লিওপল্ড ক্যাফেতে ঢুকলেন ৬৮ বছরের এক বৃদ্ধ। অবশ্য দেখলে তাঁকে বৃদ্ধ বলে মনে হয় না। মাঝ বয়সী শক্তপোক্ত লম্বা ইউরোপিয়ান মানুষটি এক কাপ ইরানি চা অর্ডার দিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে একটি খালি টেবিল খুঁজতে থাকলেন। ফাঁকা কোনও টেবিল নজরে না এলেও একটি টেবিল দেখলেন যেখানে একজন একা বসে আছেন। সেখানেই বসবেন বলে স্থির করলেন ইউরোপিয়ান ভদ্রলোকটি।
সেই টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন ইউরোপিয়ান। চেয়ারে বসে থাকা ভদ্রলোকের সামনে এসে তিনি একটু গলা খাকড়ালেন। চেয়ারের ভদ্রলোকটি ঘুরে তাকাতেই ইউরোপিয়ানটি নমস্কার করে ভাঙা ইংরেজিতে বললেন, “আমার নাম রবার্ট। এখানে বসতে পারি?” চেয়ারের ভদ্রলোকটি বললেন, “নিশ্চয়ই।”
রবার্ট চেয়ারে বসতেই অপর ভদ্রলোকটি বললেন, “আমার নাম দামন ইরানি। আপনি কি কোনও ভাবে পোল্যান্ড থেকে এসেছেন?” একটু হেসে রবার্ট বলল, “হ্যাঁ। পূর্ব ইউরোপে আমরা যারা থাকি তাদের ইংরেজি টানটা খুব সহজেই আমাদেরকে ধরিয়ে দেয়। অবশ্য আমি এখন সরকারিভাবে একজন ইজরায়েলি নাগরিক।”
দামনেরও বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। এককালে ব্যবসা সূত্রে অনেকবার রাশিয়া যেতে হত দামনকে। সেই কথাটা রবার্টকে সে বলল। রবার্ট একটু মাথা নেড়ে হঠাৎ যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল।
কথা ঘোরানোর জন্য রবার্ট বলল, “তা রাশিয়া ছাড়া আর কোথায় গেছেন আপনি? ইরান গেছেন? আপনার তো নামও ইরানি। জানেন তো আমি অর্ডারও করেছি ইরানি চা।” আর এ কথা বলতেই দামন হো হো করে হেসে উঠল। সে বলল, “না যদিও আমার নাম ইরানি, আমি নিজে কোনও দিন ইরান যাইনি। যদিও বহু বছর আগে আমার পূর্ব পুরুষরা ইরান থেকে ভারতে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন।”
রবার্ট এর জবাবে বলল, “ইরান দেশটা সুন্দর খুব। সুযোগ পেলে একটু ঘুরে আসবেন। আমি সেখান থেকেই ভারতে এলাম এই আজ। তবে এখনকার ইরান আর অত শান্তিপূর্ণ নেই। তবে এর আগে অনেক ছোটবেলায় কয়েকদিন ছিলাম সেদেশে। অতটা মনে নেই।”
দামন জিজ্ঞাসা করল, “আপনি পোল্যান্ডের হলে ছোট বেলায় ইরানে কেন ছিলেন?” এই প্রশ্ন শুনেই এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে রবার্ট জবাব দিল, “যেই কারণে আপনার পূর্ব পুরুষরা ইরান ছেড়ে ভারতে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন।”
একবার ঘড়ির দিকে চোখ দিয়ে দামন দেখল সবে মাত্র সাড়ে আটটা বাজে। সে রবার্টকে জিজ্ঞাসা করল, “আর এক কাপ চা হয়ে যাক?” রবার্ট সম্মতি জানাতেই দামন ইশারা করে এক ওয়েইটারকে ডাকলেন। এরপর রবার্টকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ভারতে নিশ্চয়ই এটা আপনার প্রথমবার আসা নয়?”
“আমার নমস্কার দেখে এই প্রশ্নটা জিজ্ঞাসা করলেন?”, পাল্টা প্রশ্ন করল রবার্ট। এরপর একটু থেমে সে বলল, “না এটা আমার দ্বিতীয় দফা ভারতে আসা। প্রথমবার অবশ্য খুব ছোটবেলাতে এসেছিলাম। খুব একটা মনে নেই। তবে এবার এসে মনে হচ্ছে অনেক কিছু বদলে গেছে।” এরপর সে যোগ করল, “অবশ্য সারা বিশ্বই তো বদলে গেছে। এতে আমার আশ্চর্য হওয়া উচিত না।”
দামন বেশ কিছুক্ষণ রবার্টের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। বিষয়টি লক্ষ্য করে রবার্ট বলল, “আমি একজন ইহুদি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমি ও আমার ভাই বোনদের সাইবেরিয়ার লেবার ক্যাম্পে রাখা হয়েছিল। পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্রিটিশদের সঙ্গে যোগ দিলে আমাদের ক্যাম্প থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ততদিনে তো আমাদের কোনও দেশ নেই। তাই আমাদের ইরান হয়ে ভারতে নিয়ে আসা হয়েছিল। আমার মতো আরও কয়েক হাজার বাচ্চা সেই সময় ভারতে আশ্রয় পেয়েছিল। তাই মরে যাওয়ার আগে পুরোনো সেই ইতিহাসকে ফের একবার নিজের চোখে দেখতে ফিরে এসেছি তোমাদের দেশে।”
দামন কথাটা শুনে একটু অবাক হয়েই রবার্টকে জিজ্ঞাসা করল, “কিন্তু আমি তো জানতাম যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদিদের উপর অত্যাচার চালিয়েছিল জার্মানরা।” এরপর দামন বলল, “আমাকে ক্ষমা করবেন, আসলে সারা জীবন টাকার পিছনে অনেক ছুটেছি। কোনও দিনই সেভাবে ইতিহাসের প্রতি আকৃষ্ট ছিলাম না। ভারত আমার নিজের দেশ হলেও আমার শিকড় যে ইরান, সেই কথাটা আজ ফের একবার মনে করিয়ে দিলেন আপনি। তবে আজ একজন বিদেশির থেকে নিজের দেশের বিষয়ে একটু জানতে ইচ্ছা করছে। তা রাশিয়ার ক্যাম্প থেকে আপনি এখানে কী করে এলেন?”
রবার্ট বলল, “আসলে তুমি নিশ্চয়ই দিগ্বিজয়সিনজির নাম শুনেছ। এককালে জামনগরের রাজা ছিলেন তিনি।” একটু থেমে রবার্ট এবার বলতে শুরু করল, “তবে তোমাকে প্রথম থেকেই বলি শোন, অনেকেই মনে রাখেনি যে ইংল্যান্ড ও আমেরিকার সঙ্গে হাত মেলানোর আগে কিন্তু স্টালিন হিটলারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। মোলোটভ-রিবেনট্রপ চুক্তির মাধ্যমে হিটলার ও স্টালিন পোল্যান্ডকে একটা কেকের মতো ভাগ করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৩৯-এ হিটলার পোল্যান্ডে হামলা চালানোর কয়েকদিন পরই রাশিয়াও পূর্ব দিক থেকে তাদের সৈন্য লেলিয়ে দেয় আমার দেশের উপর। আমাদের বাড়ি পূর্ব পোল্যান্ডের ক্রেসি নামক এক গ্রামে ছিল। জার্মানদের মতো রাশিয়ানরাও পোলিশ জনগণের উপর অকথ্য অত্যাচার চালাতে থাকে। অবিচারে খুন, গ্রেফতার, রেপ শুরু করে। আমাদের জমি হাতিয়ে নিয়ে আমাদের বাড়িতে আগুন লাগাতে শুরু করল রেড আর্মি।”
একটু থামল রবার্ট। ফের শুরু করল, “আমি আমার দাদা স্কাজ, আমার মা, আন্টি ও দাদু-দিদার সঙ্গে থাকতাম। রাশিয়ান সেনা আসার কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের তোলা হয় ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলের এক মালগাড়িতে। সেখানে গোরু, ছাগলের মতো আমাদেরকে গাদাগাদি করে পারি দিতে হয় সাইবেরিয়ার উদ্দেশে। অবশ্য ট্রেনে ওঠার সময় আমরা জানতাম না কোথায় যাচ্ছি আমরা। সত্যি কথা বলতে আমার সেই সময়টা আবছা আবছা মনে আছে। পরে মায়ের থেকে পুরোটা শুনেছিলাম। তবে এটা আমার মনে আছে যে আমাদেরকে কোনও খাবার দেওয়া হয়নি সেই রেল যাত্রার সময়। মাঝে মধ্যে কোথাও ট্রেন থামলে বিশাল পাইপ দিয়ে আমাদের কামরার গেট লক্ষ্য করে জল ছোড়া হত। সেই জল খাওয়ার জন্য হুরোহুরিতে একবার আমার দাদা উপর এক বৃদ্ধ পা রেখে দেয়। স্কাজের মনে হয় সেই চাপে পা ভেঙে গিয়েছিল। তবে তা জানার উপায় ছিল না।”
“টানা রেল যাত্রার পর আমরা শেষ পর্যন্ত সাইবেরিয়ার লেবর ক্যাম্পে এসে পরি। সেখানে আমাদেরকে দিয়ে অকথ্য পরিশ্রম করানো হত। আমরা বাচ্চা ছিলাম। তা সত্ত্বেও আমাদেরকে দিয়ে ভারী জিনিস বহন করানো হত। এভাবে দুই বছর চলার পর একদিন খবর পেলাম যে আমাদেরকে মুক্তি দেওয়া হবে। তবে দেশে ফেরার কোনও উপায় আমাদের কাছে নেই। আমাদেরকে ইরানে নিয়ে যাওয়া হবে আপাতত।”
একটু হেসে রবার্ট বলল, “পরে জানতে পেরেছিলাম যে কেকের মতো পোল্যান্ডকে কেটে হিটলারের খিদে মেটেনি। সে রাশিয়ার উপর হামলা করে দেয়। আর এর জেরে রাশিয়ার নতুন বন্ধুর প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ ও আমেরিকানদের সঙ্গে জোট বাধায় আমাদের আর সে বন্দি রাখতে পারত না। তাই আমাদের স্টালিন ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল।” এরপর দামনের দিকে তাকিয়ে রবার্ট বলল, “এরপর আমরা গিয়ে পৌঁছাই সেই দেশে, যেখান থেকে আপনাদের পালিয়ে ভারতে আসতে হয়েছিল।”
রবার্ট ফের শুরু করতে যাচ্ছিল। হঠাৎ, প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ ও জিনিস ভাঙার শব্দে চারিদিক ছেয়ে গেল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দামনকে নিয়ে রবার্ট আশ্রয় নিল টেবিলের নিচে। সেখান থেকে সে দেখল, দুই সশস্ত্র যুবক নির্বিচারে লিওপল্ড লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই যেন রবার্টের মনে হল সে ১৯৩৯ সালে ফিরে গেছে। দামনের সঙ্গে তার চোখাচোখি হতেই সে তাকে সেখানে চুপ করে বসে থাকার জন্য ইশারা করল। কী হচ্ছে কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। তার আগেই চোখের সামনে পর পর লাশ পড়তে দেখতে থাকল রবার্ট ও দামন। প্রায় ১০ মিনিট সেখানে বসে থাকার পর গুলি থেমে গেলে দামন রবার্টের হাত ধরে টেনে নিয়ে লিওপল্ডের পিছন দিকে ছুটল। কাউন্টারের পিছন দিকে ঢুকে রেস্তোঁরার কিচেনে ঢুকল তারা দু’জন। সেখান দিয়ে দৌঁড়ে পিছনের এক গেট দিয়ে বেরিয়ে রাস্তায় এসে পড়ল তারা। অদূরে তখনও গুলি চলছে। সেই আওয়াজ ভেসে আসছে তাদের কানে। তবে তারা থামল না। নরোজি ফ্রুদুনজি স্ট্রিট দিয়ে তারা এগিয়ে যেতে থাকল। কিছুটা গিয়েই তাজ হোটেলের পিছন দিকে পৌঁছে গেল তারা।
রবার্ট তখন দামনকে বলল, “আমি এই হোটোলেই থাকছি। চল আমার রুমে। এখানে নিশ্চয়ই কোনও জঙ্গি হামলা চালাতে পারবে না।”
দামন এক মুহূর্ত ভেবে সম্মতি জানাতেই দুজনে হোটেলে ঢুকে গেল। লিফটে করে উঠতে গিয়ে যেন তারা ফের গুলির শব্দ শুনল। কিন্তু তখনও তারা ভাবতে পারেনি যে তাজেও হামলা চালাতে পারে জঙ্গিরা।
লিফটে উঠতে উঠতেই রবার্ট বলল, “আমি এখানে পাঁচজন ইজরায়েলি বন্ধুর সঙ্গে এসেছি। তাদর ঘরে গেলে ভালো হয়। আমার কাছে চাবি রয়েছে।” দামন সম্মতি জানাল।
চাবি খুলে ঘরে ঢুকতেই রবার্ট বুঝল তার বন্ধুরা হয়ত ডিনার করতে নিচে গেছে। তাজের ৯টি রেস্তোঁরার কোনটিতে তারা গিয়ে থাকতে পারে এই কথা ভাবছে সে তখন। সেই সময়ই দামন রবার্টের হাতটা চেপে ধরল। বলল, “ওরা এখানেও হামলা চালিয়েছে। দরজা বন্ধ কর শীঘ্রই।” রবার্ট বুঝতে পারল দামন ঠিক বলছে। কারণ গুলির আওয়াজ যেন ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। সে সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ করে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিল। তবে এখানে থাকা নিরাপদ নয় বুঝে রবার্ট কিছুক্ষণ পর দামনকে নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে ঢুকল সেই ফ্লোরে থাকা জমাদারের একটি ছোট্ট ঘুপচি ঘরে।
অন্ধকারে প্রায় কয়েক ঘণ্টা বসে থাকার পর দামন রবার্টকে বলল, “তুমি তোমার কথা তখন শেষ করতে পারনি। আমাদের এভাবে কতক্ষণ বসে থাকতে হবে তা জানি না। বরং কথা বলেই সময়টা কাটানো যাক।”
রবার্ট একটু নিঃশব্দে হেসে উঠে বলল, “কোনওদিন ভাবিনি এত বছর পর ফের এরকম কোনও পরিস্থিতিতে পড়ব যেখানে এভাবে লুকিয়ে থাকতে হবে।” এরপর ফের ১৯৪১ সালে ফিরে গেল রবার্ট।
প্রায় ফিশফিশ করেই সে বলতে লাগল, “তোমাকে ইরানে আসা পর্যন্ত বলেছিলাম না?” “হু”, দামনের সম্মতিতে রবার্ট বলতে থাকল, “আমাদের মা ইরানেই থেকে যায়। সেখানে তিনি রেড ক্রসের হয়ে কাজ করতে থাকেন। তবে আমাকে ও আমার দাদাকে একটি জাহাজে তোলা হয়। কয়েকদিনের যাত্রার পর আরব সাগরের শান্ত জল পেরিয়ে আমরা এসে পৌঁছালাম এই স্বর্গে, তোমার ভারতে। এই বম্বেতেই আমাদের জাহাজ নোঙর ফেলে। এখান থেকে আমাদের ট্রেনে করে নিয়ে যাওয়া হয় গুজরাতের জামনগরে। তখন অবশ্য গুজরাত বলে কিছু ছিল না। তখন সেটা ছিল নওয়ানগরের প্রিন্সলি স্টেট। তখন অবশ্যই এত কিছু বুঝতাম না।”
“সেখানে আমি ও আমার দাদা ছাড়াও প্রায় ১৫০ জন বাচ্চা ছিল। আমরা সবাই একসঙ্গে ইরান থেকে এখানে এসে পৌঁছাই। একজন নাদুসনুদুস লোক এসে আমাদের সামনে দাঁড়াল। তার পোশাক দেখে বুঝতে পারলাম ইনি নিশ্চয়ই রাজা হবেন। খুব একটা যে তাকে মনে আছে সেরম নয়, কারণ তারপর আর মাত্র একবারই তাঁকে দেখেছিলাম আমি।”
“রাজা এসেই আমাদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, তোমরা কেউ আজ থেকে অনাথ নও। জামনগরে থাকা প্রতিটি মানুষ আমাকে বাপু বলে সম্বধন করেন। একইভাবে তোমরাও এখন আমার জামনগরের বাসিন্দা। আমি তোমাদের বাপু। তোমাদের সব চাহিদা মেটানোর দায়িত্ব আমার।”
“তিনি তাঁর কথা রেখেছিলেন। আমাদেরকে হস্টেলে রাখা হত। সেখানে সবার আলাদা আলাদা খাট। সুইমিং পুল ছিল হস্টেলের সামনে। আমার এখনও মনে আছে কী ভাবে আমাকে জোর করে ধাক্কা দিয়ে পুল ফেল দিত বড় দাদারা। তারপরে নিজেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে সাঁতার শেখাত।”
কথা বলতে বলতে হঠাৎই পায়ের শব্দ শুনতে পেল রবার্ট। সঙ্গে সঙ্গে একজন বিদেশির গলার আওয়াজ। সঙ্গে সঙ্গে অস্ফুট গলায় রবার্ট বলে উঠল, “অলিভার। ও আমাকে খুঁজতে এসেছে।” বলেই দরজা খুলে ঘর থেকে বের হল রবার্ট। সঙ্গে সঙ্গে গুলির শব্দ শুনতে পেল দামন। দেখল হাঁটু গেড়ে মাথার উপর হাত দিয়ে বসে পড়েছে রবার্ট। তার দিকে কেউ যেন হেঁটে আসছে। বিদেশি অজানা ভাষায় একটি পুরুষ গলা তখনও চিৎকার করছে।
রবার্ট একবার দামনের দিকে কোনও রকমে ইশারা করতেই দামন বিষয়টি বুঝে গেল। অন্ধকার ঘরে থাকা কয়েকটি ঝাড়ু ও মপিং স্টিকের আড়ালে চলে গেল সে। দরজা খোলা থাকায় ঘরে আলো ঢুকছে ঠিক, কিন্তু বাকি ঘরটা ঘুটেঘুটে অন্ধকার। সে মপিং স্টিকের আড়াল থেকেই দেখল। এক বন্ধুকধারী লোক রবার্টের সামনে এসে দাঁড়াল, তারপর রবার্টকে টেনে হিঁচড়ে সে তুলে নিয়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে গেল।
৪ ডিসেম্বর, ২০০৮
হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরছে দামন। সে খবরে দেখেছে, তাজে মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ছয়জন ইজরায়েলি বাসিন্দা ছিল। তবে সে আশা করছিল রবার্টের যেন কিছু না হয়ে থাকে। বাড়ি ঢুকেই ডিরেক্টরি দেখে ইজরায়েলি দূতাবাসে ফোন লাগাল দামন। ৩ মিনিট অপেক্ষা করে আরও একমিনিট কথা বলল সে। তারপর ফোনটা রেখে দিল। রবার্ট নেই। ছয়জন মৃত ইজরায়েলিদের মধ্যে অন্যতম ছিল রবার্ট।
২৬ নভেম্বর ২০১৮
২৬/১১ হামলার দশ বছর পূর্ণ উপলক্ষে হামলায় মৃতদের শ্রদ্ধা জানাতে কয়েকশো মানুষ জড়ো হয়েছেন তাজের সামনে।
হাতে ফুল নিয়ে একটি নীল সাইন পোস্টের সামনে দাঁড়িয়ে দামন। সাইন পোস্টে পোলিশ ভাষায় লেখা, ‘গুড মাহারাজা স্কোয়ার।’
সেখানে ফুলটা রেখে দিয়ে সে মনে মনে বলল, “তুমি আমাকে ইরানে যেতে বলেছিলে রবার্ট। তবে আমি ওয়ারসতে এসেছি। তুমি আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিলে যে ভারত আশ্রয় দিতে জানে। তাই আমি আজও বেঁচে। তাই তুমিও ছিলে। আর তাই আমিও জেনেছিলাম। ক্ষমা করে দিও বন্ধু।”
2021-08-26