আমরা যারা জমির উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইন নিয়ে কাজ করি তাদের প্রভূত বিচিত্র অভিজ্ঞতা রোজই হয়। যখন সদ্য এই কাজ শুরু করি তখন ওয়ারিশ নথিভুক্ত করতে গিয়ে বুঝি প্রতি হাজারে মেয়েদের সংখ্যা কেন এতো কম! মানে ওয়ারিশ সার্টিফিকেট দেখলে এমনটাই মনে হতো। কোনও ব্যক্তি সে পুরুষ হোন বা মহিলা মারা গেলে তার ওয়ারিশ হিসেবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে সন্তান কেবল ছেলেই হয়। প্রথম প্রথম তত বুঝি নি। কিন্তু যখন দেখি ওয়ারিশ সার্টিফিকেটে পাঁচ জন, ছ জন, এমনকি আট জন ছেলে সন্তান কিন্তু কোনও মেয়েই নেই, কিরকম সন্দেহ হতে আরম্ভ করে। তারপর একটির বেশি ছেলে সন্তান থাকলেই আর আই এনকয়ারি করে নিতাম। অবধারিত ভাবে পঁচানব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির কন্যা সন্তান খুঁজে পাওয়া যেত।

যারা জানেন না তাদের এই আর আই এনকয়ারি অর্থাৎ রেভিনিউ ইন্সপেক্টর দ্বারা তদন্ত বিষয়টা বুঝিয়ে দিই আগে। যাদের জমি রেকর্ড করার আইনি ক্ষমতা আছে তারা কোনওরকম সন্দেহ হলে আর আই দের দিয়ে তদন্ত করে জমির দখল বা ওয়ারিশ কারা সেটা আইনত দেখে নিতে পারেন। এই সংক্রান্ত আইন এবং সরকারি অর্ডার আছে। তবে সব ক্ষেত্রে সন্দেহ হয় না, তাড়াতাড়ি করার জন্য চাপও থাকে তাই সব ওয়ারিশ কেসের এনকয়ারি করা হতো না আগে। এর ফলে কি হচ্ছিলো জানেন? প্রচুর আপিল কেস, কোর্ট কেস চেপে যাচ্ছিলো ডিপার্টমেন্টের ঘাড়ে। কন্যা সন্তানরা যখন জানতে পারতো যে আইন থাকা সত্ত্বেও তাদের জমিতে কোনও অধিকার নেই, দাদা ভাইয়েরা তাদের না জানিয়ে নিজেদের নাম রেকর্ড করে নিয়েছে তারা আইনানুগ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে রেকর্ড করার জন্য আবেদন করতেন।

এবার নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলি। যখন বয়সে ও অভিজ্ঞতায় ছোট ছিলাম, আর আই এনকয়ারি ওয়ারিশ কেসের জন্য দিলে প্রায়শই হুমকি ধমকি পেতাম। সেইসব ক্ষেত্রে আর আই বাড়িতে গেলে তাড়া খেতেন। ভদ্রলোক টাইপ মানুষজন কেঁদে কেঁদে বলতেন হ্যাঁ বোন আছে কিন্তু বোনের বিয়ে দিতে যেহেতু খরচ অনেক হয়েছে তাই ধর্মত নাকি মেয়েদের বাদ দেওয়াই আমার কর্তব্য। তাদের বলতে বাধ্য হতাম আপাতত ভারতীয় আইন আমার ধর্ম। সেখানে যা আছে সেইমত কাজ করতে আমি বাধ্য। পারলে বোনদের কাছ থেকে দানপত্র দলিল করে নিন।

যে সমস্ত লোক্যাল বডির উপর ওয়ারিশ সার্টিফিকেট দেওয়ার দায়িত্ব থাকে তাদের সঙ্গে দেখা হলেই বলতাম ওরা কেন এরকম সার্টিফিকেট ইস্যু করেন যেটা বেআইনি? ওরা বলতেন কি করব ম্যাডাম যারা সার্টিফিকেট চায় তারা তো ভোটারই। মেয়েরা তো বিয়ে হয়ে অন্য অঞ্চলের ভোটার। তাই অঞ্চলের ভোটারের সুরক্ষা সর্বাগ্রে। তাছাড়া ধর্মত যাদের নিজের ফ্যামিলি মেম্বারের স্বার্থ দেখা উচিত তারাই যদি না চায় তাহলে ওরা বাইরের লোক কি করবেন? অসম্ভব ভালো যুক্তি। দলমত নির্বিশেষে এমনকি পুরুষ নারী লোক্যাল বডি নির্বিশেষে সবারই এক মত! ওয়ারিশ সার্টিফিকেট ছাড়া এই সংক্রান্ত ফার্স্ট ক্লাস ম্যাজিস্ট্রেটের এফিডেভিটও গ্রাহ্য। সেখানেও দেখতাম আদালতে হলফ করে মিথ্যে কথা এভিডেভিট করে আনে মানুষ। উকিলকে জিজ্ঞেস করে উত্তর পেয়েছি, মানুষ যা হলফ করে বলে তাই সত্যি ধরে এফিডেভিট হয়। গ্রামের মানুষ বলতেন এপিঠওপিঠ। বুঝলাম সেটাই সার সত্য।

এইসব উৎপাতে ২০১৯ সালে সব ওয়ারিশ কেসে আর আই এনকয়ারি ম্যান্ডেটরি হয়ে যায়। ২০২২ সালে সরকারি অর্ডারে বলা হয় লোক্যাল বডির ফলস আর ফ্যাব্রিকেটেড অর্ডারে অফিসাররা ভালনারেবল সিচুয়েশনে পড়ছেন। মানে ভাবুন একবার, কিছু লোভী মানুষ স্রেফ নিজেদের রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়কে জমির ভাগ দেবে না বলে এতো কান্ড! এখন কি হচ্ছে তাহলে? পৈতৃক সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকার তাহলে প্রতিষ্ঠিত?

নারী দিবসের ঠিক আগের সপ্তাহের ঘটনা। যে ব্লকে কাজ করি সেখানকার সবচেয়ে পশ এলাকার একজন বর্ষিয়সী মহিলা এসেছেন দেখা করতে সকাল সকাল। বাড়িতে আর আই গেছিল। তাই ছুটে এসেছেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর ওয়ারিশ কেস করেছেন। ওয়ারিশ স্ত্রী অর্থাৎ উনি আর দুই ছেলে। যথারীতি সার্টিফিকেটে মেয়ে ছিল উল্লেখ নেই। আর আই গিয়ে দেখেছে মেয়ে ছিল কিন্তু মৃত। কিন্তু মেয়ের সন্তান আছে। যে আইনত সম্পত্তির দাবীদার। ভদ্রমহিলার বেশবাস সম্ভ্রম উদ্রেককারী। বললাম এরকম ফর্জড ডকুমেন্ট সরকারকে দিলেন কেন? নাতির অধিকার দেখা আপনার দায়িত্ব নয়। তাও আবার মৃত সন্তানের একমাত্র সন্তান? অবলীলায় বললেন উনি নাকি জানতেন না!

আমি যদিও জানতাম আর আই জানতে না পারলে কি করে বেআইনি কাজ করতে হয় সেইসব জেনেই উনি হিয়ারিং এ আসতেন। আরও জানতাম একজন মা হয়েও এটা অবলীলায় করতে পেরেছেন উনি। ঠিক একই দিনে আরও চারজন মুসলিম বোন এসেছিলেন। যদিও তারা ভাইয়ের অর্ধেক সম্পত্তি পান তবুও দুই ভাই বাবার সব জমি রেকর্ড করে নিয়েছেন। এমনকি মাকেও বঞ্চিত করা হয়েছে। বোনেরা ঝামেলায় যেতে চাননি। তবে মা কে খেতে না দিয়ে তাড়িয়ে দিচ্ছে বলে অধিকার চাইতে এসেছেন। ঠিক তার পরে আরেকজন পঞ্চাশ বছরের পুরনো সমস্যা উদ্ধারে এসেছিলেন। সেখানেও মালিকানা নির্ধারণে ওয়ারিশন প্রযোজ্য। দেখলাম ছয় ভাই কোনও বোন নেই। বলতেই বললেন এতো আগে ওয়ারিশ সার্টিফিকেটে বোনদের রাখার চল ছিল না। খুব ভালো লাগলো। ভদ্রলোক অকপট।

১৯৫৬ সালে হিন্দু মেয়েরাও যে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তির সমান দাবীদার এই আইন হয়েছে। তার আগে মেয়েদের সম্পত্তি দিতে কত কষ্ট করতে হতো শরদিন্দু ব্যোমকেশের খুঁজি খুঁজি নারিতে লিখে গেছেন। আইন আইনের মতো আছে। মাঝখানে কেটে গেছে ৬৭ বছর। এই ২০২৩শে কিছু ক্ষেত্রে এবং ঝামেলা এড়াতে ঠিকঠাক ওয়ারিশ রেকর্ড হচ্ছে। অনেকসময় শুনি বিয়েতে খরচ দেখিয়ে আগেভাগে কড়ার করিয়ে নেওয়া হচ্ছে যাতে বোনেরা সম্পত্তির দাবী ছাড়ে। কেবল যে পরিবারে ভাই নেই সেখানে সমস্যা নেই।

বাপের বাড়ি উত্তরাধিকার সূত্রে কেবল ছেলেদের। ওটা ছেলেদের নিজের বাড়ি হয়। মেয়েদের কিন্তু রোজগার করে নিজের বাড়ি আর্ন করে তারপর বলতে হয় আমার বাড়ি। ছেলেরা অবলীলায় বলতে পারে বাবার বাড়িই আমার বাড়ি। অন্তত বাবা মারা যাওয়ার পর তো পারেই। আইন থাকা সত্ত্বেও বেশীরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েদের রীতিমত আইনি লড়াই করে পেতে হয়। বেশীরভাগ মানুষ সম্পত্তির অধিকার বলতে পুরুষের অধিকার বোঝে।

এখানে আমার মত একমাত্র মেয়ে সন্তান ওয়ালা পরিবার এবং ল এবাইডিং ভদ্র মানুষদের কথা লেখা হয়নি। সংখ্যায় এখনো এরা নগণ্য। শহরাঞ্চলে এই অনুপাত কিঞ্চিৎ বেশি। ডিপার্টমেন্টের কড়াকড়ি সত্ত্বেও এখনো মেয়েদের ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা জারি আছে।

©স্বাগতা মণ্ডল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.