যে দিনটিকে আমরা জামাই ষষ্ঠী, বাঁটাষষ্ঠী বা স্কন্দষষ্ঠী নামে জানি, তারই আরেক নাম ‘অরণ্য ষষ্ঠী’। এটি একটি নারীব্রত। জ্যৈষ্ঠ্যমাসের শুক্লা ষষ্ঠীতে পালিত হয় এই ব্রত। আরণ্যক জীবনাভিজ্ঞতার এক প্রাচীন স্মৃতি এর মধ্যে লুকিয়ে আছে। অরণ্যের সঙ্গে এই দিনটি যুক্ত, সম্ভবত অরণ্য-কেন্দ্রিক সভ্যতার সঙ্গে মানুষের হারানো যোগসূত্র। তখন অরণ্য-মাতাই ছিলেন মানুষের বেঁচে থাকার উৎস ও রসদদার। মানুষ সে যুগে খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-ভেষজের জন্য অরণ্যের উপর নির্ভরশীল ছিল। তাই বছরের একটি দিন বন-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করত।
আরণ্যক-যুগে যেমন গহন অরণ্যে বাসা বেঁধে থাকতে হয়েছিল, অরণ্য থেকে বেরিয়ে এসে কৃষি সভ্যতার যুগেও কৃষি-বন (Agroforestry)-এর ধারণা গৃহীত হয়েছিল, অরণ্যের উপর নির্ভরশীলতা তাই লোকসমাজ চিরকাল করে এসেছে। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অরণ্যষষ্ঠীর আঙ্গিক বদলে গেলেও যুগের নানান পরত সরিয়ে আমাদের মূল রূপটি খুঁজে নিতে হবে। তা হল, অরণ্যের অপরিমেয় জৈববৈচিত্র্য আজও আমাদের পরম আশীর্বাদ; আমরা অরণ্য মায়ের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। কৃষিমাতা নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু অরণ্যের দেবীকে লোকসমাজ কখনও ভুলে যায় না। আজও তাই অরণ্যের কাছেই রক্ষা পাবার জন্য বারে বারে সে ফিরে যায়। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনোত্তর হিংসার দিনে সে অরণ্যের নির্জনে কালাতিপাত করতে সমর্থ্য হয়েছে। কয়েক বছর আগেও পেটের খিদেয় সে বুনোগাছে বাসাবাঁধা পিঁপড়ের ডিম আর বন-কোঁরক খেয়ে দিনাতিপাত করেছে। উদ্বাস্তু জীবনে সে সুন্দরবনের মরিচঝাঁপিতে সপরিবারে আশ্রয় নিয়েছে। বনবাসী মানুষকে বন থেকে পৃথক করা যায় না। ফুলে-ফলে-পল্লবে অরণ্য ভরে থাকুক আমাদের নানান প্রয়োজনে; অরণ্যষষ্ঠী সেই কৃতজ্ঞতার উপাসনা, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অমোচ্য-সংযোগের শাশ্বত ইতিহাস।
দেবী ষষ্ঠী সন্তানের চির মঙ্গলময়ী মাতা। যেমন আপন সন্তান, আপনার কন্যার স্বামীও তার সন্তান, এই বোধটি প্রকটিত হয় জামাইষষ্ঠী নামের মধ্যে দিয়ে। ভারতীয় মাতা তার পুত্র-কন্যার সমগ্র পরিবারটিকে একসূত্রে গাঁথতে চান এই দিনে, জামাই-আদর তারই প্রেক্ষাপটে রচিত। গ্রীষ্মের দিনে অধিকাংশ ভারতীয় ফল পেকে ওঠে শাখায় শাখায়— আম, জাম, জামরুল, কাঁঠাল, কলা, বুনো খেজুর, ফলসা, আঁশফল, কুসুম, গাব, কেন্দু, কামরাঙা পেকে ওঠে নানান রঙে, নানান স্বাদে-গন্ধে। সুখের দিনে মা ছেলেমেয়ের ভরা সংসার দেখতে চান, নাতি-নাতনির হই-হুল্লোড় শুনতে চান, গাছে গাছে দাপাদাপি স্বচক্ষে দেখতে চান। তারপর যে অনেকদিন দেখা হবে না; শুরু হবে বর্ষা, নদীনালা জলে পূর্ণ হয়ে যাবে, যাতায়াত সুখের হবে না। তাছাড়া আমন চাষে ব্যস্ত হয়ে পড়বে সবাই। তাই ফলের মরশুমে সপরিবারে নিমন্ত্রণ। আবাস সন্নিহিত বাগিচায় অঢেল ফল পেকেছে, রকমারি পাখির আনাগোনা, হনুমান-কাঠবিড়ালি-খাটাস পেটপুরে ফল পেয়েছে। এমনি এক ষষ্ঠীর দিনে দল বেঁধে কৃষি জমির উপান্তে জঙ্গল ঘেরা বাগিচায় প্রাচীন বৃক্ষের তলে অরণ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর মৃৎমঞ্চে সমবেত হয়েছে জনেধনেপূর্ণ পূজারিণীর দল।
ব্রতচারিণী হিন্দু রমণী এদিন তালপাতার পাখা বা ব্যজন সঙ্গে করে এনেছেন। আগেকার দিনে মায়েরাই তৈরি করে নিতেন এই পাখা, সব সন্তান সম্বৎসর ব্যবহার করবেন। দেবীপূজার আরও উপকরণ সঙ্গে নিয়ে মায়ের বনের মঞ্চে প্রবেশ। বৃক্ষতলে অধিষ্ঠিত বিন্ধ্যবাসিনী অরণ্যষষ্ঠী। দেবীকে আন্তরিক ভক্তিশ্রদ্ধায় পুজো করেন রমণী, সমবেতভাবে দেবীর উপাখ্যান শোনেন, তারপর বিবিধ মরশুমি ফলমূল পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনকে বিতরণ করেন, পরিশেষে নিজেরাও গ্রহণ করেন তা। সন্তান-সন্ততির পরম কল্যাণ কামনাই ব্রতের মূলকথা। বৃহত্তর অর্থে মনুষ্য সমাজ সবাই যে অরণ্যের সন্তান। দেবী অরণ্য, তুমি যাবতীয় সম্পদে ভরিয়ে দিও, আমাদের ঐশ্বর্যশালী করে তোলো। অরণ্য আহরিত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করে আমরা পরিপুষ্ট হব। আমরা সুসন্তান লাভ করব, অরণ্যকে দোহন করে দীর্ঘায়ু হব, ধনেজনে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে জনপদ।
অরণ্যষষ্ঠী অরণ্যের উপান্তে গড়ে ওঠা এক যুগবাহিত জীবনবোধ। জানপদিক-সংস্কৃতির এক অমূল্য সাধনা। শেষে অরণ্যেই ছড়িয়ে পড়বে ফলের বীজ; তারপরেই আসবে বর্ষা, বীজের সুপ্তি কেটে চারাগাছ বেড়ে উঠবে, অরণ্যের প্রভূত বিস্তার হবে। অরণ্যের মাঝে ফলাহারের এ এক দারুণ উৎসব, অরণ্যকেই বর্ধিষ্ণু করে তোলার উৎসব। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ উপন্যাসের জঙ্গলবন্ধু যুগলপ্রসাদকে দেখেছি জঙ্গলের মধ্যেই সে বনস্পতির চারা লাগায় জঙ্গলেই বনসৃজন করে। এ যে তেলা মাথায় তেল দেওয়া নয়! জঙ্গল কেটে ক্রমাগত বসতি স্থাপন করে, চাষাবাদ করে আমরা বনের রুখাশুখা মাটিকে নগ্ন করে দিই। বাদাবন কেটে ঝড়-ঝঞ্ঝার অবারিত দ্বার খুলে দিই। অরণ্য কেবল কাটার জিনিস নয়, লুঠপাটের ক্ষেত নয়, তা ভারতীয় জীবনবোধ— চিরকালই দেখিয়ে এসেছে ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতি। কলোনিয়াল লুঠেরা শক্তি ভারতবাসীকে অরণ্য লুঠপাট করতে শিখিয়েছে। কিন্তু প্রাচীন সাহিত্য শিখিয়েছে অরণ্য হচ্ছে ‘দেবতার কাব্য’।
এবার বলি, দেবী ষষ্ঠীর রূপকল্পনা কেমন? দেবী মানবীর মতোই দ্বিভুজা, দেবীর বাম কোলে অবস্থান করে এক শিশু, তার বাহন একটি কালো বিড়াল। বাহন কল্পনার মধ্যে ফার্টিলিটি-কাল্ট বা প্রজনন-সংস্কৃতিকে মান্যতা দিয়েছে হিন্দু সংস্কৃতি। বিড়ালের বংশবিস্তার সম্পর্কে প্রাচীন মানুষ সচেতন ছিল। এই দিন বিড়ালকে ভালোমন্দ খেতে দেবার মধ্যেও জীবসেবার আদর্শকে ব্রতের আঙ্গিকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এখন একে শাস্ত্রীয় ব্রত বলা হলেও তারমধ্যে লৌকিক ধারাটি চমৎকারভাবে রয়ে গেছে। এটি নারীব্রত; বিবাহিত নারী এই ব্রত পালন করেন। তবে কুমারী মেয়ে মায়ের সঙ্গে গিয়ে বিয়ের আগে থেকেই পরিচিত হয়। অরণ্যষষ্ঠী শাস্ত্রীয় ও অশাস্ত্রীয় উভয় অনুষ্ঠানের যুগলমূর্তি, দুই-ই মিশে আছে পাশাপাশি। শাস্ত্রীয় বলা হচ্ছে, এ কারণেই এই ব্রতের আঙ্গিকে বৈদিক অনুষ্ঠানের গভীরতা ও সজীবতা আছে; আছে আচমন, স্বস্তিবাচন, ‘সূর্যঃ সোমো’ মন্ত্রপাঠ, কর্মারম্ভ সঙ্কল্প, ঘটস্থাপন, আসনশুদ্ধি, ভূতশুদ্ধি, মাতৃকান্যাস, বিশেষার্ঘ্য স্থাপন, গণেশ ইত্যাদি দেবতার পূজা; আছে অঙ্গন্যাস, করন্যাস, ষষ্ঠীর ধ্যান; দেবীর পূজা এবং পূজান্তে ব্রাহ্মণকে দান-দক্ষিণা।
ভবিষ্যপুরাণে অরণ্যষষ্ঠীর যে ধ্যান ও প্রণামমন্ত্র পাওয়া যায়, তা বিবৃত করা হল।
ষষ্ঠীধ্যান:
ওঁ দ্বিভুজাং যুবতীং ষষ্ঠীং বরাভয়যুতাং স্মরেৎ।
গৌরবর্ণাং মহাদেবীং নানালঙ্কারভূষিতাম্।।
দিব্যবস্ত্রপরীধানাং বামক্রোড়ে সুপুত্রিকাম্।
প্রসন্ন-বদনাং নিত্যং জগদ্ধাত্রীং সুখপ্রদাম।।
সর্বলক্ষণসম্পন্নাং পীনোন্নতপয়োধরাম্।
এবং ধ্যায়েৎ স্কন্দষষ্ঠীং সর্বদা বিন্ধ্যবাসিনীম্।।
দেবীর প্রণামমন্ত্র:
জয় দেবী জগন্মাতর্জগদানন্দকারিণি।
প্রসীদ মম কল্যাণি নমস্তে ষষ্ঠী দেবতে।।
অরণ্যষষ্ঠীর ব্রতকথার মূল বিষয় হল, মা এবং পরিবার-কেন্দ্রিকতা যে মানুষের কাছে স্বর্গসুখের চাইতেও বেশি, তার প্রকাশ। জননীকে সংযমশীলা, নির্লোভা, ভক্তিপরায়ণা করে তুলতে সহায়তা করে এই ব্রত। মায়ের যাবতীয় মানবিক গুণ প্রকাশিত হয়। মা তার সন্তানকে প্রকৃতি প্রেম করাতে শেখান।
ব্রতকথায় রয়েছে—
এক গৃহস্থ রমণী লোভের বশবর্তী হয়ে নিত্যদিন ভাঁড়ারের নানান খাদ্যবস্তু চুরি করে খায়, প্রশ্ন উঠলে বিড়ালের নামে অপবাদ দেয় এবং এইভাবেই আত্মরক্ষা করে। এদিকে বিড়াল দেবী ষষ্ঠীর বাহন। তাই দেবীর কোপে পড়ে সেই রমণী। একাদিক্রমে ছয় পুত্র জন্মানোর অব্যবহিত পরেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়৷ তার ছয় পুত্র প্রকৃতপক্ষে শাপভ্রষ্ট বিদ্যাধর। ক্রমান্বয়ে মৃত্যুর ঘটনায় শ্বশুরবাড়িতে এবং সমাজে রমণীর প্রবল বদনাম হয়। তারা তাকে সন্তানভোজী রাক্ষসী ঠাওর করে৷ ধরে নেয়, নিজের সন্তান নিজেই ধরে খায় বধূটি! আত্মগ্লানিতে রমণী গৃহ পরিত্যাগ করে বনে চলে যায়।
বনে অজান্তেই দেবীর থানে এক বৃক্ষতলে আশ্রয় নেয় সে। গৃহে তার শাশুড়ি-মা ষষ্ঠীর আরাধনায় রত হন। বনে জন্ম নেয় বধূর সপ্তম সন্তান। জন্মাতেই পূর্বের বিদ্যাধর ভ্রাতারা নবজাতককে এসে ডাক দেয়, শিশুটিকে স্বর্গের যাবতীয় সুখের হাতছানি দিয়ে ডাকে। নবজাতক তার মা-কে জড়িয়ে ধরে বলে, মা কিংবা বোনকে ছেড়ে তার যাওয়া হবে না, যতই স্বর্গের ভোগ ও সুখ তাকে ডাক দিক না কেন! নবজাতক সেই ডাকে সাড়া দেয় না।
মায়ের ঘুম ভাঙিয়ে ডাকে সপ্তম সন্তান। সন্তানকে কোলে জড়িয়ে মা কেঁদে ওঠে; দেবী ষষ্ঠীকে একমনে ডাকতে থাকে। মা দেবীর থানেই তখন আশ্রিতা, দেবী সহসা আবির্ভূতা হন; বলেন, বিড়ালের নামে অপবাদ দেওয়ার অপরাধে তিনি তার সকল সন্তানকে লুকিয়ে রেখেছেন, তার প্রতিটি সন্তানই দেবতুল্য। মা দেবীর চরণ-প্রার্থনা করলে, দেবী এক মরা পচা বিড়ালের উপর দই ফেলে জিভ দিয়ে চেটে তা তুলে আনতে নির্দেশ দেন মা-কে। মা সেই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে দেবীর কৃপায় বিড়াল সহ হারানো ছয়পুত্র ফিরে পায়। সবাহন ষষ্ঠীদেবীকে পুজো করে মা; সপুত্র গৃহে ফিরে আসে, পরিবারে খুশির ঢল নামে।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী