহ ক্রোধোন্মত্ত হিরণ্যকশিপুকে হত্যা করে ন্যায়প্রতিষ্ঠাচক্র।—

तवकरकमलवरे नखमद्भूतशृङ्गम्
दलितहिरण्यकशिपु तनु भृङ्गम्।
केशव! धृत नरहरिरूप
जय जगदीश हरे।।४।।

এখানে লক্ষণীয় যে প্রথমাবতার পূর্ণজলচর , দ্বিতীয় অধিকজলচর স্বল্প স্থলচর, তৃতীয় স্থলবনচর হলেও জলতটই তার নিবাস, কিন্তু চতুর্থ পূর্ণতঃ স্থলচর।

পঞ্চমাবতারে ভগবান বিষ্ণু অদ্ভুতদর্শন অতি ক্ষুদ্র ত্রিপাদবিশিষ্ট বামন। এখানে সম্ভবতঃ ত্রিপাদটা লেজ। কারণ পূর্ববর্তী প্রতি অবতারেই আমরা লেজ দেখেছি, যা পরবর্তীতে আর দেখা যাবে না। অভিযোজন-বিবর্তন ক্রমে শরীর মানবদেহধারণ করলেও সম্ভবতঃ তখনও লেজটি কক্সিসে পরিণত হয়নি। প্রাথমিকভাবে মানব সৃষ্টির ইতিহাসে যে পিগমি, মাঙ্গোলীয়, অস্ট্রেলিয়ান মানবগণ দেখা যায় তারা সব ক্ষুদ্র ছিল ফলে তা অদ্ভুত দর্শন।

छलयसि विक्रमणे बलिमद्भूत वामन
पदनखनिरजनितजन पावनं ।
केशव! धृत वामनरूप
जय जगदीश हरे।।५।।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে বর্তমানে কোরোনার ধাক্কায় অতি বিষাক্ত হয়ে ওঠা পরিবেশ এক ঝটকায় অনেকটাই স্বাভাবিক। আকাশ নীল, দূষণ নেই, পাঞ্জাবে ২০০ তো উত্তর প্রদেশে ৩০০ কিলোমিটার দূর থেকেই খালি চোখে হিমালয় দর্শন হচ্ছে। দেশে বিদেশে প্রাণীরাও নিশ্চিন্তে নির্ভয়ে চারিদিকে ঘুরছে। ওজনস্তরের ফুটোটাও গায়েব। কি জানি কল্পান্ত হলো না আমার কল্পনার অন্ত হলাম! সেটা সময়ই বলবে।

v

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.