মহারাষ্ট্রের পালঘর জেলার গড়চিঞ্চলে ফরেস্ট চেকপোস্টে ১৬ই এপ্রিল ঘটে যাওয়া দুজন পঞ্চদশনামী আখড়া সাধু ও তাঁদের ড্রাইভারের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পর ২ সপ্তাহের বেশী কেটে গেলেও এর পেছনে রহস্য সমাধানে খুব সামান্যই অগ্রগতি হয়েছে। সারা দেশে কোভিভ-১৯ মহামারি ছড়িয়ে পড়ার খবর আসার তিন দিন পরেই ঘটা এই ঘটনাটি ছিলো দেশবাসীর জন্যে আরেকটা বড় আঘাত।
পুলিশের এফআইআর অনুযায়ী গ্রামের কিছু নেতার নির্দেশেই ৪০০-৫০০ জন অনিয়ন্ত্রিত হিংস্র মানুষ জড়ো হয়ে দু’জন সাধু–চিকানে মহারাজ কল্পবৃক্ষগিরি (৭০) এবং সুশীল গিরি মহারাজ (৩৫) এবং তাদের ড্রাইভার নিলেশ তেলগাদেকে (৩০) নির্দয়ভাবে হত্যা করে।
মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনিল দেশমুখ প্রাথমিকভাবে ঘটনাটিকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ ও ভুল ‘বোঝাবুঝির’ কারণে ঘটেছে বলে জানান। তাঁদের মতে গ্রামবাসীরা সাধুদের চোর বা শিশু অপহরণকারী বলে ভেবেছিলো। উদ্ধব ঠাকরে এই ঘটনাতে সাম্প্রদায়িক রঙ না দেওয়ার জন্য মানুষের কাছে আবেদন জানান। এনসিপি থেকে হওয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই মামলায় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আসামিদের তালিকা জনসমক্ষে প্রকাশ করেছেন যাতে দাবি করা যায় যে তাদের মধ্যে কোনও ‘মুসলিম’ নেই।
তবে তাদের এইসব দাবি পুলিশের এফআইআর দ্বারা সম্পূর্ণ নস্যাৎ হয়ে গেছে। সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে এই ঘটনায় “ষড়যন্ত্র” করা হয়েছে। কাসা থানায় সহকারী পিএসআই আনন্দরাও শিবাজি কালের দায়ের করা এফআইআরে (নং ০০৭৭ তারিখ ১৮/০৪/২০২০) পাঁচজন প্রধান আসামি জয়রাম ঢাক ভাওয়ার‚ ২৫‚ আর/ও দিওয়াশিপাইকি গাড়াকপাড়া‚ মহেশ সীতারাম রাওয়াত, ১৯, আর/ও কিনহাওয়ালি, খোমারপাড়া‚ গণেশ দেবজী রাও, ৩১, আর/ও দিওয়াশিপাইকি‚ ওয়াকিপাডা, রামদাস রূপজী আসরে ২৭ আর/ও গড়চিঞ্চলে‚ সাথেপদ, সুনীল সোমজী রাওয়াত‚২‚ আর/ও গড়চিঞ্চলে‚পাতিলপদ এবং অন্যান্য ৪০০ থেকে ৫০০ জন যুবক ও প্রাপ্তবয়স্কদের নাম আছে‚ যারা অসহায় সাধুদের আক্রমণ করে এবং তাদের ঘটনাস্থলেই হত্যা করে।
তবে লিখিত অভিযোগটি কাসা থানায় ১৭/৪/২০২০ তারিখে ২২টা বেজে ৫৮ মিনিটে ( জেনারেল ডায়েরি রেফারেন্স এন্ট্রি নং ০২৩‚ তারিখ ১৭/০৪/২০২০) দায়ের করা হয়। এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের মামলায় এই পাঁচ প্রধান অভিযুক্ত সহ ১০১ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। ঘটনার বিবরণ দিয়ে পিএসআই আনন্দরাও কালে তাঁর এফআইআরে উল্লেখ করেছেন যে সশস্ত্র জনতার বেআইনি সমাবেশটি একটি ষড়যন্ত্রের ফলে করা হয়েছিল।
ঘটনার বিবরণ দিয়ে পিএসআই আনন্দরাও কালে তাঁর এফআইআরে উল্লেখ করেছেন যে সশস্ত্র জনতার বেআইনি সমাবেশটি একটি ষড়যন্ত্রের আওতায় করা হয়েছিল। অভিযুক্তরা ষড়যন্ত্র করে লাঠি, কুড়াল এবং পাথরের সজ্জিত বেআইনী জনসমাবেশ করে ও গুজরাট সফরকারী সাধুদের আক্রমণ করে।
ক্রুদ্ধ জনতা তাঁদের ইকো গাড়িটিকে (নং এমএইচ০২ডিডব্লিউ৬৭২৯) থামিয়ে দিয়ে‚ এটিকে উল্টে দিয়ে যাত্রীদের টেনে বের করে নিয়ে যায় এবং তাদের চোর বলে সন্দেহ করে মারধর শুরু করে। অপরাধের ঘটনাস্থল থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কাসা থানা থেকে কালে ও তাঁর অন্যান্য কর্মীরা তক্ষুনি সরকারী যানবাহন নং এমএইচ৪৮সি০১১৭-এ চড়ে ঘটনাস্থলের দিকে যাত্রা করে ও রাত ১১.১০ নাগাদ ঘটনাস্থলে পৌঁছায়।
তারা তিন জন ব্যক্তির মধ্যে দু’জনকে জনতার আক্রমণ থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে এবং তাদের সরকারী গাড়িতে বসালে‚ জনতা তৃতীয় জনকে টার্গেট করে এবং তাদের দু’জনকে টেনে বের করে মাথায় ও শরীরে গুরুতর আঘাত করে হত্যা করে।
যেহেতু তিনি তাঁদের চিনতেন‚ কালে জয়রাম ঢাক ভাওয়ার ও অন্যান্য চারজনকে শনাক্ত করেছেন এবং তাঁর এফআইআরে উল্লেখ করেছেন যে তারা জনতাকে উস্কে দিয়ে সাধুদের হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। পুলিশ তারপর এই মামলায় ১০১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।
তাদের জন্য পুলিশ কাস্টডি রিমান্ড (পিসিআর) চেয়ে আবেদনটি ২০২০ সালের ১৮ এপ্রিল দাহানুর জেএমএফসি আদালতে করা হয়েছিল, বিচারক উভয় পক্ষের কথা শুনে মন্তব্য করেছিলেন যে‚ অপরাধটি প্রকৃতিগতভাবে “গুরুতর” এবং এই অপরাধে “প্রত্যেকের ভূমিকা সঠিকভাবে সনাক্ত করা” প্রয়োজন। আসামির সংখ্যা দেখে ২০২০ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত পিসিআর মঞ্জুর করে জেএমএফসি মন্তব্য করেছেন যে ‘তদন্তের সুযোগ বিশাল’। এইজন্য তদন্তকারী অফিসারদের সঠিকভাবে অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যে সময় পাওয়া উচিত।
এই ক্ষেত্রে সত্যিটা জানার জন্যে কিছু অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া প্রয়োজন। প্রথম প্রশ্নটি হলো এফআইআর দায়ের করতে দেরী হওয়া সম্পর্কে। ১৬ই এপ্রিল ঘটনাটি ঘটলে কেন একই দিনে এফআইআর করা হয়নি? কেন এফআইআর দায়ের করতে কয়েক দিন সময় লাগল? তবে কি এই মামলাটি ধামাচাপা দেওয়ার কোনো চেষ্টা চলছিলো?
এফআইআরে এই ঘটনায় ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এফআইআরের হিসাবে, ‘পারস্পরিক আঁতাঁত’ ও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের দ্বারা এই অপরাধ সঙ্ঘটিত হয়েছিল। এতে বলা হয়েছে যে প্রথমে যেমন ভাবা হয়েছিলো‚ ঘটনাটি তেমন “ভুল বোঝাবুঝির” কারণে ঘটেনি। এটা ছিল একটি ‘ষড়যন্ত্র’। তাহলে এই ষড়যন্ত্রকারীরা কারা ছিল? কেন এই “ভুল বোঝাবুঝির গল্প” আনা হয়েছিলো? এফআইআরে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে অভিযুক্তরা পুলিশদের গতিরোধ করতে গাছ কেটে এবং পাথর বসিয়ে রাস্তা অবরোধ করার চেষ্টা করেছিল। এটা তো নকশাল বা মাওবাদীদের পদ্ধতি। তারাও কি এই অঞ্চলে সক্রিয় আছে?
এক নম্বর অভিযুক্ত জয়রাম ভাওয়ার বর্তমানে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসবাদী) দখলে থাকা গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য। এর ফলে বামপন্থীদের জড়িত থাকার বিষয়টিও সামনে চলে আসে। এই ব্যাপারে আরও তদন্ত করা প্রয়োজন। এই ক্ষেত্রে বামপন্থী এবং মাওবাদীদের জড়িত হওয়ার সম্ভাবনাও তদন্ত করে দেখা উচিত। গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের মধ্যে কতজন বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী তা পুলিশকে সনাক্ত করতে হবে।
এই ক্ষেত্রে আরও একটি সম্ভাবনা হলো খ্রিস্টান মিশনারিদের যুক্ত থাকা। তাদের সক্রিয়তাও তদন্ত করে দেখা উচিত। খ্রিস্টান মিশনারিরা দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলে সক্রিয় রয়েছে। দরিদ্র ও আদিবাসীদের সেবা করার আড়ালে এই মিশনারিরা আসলে হিন্দুদের সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে তাদের মনে ঘৃণার বীজ বপন করে থাকে। তারা একশ বছরেরও বেশী সময় ধরে এই বিদ্বেষকে বিভিন্নভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং শেষ পর্যন্ত তারা প্রান্তিক ও উপজাতি অঞ্চলে মাওবাদীদের গোপনে সহায়তা করে চলেছে। এই বিষয়টিও তদন্ত করে দেখা উচিত।
https://www.newsbharati.com/Encyc/2020/5/5/Palghar-lynching.html