নির্বাচন-পরবর্তী হিংসার স্বরূপ জানলে আপনিও স্তম্ভিত হয়ে যাবেন : #Black2ndMayAtBengal

‘মহামৃত্যু’ মানে কি জানেন? (What is Real Death?) ‘মহামৃত্যু’ হল ‘আত্ম-বিস্মৃতি’ (Forgetfulness of the ‘self’)। নিজেকে পুরোপুরি ভুলে যাওয়া, নিজের পূর্ব ইতিহাস ভুলে যাওয়া; নিজের ধর্মের প্রতি নেমে আসা সহস্র আক্রমণের ধারাবাহিকতা ভুলে যাওয়া, পরিবারকে চোখের সামনে বিধর্মীদের কাছে ধর্ষিতা ও খুন হতে দেখেও চোখ বন্ধ করে ‘ধর্মীয় সম্প্রীতি’-র নামে ‘সেকুলারিজম’ জপ করার নামই হল ‘আত্ম-বিস্মৃতি’। বাঙালি হিন্দু এক চরম ‘আত্ম-বিস্মৃত’ ও ‘আত্মধ্বংসী’ জাত। তারা সহজেই তার উপর নেমে আসা প্রভূত-প্রহার ভুলে যায়; তারা অপরিমিত অন্যায়-অত্যাচার বিস্মৃত হয়। ভুলে যায় বলেই তাদের ক্রমাগত পালিয়ে বাঁচতে হয় পূর্ব থেকে পশ্চিমে, আরও আরও পশ্চিমে৷ দৌড় দৌড় দৌড়! জীবন হাতে করে পাশবিক পঙ্কিল পরিবেশের বন্ধন থেকে মুক্তির দৌড়! জলছবিটির মতো নিজের গ্রাম ছেড়ে অনিশ্চিত জীবনের সন্ধানে নিজের ধর্ম নিয়ে পলায়ন! মা-বোন-বউ-মেয়েকে মাংস-হাতড়ানো ভয়ঙ্কর পশুর মুখে ফেলে রেখেই নিজের জীবন বাঁচানোর দৌড়! এই আত্মবিস্মৃতি থেকে বাঙালি তখনই রেহাই পাবে, যখন যাবতীয় জীবনের জিঘাংসার সালতামামি ভুলতে দেবে না! সম্প্রীতির আলিঙ্গন নিয়ে বাস করেও প্রতিবেশীর আক্রমণের সহিংসতার ইতিহাস মনে রাখবে! বাঙালি হিন্দু টিঁকে থাকবে কিনা, তার পরীক্ষা তখনই শুরু হবে।

গত মে মাসের গোড়ায় নির্বাচন-পরবর্তী যে মহাতান্ডব সারা বাংলা জুড়ে সর্ব সমক্ষে ‘নিঃশব্দে’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল; কয়েক বছর ধরে সারা বাংলায় ইতিউতি উন্মত্ততার যে ভয়ঙ্কর কদর্য-কর্মের রূপ তার পূর্বেই প্রকাশিত হচ্ছিল, তা মোটেই সাদামাটা এক রাজনৈতিক সংঘাত ছিল না৷ এ দুই রাজনৈতিক দলের ক্ষমতার লড়াই মনে করলে ভুল হবে। রাজনৈতিক লড়াইয়ের মোড়কের মধ্যে এক আগ্রাসী সম্প্রদায়ের সংঘটিত হত্যালীলা, সাম্প্রদায়িক সরোষ। ফলপ্রকাশের পর বাংলা আড়েবহড়ে একে সাম্প্রদায়িক কসাইখানায় পরিণত হয়েছিল। রাষ্ট্রবাদ, সঙ্ঘ-বিচারধারাকে বাংলার মাটি থেকে চিরতরে মুছে দিতে বধ্যভূমি রচনার কাজ চলেছিল। অত্যাচার, লাঞ্ছনা, জুলুম, জরিমানা, ধর্ষণ আর ধ্বংসের করুণ সে কাহিনী, যাকে ওদের ভাষায় বলা চলে ‘খেলা’। ঘরভাঙার খেলা, বিরোধী শূণ্য করে দেওয়ার খেলা। যে ধরনের খেলা দেখে অভ্যস্ত বাঙালি হিন্দু। নিজের প্রাণ আর ধর্ম বাঁচাতে পূর্ব পাকিস্তান আর বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি হিন্দু সীমানা পেরিয়ে অশেষ নরক যন্ত্রণা ভোগ করে ভারতবর্ষে শরণার্থী হয়েছে; অনেকটা সেই ধরনের খেলা, তবে অবশ্যই এটা একটা ট্রায়াল। দেখে নেওয়া বাঙালি হিন্দু যদি এতেও চুপ থাকে, নেমে আসবে আরও গাঢ় সেই অন্ধকার। যা থেকে কোনো সনাতনীর রেহাই পাবার নয়।

আশ্চর্যের বিষয় হল, বাংলার মিডিয়ায় তার বিন্দুমাত্র প্রকাশ নেই। ইলেকট্রনিক মিডিয়া একেবারেই নিশ্চুপ। বুদ্ধিজীবীর মুখে ছিল কুলুপ। প্রতিবাদী কণ্ঠ গর্জে ওঠার রাস্তা নেই। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে খানিক আভাস পাওয়া গিয়েছিল বটে, বাস্তবের পরিস্থিতি ছিল তার চাইতেও ভয়ঙ্কর।

ভোট তো সারা দেশেই হয়, রাজ্যে রাজ্যে হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মতো সহিংসতা কোথায় হতে দেখেছেন? আপনারা ২০১৮ সালের হত্যালীলার পঞ্চায়েত নির্বাচন সংঘটিত হতে দেখেছেন। কিন্তু রক্তে-শোকে-সন্তাপে তা তাকে বহুগুণ ছাপিয়ে গেছে৷ ফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা জুড়ে রাষ্ট্রবাদী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এবং রাষ্ট্রবাদী অরাজনৈতিক সেবকবৃন্দের উপর নেমে এলো ভয়ঙ্কর আক্রমণ, কোনো সভ্য দেশে যা কল্পনা করা যায় না। আক্রমণের মূল লক্ষ্য রাষ্ট্রবাদী বাঙালি হিন্দু। কোন্ বাড়ি ভাঙা হবে, কোন্ নারী ধর্ষিতা হবেন, ধর্ম দেখে দেখে চিনিয়ে দেবার কাজ করেছিল শাসক-দালাল প্রতিবেশী হিন্দু। বিধর্মী হার্মাদকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার কাজে ব্যাপক ব্যবহার এই প্রথম; যদিও তার সংকেত পাওয়া যাচ্ছিল বিগত এক দশক ধরে। এই যদি প্রবণতা হয়, আক্রমণকারী কারা তার পরিচয় নেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যতে বাংলার কোনো রাজনৈতিক দলের হিন্দু নেতা-কর্মীই কিন্তু সুরক্ষিত থাকবেন না। এ এক আগুন নিয়ে খেলা হবে। রবীন্দ্রনাথের কথায় —
“আমাদের শক্তি মেরে তোরাও বাঁচবি নে রে।”

আমরা সমাজের উঁচুনিচু ভেদাভেদ করি না। কিন্তু পরিসংখ্যান আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, যারা নিধন হয়েছেন তারা প্রায় সবাই সিডিউল কাস্ট, সিডিউল ট্রাইব, আদার ব্যাকওয়ার্ড কমিউনিটির। তারা ব্রাত্যজন, তারা বনবাসী, তারা অন্তেবাসী প্রান্তবাসী। অর্থাৎ নিম্নবর্গীয় মানুষের উপরে টার্গেট করেছে এই হিংস্রতা। হিন্দু উচ্চনীচ কেউ বাদ পড়ে নি। এর কী কোনো বিচারই হবে না? বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদবে? অন্য রাজ্যের মানুষ এই জঘন্য অপরাধের বিরুদ্ধে চর্চা করছেন, প্রতিবাদ জানিয়েছেন, বিচার চেয়েছেন। ভুক্তভোগী ছাড়া, রাজনৈতিক কর্মী সমর্থক ছাড়া বাংলার সাধারণ মানুষ তা জানতেই পারেন নি। আমরা কেন প্রশ্ন করবো না শীতলকুচির ওই SC মিন্টু বর্মন, জগদ্দলের ওই SC শোভারানী মন্ডল, বীনপুরের ST কিশোর মান্ডি, ডায়মন্ড হারবারের OBC অরিন্দম মিদ্দে — আমার রক্ত, আমার ভাই! এটা রাজনৈতিক চাদরের আড়ালে এক পরিকল্পিত সম্প্রদায়িক জিঘাংসা। একদল হিংস্র মানুষকে দিয়ে অন্য সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনার খেলা। তা লঘু করে দেখলে চলবে না।

অনেকদিন ধরেই আমরা ‘ল্যান্ড-জেহাদ’, ‘লাভ-জেহাদ’ ইত্যাদি কথাগুলি শুনে আসছি। সীমান্তবর্তী গ্রামে ক্রমাগত অন্য ধর্মের মানুষের সংঘটিত জোরদারির মুখে শান্তিপ্রিয় শিক্ষিত হিন্দু নিজেদের জমি বসতবাড়ি বিক্রি করতে একরকম বাধ্য হয়। অসতর্ক সেকুলার হিন্দু পরিবারের মেয়েটিকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে বিবাহ করে তাকে ধর্মান্তরিত করা হয়, অনেকক্ষেত্রেই বিবাহ পরবর্তী জীবন সুখের হয় না। সম্প্রতি সেই সন্ত্রাসের একটি নয়া পদ্ধতি হল হিন্দু কৃষকের জমি কেড়ে নেওয়া। বাম আমলে ভূমি সংস্কারের নামে অনেক কৃষক জমি চাষ করার সুযোগ লাভ করেছিল কয়েক দশক ধরে। কিন্তু তারা সকলে জমির পাট্টা পান নি। ফলে তাদের জমির সত্ত্ব তারা অফিসিয়ালি অধিকারভুক্ত হন নি। এই অবস্থায় রাষ্ট্রবাদী শক্তির সঙ্গে থাকা কৃষকের জমি সন্ত্রাসীরা কেড়ে নিচ্ছে। তাদের কাছ থেকে জোর করে টাকা দাবী করছে পুনরায় চাষের অনুমতি লাভের জন্য। এটা সমস্যা থেকে বাঁচতে জমিচষা সেই কৃষক তৃণমূলে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।

এখন এই জোর-জবরদস্তির জীবন থেকে মুক্তির পথ কোথায়? পলায়নপর হিন্দু বাঙালির মুক্তি ও শেষ গন্তব্য কোথায়? সে কী তার আপন ধর্ম-সংস্কৃতি বজায় রেখে, সন্তান-সন্ততি নিয়ে নিরুপদ্রবে বেঁচেবর্তে থাকতে পারবে না? পারবে। হিন্দুকে বেঁচে থাকতে হলে সংগঠিত হয়েই থাকতে হবে, প্রায় একশো বছর আগেই বলে গিয়েছিলেন ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা, হিন্দুরক্ষী স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজ। বলেছিলেন “সঙ্ঘশক্তি কলিযুগে”। তিনি সঙ্ঘশক্তি সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, কারণ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন বিশাল জাতিকে এক ধর্মসূত্রে গেঁথে নেবার প্রয়োজন আছে। তিনি হিন্দুকে মহামিলনে সম্মিলিত করাকে সেবা আখ্যা দিয়েছিলেন। হিন্দু বাঙালির সংস্কৃতি ভারতীয় সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য উত্তরাধিকার। এই কাজে বাংলার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বিদ্বজ্জনের অংশগ্রহণ জরুরি, জরুরি ছাত্র ও যুবশক্তির অংশগ্রহণ, মাতৃশক্তির মহাজাগরণ। এরজন্য প্রত্যেকের মানসিক শক্তি চাই। শরীর সবল ও সুস্থ থাকলেই মানুষ মানসিক শক্তিতে বলীয়ান হতে পারে। মানুষ ভয় পেলে আর শক্তিহীন হলে তোতাপাখির মতো শেখানো বুলি শুনিয়ে যায়। পেশীতে শক্তি না থাকলে সে অমেরুদণ্ডীর মতো আচরণ করে। তখন দু’-চারশো মানুষের জনশক্তিতে ভরপুর গ্রামেও আট দশজন হিংস্র মানুষের আক্রমণ প্রতিহত করতে পারে না। মনে রাখতে হবে হিন্দু বাঙালির ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে এক দুষ্ট শক্তি, তাতে বাইরের দেশের বৃহত্তর মদত আছে। সেই পশুশক্তি প্রতিবেশীর রূপ ধারণ করে আমাদের মধ্যে লুকিয়ে আছে এবং তারা ঐতিহাসিক কারণেই শক্তিমান। স্বামী প্রণবানন্দজীর মতে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি রক্ষা তখনই সম্ভব হবে, যখন উভয়েই শক্তিশালী ও মত প্রকাশে বলিষ্ঠ হবে। আমরা চাই একই বৃন্তে সত্যিকারের দুটি কুসুম ফুটে উঠুক। হিন্দু বলে নিজেরা গর্বিত হবার মধ্যে কোনো পাপ নেই। হিন্দু অস্মিতার মধ্যে কোনো সাম্প্রদায়িক থাকতে পারে না। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগরণ হিন্দু নবজাগরণই ছিল, রামমোহন- বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম-বিবেকানন্দ প্রত্যেকেই হিন্দু অস্মিতার এক অনবদ্য মালা। মনীষী বিচিত্রায় ও ধারাবাহিকতায় ভেতর থেকে যথার্থ শক্তিশালী হওয়ার মধ্যে তাই আপত্তির কোনো কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু সবার আগে হিন্দুর প্রতি সংঘটিত জিঘাংসার দলিল পাতায় পাতায় লিখে যেতে হবে আমাদের। #Black2ndMayAtBengal


— কল্যাণ গৌতম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.