[ইদানীং সরস্বতী পূজা এসে গেছে বুঝতে পারি, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া সেই ভগ্ন মূর্তিগুলি দেখে, যেগুলি গরীব শিল্পীরা তৈরি করতে চেয়েছিলেন আসন্ন বাণী বন্দনায় বিক্রি করে দু’টো টাকা রোজগার করবেন বলে। অথচ সরস্বতী বন্দনা এক প্রাচীন রীতি। তা বিশ্ব-মান্যতা পেয়েছে ভারতের মাটি ছাপিয়েই। মধ্য যুগের বাঙালি মুসলমান কবিরা তাদের কাব্য-লেখন শুরু করেছেন সরস্বতী বন্দনা দিয়ে। কাজী নজরুল ইসলামও দেবী সরস্বতীকে বন্দনা করেছেন ভারতীয় ঐতিহ্য মেনে। ইন্দোনেশিয়ার মতো মুসলমান-শাসিত দেশও তাদের বিদেশি দূতাবাসের সামনে (আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি-তে) দেবী সরস্বতীর শ্বেত স্থাপত্য-মূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে দ্বিধা-বোধ করে না। ধর্ম-জাত-পাতকে দূরে সরিয়ে বহু নৃত্য-গীতিকার দেবী সরস্বতীর বন্দনা করে আসর জমান। অথচ ‘বাঙালি পদবাচ্য’ বাংলার সংস্কৃতি-ধ্বংসকারী কিছু মুসলমান-দুষ্কৃতি বছরের পর বছর, শতাব্দীর পর শতাব্দী দেবীর মূর্তি ভেঙে চলেছেন এবং তার উগ্র-উল্লাস সমাজে প্রোথিত করে দিচ্ছেন। শিল্পের নামে সরস্বতীর নগ্ন মূর্তি আঁকছেন-গড়ছেন সাম্প্রদায়িক শক্তির উস্কানিতে জারিত হওয়া আঁতেল শিল্পীগণ। কিছু ‘সেকুলার’ হিন্দুদের প্রাণখোলা সমর্থন এই রোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, মূর্তি-বিদ্বেষের এই সাম্প্রদায়িক রোগ সহজে সারবার নয়। এরই মধ্যে ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যে প্রশ্ন জেগেছে, কাশ্মীরের একদা প্রাণকেন্দ্র শারদা পীঠ কেন এখনও পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে ভগ্নদশা হয়েই অবস্থান করবে? কেন এখনও সেই ঐতিহ্য-মণ্ডিতস্থল ভারতবাসীর আরাধনার স্থল হবে না, ভারতবাসীর নিজের জায়গা হবে না?]
বিদ্যা ও নৃত্যগীতের আরাধ্যা দেবীরূপে পূজিতা হলেও দেবী সরস্বতী কি বরাবরই বিদ্যা-জ্ঞান ও কলাবিদ্যার দেবী ছিলেন? বিশিষ্ট বিদ্যাবিদ অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ লিখেছেন, “ঋগ্বেদের কোন স্থানে এমন উক্তি নাই যাহা দিয়া দেখানো যাইতেছে যে, সরস্বতী নদী দেবতা ব্যতীত আর কিছু।” বরং বেদে পাওয়া যায়, “অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী।” সরস্বতী অষ্টাদশ বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী, তন্ত্র ও মন্ত্রে কীর্তিতা এবং নৃত্যগীত ইত্যাদি সকল কলাবিদ্যার দেবীরূপে চিহ্নিতা হলেও আদিতে তিনি ছিলেন জলের দেবী।
‘সরস’ শব্দের অর্থ জল। শুরুতে সরস্বতী ছিলেন জলের দেবী, নদীরূপে পূজিতা। শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সরস্বতী নদীর প্রধান ভূমিকা ছিল। বিদ্যার দেবীর ধারণা এলো অনেক পরে। উর্বর নদী উপত্যকায় কৃষির ফলন ছিল পর্যাপ্ত। তাই সরস্বতী নদীতীরে আর্য-ঋষিরা রূপদান করেছিলেন বৈদিক সংস্কৃতির। ঋষিরা প্রত্যহ সে নদীর ধারে সরস্বতী বন্দনা করতেন। সেখানেই রচিত হয়েছে বহু বৈদিক সুক্ত। সেইসূত্রে জলের প্রত্যক্ষ দেবী কৃষি ও উর্বরতাকে ছাপিয়ে হয়ে গেলেন জ্ঞান ও বিদ্যার পরোক্ষ দেবী। সভ্যতার অভ্যুত্থান ও তার ক্রমবিকাশে নদী সবসময় সহায়ক ও সঙ্গত ভূমিকা পালন করে এসেছে। তাই কল্পনা করা যেতে পারে সরস্বতী নদীর দু’কূলে সৃজিত পলল মৃত্তিকার উর্বর শস্যক্ষেত্র ছিল আর্য ঋষিদের ‘শস্যাগার’। ক্রমে নদী অবলুপ্ত হলেও মানসচক্ষে নদীর অস্তিত্ব বিপন্ন হল না। সরস্বতী বন্দনা অব্যাহত রইলো। জলের দেবী হোক বা কৃষি, অথবা জ্ঞানের দেবী; সরস্বতী উপাসনা এক সুপ্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য এবং তা মান্যতা পেয়েছে ভারতের মাটি ছাপিয়েও বহু দেশে। নীল সরস্বতী বা ‘বেনতেন’ প্রমুখ দেবীর মধ্যে চীন-জাপান, দূরপ্রাচ্যে, বহির্ভারতে সরস্বতী উপাসনা ও বিশ্বজনীনতা ছড়িয়ে রয়েছে। এ এক অমোচ্য ঐতিহ্য বলেই আজও ইন্দোনেশিয়ার মতো মুসলিম দেশে দেবী সরস্বতী বিস্মৃতির গভীরে পৌঁছাতে পারে নি।
‘সরস’ শব্দের আর এক অর্থ ‘জ্যোতি’। ঋগ্বেদে সরস্বতীকে পাওয়া যায় অগ্নিরূপ, জ্যোতির্ময়ী এক দেবী রূপে। সরস্বতীর মধ্যে সূর্যকিরণের সপ্তবর্ণের ধারণা VIBGYOR এখানে পরিষ্কার। যেহেতু উদ্ভিদ দেহে বৃদ্ধি ও পরিস্ফূরণের অপরিহার্য শর্ত আলোক ও জল, সরস্বতী তাই সালোকসংশ্লেষ বা Photosynthesis প্রক্রিয়ার অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সৌরশক্তির প্রত্যক্ষ প্রভাবে জলের আবর্তন ক্রিয়া সম্পন্ন হয়, জলের সরবরাহকারিণী দেবী সরস্বতীর সঙ্গে তাই কৃষি উৎপাদনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
‘শ্রী’ অর্থে লক্ষ্মী। মাঘ মাসের শ্রী পঞ্চমী তিথিতে একসময় হয়তো লক্ষ্মীপুজোই হত, এখনও অনেক পরিবারে দেবী সরস্বতীর সঙ্গে দেবী লক্ষ্মীকেও ভক্তি সহকারে ফুল নৈবেদ্য দেন। আর এই দিনটি থেকেই যেন শুরু হয় মুকুল-বিকাশের পর্ব, বসন্তের সৌকর্য, সুপ্তির অবসান, মনের মুক্তির মরশুম। দেবী সরস্বতী উপাসনায় লাগে পঞ্চশস্য, পঞ্চপল্লব; ধান, যব, গম, মুগ, তিল দিয়ে এই পঞ্চশস্যের অর্ঘ্য রচিত হয় আর আম, অশোক, অশ্বত্থ, বট, যজ্ঞডুমুরের বিটপ দিয়ে সাজানো হয় পঞ্চপল্লব।
পলাশপ্রিয়া হলেন দেবী সরস্বতী। পলাশের রক্ত রঙ উর্বরতার প্রতীক, আর ঋতুমতী নারীর রজোদর্শনই প্রাণীজন্মের প্রথম শর্ত। দেবী সরস্বতী তাই উর্বরতার অধিষ্ঠাত্রী রূপে পূজিতা; জলের দেবী, আলোর দেবী উর্বরতার দেবী।
চতুর্মুখ ব্রহ্মার মুখপদ্মরূপ, বনহংসবাহনা সর্বশুক্লা হে দেবী সরস্বতী, তুমি অনন্তকাল আমার মানসলোকে আনন্দের সঙ্গে বিরাজ করো। ‘কাব্যদর্শ’ গ্রন্থ-রচয়িতা তথা সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্র-প্রণেতা আচার্য দণ্ডী তাঁর মঙ্গলাচরণ শ্লোকে এইভাবেই সরস্বতী বন্দনা করেছেন।
“চতুর্মুখ-মুখাম্ভোজ-বনহংসবধূর্মম।
মানসে রমতাং নিত্যং সর্বশুক্লা সরস্বতী।।”
ভারতচন্দ্র রায়ের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে দেখা যায় সরস্বতী বন্দনা —
“উর দেবী সরস্বতী : স্তবে কর অনুমতি : বাগীশ্বরি বাক্যবিনোদিনী।
শ্বেতবর্ণ শ্বেতবাস : শ্বেত বীণা শ্বেত হাস : শ্বেতসরসিজনিবাসিনী।।”
স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো বক্তৃতার পূর্বে দেবী সরস্বতীকে স্মরণ-মনন করেছিলেন। একটি কবিতায় (গাই গীত শুনাতে তোমায়) তিনি লিখেছিলেন,
“বাণী তুমি, বীণাপাণি কণ্ঠে মোর
তরঙ্গে তোমার ভেসে যায় নরনারী। “
আমেরিকার নরনারী তো ভেসেই গিয়েছিলেন, যখন স্বামী বিবেকানন্দ সম্ভাষণ করলেন, “Sisters and brothers of America.”
রবীন্দ্রনাথও তাঁর ‘সোনারতরী’ কাব্যগ্রন্থে ‘পুরস্কার’ কবিতায় দেবী সরস্বতীকে উদাত্তকণ্ঠে আহ্বান করছেন —
“মাগো, একবার ঝঙ্কারো বীণা,
ধরহ রাগিণী বিশ্ব-প্লাবিনা
অমৃত উৎস ধারা!
যে রাগিণী শুনি নিশি দিনমান
বিপুল হর্ষে দ্রব ভগবান
মলিন মর্ত্ত্যমাঝে বহমান
নিয়ত আত্মহারা!
যে রাগিণী সদা গগন ছাপিয়া
হোমশিখা সম উঠিছে কাঁপিয়া,
অনাদি অসীমে পড়িছে ঝাঁপিয়া
বিশ্বতন্ত্রী হতে।
যে রাগিণী চির জন্ম ধরিয়া
চিত্তকুহরে উঠে কুহরিয়া
অশ্রু হাসিতে জীবন ভরিয়া
ছুটে সহস্র স্রোতে!”
অন্নদামঙ্গল কাব্যে আরও বলা হয়েছে,
“তোমার করুণা যারে/সবে ধন্য বলে তারে/গুণিগণে তাহার গণন।”
শিল্পী ও বিদ্যাবিদরা চান তাদের জীবনের দুঃখনিবৃত্তি। শিল্পজীবনে ও বিদ্যার জগতে আপাত প্রতিষ্ঠাই এই দুঃখ নিবারণ করতে সক্ষম, লাভ হতে পারে জীবনে চলার পাথেয়। তাই কাব্য-সাহিত্যের জগতে, লোকসঙ্গীত ও লোকনাট্যের আসর-বন্দনায় সরস্বতীর স্তব-স্তুতি করা হয়। প্রাচীন কাল থেকেই এই রীতি মানা হচ্ছে, আধুনিক লোককবিরাও তা অনুসরণ করে থাকেন। হঠাৎ কী এমন ঘটল যে সরস্বতীর উপর এত বিক্ষোভ? মঙ্গলকাব্যে সরস্বতীবন্দনা তো আছেই, মধ্যযুগে হিন্দু-মুসলমান উভয়েই সরস্বতীবন্দনায় ব্রতী হয়েছিল! কেউ আপত্তি করতে আসে নি, বন্দনার জন্য কেউ মারধোর খেয়েছেন এমন কথা শোনা যায় নি। পুরো বিষয়টিই যে অসাম্প্রদায়িক ছিল, এই সহজ সত্যটা যেন আজকের বিদ্যাবিদরা মনে রাখেন, দেবীকে না মানলেও লোকসংস্কৃতির আঙ্গিকটাকে যেন মান্যতা দেন।
কাব্য-সাহিত্যের মুখবন্ধতে, শিক্ষা আলোচনা ও শিক্ষাদানের শুরুতে, লোকসংস্কৃতির আসরবন্দনায় সরস্বতী বন্দনা একেবারেই অসাম্প্রদায়িক রূপে বিবেচিত হত। তার দু-একটি প্রমাণ উল্লেখ করা যেতে পারে।
১. কাজী নজরুল ইসলাম একটি লেটো গানের আসরবন্দনায় সরস্বতীকে ‘সর্বমঙ্গলা’ নামে অভিহিত করেছিলেন।
“এসো গো মা সরস্বতী সর্বমঙ্গলা।
তোমার আসরে বাজে হারমনি বেহালা।।”
২. মহম্মদ কবীরের লেখা ‘মধুমালতী’ কাব্যের সূচনায় সরস্বতী বন্দনা রয়েছে।
“সরস্বতীর পদে করম নমস্কার।
পৃথিবী হইল নৌকা সংসার অপার।।
শির রাখি প্রণমি এ পদে করতার।
গোপত থাকিয়া কর মহিমা তোমার।”
অর্থাৎ মুসলমান কবিরাও সংস্কৃতির এই রীতিকে মেনেই কাব্য রচনা করেছেন। বিদ্যা নিকেতনে সরস্বতীপূজাও সেই আবহমান কাল ধরে প্রচলিত সংস্কৃতির এক পরম্পরা, এর সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার যোগ আনাটাই এক সাম্প্রদায়িক কাজ হবে। সরস্বতী নদীর তীরে পাললিক মৃত্তিকায় উর্বর কৃষি ও উন্নত জ্ঞানচর্চার স্বীকৃতি ও সংস্কৃতিতে একটি নদী হয়ে গেল দেবী। এটি একটি ধন্যবাদাত্মক চিন্তন।
সুতরাং, সরস্বতী বন্দনা ধর্মীয় যত না, তার চাইতেও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার।
ওঝাদের মন্ত্রে বাদ যান না দেবী সরস্বতী; কখনো দেখা যায় এই ঝাড়ফুঁক -এর মন্ত্র মুসলমানী লোক-চিকিৎসকও ব্যবহার করেন। অক্ষয় কুমার কয়াল সংগৃহীত একটি ঝাড়ফুঁক মন্ত্র এই রকম —
“আকর্ণ পূরি এ জুড়ি বাল্মীকির বাণ।
দেবতা অসুর কাঁপে নাহি সহে টান।।
ইন্দ্রের ঘরনি কাঁপে পাতালে বসুমতী।
চৌষট্টি ভৈরবী কাঁপে লক্ষ্মী-সরস্বতী।।”
একটি মুসলমানি ছড়ায় সরস্বতীর কথা আছে; লোকবৃত্তের বাসিন্দারা তার মধ্যে কোনো ভেদবুদ্ধি রাখতেন না, আজ কেন সরস্বতী নিয়ে এত ভেদবুদ্ধি রচনা করে বুদ্ধিজীবীরা সরস্বতীকে ব্রাত্য করে তুলছেন? ঢাকা থেকে প্রাপ্ত একটি পুরনো মুসলমানি ছড়া এইরকম,
“ধলা মাইয়া সারিন্দা হাতে
সোনার বরন কলসি কাঁখে
পাশে বইস্যা প্যাঁচা।”
সরস্বতীকে শিক্ষার অঙ্গন থেকে সরিয়ে সুবিধা করে দিচ্ছেন কাদের? কোনো প্রয়োজন তো নেই! সরস্বতী কখনই সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সংস্কৃতি ছিল না কোনোদিনই। তার অসাম্প্রদায়িক রূপ বিদ্যালয়গুলিতে ফিরিয়ে দেওয়া হোক।
দেবী আমাদের চৈতন্যের বিদ্যা দিন।
শারদা পীঠ হল একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হিন্দু মন্দির এবং বর্তমানে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে অবস্থিত এক প্রাচীন শিক্ষাকেন্দ্র। ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে এটি ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে বিশিষ্ট মন্দির বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অন্যতম। এর গ্রন্থাগারটির বিশেষ পরিচিতি ছিল, এখানেই রক্ষিত দুর্লভ পুস্তক ও পাণ্ডুলিপি পাঠ করতে পণ্ডিতেরা দীর্ঘপথ পরিক্রমা করে আসতেন। এই প্রতিষ্ঠান উত্তর ভারতে শারদা স্ক্রিপ্টের বিকাশ সাধনে ও জনপ্রিয়করণে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এর ফলে স্ক্রিপ্টটির নামকরণই হয়েছে শারদা স্ক্রিপ্ট এবং কাশ্মীরের নামকরণ হয় ‘শারদা দেশ’। এটি এমন একটি মহাশক্তি পীঠ, হিন্দু বিশ্বাস, দেবী সতীর ডানহাত সেখানেই পতিত হয়েছে। এই পীঠ কাশ্মীরি পণ্ডিতদের কাছে তিনটি পবিত্র তীর্থস্থানের অন্যতম; বাকী দু’টি হল মার্তন্ড সূর্য মন্দির এবং অমরনাথ মন্দির।
পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফফরাবাদ থেকে এই ক্ষেত্রটি প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে এবং শ্রীনগর থেকে ১৩০ কিলোমিটার দূরে। নিয়ন্ত্রণ রেখা থেকে এই স্থান ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এটি ১৯৮১ মিটার উঁচুতে। হারমুখ পর্বতের উপত্যকায় নীলম নদীর ধারে শারদা গ্রাম, যাকে কাশ্মীরি পণ্ডিতরা শিবের আবাস বলে বিশ্বাস করেন। এই শারদা পীঠ হচ্ছে ‘শারদার আসন’ বা শারদাস্থান’; হিন্দু দেবী সরস্বতীর নামে কাশ্মীর দেশ। ‘শারদা’ একটি প্রোটো-নোস্ট্র্যাটিক শব্দ, যেখানে ‘সারভ্’ কথাটির অর্থ ‘জলপ্রবাহ বা নদী’ আর ‘ডাও’ কথাটির অর্থ শিলা। এই শারদা পীঠ তিনটি স্রোতের সঙ্গমস্থলে অবস্থিত ছিল।
পীঠের সূচনা কবে থেকে সে বিষয়ে এখন বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন আছে, তবে এর প্রাচীনত্ব সন্দেহাতীত। কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, শারদা পীঠ কেবল একটি মন্দিরই নয়, সেই সঙ্গে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বটে। হয়তো ললিতাদিত্য মুক্তপিদা-র দ্বারা ৭২৪-৭৬০ খ্রিস্টাব্দে চালু হয়েছিল, হয়তো নয়। তবে আল-বিরুনি জায়গাটিকে রেকর্ড করেছিলেন, বলেছেন শারদার একটি কাঠের মূর্তি ছিল। যদিও তিনি নিজে কখনও কাশ্মীরে যাননি এবং তার পর্যবেক্ষণগুলি কিংবদন্তির উপর ভিত্তি করে তৈরি। ‘শারদা লিপি’ বলে যা কথিত, তার উদ্ভব কাশ্মীর কিনা সে বিষয়ে ভিন্নতর মতবাদ আছে। তবে শারদা পীঠে যে সেই লিপির ব্যাপক ব্যবহার ছিল এবং সেই প্রতিষ্ঠান থেকেই যে এর নাম অর্জিত হয়েছিল সে বিষয় অনুমান করা সহজ। জনপ্রিয় বিশ্বাস এই, লিপিটি একদা কাশ্মীরেই তৈরি হয়েছিল।
কিছু ইতিহাসবিদের বক্তব্য, শারদা পীঠ কখনই শিক্ষাকেন্দ্র নয়। তাদের ব্যাখ্যা, এই শিক্ষামূলক স্থান থেকে কোন উল্লেখযোগ্য ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায় নি। এর পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, শারদা পীঠ অঞ্চল ভূমিকম্প-প্রবণ। হয়তো ধসে পড়া পরিত্যক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ স্থানীয় শহুরে মানুষ সম্ভবত পরবর্তীকালে ব্যবহার করে নিয়েছে। আর সেজন্যই তার অবশেষ পাওয়া যায় নি। এই অষ্টম শতাব্দী প্রাচীন এই মন্দির ছিল তীর্থস্থান। এখানে উপনীত হতেন দূরবর্তী প্রান্তের তীর্থযাত্রীরা, এমনকি বাংলার মানুষও। এ এক স্বাভাবিক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। একাদশ শতকেও এটি ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় উপাসনালয়গুলির অন্যতম, আল-বিরুনির লিপিবদ্ধ ইতিহাসে বর্ণিত। হিন্দুদের দুর্ভাগ্য, এমন প্রাচীন সরস্বতীস্থল পাক অধিকৃত কাশ্মীরের অভ্যন্তরে। প্রতি সরস্বতী শ্রীপঞ্চমী তিথিতে ভারতীয় হিন্দুরা স্বপ্ন দেখেন, এ আবারও হিন্দুদের কাছেই ফিরে আসবে বোধে ও বাস্তবে। বাংলার যে ছাত্রছাত্রী স্কুলে সরস্বতী পুজো ফিরে পেতে চায়, পুজো চেয়ে রক্তাক্ত হয়, তাদের জন্মান্তরের লৌকিক স্মৃতি হয়তো এটাই — পুবে-পশ্চিমের এক অভিন্ন সরস্বতী বন্দনার ধারা। এক অখণ্ড ভারতভূমি। ভারতে ভাতু ভারতী।
“যা কুন্দেন্দু তুষারহার ধবলা যা শুভ্রাবস্ত্রাবৃতা
যা বীণাবরদণ্ডমণ্ডিত করা যা শ্বেতপদ্মাসনা
যা ব্রহ্মাচ্যুত শঙ্করপ্রভৃতিভির্দেবৈঃ সদা বন্দিতা
সা মাম পাতু সরস্বতী ভগবতী নিঃশেষ জাড্যাপহা।।
শুক্লাং ব্রহ্মবিচার-সার-পরমামাদ্যাং জগদব্যাপিনীং
বীণাপুস্তক-ধারিণীম্ অভয়দাং জাড্যান্ধকারাপহাম্।
হস্তে স্ফটিকমালিকাং বিদধতীং পদ্মাসনে সংস্থিতাং
বন্দে তাং পরমেশ্বরীং ভগবতীং বুদ্ধিপ্রদাং সারদাম্।।”
কল্যাণ গৌতম