যদি বলি সেই কিশোর বয়স থেকে ওঁর লেখায় মজেছি, তাহলে সত্যের অপলাপ হবে। ওই বয়সে স্বপনকুমার ছাড়া আর প্রায় কিছুই পড়িনি, চরে বেড়িয়েছি। তবে তাঁর খ্যাতির ব্যাপারটা জানতাম। আমার মামাতো পিসতুতো ভাইবোন দিদিদের মধ্যে অনেকই ( বিশেষত দিদিরা, যারা চশমা পড়ত, বিকেলবেলায় ছাদের ঘরে বই পড়ত, আর বিশুষ্ক অশত্থ পাতা দিয়ে বুকমার্ক করত) ওঁর তুমুল ভক্ত ছিল। তাদের অনেকেই আবার ঋতু গুহরও গানের ভক্ত ছিল – গুরু গুরুমা একই ঘরের। একটা সময় বুদ্ধদেব গুহ বাংলায় সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ছিলেন, শংকর বা সুনীলেরও ওপরে। এবং সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ ও সমরেশ বসুর পর তিনিই একটি লেখক পার্সোনা সচেতন নির্মাণ এবং সাজিয়ে রাখতে জানতেন।
যাইহোক, নয়ের দশকের মাঝামাঝি আমি তখন দার্জিলিঙে। আজ থেকে গোটা দুই পে কমিশন আগে সরকারি কলেজে চাকরিতে মাস গেলে হাতে যা পাই তাতে দার্জিলিঙের মতো সুজলাং সুফলাং দেশে আমার মাসের শুরুগুলো কাটে অযোধ্যার নবাবের মতো, এবং শেষদিকে এসে আমি ভিখারি রাজা লিয়ার। এরই মধ্যে Asian Age -এ একটি ছোটগল্প প্রতিযোগিতায় পুরস্কারের টাকার অঙ্কটা দেখে বুক ঠুকে পাঠিয়ে দিলাম একটি লেখা৷
না, পুরস্কার জোটেনি। তবে লেখাটি শর্টলিস্টেড হয়েছিল, এবং নামধাম সহ ছাপাও হয়েছিল।
এর কিছুকাল পরে একটি চিঠি পাই। মোটা বন্ড পেপারে ছাপা লেটারহেড, পাতার অর্ধেক জুড়ে সবুজ জঙ্গলের ড্রয়িং। লিখছেন – ‘আমি পেশায় একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, সামান্য লেখালিখিও করে থাকি। আমার বাংলা বই কয়েকজন ইংরিজি প্রকাশক ছাপতে আগ্রহী। কিন্তু নিজের লেখা অনুবাদ করার মতো সময় বা বিদ্যে কোনোটাই আমার নেই। আপনার ভাষা আমার ভালো লেগেছে। অতএব আপনি যদি এই কাজটি করতে আগ্রহী হন তাহলে উপযুক্ত পারিশ্রমিকে’… ইত্যাদি ইত্যাদি।
বলা বাহুল্য, সেই সময় ‘উপযুক্ত পারিশ্রমিক’ কথাটি আমায় গিঁথল। এবং কিছুদিনের মধ্যেই এক ভিজে মেঘের দুপুরে সোনালি জামার পোস্টম্যান এসে জানালেন, আমার নামে একটি ভারি পার্সেল এসেছে, পোস্টাপিসে নিজে গিয়ে নিতে হবে। পত্রপাঠ আমি চকবাজারের এক মুটের পিঠে ডোকোয় চাপিয়ে নিয়ে এলাম। ওঁর তখনও পর্যন্ত প্রকাশিত প্রায় সবকটি বই, উনি ভালোবেসে স্বাক্ষর করে উপহার পাঠিয়েছেন। আমি উল্টেপাল্টে দেখে অনুবাদের জন্য বেছে নিয়েছিলাম একটি চটি উপন্যাস, ‘বিন্যাস’।
এবং তার কিছুদিনের মধ্যেই এল একটি বেশ মোটা অঙ্কের চেক, অগ্রিম। আমি আপত্তি জানাতে বলেছিলেন – ‘আরে আমিও তো মক্কেলদের কাছ থেকে আগে টাকা নিয়ে কাজ শুরু করি। তুমিও কেন করবে না?’
এরপর শীতের ছুটিতে কলকাতায় এলে আমার একটি গন্তব্য হল ওঁর ওয়াটারলু স্ট্রিটের অফিস। জীবনের নানান অভিজ্ঞতা নিয়ে গল্পগাছা, দু-কলি টপ্পা, জলরঙে আঁকা ছবি, আর যাবার আগে – ‘দাঁড়াও দাঁড়াও, তুমি হলে ভাটপাড়ার ভটচাজমশাই, ছাঁদা সঙ্গে না দিলে হবে?’ এই বলে দেরাজ খুলে বের করতেন আনকোরা সিঙ্গল মল্টের বোতল। মক্কেলদের দেওয়া উপহার, উনি ততদিনে ছেড়ে দিয়েছেন।
বন্ধুরা সদলবলে এসে সেই অমৃতে ভাগ বসাতো, ওঁর লেখার মা-বাপ তুলে শ্রাদ্ধ করত, আর আমি সেসব অনুবাদ করছি বলে শাপশাপান্ত করত। একটি তাক ভরে উঠেছিল বিখ্যাত খালি বোতলে, বহুকাল মায়া করে ফেলতে পারিনি। এছাড়া ওঁর লেখা অসংখ্য চিঠি, যেগুলো বার বার বাসাবদলের সময়ে হারিয়ে যায়। ওঁর দেওয়া অগ্রিম থেকে একটি পোর্টেবল অলিম্পাস টাইপরাইটার কিনেছিলাম (তখনও ডেস্কটপ স্বপ্ন)। সেটি এখনও আছে।
উনি চেয়েছিলেন আমি ওঁর ‘কোজাগর’ ও ‘মাধুকরী’ অনুবাদ করি। একবার লিখেছিলেন – ‘জানো তো, আমার পাঠকেরা বলে ‘কোজাগর’ নোবেল পুরস্কার পাবার মতো উপন্যাস। কিন্তু যাকে কেন্দ্র সরকার, রাজ্য সরকার এমনকি অশোক সরকারও পুরস্কারের যোগ্য বলে মনে করে না, তাকে নোবেল পুরস্কার কে দেবে?’ অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি অভিমান ছিল ওঁর, আর ছিল এক বিরল স্নিগ্ধ পৌরুষ। সেটা হয়তো পারিবারিক আভিজাত্য, পরিপূর্ণ জীবন ও লেখালিখির বাইরে পেশাগত সাফল্য থেকে এসেছিল। একবার বলেছিলেন – ‘জানো তো, সরকার বাড়িতে দুধরণের চা হয়। মালিকের চা আর কর্মচারীর চা। আমি গেলে আমার জন্যে মালিকের চা আসে।’
না, ‘বিন্যাস’-এর পর অনুরোধ সত্ত্বেও আমি ওঁর আর কোনো লেখা অনুবাদ করিনি। ওঁর ইংরিজিতে প্রকাশনার প্রকল্প যতদূর জানি সেভাবে সফল হয়নি। সেটা যে হবে না, ওই কাজটি করতে গিয়েই আমি টের পেয়েছিলাম। সেটা শুধু লেখার ভালোমন্দের বিচারে নয়। ওঁর লেখায় (আমাদের অনেক সুসাহিত্যিকের লেখাতেও) এমন কিছু কিছু প্রাদেশিক সংস্কৃতিগত অনুষঙ্গ, লয় আছে যা ইংরিজিতে ফোটে না সেভাবে। (হয়তো ভারতের অন্য কোনো আঞ্চলিক ভাষায় সরাসরি হলে ফুটতে পারে, যেভাবে এককালে শরৎচন্দ্র অনুবাদ হত)। যাইহোক, এ প্রসঙ্গ এখানে আলোচ্য নয়।
সেই অলিম্পাস টাইপরাইটারে এরপর আমি নিয়মিত ওপ-এড কলাম লিখতে শুরু করি, মূলত ‘দ্য টেলিগ্রাফ’-এর জন্য। আমার নিত্যকার রুটি ও মাখন যোগাতে থাকেন দুই ভিন্ন সরকার। ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসে। এরপর বার দুই দেখা হয়েছে যখন অশক্ত চেহারা, আগের সেই মানুষটির ক্ষীণ ছায়া। ওঁর বাড়িতে আসতে বলেছিলেন। যাওয়া হয়নি। ওঁকে কোনোদিন বলা হয়নি ওঁর জন্য ওই সামান্য কাজটি করতে গিয়ে আমি কী কী শিখেছিলাম। কীভাবে একটি দীর্ঘ কাজকে ধীরে ধীরে গুছিয়ে তুলতে হয়, কীভাবে লেখার জন্য ডিসিপ্লিন গড়ে তুলতে হয়, কীভাবে কোনো কাজকে তার বাজার মূল্যে নয় সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ মূল্যে দেখতে জানতে হয় এবং সেইমতো মর্যাদা দিতে হয়, কীভাবে অন্যকে এবং নিজেকে মর্যাদা দিতে হয়। বলা হয়নি।
বুদ্ধদেব গুহকে নিয়ে বেশ কিছু স্মৃতিচারণ পড়লাম আজকে।এই লেখাটা বেশ অন্যরকম লাগলো কারন এই ঘটনাটা অজানা ছিল। লিখেছেন এই মুহুর্তে বাংলার অন্যতম শক্তিমান লেখক পরিমল ভট্টাচার্য———————————–