বিচার ব্যবস্থার ওপর দেশের মানুষের আস্থা থাকবে কি ?

কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর নাগরিকত্বের বিরুদ্ধে ওঠা তদন্তের আবেদন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি নাকচ করে দিয়েছেন বলে একটা সংবাদ জানা গেল বিভিন্ন পত্র পত্রিকা মারফত। সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় বিভিন্ন দিক বিচার করে যে মতামত প্রদান করে,সেই মতামতই সর্বদা মানুষ মেনে চলেন, যদিও কখনও কখনও সেই রায় পক্ষপাতদুষ্ট ও স্বেচ্ছাচার বহন করে বলে মনে হয়।যেমন বর্তমানে রাহুল গান্ধীর নাগরিকত্বের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের নিস্পত্তিতে বিচারপতি তদন্ত প্রক্রিয়া নাকচ করে দিলেন,এ পর্যন্ত সব কিছু ঠিকঠাক আছে ।প্রশ্ন হলো প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ এই প্রসঙ্গে কেন বলতে গেলেন ‘কেউ তাঁকে ব্রিটিশ নাগরিক বললেই তিনি ব্রিটিশ নাগরিক হয়ে যাবেননা’ জাতীয় মতামত তথা কথা ? বিচার প্রক্রিয়ার বাইরে অহেতুক মন্তব্য করাটা কি বিচারপতিদের ন্যয্য এক্তিয়ারের মধ্যেই পড়ে ? যদি তাই না হয়, তাহলে ‘কেউ তাঁকে ব্রিটিশ নাগরিক বললেই তিনি ব্রিটিশ নাগরিক হয়ে যাবেন না’ জাতীয় কথা বলে অহেতুক আড়াল করা কেন ? কেউ কাউকে অহেতুক কোনও কথা বললে তিনি সেটা বনে যান না; এটা যেমন সঠিক,ঠিক তেমনই সঠিক হলো ভাষার চাতুরিতে দোষীকে আড়াল করা গেলেও নির্দোষ বানানো যায় না। আর এইমত বিচার প্রক্রিয়া ভবিষ্যতের জন্য উদাহরণ হয়ে উঠে সমাজে বিষ নিক্ষেপ করতে থাকে সেকথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

প্রথমেই এই প্রধান বিচারপতির সামান্য পরিচয় প্রদান করতে চাই।ইনিই প্রথম অসমিয়া যিনি দেশের শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি পদে উন্নীত হয়েছেন । 18 নভেম্বর, 1954 -অসমের এক কংগ্রেসি পরিবারে তাঁর জন্ম হয় ।তাঁর পিতার নাম কেশব চন্দ্র গগৈ। এই কেশবচন্দ্র গগৈ 1982’তে অসম রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন হন। রঞ্জন বাবু 1978 সালে প্রথমবার রাজ্য ‘বার কাউন্সিল’এর সদস্য হন এবং ওই সময় তিনি গৌহাটি হাইকোর্টে প্রাক্টিস শুরু করেন। এরপর 28 ফেব্রুয়ারি-2001, তিনি গৌহাটি হাইকোর্টের স্থায়ি বিচারপতি নিযুক্ত হন । এরপর 9 সেপ্টেম্বর 2010 তারিখে বদলি হয়ে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টে যান। 2011সালের 12 ফেব্রুয়ারি পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন।আর 2012 সালের 24 এপ্রিল তিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন । সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি থাকাকালীন 12 জানুয়ারি, 2018 তারিখে তৎকালীন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি জে. চেলামেশ্বর,কুরিয়েন জোসেফ,মদন বি লকুরকে নিয়ে জে চেলামেশ্বরের বাসভবনে প্রকাশ্য সাংবাদিক সম্মেলন করে একপ্রকার সোজাসুজিই প্রধান বিচারপতির দিকে নজিরবিহীন ভাবে আঙুল ওঠান এবং ইঙ্গিত করেন যে সুপ্রিম কোর্টের আভ্যন্তরীণ বিষয়গুলি স্বচ্ছ নয়। আরও মতামত ব্যাক্ত করেন যে এইমত বিচার ব্যবস্থা চলতে থাকলে গণতন্ত্র বিপন্ন হয়ে পড়বে। উপরন্তু বলেন স্বেচ্ছাচারিতা গণতন্ত্রের পক্ষে সবচাইতে সংহারক ক্ষতিকর প্রক্রিয়ার অন্যতম। এটাই উচ্চতম ন্যায়ালয়ের বর্তমান প্রধান বিচারপতির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।

এবার বর্তমান প্রধান বিচারপতির সাম্প্রতিক বিচার প্রসঙ্গে কিছু কথা বলতে হয় ।উনি বলেছেন,’কেউ কাউকে ব্রিটিশ নাগরিক বললেই তিনি ব্রিটিশ নাগরিক হয়ে যান না’ মেনে নিয়েও বলতে হচ্ছে ব্রিটিশ নাগরিক না হলেও তিনি কি ভারতীয় নাগরিক হয়ে যেতে পারেন ?কেউ ব্রিটিশ নাগরিক হোন বা না হোন, সেটার চাইতে বেশী বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত নয় কি যে তিনি সম্পূর্ণরূপে ভারতীয় ? হ্যাঁ, বিশেষত তিনি যখন ভারতের পার্লামেন্টে আসন দখলের চেষ্টা করছেন,তখন তাঁর আসল পরিচিতি কি,সেটা জানার কি কোনও অধিকার জনগণের নেই ? মেনে নিলাম, বিচারপতি শ্রী গগৈ নিজে সম্পূর্ণরূপে রাহুল গান্ধী’কে ভারতী বলে মানেন এবং জানেন। তা হলেও কি সবকিছু শেষ হয়ে যায় ? না, যেতে পারে না । একজন ব্যক্তি প্রধান বিচারপতি তাঁর নিজস্ব জ্ঞানক্ষমতায় যা বলবেন,সেটা কোনও সামগ্রিক বিচার হতে পারেনা । তথ্য ও প্রমাণ ছাড়া বিচার করা বা বিচার বিভাগ এড়িয়ে যাওয়া কখনোই সুস্থ বিচার বলে গণ্য হতে পারেনা।একজন প্রধান বিচারপতি তথ্য ও প্রমাণ না দেখে একজনকে সম্পূর্ণ ভারতীয় ঘোষণা করে দেওয়ায় মতামতটি সম্পূর্ণরূপে আলোচনার উর্দ্ধে উঠতে অক্ষম হয়েছে,একথা অমান্য করা যায় না । উপরন্তু এইমত এক স্পর্শকাতর বিষয়ের তদন্তে প্রাথমিকভাবে জল ঢেলে দেওয়ায় মাননীয় প্রধানবিচারপতির নিরপেক্ষতা প্রশ্নের সম্মুখে পড়েছে,একথা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে বলেই মানতে হচ্ছে ।

এবার প্রশ্ন হলো ড.সুব্রম্ম্যণিয়ম স্বামির দ্বারা উত্থাপিত প্রসঙ্গ নিয়ে । খবরের কাগজ মারফত যতটুকু জানতে পেরেছি তাতে ড.স্বামি বলেছেন লন্ডনের কোনও এক বিশেষ ব্যাবসায়ী সংস্থার মালিক হিসেবে আমাদের রাহুল গান্ধী বে’নামে রাউল ভিঞ্চি নাম ব্যবহার করে মালিক বনে আছেন।সত্য-মিথ্যা যাচাই করার জন্য কী একবারও জিজ্ঞাসা করা যেতনা যে ওই কোম্পানির মালিক কি রাহুল গান্ধী ওরফে রাউল ভিঞ্চি?যদি সত্যি না হয়,তাহলে রাহুলকে বলা যেত এটা সুনির্দিষ্ট দিনের মধ্যে তিনি যেন মিথ্যে প্রমাণ করেন,এমনও বলা যেত।আর যদি সত্য হয় তাহলে তাঁকে বলা যেত,আপনি রাহুল গান্ধী না কি রাউল ভিঞ্চি? এরপর নিশ্চিত ভাবেই একটা উপসংহারে আসা যেত।আর একই ব্যাক্তি দু’রকমের নাম ব্যবসার করায় জন গণের সাথে প্রতারণা করেছেন বলে একটা সামান্যতম শাস্তির ব্যবস্থাও করা যেত। তা হলে প্রাজ্ঞ বিচারপতি শ্রী রঞ্জন গগৈ তেমন রাস্তায় হাঁটলেন না কেন ? তবে কি আমরা ভাববো যে ঘটনাটা একটু বিশদে তদন্ত করলে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরনোর সম্ভাবনা ছিল ? কেঁচো হোক, আর কেউটেই হোক,প্রধান বিচারপতির কাজ কিন্তু সেটা দেখা নয়। আসল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ‘সত্য খুঁজে বের করা’।তবে কি আমরা ভাবব যে ইতিপূর্বে প্রধান বিচারপতির বিরূদ্ধে ওঠা নারী নিগ্রহের মামলায় যেমন যিনি নিগ্রীহিতা হয়েছেন,তাঁর বিরুদ্ধে মামলা চলবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে,এটাও ঠিক ওই মামলাটাকে আড়াল করার জন্য ব্যবহার করা হলো ? যেন কেউ কিছু বললেই কিছু এসে যায় না ! 12 জানুয়ারি, 2018’তে বিচারপতি জে.চেলামেশ্বরের বাড়িতে ঘোষণা করা হয়েছিল ‘সুপ্রিম কোর্টের আভ্যন্তরীণ বিষয়গুলি স্পষ্ট নয়’- বর্তমান ঘটনাগুলি কী সেই স্মৃতিই বহন করে আনছে না ? সেক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, সর্বোচ্চ বিচারকের আসনে বসে প্রধান বিচারপতি পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য কী এমন করেছেন ?

প্রাক্তন বিচারপতি চেলামেশ্বরের বাসভবনে বসে বলা হয়েছিল বিচার ব্যবস্থা এইমত চলতে থাকলে গণতন্ত্র মৃত্যুর দিকে চলে যাবে। এবার প্রশ্ন হলো, এইমত ভিন্নপথে পরিচালিত করা কি গণতন্ত্রের পক্ষে শুভলক্ষণ ? না, হতে পারেনা ।এরপর ভবিষ্যতে কোনও বিচারপতি মারাত্মক কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মামলা স্থগিত করে দেন এবং সুব্রম্ম্যণিয়ম স্বামি বনাম রাহুল গান্ধী মামলার উদাহরণ টেনে আনেন,তখন কি দোষ দেওয়া যাবে ? এক কথায় উত্তর হয়,দোষ দেওয়া যাবেনা। সুতরাং গণতন্ত্র নিস্পেষিত হতে থাকবে,একথা মনে করা যেতেই পারে।তা হলে আমরা ভাবব কি যে বর্তমান বিচার ব্যবস্থা আমাদের গণতন্ত্রকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ? হ্যাঁ, এক্ষেত্রে একটা কথা না বললে কিন্তু কথাটা গুরুত্ব হারাবে। কথাটা হলো, চেলামেশ্বরের বাসভবনে যেদিন সাংবাদিক সম্মেলন করা হয়েছিল, সেদিনই বুঝতে পারা গিয়েছিল যে ভারতের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ও রাজনীতি মুক্ত নয়। আজও তেমনটা মনে করার উপকরণের অভাব হচ্ছে না বলেই মনে হয়।বড় দুর্ভাগ্য আমাদের।স্বাধীনতার সত্তর বছর পরেও আমরা স্বাধীনতা কি জিনিস বুঝতে বা শিখতে যেমন পারলাম না,ঠিক তেমনই বিচার ব্যবস্থাকে বানাতে পারলাম না নিরপেক্ষ।তাই আমাদের জাতির মেরুদণ্ড তথা উপযুক্ত বিচার পাওয়ার জায়গাটা কিছু মানুষের স্বেচ্ছাচারিতায় নিরপেক্ষতার পরিবর্তে হয়ে উঠছে পক্ষীয় ।

মনে করার দরকার আছে,সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের প্রধান বিচারপতি কখনও প্রাদেশিক বা রাজনৈতিক দলীয় প্রতিনিধি হতে পারেন না ।ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপতি,প্রধানমন্ত্রী, সেনা প্রধান, নির্বাচন কমিশনার যেমন একজন হন, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিও হতে পারেন একজনই । সুতরাং তাঁর প্রাদেশিকতার পরিচয়ের চাইতে বড় হয়ে ওঠে ‘ভারতীয় পরিচয়’। অসম হতে ওনার আগমণ হলেও ওনার মূল পরিচিতি হলো উনি একজন ভারতীয়। পূর্বাংশের এক ছোট্ট রাজ্য অসম হতে তাঁর আগমণ হলেও সেই রাজ্যটি কিন্তু কোনদিন রাজনৈতিক দৈন্যতায় ভোগেনি।গোপীনাথ বড়দলৈ থেকে আরম্ভ করে বহু পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ উপহার দিয়েছে এই ছোট্ট রাজ্যটি। বাকি ছিল সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হওয়াটা। শ্রী গগৈ সেই খামতিটাও পূরণ করে দিয়েছেন। একটা কথা বলে রাখা উচিত,মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রী রঞ্জন গগৈ শুধু অসমের গর্ব নয়,সারা ভারতের গর্ব । তা সত্ত্বেও প্রধান বিচারপতিকে একটি কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই,সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় কিন্তু সর্বার্থেই সর্বোচ্চ নয় । এক্ষেত্রে আমাদের সংসদই এগিয়ে আছেন,একথা মান্য করতেই হয়। অত্যন্ত অবিচার চলতে থাকলে সংসদের পক্ষে বৃহত্তম গণতন্ত্রের সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে উদাসীন থাকা হয়ত সম্ভব হবেনা।না তেমন অপ্রীতিকর কোনও অবস্থা আমরা চাইনা। তবে মাননীয় প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনিক এবং বিচার ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ দৃষ্টিপাত রেখে সুচারুরূপে পরিচালনা করবেন, এই আশা রাখতেই পারি ।

  

পবিত্র রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.