বিশ্ববিখ্যাত গণিতবিদ,গণিতের বিস্ময়বালক যাকে বলা হতো সেই রামানুজনকে হয়তো আপনারা সবাই ই চেনেন।রামানুজন নামটাও অতীব সুন্দর, রামের অনুজন বা শ্রী রামচন্দ্রের ছোট ভাই যিনি তিনি রামানুজন।
রামনুজন গণিত নিয়ে এত পাগল ছিলেন যে ইন্টার পরীক্ষার স্তরে গণিত পরীক্ষার পরদিন ইংরেজি পরীক্ষায় তিনি ফেল করেন কারণ তার চিন্তাচেতনায় ছিল কেবল গণিত আর গণিত। তবে আজকের আলোচ্য উনার জীবনী নয়,বরং উনার জীবনীর একটি বিশেষ অংশ।
যখন তার অসামান্য প্রতিভার কথা প্রকাশ পেতে থাকে তখন বিখ্যাত গণিতবিদ ক্যাম্ব্রিজের জি.এইচ. হার্ডিকে তাঁর সম্বন্ধে জানানো হয়। তখন হার্ডি সাহেব তাকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করলেন গবেষণা কর্মের জন্য। আর তখন ই শুরু হলো সমস্যা।
তৎকালীন ভারতে হিন্দু সমাজে বিদেশযাত্রা,সমুদ্র পারি দেয়া এগুলো সম্বন্ধে মারাত্মক কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। প্রচলিত বিশ্বাস ছিল যে ধর্মে নাকি সমুদ্রযাত্রা,বিদেশগমন নিষিদ্ধ। পরম্পরার এই অন্ধত্ব বাঁধা হয়ে দাড়ালো রামানুজনের সামনে।
আপনারা ইউটিউবে দেখবেন বর্তমানে পুরীর যিনি শংকরাচার্য, স্বামী নিশ্চলানন্দ মহারাজ তিনি তার লেকচারে ভারতীয়দের বিদেশ গমন করতে মানা করেন,বলেন এতে নাকি অপবিত্র হয়ে যায় মানুষ। আবার শংকরাচার্য স্বামী নিশ্চলানন্দের গুরু শ্রী করপাত্রী মহারাজ একটি আস্ত বই ই লিখেছিলেন বিদেশগমন নিষিদ্ধ তা নিয়ে। বইটির নাম “বিদেশযাত্রা শাস্ত্রীয় পক্ষ”। মজার বিষয় হলো এই বইতে তিনি আমাদের বঙ্গ প্রদেশকেও শাস্ত্রমতে(!) অপবিত্র বলেছেন। বলেছেন একমাত্র তীর্থ ব্যতীত অন্য কোন কারণে বঙ্গে আসলে সেই ব্যক্তিকে শুদ্ধ হতে হবে আবার আর্যাবর্তে প্রবেশের আগে!
আর পরম্পরার নামে এই মারাত্মক অন্ধ কুসংস্কারগুলোই স্মরণীয় গণিতবিদ,অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ,নিরামিষভোজী ব্রাহ্মণ সন্তান শ্রীনিবাস রামানুজনের বিশ্ববাসীর সম্পদ হবার পথে বাঁধা হয়ে দাড়ালো। তবে পরবর্তীতে তিনি বিদেশ যেতে সক্ষম হন অনেক চড়াই উৎরাই পাড়ি দিয়ে।
এখন প্রশ্ন হলো এই যে পরম্পরা চালু করা হয়েছিল বিদেশ গমন নিয়ে, সমুদ্র যাত্রা নিয়ে এর শাস্ত্রীয় ভিত্তি আছে কি? পবিত্র বেদ কী বলছে? কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গুরু নয়, সবসময় আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ গুরু,সকল গুরুদেরও গুরু পরমেশ্বর নিজেই। যোগ দর্শনে বলা হয়েছে যে,
“পূর্বেষামপি গুরুঃ কালেনানবচ্ছেদাৎ।।” (১/২৬)
অর্থঃ সেই ঈশ্বর সকলের, পূর্বজগণেরও গুরু, কেননা কালের দ্বারা তাঁর অবচ্ছেদ নেই।
পবিত্র বেদ কেবল আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানের উৎস নয়, বরং এটা পার্থিব উন্নতির জন্য দরকারী বস্তুগত বিজ্ঞানেরও উৎস, একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধি।
আর পবিত্র বেদেই আছে জলযান,নৌকা,জাহাজ এসব নির্মাণের কথা।
আ নো নাবা মতিনাং যাতং পারায় গন্তবে ৷
যুংজাতামশ্বিনা রথম্ ॥
অরিত্রং বা দিবস্পৃথু তীর্থে সিন্ধুনাং রথঃ ৷
ধিযা যুযুজৃ ইন্দবঃ ॥ (ঋগ্বেদ ১।৪৬।৭৮)
অনুবাদ-নৌকা ও জাহাজকে ঠিক রাখতে হবে নদী ও সমুদ্র পারাপার হতে এবং রথ প্রস্তুত রাখতে হবে ভূমিতে ভ্রমণ করতে৷ বায়ুতে চলাচলের জন্য উড়োজাহাজ তৈরিতে প্রকৌশলীদের নিযুক্ত করতে হবে ৷
উভা দেবা দিবিস্পৃশেন্দ্রবায়ু হবামহে ৷
অস্য সোমস্য পীতয়ে॥ (ঋগ্বেদ ১।২৩।৩)
অনুবাদ-অগ্নি ও বায়ু উড্ডয়নযান( উড়োজাহাজ) আকাশে বহন করে যাত্রীদের সুবিধার জন্য ।
ঋগ্বেদ অন্য মন্ত্রে বলছেঃ
অশ্বিনোরসনং রথমনশ্বং বাজিনীবতোঃ ৷
তেনাহং ভুরি চাকন ॥ (ঋগ্বেদ ১।১২০।১০)
অনুবাদ- জ্ঞানীগণের উচিত এমন ধরনের যানবাহনের নকশা করা যা সহজে ও আরামদায়কভাবে চলতে পারে, এ ধরনের যন্ত্র বিদ্যুতের সহায়তায় তাদেরকে দ্রুত নিয়ে যাবে ৷
অর্থাৎ, বেদে নিশ্চিতভাবেই সমুদ্রযাত্রার,দূরযাত্রার কথা রয়েছে এবং প্রাচীনকালের প্রত্নতাত্ত্বিক দৃষ্টান্ত যদি আমরা দেখি, যদি শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা বা ঢোলাভিরা বন্দরের ধ্বংসাবশেষ দেখি, তাহলে আমরা প্রমাণ পাই হিন্দুদের বিদেশযাত্রার,তৎকালীন সময়ে আরব,দূরপ্রাচ্য সহ বিভিন্ন স্থানে সনাতনীদের বাণিজ্যিক আসা যাওয়া ছিল। শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা নগরী ছিল তৎকালীন সময়ে ভারতবর্ষের বন্দর নগরী!
শুধু তাই নয়, একসময় সনাতন সংস্কৃতি চম্পা (ভিয়েতনাম), খেমার (ক্যাম্বোডিয়া), ইন্দোনেশিয়া,থাইল্যান্ড(শ্যামদেশ) সর্বত্রই বিস্তৃত ছিল। চোল সাম্রাজ্য ওসব অঞ্চলে উপনিবেশ ও গড়ে তুলেছিল।
অথচ পরবর্তীকালে এরকম পরম্পরা চালু করা হয় যে কালাপানি পার হলে হিন্দুরা জাতিচ্যুত হবে। এর ফল বৃটিশ আমলের প্রথম দিকেও হিন্দুদের ভুগতে হয়েছে, যদিও পরবর্তীতে সাধারণ সনাতনীরাই এই পরম্পরা বর্জন করেছে। আর সাধারণ জনগণের ক্ষমতাই চূড়ান্ত ক্ষমতা, জনগণ জেগে উঠলে পরম্পরার নাম দিয়ে কোন অন্ধত্বই টিকে থাকতে পারেনা।
তাই সবসময় মনে রাখতে হবে যে কোন বক্তব্যকেই যুক্তি,বিবেকের বিচারে যাচাই করা আমাদের কর্তব্য। কোন কিছুকেই অন্ধবিশ্বাস করা যাবেনা।
ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি
বাংলাদেশ অগ্নিবীর
সত্য প্রকাশে নির্ভীক সৈনিক